সংকলন
তোহফায়ে রমযান
Featured তোহফায়ে রমযান

রমযান সম্পর্কে নববি নির্দেশনা | প্রথম পাঠ

ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন, রাসুল صلى الله عليه وسلم—এর মাহে রমযানের হিদায়াত হলো, বিভিন্ন ইবাদতে মনোযোগী হওয়া। প্রতি রমযানে হযরত জিব্রিল আ. আল্লাহর রাসুলের সাথে পবিত্র কুরআনের দাওর করতেন। যখন জিব্রিল আমিন আ. রাসুলের নিকট আসতেন তখন রাসুল صلى الله عليه وسلم অধিক পরিমাণে দান করতেন। সেই দান ও নেক আমলের গতি হত প্রবহমান বায়ুর চেয়েও বেশি।

হযরত রাসুলে কারিম صلى الله عليه وسلم ছিলেন সবচেয়ে উদার। রমযান মাসে এই উদারতায় আরও বৃদ্ধি ঘটত। তিনি ছিলেন মহান দাতা। রমযানে তাঁর দানের পরিমাণ ব্যাপক হয়ে যেত। এ মাসে তাঁর দান—সদকা, অনুগ্রহ বর্ষণ ও কুরআন তিলাওয়াত অনেক গুণ বেড়ে যেত। সেই সাথে সালাত—যিকির ও ইতিকাফের পরিমাণও অনেক বৃদ্ধি পেত।

free delivery

রাসুল صلى الله عليه وسلم রমযানে এত পরিমাণ ইবাদত করতেন যা অন্য কোনো মাসে করতেন না। কখনো কখনো তিনি রমযানে পানাহার ব্যতীত ধারাবাহিক রোযা রেখে যেতেন। যাতে দিনরাতের সম্পূর্ণ সময়কে ইবাদতে ব্যবহার করতে পারেন। তবে তিনি সাহাবা রা.কে এভাবে পানাহার ব্যতীত ধারাবাহিক রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম রা. বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা আপনাকে এভাবে রোযা রাখতে দেখি যে! রাসুল বললেন, আমার অবস্থা তোমাদের মতো নয়। আমি আমার রবের সান্নিধ্যে অবস্থান করি। তিনি আমাকে আহার করান এবং পান করান।

ধারাবাহিক রোযা পালনের সময় আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবিবকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মারেফাতের বিষয়, অতুলনীয় হিকমাহ ও রিসালাতের আলোকধারা দিয়ে শক্তি যোগাতেন। তা প্রকৃতার্থে পান করা বা খাবার খাওয়া ছিল না। কেননা বিষয়টা যদি পানাহারই হতো তাহলে এটা রাসুলের বিশেষ রোযা হতো কীভাবে!

রাসুল صلى الله عليه و ছিলেন সবচাইতে বেশি যিকিরকারী, সবচেয়ে ইবাদতগুজার। তিনি রমযান মাসকে ইবাদতের জন্য মওসুম বানিয়েছিলেন। রমযান মাস ছিল রাসুলের নিকট যিকির—তিলাওয়াতের মাস। প্রিয় নবীজি রাতে দাঁড়িয়ে প্রিয়তম রবের সাথে একান্ত আলাপে নিমগ্ন থাকতেন। তাঁর দুআয় কাকুতি—মিনতি ঝরে পড়ত। প্রতিপালকের নিকট কায়মনোবাক্যে সাহায্য, বিজয় ও সঠিক পথ চাইতেন। রাত্রিকালীন নামাজে দীর্ঘ তিলাওয়াত করতেন। লম্বা রুকু ও সিজদা করতেন। ইবাদত করে তাঁর তৃষ্ণা যেন মিটত না। রাতে নামাজে দাঁড়িয়ে আখেরাতের সম্বল ও পাথেয় গোছাতেন। সেই সাথে তাঁর আত্মিক শক্তিও বৃদ্ধি পেত। সুরা মুযযাম্মিলের প্রথম কয়টি আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলছেন ,
يَاأَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ. قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًا. نِصْفَهُ أَوِ انْقُصْ مِنْهُ قَلِيلًا. أَوْ زِدْ عَلَيْهِ وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا.
অর্থ : হে চাদরাবৃত! রাতের কিছু অংশ ছাড়া বাকি রাত (ইবাদতের জন্য) দাঁড়িয়ে যান। রাতের অর্ধাংশ বা অর্ধাংশ থেকে কিছু কমান, বা তার থেকে কিছু বাড়িয়ে নিন এবং ধীরস্থিরভাবে স্পষ্টরূপে কুরআন তিলাওয়াত করুন।

অপর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে
وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَكَ عَسَى أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُودًا.
অর্থ : রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পড়বেন, যা আপনার জন্য এক অতিরিক্ত ইবাদত। আশা করা যায় আপনার প্রতিপালক আপনাকে ‘মাকামে মাহমুদ’—এ পৌঁছাবেন।

রাসুল صلى الله عليه وسلم—এর দিনের ইবাদত ছিল দাওয়াত ও জিহাদ, নসিহত ও তরবিয়ত এবং ফতোয়াপ্রদান। আর রাতের এবাদত ছিল দীর্ঘ কেরাত ও রুকু—সিজদায় নামাজ পড়া। রমযান মাস কেন্দ্রিক রাসুলের অন্যতম হিদায়াত এই যে, চাঁদ উদিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই রোযা রাখতে হবে।

রাসুল صلى الله عليه وسلم রমযানে সাহরি খাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন, তোমরা সাহরি খাও। কারণ, সাহরিতে বরকত রয়েছে।
সাহরির সময় বরকতপূর্ণ। তা রাতের শেষ প্রহর। এ সময়ই আল্লাহ তাআলা অবতীর্ণ হন। এটা ইসতিগফারের সময়।

নেক ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ.
অর্থ : তারা সাহরির সময় ইস্তিগফার করত।
এছাড়াও সাহরি গ্রহণ করলে রোযা রাখা সহজ হয়। রোযা রেখে ইবাদত করাও কঠিন লাগে না। সাহরিতে রয়েছে নেয়ামতদাতার নেয়ামত গ্রহণের আমল।

রাসুল صلى الله عليه وسلم থেকে প্রমাণিত আছে যে, তিনি ইফতারে বিলম্ব করতেন না। তিনি বলেছেন, লোকেরা যতদিন যাবত ওয়াক্ত হওয়ামাত্র ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের উপর থাকবে।

তিনি একটি শুকনো বা রসালো খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। সামান্য পানি পান করে নিতেন। কেননা শূন্য উদরের জন্য মিষ্টান্ন উত্তম খাদ্য। আর খেজুরে রোযাদারের জন্য উপকারী উপাদান রয়েছে।

আরেকটি সহিহ বর্ণনায় আছে, রাসুল صلى الله عليه وسلم বলেছেন, প্রত্যেক রোযাদারের জন্য ইফতারের সময় একটি দুআ কবুল করার প্রতিশ্রম্নতি রয়েছে। এজন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইফতারের সময় দুআর ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন এবং স্বয়ং তিনি দুআ করতেন। রাসুল صلى الله عليه وسلم মাগরিব সালাতের পূর্বে ইফতার করে নিতেন। রাসুলুল্লাহ صلى الله عليه وسلم বলেছেন, যখন রাত ওদিক থেকে ঘনিয়ে আসে আর দিন এদিক থেকে চলে যায় এবং সূর্য ডুবে যায়, তখন রোযাদার ইফতার করবে।

রাসুলে কারিম صلى الله عليه وسلم রমযান কখনো কখনো মাসে সফর করেছেন। তখন তিনি কখনো রোযা রেখেছেন, কখনো রাখেননি। এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম রা.কেও তিনি ইচ্ছাধিকার দিয়েছেন। কিন্তু যখন শত্রুদল একেবারে নিকটে থাকত, তখন সকল সাহাবিকে রাসুলুল্লাহ صلى الله عليه وسلم রোযা না রাখার নির্দেশ দিতেন। রাসুল صلى الله عليه وسلم পবিত্র রমযান মাসে কিছু গযওয়াহ ও সারিয়ায় অংশগ্রহণ করেছেন। ইসলামের প্রথম জিহাদ, হক—বাতিলের মাঝে পার্থক্যকারী প্রথম যুদ্ধ বদরযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল পবিত্র রমযান মাসে। এই যুদ্ধে আল্লাহ এমনভাবে রাসুল صلى الله عليه وسلم ও তাঁর সঙ্গীদেরকে সাহায্য করলেন, যার উদাহরণ দ্বিতীয়টি নেই। আল্লাহর রাসুল দুটি গযওয়াহ ব্যতীত আর সকল গযওয়ায় রোযা রেখেছেন। ইমাম তিরমিযি রহ. হযরত উমর রা.—এর সূত্রে এমন হাদিস বর্ণনা করেছেন। এজন্য বোঝা যায়, রমযান মাসে সফর করলে রোযা রাখা—না রাখা উভয়টিরই সুযোগ রয়েছে।

রমযানে রাসুল صلى الله عليه وسلم—এর আরেকটি দিকনির্দেশনামূলক আমল এই যে, রোযা অবস্থায় তিনি পবিত্রাত্মা সহধর্মিনীগণকে চুমু খেয়েছেন। রোযা অবস্থায় স্ত্রীকে চুমু খাওয়াকে তিনি পানি দিয়ে কুলির সাথে তুলনা করেছেন।
রাসুল صلى الله عليه وسلم থেকে প্রমাণিত যে, এই তিন কাজ করলে রোযা ভেঙে যাবেÑ পান করা, আহার করা, স্ত্রী—সঙ্গম করা। রোযা রাখা অবস্থায় এর যে—কোনোটি করলে কাযা ও কাফফারা উভয়টিই আবশ্যক হবে।

আল্লাহর রাসুল صلى الله عليه وسلم রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। এসময় তিনি তাঁর কলবকে আল্লাহর সমীপে সমর্পণ করতেন। দুনিয়ার সকল চিন্তা—কাজ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যেতেন। তাঁর হৃদয়—চক্ষুকে এসময় সৃষ্টিজগতের মাঝে বিচরণ করাতেন। মানুষের সাথে মেলামেশা কমিয়ে ফেলতেন। বাড়িয়ে দিতেন যিকির, ইবাদত ও রবের নিকট দুআ—রোনাযারি। স্বীয় অন্তরকে আল্লাহর সত্তা ও গুণবাচক নামের ধ্যানে ডুবিয়ে দিতেন। মস্তিষ্ককে কালামুল্লাহর সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ উপলব্ধি করার মাঝে ব্যস্ত রাখতেন। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালিমা দ্বারা আল্লাহর মারেফাত হাসিল করতেন। তখন তাঁর দিব্যচোখে হাজারো ঐশী জ্ঞান উদ্ভাসিত হত। আসমান—যমিনের অসংখ্য রহস্য উন্মোচিত হতো তাঁর সাম্মুখে। রাসুলুল্লাহ صلى الله عليه وسلم ছিলেন আল্লাহর পরিচয় লাভে সবচেয়ে অগ্রবতীর্ ব্যক্তি। আল্লাহকে তিনি সবচেয়ে বেশি চিনতেন ও জানতেন। ছিলেন সবার চাইতে বেশি মুত্তাকি। সবার চাইতে অধিক মুতাওয়াক্কিল তথা আল্লাহর উপর ভরসাকারী। নিজ সত্তাকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন পরম প্রভুর সম্মুখে।

সুতরাং, তাঁর তরেই সকল দরুদ ও সালাম, পৃথিবীর বুকে যত বালুকণা ও আলোকরশ্মি আছে তৎসমান।

Facebook Comments

Related posts

কেন সিয়ামকে ফরয করা হলো? | দ্বিতীয় পাঠ

সংকলন টিম

রমযান মাস ও পবিত্র কুরআন | তৃতীয় পাঠ

রোযাদারের সংগীত | চতুর্থ পাঠ

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!