সংকলন
কেন সিয়ামকে ফরয করা হলো?
তোহফায়ে রমযান

কেন সিয়ামকে ফরয করা হলো? | দ্বিতীয় পাঠ

আল্লাহ বান্দার উপর যত বিষয় ফরয ও আবশ্যক করেছেন সবগুলোর মাঝেই রয়েছে সূক্ষ্ম তাত্ত্বিক বিষয় ও গভীর প্রজ্ঞা। আল্লাহ হাকিম, মহা প্রজ্ঞাময়। তাঁর কোনো কাজই প্রজ্ঞাশূন্য নয়। সেসব গভীর হিকমাহ ও তত্ত্ব বোঝা সবার পক্ষে সম্ভব নয়।

রমযানের রোযার মাঝেও রয়েছে কিছু তত্ত্ব ও হিকমাহ। যার কিছু আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারিমে বলে দিয়েছেন।
আল্লাহ বলেছেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ.
অর্থ : হে মুমিনরা! তোমাদের উপর সিয়ামকে ফরয করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববতীর্দের উপর ফরয করা হয়েছিল। যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।

free delivery

এই আয়াত দ্বারা বোঝা গেল, সওম ফরয করার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, তাকওয়া অর্জন। রোযাদার রোযার মাধ্যমে আল্লাহর সবচেয়ে নৈকট্য হাসিল করতে পারে। তার উদর আহারশূন্য, অথচ হৃদয়টা নুরে পরিপূর্ণ। তার বুকে প্রচুর তেষ্টা; কিন্তু অন্তর আল্লাহর মুহব্বতে পরিতৃপ্ত। তার দেহ পানিশূন্য, অথচ চক্ষুদ্বয় অশ্রম্নতে ভরপুর। রাসুল صلى الله عليه وسلم কত সুন্দর বলেছেন, হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মাঝে যার সামর্থ্য আছে সে যেন বিবাহ করে নেয়। আর যার সামর্থ্য নেই সে যেন রোযা রাখে। কেননা, রোযা তার জন্য ঢালস্বরূপ।

রোযার কারণে খাদ্য ও পানি প্রবাহিত হওয়ার নালী সংকুচিত হয়ে যায়। আর এসবই হলো মানবদেহে শয়তানের চলাচলের পথ। এসব রগ ও নালী সংকুচিত হবার কারণে মনে শয়তানের ওয়াসওয়াসা হ্রাস পায়।

রোযার কারণে প্রবৃত্তির কামনা—চাহিদা দুর্বল হয়ে পড়ে। মন্দ চিন্তা—ফিকির মন থেকে দূর হয়ে যায়। পাপের প্রতি আসক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। অন্তর খোদায়ি নুরে নুরান্বিত হয়।

রোযা রোযাদারকে তার অন্নহীন অসহায় গরিব—দুঃখী ভাইয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ফলে রোযাদার অসহায় নিরন্নের উপর দয়া ও অনুগ্রহ করতে উৎসাহিত হয়।

রোযা যেন তাযকিয়ায়ে নফস তথা আত্মার পরিশুদ্ধির মাদরাসা। দৃষ্টি হিফাযতের প্রশিক্ষণ। অঙ্গ—প্রত্যঙ্গ হিফাযতের কার্যকরী চর্চা। রোযা আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মাঝে গোপন সম্পর্ক, গভীর প্রেম বিনিময়ের উপায়। এজন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ صلى الله عليه وسلم বলেন, প্রত্যেক বান্দাকে তার আমলের নির্ধারিত সওয়াব প্রদান করা হবে; রোযা ব্যতীত। সে শুধুই আমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য রোযা রেখেছে। আমি স্বয়ং তার রোযার প্রতিদান দান করব।

এত বিরাট প্রতিদান দেয়ার কারণ হলো বান্দার রোযার খবর একমাত্র আল্লাহই জানেন। কেউ দেখতে পায় না সে প্রকৃত রোযাদার কি না। কিন্তু সালাত—হজ্জ ও অন্যান্য ইবাদত অন্যরা দেখতে পায়।

এজন্য পূর্ববতীর্ মনীষীগণ রোযাকে বানিয়েছিলেন আল্লাহর বিশেষ নৈকট্যপ্রাপ্তির মাধ্যম। ইবাদত ও নেকি অর্জনের মওসুম। তাই রমযান এলে তারা অন্যরকম আবেগ—ভালোবাসা দিয়ে রমযানকে স্বাগত জানাতেন। আর রমযান সমাপ্তির সময় বিরহ বেদনায় কাঁদতেন।

পূর্বসূরিগণ রোযা ও রমযান মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তাঁরা হৃদয় উজাড় করে মাহে রমযানকে ভালোবাসতেন। রমযানে ইবাদতে অত্যন্ত পরিশ্রম করতেন। নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে রমযান পালন করতেন। রমযানের রাতগুলো তাদের কাটত বিনিদ্র; সালাত বা কুরআন তিলাওয়াতে, দুআ বা কান্নায়। আর রমযানের দিবসগুলো তাঁদের কাটত যিকির তিলাওয়াতে, দীন—শিক্ষাদান বা দাওয়াত ও নসিহতে। পূর্বসূরিদের নিকট রমযান ছিল চোখের শীতলতা, হৃদয়ের প্রশান্তি, আত্মার খোরাক। সিয়ামের লক্ষ্য—উদ্দেশ্য দ্বারা তাঁরা তাদের আত্মা সমৃদ্ধ করতেন। রমযানের শিক্ষা দ্বারা অন্তরকে আলোকিত করতেন। রমযানের প্রজ্ঞা ও হিকমাহ দ্বারা দিলকে করতেন প্রশান্ত।
সালাফদের থেকে এও প্রমাণিত যে, তারা মসজিদে কুরআন শরীফ নিয়ে বসে থাকতেন; তিলাওয়াত করতেন এবং তিলাওয়াত শিক্ষাদান করতেন। পরম প্রভুর দরবারে চোখের অশ্রম্ন অর্পণ করে কাঁদতেন। রমযানে যবান ও নযরের পুরাপুরি হিফাযত করতেন তাঁরা।

সিয়াম মুসলিম ঐক্যের একটি বড় নিদর্শন। একই সময়ে সবাই সাহরি করছে। একই সময়, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত, সবাই না খেয়ে আছে। আবার একই সময় সকলে ইফতার করছে। এ এক অসম্ভব সুন্দর ঐক্যের চিত্র।

হে রোযাদার ভাই! রোযা আপনার পাপের জন্য কাফফারাস্বরূপ। সকল গুনাহ মোচনকারী একটি আমল রোযা। রাসুল صلى الله عليه وسلم বলেছেন, এক জুমআ পরবতীর্ জুমআ পর্যন্ত, এক ওমরাহ পরবতীর্ ওমরাহ পর্যন্ত, এক রমযান থেকে পরের রমযান মধ্যবর্তী সময়ের জন্য গুনাহর কাফফারাস্বরূপ; যদি না সে কোনো কবিরা গুনাহ করে।

হে সিয়াম পালনকারী! রোযা দেহের সুস্থতার জন্যও উপকারী। তা দেহের বিভিন্ন ক্ষতিকারক উপাদান ধ্বংস করে দেয়। পাকস্থলিকে প্রশান্তি দেয়। রক্ত পরিশুদ্ধ করে। হার্টে গতি সঞ্চার করে। সেই সাথে হৃদয় ও আত্মাও শক্তিশালী হয়। চরিত্র হয় আরও উন্নত ও সুন্দরতর।

রোযাদার যখন রোযা রাখে তখন তার অন্তর কোমল হয়, ন¤্র হয়, বিনয়ী হয়। মনের অতি স্বপ্ন—আকাক্সক্ষা অপসারিত হয়, অন্তরের লোভ হ্রাস পায়। এজন্য সহজেই তার দুআ আল্লাহ কবুল করেন। রোযায় রয়েছে এক আজিব রহস্য। এর দ্বারা আল্লাহর প্রতি নির্ভেজাল দাসত্ব প্রকাশিত হয়। আল্লাহর হুকুমে আত্মসমর্পিত হওয়ার ঘোষণা হলো রোযা। কেননা রোযাদার আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল করার জন্য হালাল কাজ, যথা পানাহার ও স্ত্রী—মিলন থেকে সংযম অবলম্বন করে।
রোযা মুসলমানকে প্রবৃত্তির উপর জয়ী হতে শেখায়। এটা সবরের অর্ধাংশ। যে মুসলিম কোনো শরীয়তসম্মত উযর ছাড়া রোযা তরক করে সে কখনোই মনের উপর কতৃর্ত্ব অর্জন করতে পারে না। কস্মিনকালেও সে নফসের কু—প্ররোচনার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে না।

রোযা আত্মার জন্য অত্যন্ত উপকারী একটি ঔষধ। এর দ্বারা রোযা পালনকারী অনেক কঠিন ও কষ্টকর কাজে সক্ষমতা লাভ করতে পারে। প্রবল ধৈর্যশক্তি অর্জিত হয়। দীনের জন্য আত্মত্যাগ ও অগ্রগামিতার জযবা দৃঢ় হয়। এজন্যই দেখা যায়, যখন তালুত বাদশাহ আল্লাহর শত্রুদেরকে ধ্বংস করার জন্য রওয়ানা হলেন আল্লাহ তাআলা তার অনুসারীদের ঈমানি শক্তি পরীক্ষা করার জন্য একটি নদীর প্রসঙ্গ উল্লেখ করলেন। আল্লাহর নির্দেশে তালুত আ. তার অনুসারীদেরকে বললেন, যে এই নহরের পানি পান করবে সে আমার দলে থাকতে পারবে না। আর যে পান না করে থাকবে সে আমার দলে থাকবে। তবে এক চুল্লির জন্য ছাড় আছে।

এই ঘোষণার পর তালুত আ.—এর বাহিনীর যারা ধৈর্য—সংযমে অগ্রগামী ও প্রবৃত্তির উপর কঠোর ছিলেন তারা সফল হলেন। আর যারা প্রবৃত্তিপূজারি তারা প্রবৃত্তির ধেঁাকায় পড়ে এমন খোদায়ি সন্তুষ্টিপ্রাপ্তদের দলে থাকতে পারেনি।
শেষকথা, সিয়ামের হিকমাহগুলো হলো তাকওয়া অর্জন, অন্তরের কুমন্ত্রণা ও ধেঁাকা থেকে বেঁচে আল্লাহর যাবতীয় হুকুম—নির্দেশ পালনে সচেষ্ট হওয়া। নফসের উপর কর্তৃত্বলাভ করা। দেহের সুস্থতা লাভ করা। পাপরাজি ধ্বংস হওয়া। রোযার মাধ্যমে হৃদয়ে অপরের প্রতি হৃদ্যতা ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। ক্ষুধার্ত ও নিরন্ন মানুষের কষ্ট অনুভূত হয়। সবোর্পরি আত্মায় এক অন্যরকম আলোকরশ্মি সঞ্চিত হয়, যা অন্য কোনো ইবাদত দ্বারা অর্জিত হয় না।
এসব হিকমাহ সম্পর্কে আল্লাহই সর্বাধিক অবগত।

Related posts

রমযান সম্পর্কে নববি নির্দেশনা | প্রথম পাঠ

সংকলন টিম

রমযান মাস ও পবিত্র কুরআন | তৃতীয় পাঠ

রোযাদারের সংগীত | চতুর্থ পাঠ

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!