কালের রঙিন পাখায় ভর করে বারবার আমাদের মাঝে সূচিত হয় মাহে রবিউল আউয়াল। এ মাসেই মানবতার মুক্তিদূত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্ধকারময় এ ধরিত্রীর বুকে আলোর দ্যুতি নিয়ে আগমন করেন। তাঁর আগমনে তিমিরাচ্ছন্ন পৃথিবী হয়ে ওঠে আলো ঝলমল। মৃতপ্রায় মানবতার শরীরে সঞ্চারিত হয় নবপ্রাণ। তাবৎ সৃষ্টি মোহিত হয়ে ওঠে এমন এক মধুময় সুঘ্রাণে, যার সৌরভ কিয়ামত অবধি মানবতাকে মোহিত করবে।
এ মাসে শুধু বিশ্বনবী জন্মগ্রহণই করেননি, বরং এ মাসেই হিজরতের মহান ঘটনা সংঘটিত হয়, যা ছিল ইসলামের দাওয়াতী ও সামরিক বিজয়ের শুভসূচনা। অতঃপর এ মাসেই প্রিয় নবীর চির বিদায়ের হৃদয়বিদারক ঘটনাটিও সংঘটিত হয়। এসব দিক বিবেচনায় এ মাস শুধু মুসলিম উম্মাহর জন্যই নয়, বরং গোটা মানবতার জন্যই এক ঐতিহাসিক মাস। ইতিহাস সব সময়ই হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়ে। আর এ কারণেই এ মাসে অধিক পরিমাণে সীরাত বিষয়ক ওয়াজ-মাহফিল, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। পত্র-পত্রিকাগুলোও সীরাতের ওপর বড় কলেবরের বিশেষ সংখ্যা ও ক্রোড়পত্র বের করে এবং চিন্তা ও রুচিশীল ব্যক্তিরা অধিকহারে সীরাত চর্চায় আত্মনিবেশ করেন।
সীরাতে মুহাম্মদীকে শুধু এ মাসের সাথেই সংশ্লিষ্ট করে নেয়া সীরাতের সাথে বে-ইনসাফী ও অন্যায় ছাড়া আর কিছুই নয়। সীরাতে নববী তো একটি অন্তহীন স্রোতধারা। কারণ রাসূলের নবুওয়াত বিশ্বজনীন ও সার্বজনীন। কোনো ব্যক্তি এক মুহূর্তের জন্যও প্রিয় নবীর সীরাত ও শিক্ষা-আদর্শ থেকে দূরে থাকতে পারে না। এজন্য সীরাতের সাথে আমাদের সম্পর্ক চিরন্তন ও চিরস্থায়ী। জিহবার জন্য এর চেয়ে সৌভাগ্য কী হতে পারে যে, তা আল্লাহ ও রাসূলের যিকিরে সদা সিক্ত হবে। কলমের জন্য এর চেয়ে সৌভাগের কারণ আর কী হতে পারে যে, সে প্রিয় নবীর গুণ বর্ণনায় নিজেকে বিলীন করে দেবে।
মোটকথা, এই মাসকে কেন্দ্র করে মানুষের মাঝে সীরাত চর্চার যে পরিবেশ, মানসিকতা, চেতনা ও অভিরুচির স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে, প্রয়োজন সেই স্ফুলিঙ্গকে দাবাগ্নিতে পরিণত করা, উঞ্চ ঈমানের শীতল আংটিকে উত্তপ্ত করা এবং চিন্তা ও ভাবনার ওপর পড়ে থাকা ধুলাবালিকে পরিস্কার করা।
এই উদ্দেশ্যে সীরাতে মুহাম্মদীর অধ্যয়ন ও চর্চা জরুরি। সীরাতের বিষয় চির বসন্তকালের মতো। যার সজীবতা ও সতেজতা কখনো শেষ হয় না। আর না কিয়ামত পর্যন্ত শেষ হবে। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় নবীর সাথে উম্মতে মুহাম্মদীর সম্পর্ক একটু স্বতন্ত্র্য ও ভিন্নতর। তার কয়েকটি কারণ নিম্নরূপ :
এক. অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী ধর্মকে তাদের বাস্তব ও ব্যবহারিক জীবন থেকে সম্পূর্ণ বিদায় করে দিয়েছে। ইউরোপে রাষ্ট্র ও গির্জার লড়াই শেষপর্যন্ত এখানেই পরিসমাপ্ত হয় যে, মানুষের বাস্তব ও ব্যবহারিক জীবনের সাথে গির্জার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। ধর্মের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ ও তার সফলতা গোটা বিশ্বের জাতিগোষ্ঠীর ওপর বিরাট প্রভাব ফেলে। ধর্মের সাথে মানুষের যে সুদৃঢ় বন্ধন ছিলো তা ধীরে ধীরে শিথিল হতে থাকে। অন্যরা দূরে থাক, যেসব মুসলিম রাষ্ট্র ইউরোপের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল কিংবা ইউরোপের উপনিবেশ ছিলো তারাও এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়া এর জ্বলন্ত উদাহরণ। এর ফল এই হয়েছে যে, ইউরোপিয়ান জাতিগোষ্ঠীর নিকট তাদের ধর্মীয় ব্যক্তিদের মর্যাদা ‘সম্মানীয় ব্যক্তি’ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়, তারা অনুসরণযোগ্য আর থাকেনি।
পক্ষান্তরে মুসলমানদের বিষয়টি সম্পূর্ণ এর থেকে ভিন্নতর ছিলো। মুসলিম সমাজে আলহামদুলিল্লাহ ওলামা ও জনসাধারণের মধ্যে ক্ষমতার রশি নিয়ে কখনও টানাটানি ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হয়নি এবং ওলামায়ে কেরামও তাদের ধর্মীয় অবস্থানকে সাধারণ জনগণের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেননি। আর না বিরোধীদেরকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। এ কারণেই ওলামা ও জনসাধারণের মাঝে কখনও এমন দ্বন্দ্ব-লড়াইয়ের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি, যা ইউরোপে গির্জা ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিলো।
অতঃপর ইসলাম তার পয়গম্বরকে একজন আদর্শ মানব হিসেবে উপস্থাপন করেছে এবং তাঁর শিক্ষা-আদর্শ এতই সহজ-সরল ও মানব প্রকৃতির সাথে সাজুয্যপূর্ণ, যার ওপর আমল করা কোনোই কঠিন নয়। এজন্য এই উম্মতের সম্পর্ক তার পয়গম্বরের সাথে শুধু সম্মান ও মর্যাদার সম্পর্ক নয়, বরং আনুগত্য ও অনুসরণেরও সম্পর্ক। ইসলামের অনুসরণ করাকে তিনি আমাদের জন্য আবশ্যকীয় ঘোষণা করেছেন। কুরআন আমাদেরকে বারবার আল্লাহর বিধি-নিষেধ ও রাসূলের শিক্ষা-আদর্শের ওপর আমল করার নির্দেশ দেয় এবং তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়াকে কুফর আখ্যা দেয়। কুরআন বলে—
‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত হও। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে রাখে তাহলে জেনে রাখ, আল্লাহ কাফিরদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আলে ইমরান-৩২)
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, ‘যদি তোমরা মুমিন হও, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর।’ (সূরা আনফাল-১)
আরো ইরশাদ হচ্ছে, ‘যে রাসূলের আনুগত্য করল, সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল।’ (সূরা নিসা-৮০)
এসব আয়াতে রাসূলের আনুগত্যকে আল্লাহর আনুগত্যই আখ্যা দেয়া হয়েছে এবং তাঁর আনুগত্যকেই ঈমানের কষ্টিপাথর আখ্যায়িত করা হয়েছে।
রাসূলের বিধি-নিষেধ শরীয়তের আইনের অন্যতম মৌলিক উৎস। এজন্যই আল্লাহ নির্দেশ করেছেন, রাসূল যা নির্দেশ দেয় তার ওপর আমল কর এবং যা থেকে নিষেধ করে তা থেকে বেঁচে থাক। তিনি ইরশাদ করেন, ‘রাসূল যা-কিছুর নির্দেশ করেন সেগুলো মজুবতভাবে আঁকড়ে ধরো এবং যা-কিছু থেকে নিষেধ করেন সেগুলো বর্জন করো।’ (সূরা হাশর-৭)
রাসূল যে ফয়সালা দিবেন তাতে রদবদল করার কোনো ক্ষমতা ও অধিকার মানুষের নেই। বরং বিবাদ-দ্বন্দ্বের সময় যে ব্যক্তি রাসূলের ফয়সালার ওপর সন্তুষ্ট থাকবে না এবং আল্লাহর নির্দেশকে নিজের ওপর বাস্তবায়ন করতে উদ্বুদ্ধ হবে না, সে মুসলমানই না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারভার তোমার ওপর অর্পণ না করে।’ (সূরা নিসা-৬৫)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশাবলীর আনুগত্যই যথেষ্ট নয়, বরং তাঁর আমলের আনুগত্য ও অনুসরণও জরুরি। বরং রাসূলের ইত্তেবা ও অনুসরণ আল্লাহর ভালবাসা পাওয়ার অনিবার্য শর্ত। তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণ মানুষকে স্বয়ং আল্লাহর প্রিয়পাত্র বানিয়ে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বল, যদি তোমরা আল্লাহর ভালবাসা পেতে চাও, তাহলে আমার আনুগত্য কর, তাহলে তিনি তোমাদের ভালবাসবেন।’(সূরা আলে ইমরান-৩১)
সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সত্তা ও গুণাবলী উম্মতের জন্য সর্বোত্তম নমুনা ও আদর্শ আখ্যা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ।’(সূরা আহযাব-২১)
সুতরাং রাসূলের সত্তার সাথে কারো আনুগত্য ও অনুসরণের সম্পর্কের অর্থ হলো তার সীরাত ও জীবনাদর্শের অধ্যয়ন ও চর্চা করা অপরিহার্য। কেননা এই অধ্যয়ন ও চর্চা ছাড়া তার আনুগত্য ও অনুসরণ সম্ভব নয়।
দুই. পয়গম্বরের সাথে মানুষের সম্পর্ক অনিবার্য প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক। কেননা তিনি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল ও তাঁর প্রিয় বান্দা। আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কেরামকে এরও অনুমতি দেননি যে, রাসূলের সাথে কথাবার্তা বলার সময় তাঁদের আওয়াজ রাসূলের আওয়াজ থেকে উঁচু হয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর কন্ঠস্বরের ওপর নিজেদের কন্ঠস্বর উঁচু করো না।’ (সূরা হুজরাত-২)
আরো ইরশাদ হয়েছে, রাসূলকে ডাকার ধরন যেন অন্যদের ডাকার ধরনের মতো না হয়। ইরশাদ হচ্ছে, ‘রাসূলের আহবানকে তোমরা তোমাদের একে অপরের প্রতি আহবানের মতো গণ্য করো না।’ (সূরা নূর-৬৩)
শুধু রাসূলের ভালবাসাই যথেষ্ট নয়, বরং সে ভালবাসা হতে হবে উম্মাদনা ও পাগলের মতো। এমন ভালবাসা যা নিজের জান-প্রাণ থেকেও বেশি হবে। হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্ততি থেকেও বেশি রাসূলকে ভালো না বাসবে।’ (বুখারী ও মুসলিম)
বাস্তব কথা হলো, আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের অন্তরে রাসূলের এমন ভালবাসা প্রোথিত করে দিয়েছেন যা অতি পবিত্র, সত্য, নিষ্কলুষ ও নির্মল, যার কোনো তুলনা পৃথিবীতে নেই।
সুতরাং মুসলমানদের সম্মিলিত আকীদা-বিশ্বাস হলো, রাসূলের সম্মান ও ভালবাসা ঈমানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তার অবমাননা ও অসম্মান কুফর ও ইরতিদাদের (ধর্মান্তর) কারণ। এটি সর্বস্বীকৃত বিষয়। আমাদের পূর্বসূরী মনীষীদের অবস্থা এই ছিল যে, তাঁরা শুধু রাসূলকে ভালই বাসতেন না, বরং তাঁর স্বভাবজাত রুচি-অভিরুচিও তাঁদের নিকট প্রিয় ছিল। কেউ তাঁর সম্পর্কে অসন্তুষ্টি ও অনাগ্রহ প্রকাশ করবে, এটাও তাঁরা বরদাশত করতে পারতেন না। এজন্যই ফুকাহায়ে কেরাম রাসূলের কোনো সুন্নাত ও আমলের উপহাস করাকে কুফরের কারণ আখ্যা দিয়েছেন।
রাসূলের প্রতি এই ভালবাসা ততক্ষণ সৃষ্টি হতে পারে না, যতক্ষণ তার জীবন ও সীরাতকে অধ্যয়ন ও চর্চা না করা হবে। কারণ যতক্ষণ মানুষ কারো ব্যক্তিত্ব, তার পবিত্র জীবন ও কীর্তি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল না হবে ততক্ষণ তার অন্তরে ওই ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে না আযমত ও মুহাব্বত সৃষ্টি হবে আর না তার সত্য ভালবাসা তার অন্তরে বিকশিত হবে। এ বিষয়ে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কথা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক ব্যক্তি রামের পূজা করেও হিন্দু হয় আবার রামের প্রতিকৃতি অগ্নিদগ্ধ করেও হিন্দু হয়। খৃস্টানদের সাথে ইহুদীদের উঞ্চ সম্পর্কের ধরনটিই দেখুন। ইহুদীরা আজও হযরত ঈসা মসীহকে জারজ সন্তান এবং হযরত মারিয়ামকে যিনাকারীনি আখ্যা দেয়। এখন চিন্তা করুন, হযরত ঈসার কতটুকু আযমত, মুহাব্বত ও ভালবাসা তাদের অন্তরে আছে?
তিন. ইসলামের সকল সম্পর্কের ভিত্তিমূল হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ এবং শরীয়তের সকল বিধি-বিধানের বুনিয়াদ হলো তাঁর মহান সত্তা ও সিফাত। আমরা আল্লাহকে এক স্বীকার করি। ওহী ও রিসালতের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করি। আখিরাতের ওপর আমাদের ঈমান আছে। কিছু জিনিসকে ফরজ ও ওয়াজিব আর কিছু জিনিসকে হারাম ও মাকরূহ মনে করি এবং কিছু আহকাম হালাল ও বৈধ সাব্যস্ত করি। এই সকল বিশ্বাস ও আমলগত আহকামের বুনিয়াদ হলো আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত। আল্লাহর কিতাব দ্বারা উদ্দেশ্য ওই আসমানী কিতাব যা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর ওপর নাযিল হয়েছে। আর সুন্নাত হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদেশ-নিষেধ ও কর্মকান্ড।
মোটকথা, দীনের এই দুই মূল উৎস রাসূলের সত্তার সাথেই সংশ্লিষ্ট। এজন্য সত্য দীনের ধারক-বাহকরা সর্বদা রাসূলের মহান সত্তাকেই টার্গেট বানিয়েছে। ক্রুসেড যুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয়ের পর পশ্চিমা গোষ্ঠী নিরাশ হয়ে গেল যে, এখন আর মুসলমানদেরকে সম্মুখ সমরে পরাজিত করা সম্ভব নয়। তাই তারা কৌশল পরিবর্তন করে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কলমের মাধ্যমে ইসলামের ওপর হামলা শুরু করল। যেটাকে ওরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার আন্দোলন বলে। এ রাস্তায় তারা কুরআন-হাদীসের সনদ ও গ্রহণযোগ্যতা থেকে শুরু করে আহকামে শরীয়তের যৌক্তিকতা ও ইসলামী ইতিহাস পর্যন্ত-দীনের প্রত্যেক বিভাগকেই হামলার টার্গেট বানিয়েছে। কিন্তু ইসলামের নবীর পবিত্র ও নিষ্কলুষ জীবনকেই তারা বিশেষ টার্গেটের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। কেননা তাঁর সত্তার ওপরই ইসলামের ভিত নির্মিত। যদি তাঁর সত্তা ও ব্যক্তিত্বকে আহত ও সন্দেহযুক্ত করে দেয়া যায়, তাহলে দীনের গোটা প্রাসাদকেই সহজেই বিধ্বস্ত করা সম্ভব হবে। সুতরাং ওরিয়েলিস্টরা এই কু-উদ্দেশ্যে সীরাত বিষয়ে এত বিপুল লেখা-লেখি করেছে যে, তার ফিরিস্তির জন্য স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থের প্রয়োজন।
এগুলোর বেশিরভাগ ইংরেজী ও অন্যান্য ইউরোপিয়ান ভাষায় রচিত। আর দুর্ভাগ্যবশতঃ সেসব ভাষাই আজ জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণা-অনুসন্ধান ও আবিষ্কার-উদ্ভাবনের প্রতিনিধিত্ব করছে। এজন্য বর্তমান যুগে শুধু অমুসলিমরাই নয়, বরং আধুনিক শিক্ষিত মুসলমানরাও এই ভাষাগুলোকে প্রচলিত মুদ্রার মতো ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে এবং তারা তাদের শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলো, বরং ধর্ম ও ইতিহাসও এসব ভাষাতেই অধ্যয়ন করছে।
এর ফল এই হয়েছে যে, যাদের সীরাত অধ্যয়ন কিংবা ইসলামের জ্ঞানার্জনের সুযোগ হয়, তারা এসব ভাষায় রচিত ওরিয়েন্টলিস্টদের গ্রন্থগুলোই অধ্যয়ন করে এ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে। ফলে তাদের অন্তরেও সন্দেহ-সংশয়ের কাঁটা বিধতে থাকে এবং তারা পশ্চিমের চশমায় দেখতে শুরু করে। অথচ ওরিয়েন্টালিস্টদের লেখা ও রচনাগুলো ইসলাম সম্পর্কে অতি বাড়াবাড়ি, গোঁড়ামী, স্বজনপ্রিয়তা ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্ত নয়। দ্বিতীয়তঃ ওরিয়েন্টালিস্টদের বড় একটি অংশ এমন রয়েছেন, যারা আরবী ভাষা সম্পর্কে সরাসরি ওয়াকেফহাল নন। তাদের জ্ঞান ভায়া হয়ে এসেছে এবং তারা এমন এমন উক্তির পুনরাবৃত্তি করেছে, যার অসারতা ও অযৌক্তিকতা বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
মোটকথা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য ও অনুসরণের জন্যে, তাঁর কাঙ্ক্ষিত মুহাব্বত-ভালোবাসায় হৃদয়-মনকে সিক্ত করার জন্যে, ঈমানের সুরক্ষার জন্যে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে কলম ও বুদ্ধিবৃত্তিক ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সহীহ সূত্রের সীরাতে নববী অধ্যয়ন করা সময়ের অপরিহার্য দাবী। যার প্রতি অবহেলা করা কোনোভাবেই সমীচীন হবে না। বিশেষ করে মুসলিম যুবসমাজকে সীরাত চর্চায় আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে। মুসলমানদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ ধরনের আয়োজন থাকা উচিত। যাতে মুসলিম সন্তানরা প্রয়োজন পড়লেই সীরাতের কিতাব অধ্যয়ন করতে পারে।
এটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যে, সীরাতের কিতাব কীভাবে অধ্যয়ন করবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সীরাতের দুটি অংশ রয়েছে। একটি অংশ তাঁর ফাযায়েল ও প্রশংসা। এর তো কোনো শেষ নেই। তাঁর ফযীলত ও প্রশংস অগণিত। কবির ভাষায়-‘আল্লাহর পরে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ সত্তা।’ সাধারণভাবে আমাদের অধিকাংশ ওয়াজ-মাহফিলে এ অংশটিরই বেশি আলোচনা হয়। আমি এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছি না। কিন্তু সীরাত অধ্যয়নের ক্ষেত্রে এই একটি বিষয়কেই যথেষ্ট মনে ঠিক নয়। বরং সীরাত অধ্যয়নের এটিও একটি দিক যে, রাসূলের সীরাতকে নিজের বাস্তব জীবনের জন্য আয়না ও দর্পণ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এবং সেটিকে সামনে রেখে নিজের সংশোধন করতে হবে ও স্বীয় আমল-আখলাককে সে আলোকে সজ্জিত করবে।
ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে তো আমরা সুন্নাতে নববীর দিকে প্রত্যাবর্তন করি, কিন্তু সামাজিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন, সাংস্কৃতিক জীবন ও আন্তর্জাতিক জীবনকে আমরা সীরাতে নববীর আলোকে সজ্জিত করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি না। অথচ এগুলো ছাড়া ইসলামকে কল্পনাই করা যায় না। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামের ওপর ঈমান আনার সাথে সাথে তার পূর্ণাঙ্গতার ওপরও ঈমান ও আস্থা পোষণ করতে হবে। এমনিভাবে সীরাতে নববীর আলোকে আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে কোথায় মুসলমানদের অবস্থা মক্কী জীবনের মতো এবং সেখানে আমাদের ভূমিকা কী হবে আর কোথায় মুসলমানদের অবস্থা মাদানী জীবনের মতো এবং সেখানে আমাদের জন্য রাসূলের আদর্শ কী?
আফসোস! শত আফসোস!! আমরাও আমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে ওইসব লোকের মতো শুধু পার্থিব ও বস্তুগত লাভ-ক্ষতির দৃষ্টিকোণ থেকেই বিবেচনা ও পরিকল্পনা করি, যারা আল্লাহ, রাসূল ও তাঁর দীনের ওপর ঈমান রাখে না। অথচ মুসলমান হিসেবে আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে রাসূলের আদর্শের অনুসরণ ও আনুগত্য করা অপরিহার্য।
লেখক : পরিচালক, শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও আমীর, পয়ামে ইনসানিয়াত বাংলাদেশ।
Facebook Comments