‘উহুদ প্রান্তর’ ইসলামের ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। এ প্রান্তরের সাথে জড়িত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাঁত মুবারাকের শাহাদাত, একদিনে ৭০ জন সাহাবা রাযিয়াল্লাহু আনহুমের শাহাদাত। যা ঐসময়ের প্রেক্ষাপটে এক বিপর্যয়ের কারণ ছিল। মুনাফিকদের পরিচয়ও এই প্রান্তরেই হয়েছিল। মুসলমানদের জন্য শিক্ষাও রয়েছে এই ময়দানে। সিরাতের আলোকে চেষ্টা করব এই প্রান্তরের ঘটনাগুলো তুলে ধরতে ইনশাআল্লাহ।
প্রেক্ষাপট
উহুদের প্রেক্ষাপট হিসেবে একটি বিষয় কাজ করেনি। এখানে অনেকগুলো বিষয় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল। যেমন, প্রতিশোধ, রাজনৈতিক আধিপত্য, ধর্মীয় বিরোধসহ অনেকগুলো বিষয়।
প্রথমত, বদরের যুদ্ধে হারার পর মুশরিকদের ভেতর এক অন্তর্জ্বালার উদ্রেক হয়। তারা পেরেশান হয়ে উঠে তাদের ভেতরে জ্বলতে থাকা প্রতিশোধের আগুনে। আর তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে উহুদ প্রান্তরে।
দ্বিতীয়ত, আরব উপদ্বীপের একটি শক্তিশালী গোত্র ছিল কুরাইশরা। কিন্তু বদরের প্রান্তরে আল্লাহর ইচ্ছায় মুজাহিদ বাহিনীর হাতে কচুকাটা হওয়ার পর তাদের এই শক্তিমত্তায় ভাটা পড়ে যায় এবং আরবের অন্যান্য গোত্রদের কাছে তাদের এই শক্তিমত্তা ও আধিপত্য প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে যায়। যার দরুণ তারা মরিয়া হয়ে উঠে আধিপত্য ফিরে পাওয়ার জন্য। এবং শুধুমাত্র এই যুদ্ধই পারে তাদের আধিপত্য ফিরিয়ে দিতে।
তৃতীয়ত, মদিনায় হিজরতের পর মুসলমানরা অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং কুরাইশরা দ্বীন ইসলামের এই অগ্রগতি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। তারা এ যুদ্ধের মাধ্যমে চেয়েছিল এই অগ্রগতি এক্কেবারে রুখে দিতে। কিন্তু আল্লাহ আযযা ওয়াজাল্লার পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। এখানে একটি আয়াত না বললেই নয়। আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা তাওবার ৩২ নং আয়াতে বলেন—
“তারা তাদের মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর আলোকে নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তা হতে দিবেন না, তিনি তাঁর আলোকে পূর্ণ না করে ছাড়বেন না, যদিও কাফিরগণ তা অপছন্দ করে”।
এছাড়াও আরও অনেক বিষয় এই যুদ্ধে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল।
যুদ্ধ–প্রস্তুতি
সময়টা ছিল ৩য় হিজরির শাওয়াল মাস। কুরাইশরা তাদের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ৩০০০ সৈন্যের এক বিশাল সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। এই বাহিনীতে নারী, পুরুষ, দাসসহ প্রতিবেশী গোত্রগুলোও অংশ নেয়। এই যুদ্ধে নারীদের নেয়ার মূল কারণ ছিল পুরুষদের যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা। এজন্য আবু সুফিয়ান, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যা, ইকরিমা ইবনে আবু জাহেল সহ অনেক বড় বড় কুরাইশ নেতা তাদের স্ত্রীসহ যুদ্ধে গমন করেন। এই যুদ্ধের অর্থায়ন হয়েছিল বদর যুদ্ধের সময় আবু সুফিয়ানের হাতে রক্ষিত বিশাল কাফেলার মালামাল বিক্রি করে। আর এই কাফেলায় মক্কার প্রায় প্রত্যেকটি পরিবার বিনিয়োগ করেছিল।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে একজন নবী ছিলেন তা নয়; তিনি একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়কও ছিলেন। তার প্রমাণ তিনি বরাবরের মতো এই যুদ্ধেও দিয়েছিলেন। মুসলিমদের গোয়েন্দা বিভাগও কম নয়। মক্কার ভেতরেই ছিলেন মুসলমানদের গোয়েন্দা বসা। তিনি আর কেউ নন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চাচা আল আব্বাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিব রাযিয়াল্লাহু আনহু। তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে মদিনা আসার জন্য অস্থির হয়েছিলেন। কিন্তু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মক্কায় অবস্থান করতে আদেশ করেছিলেন। তাকে মক্কায় থেকেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরর হয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আঞ্জাম দিতে হয়েছিল। যা ছিল সত্যিই ভয়ংকর রকমের কঠিন। কিন্তু তিনি এই দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথেই আঞ্জাম দিয়েছিলেন। তিনি এ কাজে এতটাই দক্ষ ছিলেন যে, কুরাইশদের পরিকল্পনা নেয়ার মাত্র তিনদিনের মধ্যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চিঠির মাধ্যমে খবর পাঠাতে সক্ষম হন এবং সঠিক তথ্যসহ। সুবহানাল্লাহ!
তার চিঠির ভাষ্য অনেকটা এমন ছিল,
“কুরাইশরা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়তে বিশাল সেনাবাহিনী জড়ো করেছে। আপনি আপনার পরিকল্পনা মোতাবেক তাদের মোকাবিলা করুন। তাদের সেনাদলে আছে তিন হাজার সৈনিক, দু’শো ঘোড়া, বর্ম পরিহিত সাতশো যোদ্ধা এবং তিন হাজার উট। তারা তাদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এ যুদ্ধে নামতে যাচ্ছে”।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তবুও আল হুবাব ইবনুল মুনযিরকে তথ্য যাচাইয়ের জন্য পাঠান এবং তিনিও একই সংবাদ নিয়ে আসেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বিষয়টি গোপন রাখেন অন্যান্য সাধারণ সাহাবি রাযিয়াল্লাহু আনহুম থেকে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুরা সদস্যদের ডাকলেন। আলোচনা থেকে দুইটি প্রধান মতে সবাই সম্মত হলো।
প্রথম মতের প্রস্তাবনাটি এমন ছিল যে, মুসলিম বাহিনীর যোদ্ধারা মদিনার ভেতরে থেকে মদিনাকে দূর্গ হিসেবে ব্যবহার করে যুদ্ধ পরিচালনা করবে। এতে করে মদিনার অভ্যন্তরে থাকা নারী -শিশুরাও সুযোগ পাবে যুদ্ধের। এ মতটি ছিল স্বয়ং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের। মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবন উবাইও এই মতের পক্ষে ছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রস্তাব করার কারণ ছিল কৌশলগত; কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের প্রস্তাব করার কারণ ছিল মদিনার বাইরে যুদ্ধ করতে যাওয়ার ভয়।
দ্বিতীয় মতের প্রস্তাবনাটি ছিল যে, মুসলিম বাহিনীর মুজাহিদগণ খোলা ময়দানে কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ করবে। মদিনার ভেতরে কাফের বাহিনী ঢুকবে এবং মুসলিমদের ঘরবাড়ি আক্রমণ করবে এটা তাদের জন্য ছিল লজ্জাকর।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের মতকে প্রাধান্য না দিয়ে দ্বিতীয় মতটাই গ্রহণ করলেন। তিনি যে তার সাহাবা রাযিয়াল্লাহু আনহুমদের মতের প্রতি কতটা গুরুত্বারোপ করতেন, এই ঘটনা তা প্রমাণ করে দেয়।
মদিনা থেকে মাইলখানেক দূরে উহুদ পাহাড়ের পাশে তাদের গন্তব্য স্থির করা হয়।
উহুদ প্রান্তর
১০০০ মুজাহিদকে সাথে নিয়ে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদ প্রান্তরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই হঠাৎ করে তার ৩০০ অনুসারী নিয়ে বেরিয়ে গেল। তার যুক্তি ছিল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মতকে দামই দেননি। আসলে এটা শুধু একটা বাহ্যিক বিষয় ছিল। এর ভেতরের রহস্য হচ্ছে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই চেয়েছিল মুজাহিদ বাহিনীর মনোবল ভেঙে দিতে। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। তিনি চেয়েছিলেন মুনাফিকদেরকে পৃথক করে দিতে। আর তাই হলো। আর তা ওয়াহি আকারেও নাযিল হয়েছিল। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’য়ালা কুরআনের সুরা আলে ইমরানের ১৬৬ ও ১৬৭ নং আয়াতে বলেন—
“দু’দল পরস্পরের সম্মুখীন হওয়ার দিন যে বিপদ পৌঁছেছিল, তা আল্লাহর হুকুমে ঘটেছিল, এর উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃত মু’মিনদেরকে জেনে নেয়া। আর মুনাফিকদেরকেও জেনে নেয়া। তাদেরকে বলা হয়েছিল; এসো, ‘আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর, কিংবা (কমপক্ষে) নিজেদের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা কর’। তখন তারা বলল, ‘যদি আমরা জানতাম যুদ্ধ হবে, তাহলে অবশ্যই তোমাদের অনুসরণ করতাম’। তারা ঐ দিন ঈমানের চেয়ে কুফরীরই নিকটতম ছিল, তারা মুখে এমন কথা বলে যা তাদের অন্তরে নেই, যা কিছু তারা গোপন করে আল্লাহ তা বিশেষরূপে জ্ঞাত আছেন”।
এই আয়াতের পরপরই আরেকটি আয়াতে এ বিষয়ে স্পষ্ট বলে দেন যে তিনি চান না মুমিন এবং মুনাফিককে একত্রে রাখতে। সুরা আলে ইমরানের ১৭৯ নং আয়াতে আল্লাহ তা পরিষ্কার করে বলেছেন—
“অসৎকে(মুনাফিককে) সৎ(মুমিনদের) থেকে পৃথক না করা পর্যন্ত তোমরা যে অবস্থায় আছ, আল্লাহ মু’মিনদেরকে সে অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না এবং আল্লাহ তোমাদেরকে গায়িবের বিধান জ্ঞাত করেন না, তবে আল্লাহ তাঁর রাসূলগণের মধ্যে যাকে ইচ্ছে বেছে নেন, কাজেই তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রসূলগণের প্রতি ঈমান আন। যদি তোমরা ঈমান আন আর তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তোমাদের জন্য আছে মহাপুরস্কার”।
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের চলে যাওয়ার পর আরো ২ টি গোত্র মনোবল হারিয়ে ফেলেছিল। গোত্র ২ টি হলো -বনু সালিমা এবং বনু হারিসা গোত্র। কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে দৃঢ়পদ রেখেছিলেন। তাদের এই মনোবল হারিয়ে ফেলাটা ইচ্ছাকৃত ছিল না। যা সুরা আলে ইমরানের ১২২ নং আয়াতে আল্লাহ তা সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন—
“যখন তোমাদের মধ্যকার দু’দল ভীরুতা প্রকাশ করতে মনস্থ করেছিল, কিন্তু আল্লাহ উভয়ের বন্ধু ছিলেন, মু’মিনদের উচিত আল্লাহর উপর ভরসা করা”।
প্রত্যেক যুদ্ধের আগেই কমান্ডার বা সেনাপতিগণ তাদের যোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে এবং দিকনির্দেশনা দিতে কিছু না কিছু বক্তব্য দেন। আমাদের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের সেনাপতি হিসেবে তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনিও মুজাহিদদের দিকনির্দেশনামূলক কিছু নাসিহাহ দিয়েছিলেন। তার সেই অসাধারণ বক্তব্য অনেকটা এমন ছিল,
“ভাইয়েরা আল্লাহ তা’য়ালা তার কিতাবে আমাকে যা আদেশ করেছেন, আমি তোমাদের তাই আদেশ করছি; আল্লাহর আনুগত্য করো। যা কিছু তিনি নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো। তোমরা যারা নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে জানো এবং ধৈর্য, দৃঢ় বিশ্বাস, নিষ্ঠা, আন্তরিকতার সাথে সাথে নিজেদের প্রস্তুত করেছো, আজ তাদের জন্য পুরষ্কার লুফে নেয়ার সুযোগ! নিশ্চয়ই শত্রুর সাথে জিহাদ করা সহজ কাজ নয় বরং কষ্টকরই বটে। খুব অল্প ক’জন ধৈর্য্যের সাথে তা করতে পারে। তবে আল্লাহ তাদের মাঝে আছেন যারা তাকে মেনে চলে। আর যারা তাকে মানেনা তাদের সাথে রয়েছে শয়তান। তাই ধৈর্য্যের সাথে জিহাদ করো আর খুঁজে ফেরো সেই প্রতিশ্রুতি (শাহাদাত) যা আল্লাহ তোমাদের দিয়েছেন। আর আমি যা তোমাদের আদেশ করছি তা অবশ্যই পালন করবে। কেননা, আমি তোমাদেরকে তাই করতে বলি, যা সঠিক। মনে রেখো অনৈক্য, মতভেদ আর হতাশাই হলো দুর্বলতা আর শক্তিহীনতার কারণ। যারা এমন করে আল্লাহ না তাদের ভালোবাসেন। আর না বিজয় দান করেন”।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন একজন বিচক্ষণ সেনাপতি। তিনি নাসিহাহ দেয়ার পর যুদ্ধক্ষেত্র ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। কোনদিক দিয়ে কীভাবে আক্রমণ করা হবে এবং তারা কীভাবে আক্রমণের স্বীকার হতে পারেন তা বুঝার চেষ্টা করলেন। ঐসময় তার চোখে মুজাহিদদের পেছনে থাকা একটি পাহাড় চোখে পড়লো। যা উহুদের বরাবর ছিল। তিনি ধারণা করলেন মুসলিমরা এ দিক দিয়ে আক্রমণের স্বীকার হতে পারে৷ তাই তিনি ৫০ জন তীরন্দাজকে পাহাড়ের উপর অবস্থান করার আদেশ করলেন এবং অত্যন্ত কঠোরভাবে তাদের কিছু নাসিহাহ করলেন। নাসিহাহগুলো এমন ছিল,
“আমার কাছ থেকে নির্দেশ পাওয়ার আগ পর্যন্ত তোমরা এই পাহাড়েই অবস্থান করবে। যদি তোমরা দেখ শকুন এসে আমাদের মৃতদেহ খুবলে খাচ্ছে, তবু আমার ইশারা ছাড়া তোমরা এখান থেকে সরবে না”।
এদিকে কুরাইশরা নানারকম কূটকৌশল শুরু করল। তারা মুসলমানদের মধ্যে ফাটল ধরাতে চাচ্ছিল। কিন্তু তাদের এই কূটকৌশল ব্যর্থ হলো।
যুদ্ধ
যুদ্ধের আগে দ্বন্দ্বযুদ্ধ ছিল আরবদের প্রথা। উহুদেও ঠিক এমনটাই হয়েছিল। কুরাইশদের পতাকাবাহক তালহা ইবনে উসমান মুসলিম বাহিনীর যোদ্ধাদের বিভিন্ন কটুক্তি করার মাধ্যমে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। সে মুসলিম বাহিনীকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ পর্যন্ত ছুড়ে দেয়। আলী ইবনে আবি তালিব রাযিয়াল্লাহু আনহু [অনেক ইতিহাসবিদের মতে যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু] চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্ট করেন এবং তাকে এমনভাবে আঘাত করেন যে তার শরীর থেকে পা বিচ্ছিন্ন করে দেন। আল্লাহু আকবার।
যুদ্ধের আগে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি তরবারি হাতে নিয়ে সাহাবা রাযিয়াল্লাহু আনহুদের মধ্যে আসেন৷ তাদের প্রশ্ন করেন, কে এই তরবারি নিতে চায়? সাথে শর্ত জুড়ে দেন যে, তরবারি নিতে হলে এর হক আদায় করতে হবে। আর তা হলো তরবারি দ্বারা শত্রুকে এমনভাবে আঘাত করতে হবে যেন তরবারি বেকে যায়। যা নিতান্তই সহজ কাজ নয়। কিন্তু সাহাবা রাযিয়াল্লাহু আনহুদের মধ্যে এমন কিছু সাহসী সাহাবা ছিলেন, যাদের আত্মবিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ যদি চান তো আমার দ্বারা এই কাজ খুব সহজেই করিয়ে দিতে পারবেন। এমনই একজন দুঃসাহসী সাহাবি হলেন আবু দুজানা রাযিয়াল্লাহু আনহু, তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছ থেকে তরবারিটি নেন। আর হক আদায়ে নেমে পড়েন। তিনি তরবারি নিয়ে সোজা মুশরিক বাহিনীর মাঝে ঢুকে পড়েন এবং হত্যাযজ্ঞ চালানো শুরু করেন। এই দিন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’য়ালা তার জন্য মনে হয় নির্ধারিত করে রেখেছিলেন। তিনি এক মুশরিককে এমনভাবে আঘাত করেছিলেন যে, মাথা থেকে উরু পর্যন্ত দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। আল্লাহু আকবার! ইতিহাসবিদগণ আবু দুজানাকে উহুদের ‘হিরো’ বলে আখ্যায়িত করেন৷
যুদ্ধের প্রথমে মুসলিম বাহিনীর আক্রমণের সামনে কুরাইশ বাহিনী দাঁড়াতে পারেনি। তারা ময়দান ছেড়ে পালাতে শুরু করে। এমনকি তাদের পতাকাবাহক গোত্র বনু আব্দুদ দারের ৮ জনকে হত্যা করা হয় এবং তাদের পতাকা মাটিতে ফেলে দেয়া হয়। এতে কুরাইশরা আরও ভয় পেয়ে যায় এবং ময়দান ছেড়ে পালাতে থাকে। ঠিক এসময় কিছুসংখ্যক সাহাবি যুদ্ধ শেষ মনে করে গনিমতের মাল সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েন৷ যা দেখে পাহাড়ে অবস্থানরত ৫০ জন তীরন্দাজ সাহাবা রাযিয়াল্লাহু আনহুমের ৪০ জনই নিচে নেমে আসেন। আর এই সুযোগেই আক্রমণ চালান কুরাইশ বাহিনীর এক সিংহ খালিদ বিন ওয়ালিদ। পরবর্তীতে যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তার আক্রমণে মুসলিম শিবির কেঁপে ওঠে। আক্রমণ এমন ছিল যে, মুসলিম বাহিনীকে পুরো ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছিল। এই সুযোগে মুশরিক বাহিনী রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্যাম্পেও আক্রমণ করে এবং তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। যা ছিল তাদের মূল মিশন। এমনকি তাকে এমনভাবে আঘাত করা হয়েছিল যে তার দাঁত ভেঙে যায়।
এরই মধ্যে গুজব ছড়ানো হয় যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নাকি মুশরিকরা হত্যা করে ফেলেছে। মূলত মুশরিকরা মুসআব ইবনে উমাইর রাযিয়াল্লাহু আনহুকে শহিদ করেছিল। তার চেহারা অনেকটা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতো ছিল। আর তাতেই মুশরিকরা মনে করেছিল তারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে হত্যা করেছে৷ যার দরুন অনেক মুজাহিদ অস্ত্র ছেড়ে মদিনায় পালিয়ে যান। কিন্তু তখনো কিছু আল্লাহর বান্দা এমন ছিলেন যারা অপরাজেয়। তারা দমে যাননি। যুদ্ধ করেই যান এবং আল্লাহর দেয়া প্রতিশ্রুতিকে (শাহাদাত) খুঁজে নেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করতে যে-কজন সাহাবি ছিলেন, তন্মধ্যে যার নাম উল্লেখ না করলেই নয়, তিনি একজন নারী সাহাবি ছিলেন। নাম নুসাইবাহ বিনতে কা’ব রাযিয়াল্লাহু আনহু।
এভাবেই কোনোরকমে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবন রক্ষা করা হয় এবং যুদ্ধে মুসলিমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর ৭০ জন সাহাবি শাহাদাতবরণ করেন। যার মধ্যে ছিলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় চাচা হামযাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব রাযিয়াল্লাহু আনহু, মুসআব ইবনে উমাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু, আব্দুল্লাহ ইবনে জাহশ রাযিয়াল্লাহু আনহু, হানযালা ইবনে আবি আমীর রাযিয়াল্লাহু আনহু সহ আরও অনেক প্রখ্যাত সাহাবি।
শিক্ষা
১) এই যুদ্ধের মাধ্যমে আল্লাহ মুনাফিক ও মুমিনদের মাঝে চিহ্নিত করে দেন।
২) জিহাদে বা যেকোনো কাজে দায়িত্বশীলদের কথা পরিপূর্ণ অনুসরণ না করার খেসারত যে কী ভয়াবহভাবে দেয়া লাগে তা মুসলিমরা শিক্ষা পেয়েছিল।
৩) জান্নাত পাওয়ার জন্য কষ্ট করতে হয়।
৪) কাফিররা বিজয়ের মাধ্যমে মনে করে তারা দুনিয়ার সব পেয়ে গেছে। কিন্তু আল্লাহ তাদের সুযোগ করে দেন, যাতে তাদের খারাপের পাল্লা ভারী হয়৷
৫) যুদ্ধে জয়-পরাজয় হবে। কিন্তু মুসলমানরা জিতুক বা পরাজয় বরণ করুক তারা সবসময় জয়ী।
৬) পরিস্থিতি যেমনই হোক আল্লাহকে স্মরণ করে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এর নামই জিহাদ।