নবিজি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরবের বুকে যে দাওয়াত প্রচার করেছিলেন ধীরে ধীরে সেই দাওয়াত ছড়িয়ে পড়েছিল অর্ধবিশ্ব জুড়ে। এই দাওয়াতের সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছিল পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য। অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষ পেয়েছিল আলোর দিশা। পথহারা পেয়েছিল পথের সন্ধান। মাজলুম পেয়েছিল জুলুম থেকে মুক্তি।
প্রথম যুগের মুসলমানরা ছিলেন নবিজির হাতে গড়া শিষ্য সাহাবায়ে কেরাম। তারা তৈরী করেছিলেন তাবেঈদের এক বিশাল জামাত। তারা তৈরী করেছিলেন তাবে তাবেঈদের জামাত। এই সময় মুসলমানদের ঈমানি শক্তি ছিল পাহাড়ের চেয়েও দৃঢ়। দিনের বেলা তারা ছিলেন অশ্বারোহী, আর রাতের আঁধারে রবের ইবাদতে ব্যস্ত একনিষ্ঠ বান্দা। তারা নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন আল্লাহর কালিমা সমুন্নত করার জন্য। কিন্তু সময়ের আবর্তনে পরবর্তীদের মধ্যে ধীরে ধীরে এই চেতনা হ্রাস পেতে থাকে।
নতুন নতুন ফিতনা মুসলিম বিশ্বকে একের পর এক আঘাত করতে থাকে। আভ্যন্তরিন কোন্দল ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ইসলামী সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে ফেলে। শাসকদের হাত ধরে সুচনা হয় অবক্ষয়ের। তারা নিজেরা নানাভাবে নৈতিক অধপতনের শিকার হয়। জনগনও তাদের অনুসরণ করতে থাকে। হিজরী সপ্তম শতাব্দীর ঘটনাবলী পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি এ সময় শাসকগোষ্ঠী ও জনগন এমন অনেক পাপাচারে জড়িয়ে পড়ে যা হিজরী প্রথম শতাব্দীতে কল্পনাও করা যেত না। এই সময়ের মুসলমানদের এই অধপতনের জন্য মোটাদাগে ৫টি বিষয়কে দায়ী করা যায়।
১। দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা
২। জিহাদ ত্যাগ করা
৩। আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত প্রচারে অনাগ্রহ
৪। আকিদাগত বিভ্রান্তি ও দূর্বলতা
৫। মুসলমানদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব।
এই পাঁচটি বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
১। দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা
এটি এমন এক রোগ যা মুমিনদেরকে তাদের প্রকৃত গন্তব্য ও মিশন ভুলিয়ে দেয়। এই লোভে পড়ে মুমিনরা তাদের মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে যায়। অস্থায়ী পার্থিব বিষয়াদী নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হিজরী সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে আমরা দেখি এই সময়ের লোকজন পার্থিব ভোগবিলাসে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
এটা ঠিক, এই সময়ে সে সকল মহান মুজাহিদরা জীবিত ছিলেন যারা সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবী রহিমাহুল্লাহর সাথে বাইতুল মাকদিস জয়ের জিহাদে অংশগ্রহন করেছিলেন। জীবিত ছিলেন তারাও যারা শিহাবুদ্দিন ঘুরীর সাথে লড়াই করেছিলেন ভারতবর্ষের মাটিতে, চূর্ন করেছিলেন পৃথ্বীরাজের দর্প।
এই মহান মুজাহিদদের একটা বড় অংশই তখন জীবিত ছিলেন, কিন্তু তরুণ সমাজের মধ্যে পূর্বসূরীদের এই চেতনা কাজ করছিল না। তারা ছিল ভোগ বিলাসে ব্যস্ত। শাসকদের অবস্থাও তাদের ব্যতিক্রম ছিল না। আমীর ও উজিরদের ঘরের শোভাবর্ধন করতো পারস্য ও তুর্কিস্তান থেকে আসা গায়িকা দাসী। নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র এ সময় সহজলভ্য হয়ে উঠেছিল। যা থেকে তখনকার মানুষের রুচি ও মনমানসিকতা অনুধাবন করা যায়।
২। জিহাদ ত্যাগ করা
দুনিয়ার প্রতি মোহবৃদ্ধির চুড়ান্ত পরিনতি হলো জিহাদ ত্যাগ। যখন মানুষ দুনিয়ার মোহে আটকা পড়ে, সম্পদ ও পরিবারের মায়া ছাড়তে পারে না তখন সে জিহাদের জন্যও প্রস্তুত হতে পারে না। জিহাদের পথে ঝুঁকি রয়েছে। রয়েছে মৃত্যুর সম্ভাবনা। দুনিয়ার মোহত্যাগ করা ছাড়া এ পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব না। আমরা আমাদের সময়েও এটি ঘটতে দেখছি। দুনিয়া ও দুনিয়ার মোহ আমাদের অন্তরে জেঁকে বসেছে। ফলে দূর হয়েছে শাহাদাতের তামান্না। জিহাদের ময়দানের চেয়ে বিলাসী জীবন হয়ে উঠছে আমাদের প্রিয়। আমরা যে সময়ের মানুষের কথা বলছি, তারাও দুনিয়া নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। জিহাদ ত্যাগ করেছিল।
খিলাফতে আব্বাসিয়্যা ছিল মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্র। উম্মাহকে বহিশত্রুর আক্রমন থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল তাদের। এ সময় খেলাফতের মসনদে ছিলেন খলিফা নাসির লি দিনিল্লাহ। কিন্তু আমরা দেখি তিনি জিহাদের প্রতি কোনো আগ্রহই দেখাননি। বহিশত্রুর মোকাবেলা করার চেয়ে আঞ্চলিক মুসলিম শাসকদের দমন করাই তাঁর মূল কাজ হয়ে দাড়িয়েছিল।
ঐতিহাসিক ইবনুল আসির তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, তাঁর সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল নিশানাবাজী ও কবুতরের খেলা দেখায়। বর্তমান সময়ও আমরা দেখছি কীভাবে বিভিন্ন খেলাধুলা ও টুর্নামেন্ট মানুষের সকল আগ্রহ ও ব্যস্ততার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। মানুষ খেলার প্রতি তাদের সকল সময় ও মনোযোগ ব্যয় করছে। খেলোয়ারদেরকে নিজেদের আইডল হিসেবে মেনে নিচ্ছে। এসবই আমাদের পতনের কারণ নির্দেশ করছে।
খলিফা নাসির জিহাদের পরিবর্তে নিশানাবাজী ও কবুতরের খেলাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। নিশানাবাজী তাঁর কাছে এতটাই গুরুত্ব রাখতো যে এজন্য তিনি ‘আল ফুতুওয়্যাতু’ (তারুণ্য, যৌবন) নামে একটি দল গঠন করেন। এই দলের সদস্যদের জন্য বিশেষ ধরনের পোশাক বরাদ্দ করা হয়। এই পোশাককে বলা হত লিবাসুল ফতুয়্যাহ। যারা এই পোশাক পরতো শুধু তারাই নিশানাবাজীতে অংশ নিতে পারতো। খলিফার নৈকট্য অর্জনের জন্য আঞ্চলিক শাসকদের অনেকেই এই দলের সদস্যপদ গ্রহন করে।
খিলাফতের পক্ষ থেকে তাদেরকে লিবাসুল ফতুয়্যাহ দেয়া হয়। খলিফার এই আচরণের প্রভাব জনগনের উপরও বিদ্যমান ছিল। সেনাবাহিনীতে যোগদানের চেয়ে রাজদরবারে কোনো পদ অর্জনকে চুড়ান্ত সাফল্য মনে করা হত। সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকদের ব্যস্ততা ছিল নাচগান ও কাব্যচর্চা।
৩। দাওয়াত ফী সাবিলিল্লাহ ত্যাগ করা
ইসলামের শুরুর যুগে মুসলমানরা সচেষ্ট ছিলেন দীনের দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে। এ সময় মুসলমানদের আমল আখলাক ও আচার-ব্যবহারই অন্যদের কাছে পৌছে দিত ইসলামের সৌন্দর্যের বার্তা। শাসকগোষ্ঠিও এ দিকে খেয়াল রেখেছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে এই স্পৃহা নষ্ট হয়ে যায়। যদিও সুফিদের এক বড় জামাত নিজেদেরকে এই মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার কাজে নিয়োজিত রেখেছিলেন, কিন্তু শাসক ও সাধারণ জনগনের এদিকে তেমন একটা ভ্রুক্ষেপ ছিল না।
দাওয়াত ফি সাবিলিল্লাহ ইসলামের গুরুত্বপূর্ন একটি দায়িত্ব। যে ব্যক্তি অন্যকে দীনের দাওয়াত দেয় না, সে অন্যের মাদউ হয়। অর্থাৎ তাকেই অন্য কেউ দাওয়াত দেয়। সে অন্যের দাওয়াত গ্রহন করে। ইতিহাসে যখনই মুসলমানরা দাওয়াতের ব্যাপারে গাফেল হয়েছে তখনই তাদের মাঝে বিজাতীয় রীতিনিতি ও সংস্কৃতি প্রবেশ করেছে। হিজরী সপ্তম শতাব্দীর মুসলমানরাও দ্বীনের দাওয়াত প্রচারের ব্যাপারে গাফেল ছিলেন।
খাওয়ারেজম সাম্রাজ্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী লিখেছেন, খাওয়ারেজমের সুলতানরাও সেই একই ভুল করলেন, যে ভুল করেছিলেন স্পেনের আরব শাসকরা। এই ভুল আল্লাহ ক্ষমা করেননি। তারা নিজেদের সকল শক্তি ব্যয় করেছিলেন সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ও প্রতিপক্ষকে দমন করার কাজে। যে সব মানব বসতি তাদের সীমান্তের কাছে ছিল সেখানে ইসলামের দাওয়াত পৌছানোর ব্যপারে তারা কোনো চিন্তা ফিকির করেননি। ধর্মীয় আবেগ ও প্রেরণার কথা বাদই দিলাম, রাজনৈতিক কারণেও তো তারা এই বিস্তৃত মানব বসতিকে নিজেদের সমমনা ও একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী করে তুলতে পারতেন। এই কাজ করলে তারা সেই বিপদ থেকে রক্ষা পেতেন, যা পরে তাদের সামনে এসে দাড়িয়েছিল।
৪। আকিদাগত বিভ্রান্তি
হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বে আকিদাগত কয়েকটিও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল। এর কয়েকটিকে দমন করা গেলেও তাঁর প্রভাব অক্ষত ছিল। ফাতেমিরা তিনশো বছর মিশর শাসন করেছিল। এই সময় তারা তাদের বাতিল মতবাদ প্রচারের সর্বাত্মক চেষ্টা করে। বুয়াইহিরা বাগদাদে নানাভাবে শিয়া মতবাদ প্রচার করেছিল। যার ফলাফল স্বরুপ বাগদাদে নিয়মিত শিয়া সুন্নী দাংগা হচ্ছিল।
কাযভিনের কাছে আলামুত কেল্লায় হাসান বিন সাব্বাহ বাতেনী মতবাদ প্রচার করেছিল। তাঁর মৃত্যুর পরেও এই ফিরকা তাদের শক্তি হারায়নি। তারা একের পর এক শায়খুল জাবাল নির্বাচিত করে তাঁর অধীনে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় মুসলিম বিশ্বে কবর ও মাজার কেন্দ্রিক শিরক বিদআতের ব্যাপক প্রসার ছিল। লোকজন নিজেদের প্রয়োজন পূর্ন করার জন্য মাজারে যেত। মৃত ব্যক্তির কাছে প্রার্থনা করত।
এই ধরনের লোকদের বেশিরভাগই ইবাদত বন্দেগির বদলে মাজারে গমনকেই নিজেদের মূল উদ্দেশ্য বানিয়ে নিয়েছিল। বর্তমান সময়েও আমরা দেখছি মুসলিম জনসাধারনের এক বিশাল অংশ নিয়মিত মাজারে যাচ্ছে। মৃত ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাচ্ছে, সন্তান ও ধন সম্পদ চাচ্ছে। তারা সহীহ আকিদা ও বিশ্বাস থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে।
৫। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব
হিজরী সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে মুসলিম বিশ্বের শাসকরা ব্যস্ত ছিলেন পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে। মধ্য এশিয়ায় ঘুরী সাম্রাজ্য ও খাওয়ারেজম সাম্রাজ্য একে অপরের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্তি পরিক্ষা করছিল। হেজাজে কাতাদাহ হুসাইনি ও সালেম হুসাইনি নামে দুই আমির নিজেদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ব্যস্ত ছিলেন। মিসর ও সিরিয়ায় সালাহুদ্দিন আইয়ুবির বংশধররা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে ব্যস্ত ছিলেন। তাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ক্রুসেডারদের আবার মুসলিম ভূখন্ডে আক্রমনের সাহস দেখাচ্ছিল।
এই পাঁচটি বিষয় উম্মাহর অধঃপতন ডেকে আনছিল। হিজরী পঞ্চম শতাব্দীতেও এই বিষয়গুলো মুসলিম ভূখন্ডে ক্রিয়াশীল ছিল। তখন মুসলমানদের উপর আজাবরুপে আবির্ভুত হয় ক্রুসেডাররা। তারা লাখ লাখ মুসলমানকে হত্যা করে বাইতুল মাকদিস দখল করে নেয়। পরে নুরুদ্দিন জেংগি ও সালাহুদ্দিন আইয়ুবী উম্মাহর ত্রানকর্তা হিসেবে আবির্ভুত হন। তারা উম্মাহর মধ্যে জিহাদের প্রেরনা জাগিয়ে তোলেন। ঘুমন্ত উম্মাহ আবার জেগে উঠে। কিন্তু তাদের পর আবারও পুরনো গাফলত জেঁকে বসে। মুসলমানরা নিজেদের শক্তি হারাতে থাকে। তাদের মধ্যে অধঃপতনের লক্ষনগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। তারা নবী মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনীত দীন থেকে সরতে থাকে।
(মাওলানা ইসমাইল রেহানের লেখা অবলম্বনে)