রোযাদারগণের রয়েছে কিছু বিশেষ সংগীত। কিছু শ্রদ্ধাপূর্ণ গীত। সে গীত বা গান সম্পর্কেই আলোচনা করতে চাচ্ছি।
রোযাদারগণ সবচেয়ে বেশি আল্লাহকে স্মরণ করেন ও তাসবিহ—তাহলিল পাঠ করেন। রোযাদারগণই সর্বাধিক ইসতিগফার করেন। যখন রোযাদারদের জন্য দিবস দীর্ঘ হয়ে যায়, তখন যিকিরের দ্বারা তারা দিবসের দীর্ঘতাকে খাটো করে নিয়ে আসেন। যদি ক্ষুধার জ¦ালা তাদেরকে কষ্ট দেয়, তাহলে যিকির দিয়ে তারা সেই কষ্টকে দূর করে দেয়। তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করে আনন্দ পায়। যিকির করে সৌভাগ্য লাভ করে। তারা আল্লাহকে স্মরণ করে, ফলে আল্লাহও তাদেরকে স্মরণ করেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, আমাকে স্মরণ করো, তাহলে আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব।
আর যে—ব্যক্তি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে তার নেয়ামত আল্লাহ বৃদ্ধি করে দিবেন।
সত্যনিষ্ঠ রোযাদারদের গুণ হলো তারা দাঁড়িয়ে ও বসে আল্লাহর যিকির করে। তাদের তনুমন আল্লাহর যিকিরে সিক্ত হয়। তাদের হৃদয়ে আল্লাহ নামের স্মরণ প্রশান্তির বারি বর্ষণ করে। আল্লাহর ভালোবাসায় তারা সৌভাগ্যবান হয়। পরম প্রিয়ের সাক্ষাতের জন্য তাদের হৃদয় ব্যাকুল হয়।
রাসুল صلى الله عليه وسلم কত সুন্দর বলেছেন, যে—ব্যক্তি আল্লাহর যিকির করে আর যে যিকির করে না, উভয়ের উদাহরণ হলো (যিকিরকারী) জীবিত মানুষ সদৃশ আর (যিকির ত্যাগকারী) মৃত মানুষ সদৃশ।
লা ইলাহা ইল্লাহ এই হলো ঈমানের কালিমা। কত মানুষ দুনিয়াতে আছে, যারা খাচ্ছে—দাচ্ছে, ঘুমুচ্ছে, আনন্দ—বিনোদন করছে, অথচ ঈমানের কালিমা তারা জানে না। এমতাবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়ে যাচ্ছে। এরা দুনিয়ার জীবন চিনেছে, কিন্তু প্রকৃত জীবন তথা আখেরাতের জীবন চিনতে পারেনি।
যিকিরকারীদের ফযিলত বর্ণনা করতে গিয়ে রাসুল صلى الله عليه وسلم বলেছেন, মুফাররিদুনগণ অগ্রগামী হয়ে গেছে। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! মুফাররিদুন কারা? রাসুল বললেন, অধিক পরিমাণে আল্লাহর যিকিরকারী পুরুষ ও নারীরা।
যিকিরকারী রোযাদার সবার চেয়ে অধিক কল্যাণ অর্জনকারী। এরা জান্নাতের দিকে দ্রুত—ছুটে—চলা মানুষ। জাহান্নামের আগুন থেকে যোজন যোজন দূরত্ব অবলম্বনকারী সচেতন মুসলিম। এদের ঝুলি অগণিত নেক আমলে পরিপূর্ণ। এদের নেকির পাত্র অসংখ্য নেক ও খায়েরে ভরপুর।
রাসুল صلى الله عليه وسلم থেকে বর্ণিত যে, তাঁকে একজন সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন, কোন আমলে তিনি সর্বদা নিয়োজিত থাকবেন? রাসুল صلى الله عليه وسلم বললেন, তোমার জিহ্বা যেন সর্বদা আল্লাহর যিকির দ্বারা সিক্ত থাকে।
যিকির সম্পর্কে কত সুন্দর অভিব্যক্তি! চমৎকার দিকনির্দেশনা! সৌন্দর্যে অতুলনীয় বাণী। কীভাবে রোযাদার ক্ষুধার কষ্ট পায়! অথচ তার দিন অতিবাহিত হচ্ছে খোদার পবিত্র নাম স্মরণ করে। কীভাবে সে পিপাসার্ত হতে পারে, যখন সে আল্লাহর নামের যিকিরে জিহ্বাকে সিক্ত রাখে!!
যারা সর্বদা আল্লাহর যিকিরে নিয়োজিত থাকে, তারাই যিকির করতে করতে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে। সর্বাধিক যিকিরকারীদের আমলের খাতা থাকবে নেকিতে পরিপূর্ণ। তাদের আশা—আকাক্সক্ষা পূরণ করা হবে। তাদেরকে বিশেষ প্রতিদান দেয়া হবে।
যখন মানুষ যিকির থেকে দূরে সরে যায় তখন বিভিন্ন দুশ্চিন্তা—পেরেশানি তাদেরকে বেষ্টন করে নেয়। দুঃখ—দুর্দশা তাকে অসহায় দুর্বল করে ছাড়ে। কারণ, তার কাছে তো এই বিপদ—মুসিবত থেকে উদ্ধার লাভের মহা উপকরণ ছিল; কিন্তু সে তা ব্যবহার করেনি। তাদের কাছে যাবতীয় মানসিক রোগের ওষুধ ছিল; অথচ তারা তা ব্যবহার করেনি। আল্লাহ বলেন,
الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُمْ بِذِكْرِ اللَّهِ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
অর্থ : যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের কলব আল্লাহর যিকিরে প্রশান্তি লাভ করে। আর শোনে রাখো, আল্লাহর যিকিরের মাধ্যমে কলব প্রশান্তি লাভ করে।
রাসুলুল্লাহ صلى الله عليه وسلم ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ‘সুবাহানাল্লাহিল আযিমি ওয়া বিহামদিহি’ পাঠ করবে, তার জন্য জান্নাতে একটি সুদীর্ঘ বৃক্ষ রোপণ করা হবে।
এই হাদিস আমাদেরকে বলছে, স্বল্প সময়ে আমরা কত শত খেজুর গাছ রোপণ করতে পারি জান্নাতের মহা মূল্যবান যমিনে!
অপর একটি হাদিসে রাসুল صلى الله عليه وسلم বলেন, আমার কাছে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ও লা—ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার বলা— সূর্য যত বস্তুর উপর আলো ছড়ায় সব কিছু থেকে বেশি প্রিয়।
দুনিয়া আর কী? দুনিয়ার স্বর্ণ—রূপা আর কতটুকুই বা দামী! পার্থিব জগতের ধন—সম্পদ আর রাজ প্রাসাদ কতুটুকুই বা মূল্যবান!!
অনুরূপভাবে রাসুল صلى الله عليه وسلم বলেছেন, যা কিছুর উপর সূর্য উদিত হয় সেসব কিছু থেকে দামী ও মূল্যবান হলো ‘সুবাহানাল্লাহ ও আলহামদুলিল্লাহ’।
যে—ব্যক্তি তার সময়গুলো এই সব যিকির ও তাসবিহ দ্বারা পূর্ণ করে দুনিয়া থেকে যেতে পারবে, সে আখেরাতে নুর ও সুরূর (আনন্দ) লাভ করবে।
রাসুল صلى الله عليه وسلم বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের আমলসমূহের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ও আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় আমলের কথা বলে দিব? যা স্বর্ণ—রূপা আল্লাহর রাস্তায় দান করার চাইতে উত্তম এবং তোমাদের জন্য শত্রুদলের মুখোমুখি হওয়া ও তাদের গর্দানে আঘাত করার চেয়েও বেশি প্রতিদানময়! সাহাবাগণ বললেন, অবশ্যই বলে দিন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহর রাসুল বললেন, তা হলো আল্লাহর যিকির।
নেককার ব্যক্তিগণ যখন ফজর নামাযান্তে বসেন, তখন আল্লাহর যিকিরে মশগুল থাকেন। দিবস হওয়া পর্যন্ত তারা এই আমল করেন। তাদের কেউ কেউ ফজর নামায শেষে পবিত্র কুরআন খুলে বসেন এবং তিলাওয়াত করতে থাকেন। কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ অনুধাবন করে সেখান থেকে আত্মার খোরাক সংগ্রহ করেন, হৃদয়ের আলো গ্রহণ করেন।
সুতরাং, হতভাগার চূড়ান্ত সেসব লোক, যারা রমযানের মতো মহা বরকতময় মাস পেয়েও যিকিরে তিলাওয়াতে তা অতিবাহিত করতে পারে না!!