গতরাতে ঘুমোবার আগে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম ক্ষণিকের জন্য৷ কত সুন্দর করে দীনের কথা বলে চলেন তিনি৷ তার উচ্চারিত প্রতিটি হরফে যেন রজনীগন্ধার বাসনা জড়ানো৷ সে মোহময় সুবাসে তন্ময়তায় হারিয়ে গিয়েছিলাম যেন৷ চলুন, আপনাদেরও নিয়ে যাই শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহ‘র সেই সুবাস জড়ানো অলিন্দে৷ আজকে ২য় পর্বঃ
১১,
বিপুল বিস্ময়কর এক সম্পর্ক আল্লাহ তা’লা আমাদের মধ্যে সৃষ্টি করে দিয়েছেন৷ একজন মুসলমান, সে প্রাচ্যের হোক কিংবা পাশ্চাত্যের, তার ভাষা বোধগম্য হোক কিংবা দুর্বোধ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি-গোত্রীয় শিষ্টাচার পরিচিত হোক কিংবা অপরিচিত কিন্তু যখনই জানতে পারি সে মুসলমান, সে ওই কালিমা স্বীকার করে নিয়েছে তাওহীদের যে কালিমা আমারও আত্মার আশ্রয় এতসব ভিন্নতা সত্বেও তাকে আপন মনে হয়৷ আত্মার আত্মীয় যেন৷ তার জন্যে হৃদয়ের গহীনে কোথাও বোধ করে উঠি ভালোবাসার নরোম কোমল উষ্ণতা৷
১২,
আল্লাহ তা’লা আমাদের পরস্পরকে নানান সম্পর্কের বাঁধনে বেঁধে দিয়েছেন৷ কিন্তু এতসব বন্ধনের মধ্যে সবচে’ মজবুত বন্ধনটি এই কালিমার বন্ধন৷ যা কখনও ছিন্ন হবার নয়৷ এ সম্পর্ক এমনই যা কখনও মুছে যাবার নয়৷ রক্তের সম্পর্কেও চিড় ধরে কখনও, দেখা দেয় অনাকাঙ্খিত ফাটল; কিন্তু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র মধ্যস্থতায় যে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি আমরা পরস্পরে তাতে কখনও ফাটল ধরে না৷ তা অটুট ও অমলিন থাকে চিরদিন৷
১৩,
তাওহীদের কালিমায় বিশ্বাসী যত মুসলমান ছড়িয়ে আছে পৃথিবীময় তারা পরস্পরের আত্মার আত্মীয়৷ হয়তোবা দেখা হয় না তাদের একের সাথে অন্যের, হয়তোবা তাদের মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে কোনো বিশালাকার পর্বত, হয়তোবা উত্তাল সমুদ্দুর বাঁধা হয়ে আছে তাদের প্রাত্যহিক সাক্ষাতের পথে তবু মহান রব এমন এক অদৃশ্য বাঁধনে বেঁধে রেখেছেন আমাদের পৃথিবীর কোনো শক্তি যে বাঁধন আলগা করবার ক্ষমতা রাখে না৷ সে বাঁধন একত্ববাদের কালিমা: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ৷
১৪,
মহান রবের আদেশের সমুখে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করা এবং তাঁর প্রেরিত রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন পূর্ণাঙ্গরূপে অনুসরণ করার সদিচ্ছা পোষণ করাই তাওহীদের কালিমার দাবী৷
১৫,
এই কালিমা তার স্বীকারোক্তি প্রদানকারী ব্যক্তির থেকে দাবী করে— তার যাবতীয় আচরণ, শিষ্টাচার, পারস্পরিক লেনদেন সব পরিচালিত হবে মহান রবের ইচ্ছানুযায়ী৷ ব্যক্তি জীবন, পারবিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবন সর্বত্র সমুখে রাখতে হবে রবের বিধান৷ মহান রবের নির্দেশ এবং তাঁর রাসুলের হেদায়েত ব্যতিরেকে মুসলামান তার একটি পদক্ষেপও গ্রহণ করবে না৷ তার চোখের পলক ফেলবে রবের সন্তুষ্টির কথা মাথায় রেখে৷ বাজারে চলাফেরা করবে তাঁর নজরদারির কথা চিন্তায় রেখে৷ ইবাদাত করবে সেটাও তার নির্দেশিত রীতি-পদ্ধতির অনুসরণে৷ এটাই এই কালিমার দাবী৷
১৬,
তাওহীদের এই কালিমা মেনে নেয়ার অর্থ হলো আল্লাহ তা’লার সাথে একটি অঙ্গিকারে আবদ্ধ হওয়া: জীবন পরিচালিত হবে রবের নির্দেশনানুযায়ী৷ এমন যেন না হয়— মুখে কালিমা উচ্চারণ করে জীবন পার করে দিলাম আর শেষ বিচারের দিন মহান রবের সমুখে দাঁড়াতে হলো তাঁর সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গের লজ্জা নিয়ে৷ অঙ্গীকার ভঙ্গকারীকে তিনি পছন্দ করেন না— এ আপ্তবাক্য যেন সদা জাগরূক থাকে আমাদের হৃদয়ে৷
১৭,
এই কালিমাকে যে গ্রহণ করে তার জীবন চলার পাথেয় রূপে, যে সচেষ্ট হয় কালিমার দাবী রক্ষার মহান ব্রতে তার হৃদয়ে সদা ভাস্বর থাকে আল্লাহ তা’লার ভয়৷ তার প্রতিটি চাউনি পর্যন্ত হয়ে ওঠে সতর্ক৷ রাব্বুল আলামিনের প্রতি এমন ভয় কাতুরে থাকার নাম হলো—তাকওয়া৷ খোদাভীতি৷
১৮,
সমস্ত কোরআনের সারসংক্ষেপ— হে ঈমানদারগণ! তোমরা তাকওয়া অর্জন করো৷
১৯,
তাকওয়া— এটি ফার্মাসিস্টের আবিস্কৃত কোনো ক্যাপসুল নয় যা গিলে নিলে হৃদয়ে খোদাভীতি বাসা বাঁধবে৷ কিংবা তাকওয়া নয় কোনো সুপেয় পানীয় যা ঢকঢক গলঃধকরণ করলেই অন্তরে খোদার ভয় মুহূর্তেই চাঙ্গা হয়ে উঠবে৷ বরং তাকওয়া তৈরী হয় ‘সত্যবাদীর’ পবিত্র সংস্পর্শে৷
২০,
‘সত্যবাদী’ কেবল সেই নয় যে সত্যভাষী, মিথ্যা ভাষণে অনভ্যস্ত৷ বরং ‘সত্যবাদী’ সেই যার ভাষণ সত্য, যার আদান প্রদান সত্য, যে মহান রবের সাথে কৃত অঙ্গীকার রক্ষার্থে একনিষ্ঠ৷ এমন ‘সত্যবাদী’র সাথে অতিবাহিত হয় যার ‘রাত্র-দিন’ তাকওয়া নোঙড় গাড়ে তারই হৃদয়-বন্দরে৷
চলবে…(ইনশাল্লাহ)
Facebook Comments