সংকলন
দরসে কোরআন

তেলাওয়াত হোক তাদাব্বুর ও তারাওহের সাথে | সাদিকুর রহমান সাদী

শাবান পেরিয়ে চলছে  রমাদ্বান। ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছে কুরআন নাজিলের মাস। মহিমান্বিত এই মাস মুখরিত হয়ে উঠে কুরআনপ্রেমিদের মনকাড়া মিষ্টিমধূর তেলাওয়াতে। সুরের মোহনায় সৃষ্টি হয় এক ঘোরলাগা জান্নাতি পরিবেশ। রহমতের মাসে দিন কিবা রাত, সময় পেলেই আমরা বসে পড়ি কুরআন নিয়ে। মন উজাড় করে তৃপ্তি নিয়ে তেলাওয়াত করি৷ সৃষ্টিকর্তার পরম করুণায় মাস জুড়ে পুরো কুরআন পড়ে ফেলি কয়েকবার। বছর জুড়েও চলে কুরআন পাঠের এই মহা উৎসব৷ ঘরে-ঘরে জমে উঠে তেলাওয়াতের মজমা। সালাত-কিয়াম জুড়েও থাকে কুরআনী আমেজ।

একবার ভাবুন তো,কুরআন পাঠের এই মহাউৎসব কি জমে উঠে তাদাব্বুর ও  তাফাক্কুরের সাথে??? তেলাওয়াত করতে গিয়ে কখনো ভেবেছি, দেখিতো আমি কি পড়ছি?আমার প্রভু কি  আমাকে কিছু বলছেন? ভেবে দেখেছি, আমি যা পড়ছি তা যদি বুঝে পড়তাম তাহলে তেলাওয়াতের স্বাদ আরো কত গুন বেড়ে যেত? কী অভাবনীয় পরিবর্তন আসতো আমার জীবনে?

হয়তো কখনো ভাবিনি। লম্বা সময় নিয়ে তেলাওয়াত করলেও মনের কোণে  উদয় হয়নি কুরআনের প্রতি তাদাব্বুরের ভাবনা।কুরআনের আয়াত নিয়ে ফিকিরের ভাবনা।অনুভব করিনি তাদাব্বুরে কুরআনের প্রতি হৃদয়ের সুপ্ত টান। অথচ নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তাদাব্বুর ও তাফাক্কুরের সাথে তেলাওয়াত আর সাধারণ তেলাওয়াতের ফায়দা কখনো এক হবে না৷ তাদাব্বুরের ফায়দা নিয়ে  কি চমৎকারই বলেছেন ইবনুল কাইয়ুম রহঃ! তিনি লিখেন-

‘তাদাব্বুর ও চিন্তা-ভাবনার সাথে কুরআন তিলাওয়াত করার মত অন্তরের জন্য উপকারী আর কিছু নেই। কুরআনের তিলাওয়াত মানুষের অন্তরে যেসব বিষয় সৃষ্টি করে তা হলো- আল্লাহর প্রতি ভালবাসা, জাহান্নামের ভয়, জান্নাতের প্রত্যাশা, তাওবা করার প্রতি আগ্রহ, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল, আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি সন্তুষ্টি, সব ব্যাপারে নিজেকে আল্লাহর কাছে সপে দেওয়ার মানসিকতা, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা, ধৈর্য ধারণ, অন্তরকে সজীবতা ও পূর্ণাঙ্গতা দানকারী গুণাবলী ইত্যাদী। এমনিভাবে কুরআনের তিলাওয়াত অন্তর থেকে মন্দ এবং হৃদয়-বিনষ্টকারী বিষয়াবলীও দূরিভূত করে। মানুষ যদি সঠিকভাবে জানত যে, চিন্তা-ভাবনার সাথে কুরআন তিলাওয়াতের মধ্যে কী ধরনের ফায়দা আছে, তাহলে অন্য সকল কিছু বাদ দিয়ে এটি নিয়েই তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ত। সুতরাং কেউ চিন্তা-ভাবনার সাথে কুরআন তিলাওয়াত করার সময় যদি এমন কোন আয়াত তার সামনে এসে পড়ে, যার মধ্যে তার জন্য অন্তরের আরোগ্য রয়েছে, তার কর্তব্য ঐ আয়াতটাকে বারবার তিলাওয়াত করা। দরকার হয় একশবার সেই আয়াতটি পুনরাবৃত্তি করবে। যদি সময়টা রাত্রিবেলা হয়ে থাকে তবুও। কারণ হলো, চিন্তা-ভাবনার সাথে ও অর্থ বুঝার চেষ্টা করে এক আয়াত তিলাওয়াত করা সাধারণভাবে এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করার চেয়েও উত্তম।’ (১)

আল্লাহু সবহানাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র কুরআনের বহু জায়গায় কুরআন নিয়ে তাদাব্বুরের কথা বলেছেন।কখনো নির্দেশের সুরে, কখনো ধমকির ভঙ্গিতে কিংবা উপদেশ হিসেবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন-

١- أفلم یدبروا القول.
‘তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেনা?’- আল মুমিনুনঃ ৬৮

٢- كتاب أنزلناه إليك مبارك ليدبروا آياته و ليتذكر أولوا الألباب.
‘আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে, এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করতে পারে’- সূরা ছ্বোয়াদঃ ২৯
٣- أفلا يتدبرون القرآن و لو كان من عند غير الله لوجدوا فيه اختلافا كثيرا.

‘তারা কি কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করেনা? এটা যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে নাযিল হতো, তাহলে তারা এতে অনেক বৈপরীত্য দেখতে পেতো’- আন নিসাঃ ৮২

٤- أفلا يتدبرون القرآن أم على قلوب أقفالها.
‘তারা কি কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করেনা? নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?’- সূরা মুহাম্মাদঃ ২৪

তাদাব্বুর একটি আরবী শব্দ। যার অর্থ “গভীর চিন্তা-ভাবনা বা  অনুধ্যান”
তাদাব্বুর শব্দের বিশ্লেষণে ইবনে উসাইমিন রহঃ বলেন, তাদাব্বুর মানে হলো কুরআনের একটি শব্দকে বারবার হৃদয়ে পুনরাবৃত্তি করা যতক্ষণ না এর অর্থ সুস্পষ্ট হয়।(২)

কুরআন নাজিলের একটি উদ্দেশ্য এটাও, যেন মানুষ কুরআনের আয়াত নিয়ে তাদাব্বুর করে৷ তাহলে তারা কুরআনী ইলম সম্পর্কে জানতে পারবে। বুঝতে পারবে এর অন্তর্নিহিত হেকমত ও সূক্ষ বিষয়াবলী। কেননা কুরআনী তাদাব্বুর ও এর অর্থ নিয়া বারবার  চিন্তা-ভাবনা করার ফলে মানুষ কুরআনের বরকত এবং কল্যাণ অর্জন করতে পারবে।(৩)

সহজ ভাষায় বলতে গেলে,
তাদাব্বুর মানেই কুরআন নিয়ে চিন্তা করা। গভীর ভাবনায় ডুবে যাওয়া।কুরআনের প্রতিটা আয়াতকে নিয়ে ভাবা। নিবিড়ভাবে। চিন্তা-ফিকির করা। উপলব্ধির চেষ্টা করা। কেননা কুরআন কে বুঝতে না পারলে, হৃদয়ের গভীর থেকে উপলব্ধি করতে না পারলে কুরআনি শিক্ষাগুলোকে জীবনে বাস্তবায়ন করা যাবে না৷ খোদার মর্জি মতো জীবন কে সাজানো যাবে না। কুরআনের নূরে উজ্জ্বল হবে না জীবনপথ। কেননা যখন আপনি না ই বুঝবেন জীবনের দূর্গম পথে চলার জন্য দয়াময় আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আপনার জন্য কি উপদেশ বাণী রয়েছে,তখন আপনি কিভাবে জীবনযুদ্ধে সফল হবেন? হেদায়াতী নূরে নিজেকে আলোকিত করবেন??

তাছাড়া অন্তর পরিশুদ্ধির মূল উপায় হলো কুরআনের আয়াত নিয়ে তাদাব্বুর করা। চিন্তা-ফিকির করা।রাসূল সাঃ এর আমলও ছিলো তাই।

আবু যর রাঃ বর্ণনা করেন,একবার রাসূল সাঃ  একটি আয়াত নিয়ে তাদাব্বুর করতে থাকলেন, এমনকি সকাল পর্যন্ত তিনি এই আয়াত নিয়েই ভাবনায় মগ্ন ছিলেন।(৪)

সাহাবায়ে কেরামও কুরআন নিয়ে তাদাব্বুর ও তাফাক্কুরের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন৷

ইবনে মাসউদ রাঃ বলেন-তোমরা এই কুরআন কে কবিতার মতো আবৃত্তি করো না এবং গুরুত্বহীনভাবে অমনযোগী হয়ে তাড়াহুড়ো করে তেলাওয়াত করো না।এর বিষ্ময়কর স্থানে থেমে যাও এবং অন্তর দিয়ে তা উপলব্দি করতে থাকো।(৫)

তিনি আরো বলেন,তোমরা কুরআন পড় এবং এর আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করো। তোমাদের কারো লক্ষ্য যেন শুধু সূরা শেষ করা না হয়।(৬)

এছাড়া সালাফগণের অভ্যাসও ছিলো তারা কুরআনের আয়াত নিয়ে রাতভর চিন্তা-ফিকির করতেন।(৭)

তাদাব্বুরের সাথে কুরআন তেলাওয়াতের পদ্ধতিঃ

১. পরিপূর্ণ মনযোগ ও সচেতনতার সাথে ধীরে ধীরে কুরআন তেলাওয়াত করা। রাসূল সাঃ এর তেলাওয়াতের ধরণও এমনই ছিলো।

২.নির্দিষ্ট সময় নিয়ে বসে  কোন একটি আয়াতকে নিয়ে তাদাব্বুর করা। এর পূর্বাপর বিবেচনা করে অর্থ বুঝার চেষ্টা করা।

৩. কোন আয়াত পাঠ করলে সেই আয়াতের বিষয়বস্তুটাকে সামনে নিয়ে আসা৷ শিক্ষনীয় বিষয়গুলো গ্রহণ করা আর  বর্জনীয় বিষয়  বর্জন করা।

৪. কুরআন নিয়ে তাদাব্বুরের চূড়ান্ত রূপ হলো,কুরআন অনুযায়ী আমল করা। তবেই জীবন আলোকিত হবে কুরআনের নূরে।

প্রিয় পাঠক, নিজেকে একবার জিজ্ঞেস করুন তো, জীবনে কতশত বার কুরআন তেলাওয়াত করেছেন!তবুও কেন দীলে বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়েনি? কারণ একটাই, কুরআন নিয়ে তাদাব্বুর না করা৷
তাই এ রমাদ্বান মাস হোক কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনার শ্রেষ্ঠ সময়। কুরআনের সাথে তৈরী হোক সুগভীর সম্পর্ক। তাদাব্বুরের অভ্যাস গড়ে উঠুক এখন থেকেই।

তথ্যসূত্রঃ
(১)মিফতাহু দারিস সাআদাহ, ইবনুল কাইয়িম : ১/৫৩৫

(২) তাফসীরুল কুরআনিল কারিম,ইবনে উসাইমিন৷ সূরা ছ্বোয়াদ-২৯

(৩) প্রাগুক্ত, আয়সারুত তাফাসীর,আবু বকর আলজাযাইরী। তাইসীরুল কারিমির রহমান,আসসু’দী। সূরা ছ্বোয়াদ-২৯

(৪) মুসনাদে আহমাদ ৫/১৪৯, নাসাঈ-১০১০,ইবনে মাজাহ-১৩৫০

(৫) আলমুসান্নাফ ২/৫২১,১০/৫২৫,ইবনে আবী শায়বাহ

(৬) শুআবুল ঈমান,৫/৮,ইমাম বায়হাকী

(৭)  ক্বিয়ামুল লাইল,মুহাম্মদ বিন নাসর ১৪৮-১৫১

Facebook Comments

Related posts

দোয়া : কুরআনের কিছু নির্দেশনা | মাহমুদ সিদ্দিকী

সংকলন টিম

কুরআনি প্রশ্নোত্তর: ১ | ফাওজিয়া আল-আকিল

তাফসিরে দরসে কুরআন-২ | মাওলানা মানজুর মেঙ্গল দা.বা.

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!