সংকলন
দরসে কোরআন মাহমুদ সিদ্দিকী লেখক

দোয়া : কুরআনের কিছু নির্দেশনা | মাহমুদ সিদ্দিকী

দোয়া হলো ইবাদতের প্রাণ।

এই যে সালাত, তার সবটা মূলত দোয়া; প্রথমে আল্লাহ্‌ তাআলার বড়ত্ব-মহত্ব দিয়ে সূচনা। তারপর সুরা ফাতিহা থেকে শুরু হয় দোয়া। প্রশংসা ও গুণগান সেরে উঠতেই শুরু হয়ে যায় প্রার্থনা—“আমাদেরকে দিন সিরাতুল মুস্তাকিমের দিশা; যে-পথে চলে গেছেন আপনার নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দারা; সে-পথ নয়, যে-পথে চলেছে অভিশপ্ত ইহুদি ও ভ্রষ্ট নাসারা”।(১) ফাতিহা শেষ করতেই যে-শব্দটি পাঠ করা হয়—‘আমিন’; ‘আমাদের দোয়া কবুল করে নিন প্রভু’। মাটির সৃষ্টি সালাত আদায়কারীর আমিন বলার সাথে-সাথে তখন নুরের তৈরি ফিরিশতাও আমিন বলেন।(২)

সালাতের ভাষিক অর্থই হলো দোয়া। দরুদের ভাষিক অর্থও দোয়া। ইবাদত শেষে দোয়া না করলে প্রাণটা ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—“দোয়া হলো ইবাদতের প্রাণ”। আক্ষরিক অনুবাদে হাদিসটি দাঁড়ায় এই—“দোয়াই হলো ইবাদত”।(৩) অপর এক হাদিসে প্রিয় হাবিব বলেছেন—“দোয়া হলো ইবাদতের মগজ”।(৪) অর্থাৎ, মগজবিহীন মুণ্ডুটা যেমন অপূর্ণ থেকে যায়, তেমনি দোয়া না করলেও ইবাদতে এমন একটা অপূর্ণতা রয়ে যায়। আর আল্লাহ্‌ তাআলা তো বলেছেনই—“তোমরা আমাকে ডাকো; আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো”।(৫)

কীভাবে করব দোয়া?

সোজা বাংলায় দোয়ার মানে হলো আল্লাহ্‌ তাআলাকে ডাকা এবং তাঁর কাছে কোনোকিছু চাওয়া। আল্লাহ্‌ তাআলার কাছে চাওয়ার কিছু মূলনীতি আছে। সেইসব মূলনীতি আল্লাহ্‌ তাআলা কুরআনে শিক্ষা দিয়েছেন। সুরা ফাতিহা সহ অসংখ্য সুরাতে দোয়া করার পদ্ধতির উল্লেখ আছে। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই মূলনীতি অনুসরণ করে বহু ব্যবহারিক দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। বিভিন্ন নবি কীভাবে দোয়া করেছেন—সেগুলো বিবৃত করে কুরআন আমাদের সামনে দোয়া করার মূলনীতি বলে দিয়েছে।

১. প্রশংসা গুণগান বর্ণনা করা

দোয়া করার যে-পদ্ধতিটি কুরআন আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছে তা হলো—প্রথমেই আলাহ তাআলার দরবারে তাঁর বড়ত্ব, মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের নজরানা পেশ করতে হবে। সুরা ফাতিহার প্রথম আয়াতগুলো দেখুন—“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিনের, যিনি রহমান ও রহিম; যিনি বিচারদিবসের মালিক”।(৬)

হামদ ও সানা—প্রশংসা ও প্রশস্তি করা শেষ, এরপর অনুনয়-বিনয় প্রকাশ, তারপরে শুরু হবে মূল দোয়া। ইবনে কাসির রহ.ও এমনটাই বলেছেন।(৭)

সুরা ফাতিহার হাদিসে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—“সালাতকে আমি আমার ও বান্দার মাঝে ভাগ করে দিয়েছি; অর্ধেক আমার জন্য, অর্ধেক আমার বান্দার জন্য”।(৮) পূর্বেই বলা হয়েছে, সালাত হলো এক প্রকার দোয়া। অর্থাৎ, দোয়ার প্রথম অংশে আল্লাহ্‌ তাআলার জন্য প্রশংসা ও গুণগান পেশ করতে হবে। তারপর নিজের প্রয়োজনের কথা পেশ করতে হবে।

২. কাকুতিমিনতি করা

দোয়াকে হাদিসে বলা হয়েছে ইবাদত। ইবাদত মানে হলো রবের দাসত্ব করা, তাঁর নির্দেশ পালন করা। উবুদিয়্যাত ও দাসত্বের ক্ষেত্রে আবদ বা দাসের নিজস্ব কোনো পছন্দ বা অভিরুচির সুযোগ নেই। রব ও প্রভু যেভাবে করতে বলবেন, সেভাবেই করতে হবে। রবের প্রতি ভয় ও ভালোবাসা রেখে যাচনা করতে হবে। এই কথাটাই ইবনে কাসির রহ. (৭৭৪ হি.) বলেছেন এভাবে—“ভাষিক অর্থে ইবাদত হলো হীনতা-দীনতা। পারিভাষিক অর্থে—পরিপূর্ণ মুহাব্বাত, বিনয়-নম্রতা ও ভয়ের সমষ্টি হলো ইবাদত”।(৯)

সুতরাং পরিপূর্ণ মুহাব্বাত, নমনীয়তা ও ভয়ের সাথে দোয়া করতে হবে। তাহলে সেটা ইবাদতের পরিচয় লাভ করবে।

এই বিষয়টিই সুরা ফাতিহাতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। প্রথমে আল্লাহ্‌ তাআলার প্রশংসা ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনার পর নিজেদের দাসত্বের কথা পেশ করতে বলা হয়েছে—“আমরা কেবল আপনারই ইবাদত করি”। ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু ‘ইয়্যাকা না’বুদু’র তাফসিরে বলেছেন—“এর মানে হলো, আমরা আপনার একত্ব বয়ান করি, আপনাকে ভয় করি এবং আপনার কাছে আশা রাখি”।(১০)

৩. ভয় আশা রাখা

দোয়া করবার জন্য তৃতীয় যে-মূলনীতি সামনে আসে তা হলো—অন্তরে ভয় ও আশা রাখা। দোয়ার সময় হৃদয়ে একদিকে থাকবে আল্লাহ্‌ তাআলার শাস্তির ভয়; অপরদিকে থাকবে তাঁর ক্ষমা ও প্রতিদানের আশা।

দোয়ার মধ্যে এই গুণ থাকার কারণে আল্লাহ্‌ তাআলা কুরআনে যাকারিয়া আলাইহিসসালামের পরিবারের প্রশংসা করেছেন। তাঁর দোয়া কবুলের কথা উল্লেখ করে বলেছেন—“নিঃসন্দেহে তাঁরা ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করত; এবং আমার কাছে দোয়া করত আশায়-আশায় ও ভয়ে-ভয়ে। তাঁরা ছিল আমার প্রতি অনুগত”।(১১) সুফিয়ান সাওরি রহ. এই আয়াতের তাফসিরে বলেন—“তাঁরা আল্লাহ্‌ তাআলার প্রতিদানের আশা করতেন এবং শাস্তির ভয় করতেন”।

সর্বশ্রেষ্ঠ সাহাবি আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু একদিন খুতবা দিচ্ছিলেন। খুতবায় বললেন—“তোমরা দোয়ার সময় আশার সাথে ভয়ও রাখবে। পাশাপাশি খুব অনুনয়ের সাথে বারবার চাইতে থাকবে। কেননা আল্লাহ্‌ তাআলা এই গুণের কারণে যাকারিয়া আলাইহিস সালাম ও তাঁর পরিবারের প্রশংসা করে বলেছেন—নিঃসন্দেহে তাঁরা ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করত; এবং আমার কাছে দোয়া করত আশায়-আশায় ও ভয়ে-ভয়ে। তাঁরা ছিল আমার প্রতি অনুগত”।(১২)

একই কথা কুরআনে আরও একবার এসেছে। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের গুণাবলি বর্ণনায় এক পর্যায়ে বলছেন—“বিছানা থেকে তাদের পার্শ্বদেশ আলাদা হয়ে যায়; তাঁরা তাঁদের রবকে ডাকে ভয়ে-ভয়ে ও আশায়-আশায়”।(১৩) এই আয়াতের তাফসিরেও একই কথা; মুমিনগণ আল্লাহ্‌ তাআলার শাস্তির ভয় ও প্রতিদানের আশা—এই উভয়টির সম্মিলন ঘটিয়ে দোয়া করে।(১৪)

. আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি মুখাপেক্ষিতা প্রদর্শন করা

একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, প্রতিটি মানুষই আল্লাহ্‌ তাআলার অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী। আল্লাহ্‌ তাআলার দয়া-অনুগ্রহ ও করুণা না হলে সুস্থ-সবল, স্বাভাবিক-স্বচ্ছন্দ জীবন পরিচালনা করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। এই যে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস—রবের অনুগ্রহ ব্যতীত পরবর্তী শ্বাসটি গ্রহণেরও কোনো ক্ষমতা নেই। তাই, আল্লাহ্‌ তাআলার কাছে চাওয়ার ক্ষেত্রে নিজের মুখাপেক্ষিতা দেখাতে হবে। আল্লাহ ছাড়া আর কেউ সহায় নেই—এই কথাটা দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে খুলে বলতে হবে। স্বীকার করতে দ্বিধা করা যাবে না। এর চমৎকার উদাহরণ মুসা আলাইহিস সালামের দোয়াটি।

মুসা আলাইহিস সালাম ক্লান্ত-শ্রান্ত। মিসর থেকে সফর করে মাদায়েন পৌঁছেছেন। গাছের পাতা আর ক’টা সবজী ছাড়া সাথে খাবার-দাবার কিচ্ছু নেই। নগ্নপদ। মাদায়েন পৌঁছামাত্র পায়ের জুতাটি ছিঁড়ে গেছে। ক্ষুধায় পেট-পিঠ এক হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে ক’টা খেজুর খাওয়া দরকার।

মুসা আলাইহিস সালাম একটি গাছের ছায়ায় গিয়ে বসলেন। বসে দোয়া করলেন। কুরআন আমাদেরকে সেই দোয়া বিবৃত করে শোনাচ্ছে—“রব আমার, আপনি আমার প্রতি যে-রহমত নাযিল করবেন, নিশ্চয় আমি তার অভাবী”।(১৫) এই আয়াতে মুসা আলাইহিস সালাম নিজের অভাবী অবস্থার বিবরণ দিয়ে আল্লাহ্‌ তাআলার প্রতি সম্পূর্ণ মুখাপেক্ষিতা প্রদর্শন করেছেন; এই মুহূর্তে কেবল আল্লাহ্‌ তাআলার অনুগ্রহ দরকার।

দীর্ঘপথ সফরের পর আল্লাহ্‌ তাআলার প্রতি মুখাপেক্ষিতার যে-চিত্রায়ন এই দোয়ায় মুসা আলাইহিস সালাম করেছেন, তা আমাদের দোয়ায় থাকতে হবে।

একই চিত্র পাওয়া যায় কুরআনে বর্ণিত আদম আলাইহিস সালাম, নুহ আলাইহিস সালাম, এবং ইউনুস আলাইহিস সালামের দোয়ায়।

কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন নবিদের দোয়া

উপরোক্ত মূলনীতিগুলো যেসব দোয়ায় শতভাগ পাওয়া যায়, তা হলো—কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত দোয়াসমূহ। কুরআনে বর্ণিত দোয়াগুলো দুই ধরনের। এক, বিভিন্ন সময়ে করা পূর্ববর্তী নবিদের দোয়া। দুই, মুমিনদের সিফাত হিসেবে বা সাধারণভাবে বর্ণিত দোয়া।

কুরআনে আল্লাহ্‌ তাআলা বিভিন্ন নবির দোয়া উল্লেখ করেছেন। সেসব দোয়ার শব্দগুলো যেমন সর্বোচ্চ মুখাপেক্ষিতা প্রদর্শন করে, তেমনি দোয়ার সকল শর্তগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করে চমৎকারভাবে। এই দোয়াগুলোর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো—এগুলো সরাসরি ওহির মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তাআলা নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাযিল করেছেন। এজন্য দোয়াগুলো স্মরণে রাখা খুবই জরুরি। সাধারণ দোয়ার চেয়ে কুরআনের এইসব দোয়া আল্লাহ্‌ তাআলার কাছে আমাদের আকুতি তুলে ধরবেও বেশি।

আদম আলাইহিস সালামের দোয়া 

কুরআনে একাধিক জায়গায় আদম আলাইহিস সালামের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা আ’রাফে আল্লাহ্‌ তাআলা আদম আলাইহিস সালামের দোয়াটিকে বিবৃত করেছেন এভাবে—“প্রভু, আমরা যুলুম করেছি নিজেদের প্রতি। আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন, আপনি যদি আমাদের প্রতি রহম না করেন, তাহলে তো অতি অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব”। [رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ] (১৬)

নুহ আলাইহিস সালামের দোয়া 

প্রবল প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে সবকিছু। নুহ আলাইহিস সালামের এক সন্তানও ডুবে মরছে। নুহ আলাইহিস সালাম আর্তনাদ করে উঠলেন—আয় রব, আমার ছেলেটা ডুবে মারা যাচ্ছে; সে তো আমার পরিবারের। আল্লাহ্‌ তাআলা জানিয়ে দিলেন—সে আর তোমার পরিবারের নয়; বরং আগাগোড়া বদআমল। তারপর আল্লাহ্‌ তাআলা বললেন—“সুতরাং যে-বিষয়ে তোমার ইলম নেই, সে-বিষয়ে আমার কাছে কিছু চেয়ো না। মূর্খদের দলভুক্ত হতে তোমাকে বারণ করছি”। প্রত্যুত্তরে নুহ আলাইহিস সালাম ক্ষমা চাইলেন আল্লাহ্‌ তাআলার কাছে—“প্রভু, যে-বিষয়ে আমার ইলম নেই, সে-বিষয়ে আপনার কাছে কোনোকিছু চাওয়া থেকে আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি। আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন এবং আমার প্রতি রহম না করেন, তাহলে তো আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব”। [رَبِّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَسْأَلَكَ مَا لَيْسَ لِي بِهِ عِلْمٌ ۖ وَإِلَّا تَغْفِرْ لِي وَتَرْحَمْنِي أَكُن مِّنَ الْخَاسِرِينَ] (১৭)

এই হলো উভয়ের দোয়া। উভয় দোয়াতে যে-বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে তা হলো—অক্ষমতা, অনুনয়-বিনয়, ভয় ও আশা, আল্লাহর প্রতি সর্বোচ্চ মুখাপেক্ষিতা এবং বান্দার অসহায়ত্ব। আল্লাহ্‌ তাআলা নবিদের জবানের এইসব দোয়া আমাদেরকে বিবৃত করেছেন মূলত শিক্ষা দেওয়ার জন্য। নয়ত, নবিগণ সকল ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে। আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁদের অগ্র-পশ্চাতের সবকিছু ক্ষমা করে দিয়েছেন।

মুসা আলাইহিস সালামের দোয়া 

এক কিবতি ও বনি ইসরাইলের এক সদস্য মারামারিতে লিপ্ত হয়েছে। বনি ইসরাইলের লোকটি মুসা আলাইহিস সালামের কাছে সাহায্য চাইল। মুসা আলাইহিস সালাম কিবতিকে ঘুষি মেরে বসলেন। সেই ঘুষিতে কিবতি লোকটি মারা গেল। মুসা আলাইহিস সালাম সন্ত্রস্ত হলেন। সন্ত্রস্ত হয়ে আল্লাহ্‌ তাআলার কাছে ক্ষমা চেয়ে দোয়া করলেন—“ইয়া রব, নিশ্চয় আমি যুলুম করেছি নিজের প্রতি। সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন”। [رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي] (১৮)

সেই ঘটনার পর দীর্ঘ পথ সফর করে মুসা আলাইহিস সালাম মাদায়েনে গিয়ে পৌঁছেন। সেখানে পৌঁছে দোয়া করেন—“আয় রব, আপনি আমার প্রতি যে-রহমত নাযিল করবেন, নিশ্চয় আমি তার অভাবী”। [رَبِّ إِنِّي لِمَا أَنزَلْتَ إِلَيَّ مِنْ خَيْرٍ فَقِيرٌ] (১৯)

আল্লাহ্‌ তাআলার নির্দেশে মুসা আলাইহিস সালাম তাঁর কওমের সত্তুর জন লোককে নির্বাচন করলেন তুর পাহাড়ে নিয়ে যাবেন বলে। পথিমধ্যে তাদের হঠকারিতার ফলে আল্লাহ্‌ তাআলার পক্ষ থেকে এক প্রকম্পন তাদেরকে আক্রান্ত করে। মুসা আলাইহিস সালাম তখন দোয়া বলেন—“আয় রব, আপনি যদি চাইতেন, তাহলে বহু আগেই এদেরকে ধ্বংস করে দিতেন; এবং আমাকেও। আমাদের কিছু নির্বোধের আমলের কারণে আপনি কি আমাদের ধ্বংস করে দিবেন। এটা আপনার পরীক্ষা। এই পরীক্ষার মাধ্যমে যাকে ইচ্ছা আপনি ভ্রষ্ট করেন, যাকে ইচ্ছা সুপথ দান করেন”। এই কাকুতি-মিনতি পেশ করার পর দোয়া করেন—“আপনি আমাদের অভিভাবক। সুতরাং আমাদেরকে আপনি ক্ষমা করে দিন; এবং রহম করুন আমাদেরকে। আর আপনি তো সর্বোত্তম ক্ষমাকারী। আপনি আমাদের জন্য ‘হাসানাহ’ লিখে রাখুন এই দুনিয়াতে এবং পরকালে। নিশ্চয় আমরা আপনার পথে ফিরে এলাম”। [أَنتَ وَلِيُّنَا فَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا ۖ وَأَنتَ خَيْرُ الْغَافِرِينَ ۞ وَاكْتُبْ لَنَا فِي هَٰذِهِ الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ إِنَّا هُدْنَا إِلَيْكَ] (২০)

ইউনুস আলাইহিস সালামের দোয়া 

মোসুলের এক গ্রামে ইউনুস আলাইহিস সালামকে নবি করে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তারা নবির দাওয়াতে সাড়া না দিলে এক সময় ইউনুস আলাইহিস সালাম তাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনদিন পড়ে শাস্তি আসার ঘোষণা দিয়ে রাগ করে চলে যান। পরবর্তীতে সেই গ্রামের বাসিন্দারা বুঝতে পেরে ইমান আনে এবং আল্লাহ্‌ তাআলার কাছে অনুনয়-বিনয় করে দোয়ার মাধ্যমে আযাব থেকে মুক্তি লাভ করে। এদিকে ইউনুস আলাইহিস সালাম একদল লোকের সাথে নৌযানে উঠে রওয়ানা দিয়েছেন অন্যমুখে। সমুদ্রের মাঝপথে গিয়ে তরী ডুবে যাওয়ার উপক্রম হলে নির্ধারিত হয়—লটারি করে একজনকে সমুদ্রে ফেলে দিতে হবে। লটারিতে নাম আসে ইউনুস আলাইহিস সালামের। তাঁকে ফেলে দেওয়া হয় সমুদ্রে। আল্লাহ্‌ তাআলার নির্দেশে এক বিশাল মাছ গিলে ফেলে ইউনুস আলাইহিস সালামকে। সুরা ইউনুস, আম্বিয়া, সাফফাত, এবং নুনে খণ্ডিতভাবে নুহ আলাইহিস সালামের এই ঘটনা বিবৃত হয়েছে। মাছের পেটে বসে ইউনুস আলাইহিস সালাম দোয়া করেন আল্লাহ্‌ তাআলার কাছে। তাঁর সারগর্ভ দোয়াটি কুরআন আমাদেরকে শেখাচ্ছে—“আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই প্রভু; আপনি চিরপবিত্র। আমিই ছিলাম যালিমদের দলভুক্ত”। [لَّا إِلَٰهَ إِلَّا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ] (২১)

এই সংক্ষিপ্ত দোয়াতে প্রথমেই আল্লাহ্‌ তাআলার তাওহিদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তারপর তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করা হয়েছে। এরপরের অংশটুকু হলো নিজের আমলের ব্যাপারে স্বীকারোক্তি। ইস্তেগফারের দোয়ার ক্ষেত্রে এই প্রসঙ্গটি খুবই জরুরি।

আইয়ুব আলাইহিস সালামের দোয়া 

আইয়ুব আলাইহিস সালামকে নিয়ে অনেক ইসরাইলি রেওয়ায়াত প্রচলিত আছে। সবকিছু বাদ দিয়ে শুদ্ধ কথাটি হলো—আইয়ুব আলাইহিস সালাম আল্লাহ্‌ তাআলা কর্তৃক পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাঁর সম্পদ ও সন্তানাদি—সবকিছুতে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন। সবকিছু আল্লাহ্‌ তাআলা নিয়ে নেন। তারপর শারীরিকভাবেও আক্রান্ত হন। তখন আইয়ুব আলাইহিস সালাম যে-দোয়াটি করেছিলেন তা হলো—“আমাকে দুঃখ-দুর্দশা আক্রান্ত করেছে; আপনি তো প্রভু সকল দয়াময়ের শ্রেষ্ঠ দয়াময়”। [أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ] (২২)

এই আয়াতে আইয়ুব আলাইহিস সালাম আল্লাহ্‌ তাআলার কাছে শুধু তাঁর দুঃখ-দুর্দশার কথা উল্লেখ করেছেন। এর বেশি কিছু বলেননি। বলার মধ্যেই এমন একটা ব্যাকুলতা ছিল, যা আল্লাহ্‌ তাআলা গ্রহণ করে নিয়েছেন। পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর দুঃখ-দুর্দশা দূর করার ঘটনা জানিয়েছেন। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (৭২৮ হি.) রহ. বলেন—“এই আয়াতটি হলো দোয়া ও প্রার্থনার ক্ষেত্রে সুন্দর আদবের উদাহরণ। একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির কাছে ‘আমি ক্ষুধার্ত বা আমি অসুস্থ’—এতটুকু বলে খাদ্য বা চিকিৎসা ব্যবস্থা চাওয়া হলো সুন্দর আদব। যদিও ‘আমাকে খাবার দিন বা আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন’ জাতীয় শব্দে চাওয়ার মাঝে একটা জোর দাবি আছে। কিন্তু প্রথম পদ্ধতিতে নম্রতা ও মুখাপেক্ষিতার প্রকাশ ঘটিয়ে প্রার্থীর অবস্থা জানানো হচ্ছে। আর দ্বিতীয়টিতে শুধু আবেদন আছে, নমনীয়তা ও মুখাপেক্ষিতা নেই”। (২৩)

কোনোকিছু চাওয়ার এই পদ্ধতিটি হলো সবচেয়ে সুন্দর পদ্ধতি। নিজের অসহায়ত্ব ও মুখাপেক্ষিতার কথা আল্লাহ্‌ তাআলার সামনে নিঃসংকোচে পেশ করে দেওয়া।

নবিদের দোয়াগুলোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো—আল্লাহ তাআলা সেইসব দোয়াকে কবুল করেছেন। তাই আশা করা যায়, আল্লাহ্‌ তাআলা আমাদের দোয়াগুলোও কবুল করবেন। “আর আমার দয়াময়তা সবকিছুকে বেষ্টন করে রেখেছে”।(২৪)

সূত্রসমূহ :

(১) ফাতিহা, আয়াত-৫-৭

(২) সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৭৮০

(৩) সুনানু আবি দাউদ, হাদিস নং-১৪৭৯; সুনানুত তিরমিযি, হাদিস নং-২৯৬৯

(৪) সুনানুত তিরমিযি, হাদিস নং-৩৩৭১

(৫) সুরা গাফির, আয়াত-৬০

(৬) সুরা ফাতিহা, আয়াত-১-৩

(৭) তাফসিরুল কুরআনিল আযিম ১/৮৮-৮৯, ইবনে কাসির, দারুল হাদিস, ১৪২৬ হি.

(৮) সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৩৯৫

(৯) তাফসিরুল কুরআনিল আযিম ১/৮৭, ইবনে কাসির, দারুল হাদিস, ১৪২৬ হি.

(১০) তাফসিরুল কুরআনিল আযিম ১/৮৮, ইবনে কাসির, দারুল হাদিস, ১৪২৬ হি.

(১১) সুরা আম্বিয়া, আয়াত-৯০

(১২) তাফসিরুল কুরআনিল আযিম ৫/৩৮০-৩৮১, ইবনে কাসির, দারুল হাদিস, ১৪২৬ হি.

(১৩) সুরা সাজদাহ, আয়াত-১৬

(১৪) তাফসিরুল কুরআনিল আযিম ৬/৩৮৭, ইবনে কাসির, দারুল হাদিস, ১৪২৬ হি.

(১৫) সুরা কাসাস, আয়াত-২৪; তাফসিরুল কুরআনিল আযিম ২/২৪০, ইবনে কাসির, দারুল হাদিস, ১৪২৬ হি.

(১৬) সুরা আ’রাফ, আয়াত-৩৩

(১৭) সুরা হুদ, আয়াত-৪৫-৪৭

(১৮) সুরা কাসাস, আয়াত-১৬

(১৯) সুরা কাসাস, আয়াত-২৪

(২০) সুরা আ’রাফ, আয়াত-১৫৫-১৫৬

(২১) সুরা আম্বিয়া, আয়াত-৮৭

(২২) সুরা আম্বিয়া, আয়াত-৮৩

(২৩) তাফসিরুল আয়াতিল কারিমা লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা… পৃ. ১৯-২০

(২৪) সুরা আ’রাফ, আয়াত-১৫৬

Related posts

তেলাওয়াত হোক তাদাব্বুর ও তারাওহের সাথে | সাদিকুর রহমান সাদী

সংকলন টিম

নির্মল জীবন-৬ | ইমরান রাইহান

সংকলন টিম

থানভীর পরশে-৪ | মাহমুদ সিদ্দিকী

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!