সংকলন
ইতিহাস প্রতিযোগিতা-১

মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে বাঙালির বাংলা (১ম পর্ব)| ফয়জুল্লাহ মনির

ভৌগলিক অবস্থানের সাথে যে ভাষার একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে, এটা মোটামুটি সব গবেষকই স্বীকার করেন। স্থান পরিবর্তনের পাশাপাশি বর্ণ, স্বভাব চরিত্র ও উচ্চারণ ভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটে। একেক জায়গার মানুষের জন্য একেক ধ্বনি উচ্চারণ করা সহজ। মাটির ভিন্নতাই এসব নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর এই ভিন্নতা নতুন উদ্ভূত কোন বিষয় নয়। বরং এটা একেবারে সৃষ্টি লগ্নের সেই আদিম যুগ থেকেই চলে আসছে। কুরআনের একটি আয়াতকে দলীল হিসাবে পেশ করা যেতে পারে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “তাঁর অস্তিত্বের নিদর্শন হচ্ছে, আসমান জমিন সৃষ্টি এবং তোমাদের বর্ণ ও ভাষার ভিন্নতা। এসবের মধ্যে রয়েছে জগৎবাসীর জন্য অসংখ্য সুস্পষ্ট প্রমাণ“। (সূরা রূম— ২২)
ব্যবহারকারীর মোট সংখ্যা অনুসারে বাংলা পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম ভাষা। বাংলাদেশ থেকে নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামের বরাক উপত্যকা, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ সহ অপরদিকে ভারতের ঝাড়খণ্ড, বিহার, মেঘালয়, মিজোরাম ও উড়িষ্যা পর্যন্ত এর পরিধি বিস্তৃত। বর্তমানে সাহিত্যের বিবেচনায় এই ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তবে এই সমৃদ্ধি এবং উন্নতির পিছনে রয়েছে এক বিদেশি সম্প্রদায়ের অপার অনুগ্রহ। তারা হল এ জাতির সফল উত্তরসূরী মুসলিম সম্প্রদায়। যদি তারা এই দেশে আগমন না করত, তবে হয়তোবা আমরা এই ভাষার অস্তিত্বই খুঁজে পেতাম না। পেতাম না সাহিত্যের হাজার বছরের এই গৌরবময় ইতিহাস। পাশাপাশি তাদের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নতিও ছিল চমকে দেবার মত। অর্থনৈতিকভাবে বাংলা তখন এতটাই প্রাচুর্যশালী ছিল যে, বিদেশিরা একে “দুনিয়ার স্বর্গ” বা “প্রাচ্যের ভেনিস” বলে পরিচয় দিত। আসুন, মূল পর্বে ঢুকার আগে আমরা ‘বাঙ্গালাহ’ নামকরণের ইতিহাস জেনে নেই।
বাঙ্গালাহ নামকরণ :
বাংলা ভাষাভাষীদের অঞ্চলগুলো তখন বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। পশ্চিম বাংলাকে রাঢ়, উত্তর বাংলাকে পুণ্ড্রবর্ধন, বরেন্দ্র ও লক্ষ্মণাবতী এবং বাংলাদেশকে গৌড় নামে অভিহিত করা হত। মুসলমানদের আগে ‘বঙ্গ’ শব্দের অস্তিত্ব থাকলেও তা খুবই ছোট একটা অঞ্চলকে বুঝানো হত। হিন্দু সেন রাজারা বাংলার বৃহদাংশ শাসন করলেও তারা নিজেদের ‘গৌড়েশ্বর’ বা ‘গৌড়ের রাজা’ বলে পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৮) কে অবিভক্ত বাংলার প্রথম স্বাধীন মুসলিম সুলতান হিসাবে গণ্য করা হয়। তিনিই সর্বপ্রথম এই পুরো অঞ্চলকে ‘বাঙ্গালাহ’ এবং এখানকার অধিবাসীদেরকে ‘বাঙালী’ নামে অভিহিত করেন। তিনি নিজেও ‘শাহ–ই–বাঙ্গালাহ’ উপাধি ধারণ করেছিলেন। এই মহতি উদ্যোগে বাঙালিরা ভৌগলিক ও ভাষাগত সামঞ্জস্যতার পাশাপাশি রাজনৈতিক ভাবেও একীভূত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। আর এখান থেকেই বাংলা বা বাঙালির ইতিহাসের সূচনা হয়। তাই উদার মনে অনায়াসেই বলে দেয়া যায়, হাজী শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ নামের এই মুসলিম শাসকই ছিলেন বাঙালি ইতিহাসের জনক বা প্রতিষ্ঠাতা।
মুসলিমপূর্ব যুগে বাংলা ভাষার অবস্থান :
বঙ্গদেশে মুসলিম বিজয় বাঙালিদের মাঝে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে। ইসলামের গণতান্ত্রিক শক্তি, শিক্ষা ও জ্ঞানের পরিমণ্ডলে এক গুরুত্বপূর্ণ আলোড়ন সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক অবস্থানের পাশাপাশি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গোড়াপত্তনে মুসলমানদের অবদান ছিল অত্যন্ত গভীর। তাদের আগমনের আগে হিন্দু শাসনামলে বাংলা ভাষা ছিল সম্পূর্ণই অবহেলিত। কেবলমাত্র বোদ্ধ ঋষিরাই এর যৎসামান্য চর্চা করতেন। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ যার সাক্ষ্য বহন করে আসছে। পক্ষান্তরে হিন্দুদের ধর্ম ও শিক্ষা সবই চলত সংস্কৃত ভাষায়। ব্রাহ্মণরাই যার উপর একচেটিয়া অধিকার লালন করতেন। বাংলা ভাষায় ধর্মচর্চা ছিল তখন সম্পূর্ণই বেআইনি। হিন্দু ব্রাহ্মণরা সাধারণ হিন্দুদের বাংলা সাহিত্য চর্চা থেকে এই বলে বিরত রাখত যে, “যারা অষ্টাদশ পুরাণ ও রামায়ন বাংলায় শোনে, তারা ‘রৌরব’ নামক নরকে যাবে”। যার দরুন জনসাধারণের অধিকাংশই শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর অব্রাক্ষ্মণরা আর ব্রাক্ষ্মণদের পদানত থাকে নি। ফলে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের কাছেও শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয় এবং সমাজে ও রাষ্ট্রে বাংলা ভাষা একটি গৌরবের আসন দখল করে। মুসলমানদের উদারনীতির কারণে তারা কেবল বাংলা ভাষা নয়, বরং সংস্কৃত ও হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর প্রতিও সমান আগ্রহ প্রকাশ করতেন। এসব সুযোগ সুবিধার কারণে এক সময় ধোপা, নাপিত, ঝাড়ুদার ও হিন্দুদের অন্যান্য নিম্নবর্ণের মানুষের মাঝেও বড় বড় প্রতিভা এবং কবি জন্ম লাভ করতে থাকে। সম্ভবত এসব কারণেই টি. এইচ. অর্নাল্ড বলেছিলেন, ইসলাম এদেশে এসেছিল যুগ যুগ ধরে লাঞ্ছিত, ভাগ্যাহত, মূক, মূঢ় জনগণের মুক্তির প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা :
মুসলিম শাসকদের হাত ধরেই সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় এবং দাফতরিক ভাষার মর্যাদা লাভ করে। তারাই সর্বপ্রথম ঘৃণিত অবহেলিত বাংলা ভাষাকে রাজ দরবারে আমন্ত্রণ জানান এবং বাঙালি কবি ও বিদ্বান ব্যাক্তিদের উদারভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। তাদের সমর্থন এবং মুসলিম কবিদের বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ ও অবদানের ফলে ব্রাক্ষ্মণ সংস্কৃতের চাপে নিষ্পিষ্ট বাংলা ভাষা অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায়। এজন্যই ড. দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, হিন্দু রাজাদের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন থাকলে বাংলা ভাষা কখনোই রাজ দরবারে স্থান লাভ করার সুযোগ পেত না। আর সমর্থন দানের ক্ষেত্রে মুসলিম শাসকরা কোন ধর্মের ভেদাভেদ করতেন না। নির্বিশেষে হিন্দু মুসলিম সকল কবি সাহিত্যিককেই সমানভাবে উৎসাহিত করতেন। আমি উদাহরণস্বরূপ হিন্দু কবিদের প্রতি তাদের পৃষ্ঠপোষকতার কয়েকটি চিত্র তুলে ধরছি—
★ সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহ (১৪৫৯—৭৪) এর প্রেরণা, উৎসাহ ও সাহায্যে হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ ‘রামায়ন’ এর প্রথম বাংলা কাব্যানুবাদ করেছিলেন কবি কৃত্তিবাস।
★ সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৩—১৫১৯) এর শাসনামলকে বলা যায় সে সময়কার বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। তার পৃষ্ঠপোষকতায় একে একে যশোরাজ খান ‘শৃকৃষ্ণবিজয়’, বিজয়গুপ্ত ‘মনসামঙ্গল’ ও বিপ্রদাস ‘মনসাবিজয়’ কাব্য রচনা করেন।
★ সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খানের অনুপ্রেরণায় কবিন্দ্র পরমেশ্বর নামক এক কবির মাধ্যমে ‘মহাভারত’ এর প্রথম অনুবাদের সূচনা হয়।
★ পরবর্তীতে সুলতান নুসরত শাহের আমলে (১৫১৯—৩২) চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছুটি খানের আদেশে শ্রীকর নন্দী নামক এক কবির হাত ধরে ‘মহাভারত’এর প্রথম অনুবাদ কার্যের সমাপ্তি হয়।
★ সুলতান শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ (১৪৭৪—৮১) এর পৃষ্ঠপোষকতায় মালাধর বসুর কলমে হিন্দুদের আরেকটি পবিত্র গ্রন্থ ‘ভগবত’ অনুদিত হয় এবং সুলতান তাকে ‘গুণরাজ খান’ উপাধীতে ভূষিত করেন।
এছাড়া মুসলিম শাসকগণ সংস্কৃত চর্চার প্রতিও যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেন। যার ফলশ্রুতিতে বহু মুসলিম লেখককেও পরবর্তীতে সংস্কৃত ভাষায় গ্রন্থ রচনা করতে দেখা যায়। তাদের হাত ধরেই হিন্দু শাসনের অবসানে ঝিমিয়ে পড়া সংস্কৃত ভাষা আবার পুনরুজ্জীবন লাভ করে। ইসলামপূর্ব যুগকে বাংলা সাহিত্যের আদি যুগ ধরা হলেও তখনকার খুঁজে পাওয়া একমাত্র লিখিত নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ কিন্তু সরাসরি বাংলা ভাষায় লিখিত ছিল না। বরং তা রচিত হয়েছিল ‘গৌড়ীয় প্রাকৃত’ ভাষায়। সেই হিসাবে মুসলিম যুগ থেকেই মূলতঃ বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় যাত্রা শুরু হয়। আমি আলোচনার সুবিধার্থে কয়েকটি যুগে বিভক্ত করে নিচ্ছি।
বাংলা সাহিত্যের গঠন যুগ (১২০৩—১৫৭৬) :
বাংলা সাহিত্যকে প্রাচুর্যশালী করার ক্ষেত্রে মুসলিম কবিদের অবদান অনস্বীকার্য। এই সময়টায় তারা নানাভাবে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে ব্রতী হন। যেমন—
১/ ভাষার উপাদান : বাংলা ভাষায় প্রচুর পরিমাণে বিদেশি শব্দের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। মুসলমান কবিরাই মূলতঃ আরবি, ফার্সি সহ অসংখ্য বিদেশি শব্দের খুব সাবলীল প্রয়োগ দেখিয়ে একে একে বাংলা অভিধানকে সম্পদশালী করে তুলতে থাকেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলা ভাষায় প্রায় আড়াই হাজার ফার্সি, আরবি ও তুর্কি শব্দের ব্যবহার আছে। উপাদান প্রাচুর্য ও শব্দের শক্তিশালী প্রাণচাঞ্চল্যের কারণে শব্দগুলোর ব্যবহার এতটাই আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়ায় যে, গোঁড়া হিন্দুরাও এগুলোকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারেন নি। উদাহরণ হিসাবে বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল থেকে কয়েকটি পংক্তি তুলে ধরছি—
পাতে পাতে লিখে ওয়াশিল (উসুল) বাকী।
পাতায় পাতায় তারা আদায় অনাদায়ের হিসেব লেখে
চান্দের নফর ধনা জানে নানা ফন্দি,
আপনে দিয়াছে আশ, ইনাম আমাদের দিবা খাসা।
২/ বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা : মুসলিমদের আগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য কেবল ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ‘চর্যাপদ’ তো পুরোটাই ধর্মের নীতিবাক্য। মুসলমানরাই সর্বপ্রথম রক্ত মাংসের মানুষ নিয়ে লিখতে শুরু করেন। তাদের রচনায় একে একে বাংলা সাহিত্যে মানবীয় গুণাবলী ফুটে উঠতে শুরু করে। হিন্দু দেবদেবীদের অপবিত্র প্রেমের পরিবর্তে মুসলমানদের পবিত্র প্রেমে জীবনের নৈতিক মূল্যবোধ ফুটে ওঠে। পাশাপাশি তারা ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রেও পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।
৩/ অনুবাদ সাহিত্য : কোন সাহিত্যই শুধু মৌলিক রচনায় সমৃদ্ধ হতে পারে না। যে ভাষা যত ধনী, তার অনুবাদ সাহিত্যও তত ধনী। বাংলা ভাষায় যা নেই, তা হয়তোবা আছে জর্মন কিংবা ফরাসী সাহিত্যে। তাই সাহিত্যকে ঋদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন পড়ে অন্য ভাষা থেকে অনুবাদ করার। অনুবাদ সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান চোখে পড়বার মত। তারা আরবি ও ফার্সি থেকে বহু ধর্মীয় গ্রন্থ, প্রেমের উপন্যাস ও অন্যান্য গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন।
৪/ নতুন ভাবধারা : মুসলমান কবিগণ তাদের কবিতায় এক নতুন আঙ্গিকের উদ্ভাবন করেন। কবিতার শুরুতে তারা আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা, রাসূলের প্রতি দরূদ প্রেরণ, মাতা–পিতার খেদমত ও গুরুজনের প্রতি ভক্তির গুরুত্ব তুলে ধরতেন। তাদের এই নতুন ধারা বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এছাড়াও তারা বাংলা সাহিত্যে রম্যকাব্যের জন্ম দিয়েছিলেন।
এ পর্যায়ে আমি সে সময়কার কয়েকজন বিখ্যাত কবি ও তাদের রচিত গ্রন্থের তালিকা তুলে ধরছি—
কবি শাহ মুহম্মদ সগীর (আনুমানিক ১৩–১৪ শতক)। সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৮৯—১৪১১) এর সমর্থনপুষ্ট ছিলেন। ‘ইউসুফ জুলেখা’ নামক প্রণয় কাব্যের জন্য তিনি বিখ্যাত। এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম মানবধর্মী রম্যকাব্য ও প্রেমের উপাখ্যান। অনেকে কবিতাটির মূল উৎস ফার্সি মনে করলেও অনিবার্যভাবেই এখানে লেখক প্রতিভার স্বতন্ত্রতার পরিচয় লক্ষ্য করা যায়।
কবি শেখ ফয়জুল্লাহ (১৬শ শতক)। তিনি সে সময়কার একজন বিখ্যাত কবি বলে বিবেচিত। তাঁর রচনার বিস্তৃতিই তাঁর প্রতিভা ও উদার মানসিকতার পরিচয় তুলে ধরে। তাঁর প্রধান তিনটি কাব্যমালার একটি হচ্ছে “গাজী বিজয়”। এটি সুলতান বারবক শাহের বিখ্যাত সেনাপতি শেখ ইসমাইল গাজীর জীবনী অবলম্বনে রচিত একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ। তখনকার সময়ে মুসলমান সুফিদের অসাধারণ আধ্যাত্মবাদ ও মানব হিতৈষণায় মুগ্ধ হয়ে হিন্দুরা তাদেরকে অতিমানবীয় ব্যাক্তিত্বের অধিকারী বলে ভাবত এবং তাদেরকে ভক্তি করে আশীর্বাদ কামনা করত। এখান থেকেই ‘সত্যপীর পূজা’ উদ্ভব হয়। শেখ ফয়জুল্লাহর “সত্যপীর পাঁচালী” ছিল এই বিষয়ক সর্বপ্রথম কাব্যগ্রন্থ। পরবর্তীতে এই বিষয়টি বাংলা ভাষার একটি সমৃদ্ধ সাহিত্যধারার সৃষ্টি করে। অপরদিকে সঙ্গীত সাহিত্যেও শেখ ফয়জুল্লাহর রচিত “রাখমালা” ছিল প্রথম সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থ। তিনি এই সুরেলা বিষয়টির অবতারণা করে বাঙালি কবিদের নিকট এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন এবং সাহিত্যের সমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করেন।
মুসলমান কবিরা তাদের ঐতিহাসিক রচনার বিষয়বস্তু কেবলমাত্র মুসলিম বীর বা খ্যাতনামা ব্যাক্তিদের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখেন নি। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য ‘গোরক্ষনাথ’ এর শিক্ষা ও অলৌকিক কার্যাবলির উপর ভিত্তি করে রচিত শেখ ফয়জুল্লাহর “গোরক্ষ বিজয়” গ্রন্থটি যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। এই বিষয়ক এটিই প্রথম গ্রন্থ এবং বাংলা সাহিত্যে এটি একটি মূল্যবান গ্রন্থ রূপে বিবেচিত। এসব ছাড়াও তিনি “সুলতান জমজমা”, “জয়নালের চৌতিষা” ও পদাবলী কাব্য রচনা করেন।
কবি আফজল আলী (আনুমানিক ১৬শ শতক)। তিনি তার রচিত ‘নসিহত–নামা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য পরিচিত। এই কাব্যটি মুসলমানদের ভাষা বিষয়ক ঐতিহ্যের দৃষ্টান্ত বহন করে।
কবি জৈনুদ্দিন (১৫শ শতক)। তিনি ছিলেন সুলতান শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহের সভাকবি। তিনিই সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুদ্ধ বিষয়ক ঐতিহাসিক কাব্য রচনা করেন। তিনি কাব্যগ্রন্থটির নামকরণ করেছিলেন ‘রসুল বিজয়’ নামে।
কবি মুজাম্মিল (১৫শ শতক)। এদেশের সাহিত্যে সর্বপ্রথম জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্রের আমদানি করেছিলেন মুসলমানরা। কবি মুজাম্মিলের ‘সায়াৎনামা’ ও ‘নীতিশাস্ত্র’ গ্রন্থে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও ‘খঞ্জন চরিত্র’ নামে তার আরেকটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে।
কবি চাঁদ কাজী (আনুমানিক ১৬শ শতক)। তিনি সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে নবদ্বীপের কাজীর পদে নিযুক্ত ছিলেন। বাংলা ভাষায় পদাবলী সাহিত্য নামে একটি মরমী ধারার সন্ধান পাওয়া যায়। ছলছল হৃদয় ছোঁয়া এই গীতি কবিতার ক্ষেত্রেও মুসলমানরা কৃতিত্বের দাবি রাখে। তারা মূলতঃ ফার্সি ‘মসনবী’র অনুসরণে এই সুফী ভাবমূলক কবিতা রচনা করতেন। কবি চাঁদ কাজী ছিলেন এই নতুন ভাবধারার প্রথম খ্যাতনামা কবি। পরবর্তীতে ‘বৈষ্ণব পদাবলী’ সহ হিন্দু মুসলমান কবিদের বহু পদাবলী সাহিত্য বাংলা ভাষার শ্রী বৃদ্ধিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দৌলত উজির বাহরাম খান (আনুমানিক ১৬শ শতক)। ইনি ছিলেন সে যুগের আরেকজন শক্তিমান কবি। তিনি বাংলা কাব্যধারার একটি মূল্যবান গ্রন্থ, রোমান্টিক প্রণয়োপখ্যান ‘লাইলী মজনু’ রচনার মধ্য দিয়ে খ্যাতি লাভ করেন। অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তেমন শিক্ষালাভ করতে পারেন নি। তবে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। চট্টগ্রামের অধিপতি ‘নেজাম শূর’ তাকে উজির পদে নিযুক্ত করেছিলেন। মর্সিয়া সাহিত্যে ‘ইমাম বিজয়’ ও ‘জঙ্গনামা’ নামে তার আরও দুটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে।
কবি মুহম্মদ কবির (১৬শ শতক)। মুসলমানদের সাহিত্যঐতিহ্য শুধুমাত্র বিষয়বস্তু, শব্দ ও আঙ্গিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। স্থানীয় পরিবেশ ও স্বদেশী নায়ক নায়িকাদের অবলম্বনে রচিত রম্যকাব্য নির্মানের ক্ষেত্রেও তারা নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন। মুহম্মদ কবির ছিলেন এ বিষয়ের অগ্রপথিক। তার রচিত ‘মধুমালতী’ কাব্যগ্রন্থ তৎকালীন যুগে এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল যে, তার পরবর্তী আরও ছয়জন কবি ওই একই নামে কাব্য রচনা করেছিলেন।
কবি দোনাগাজী (১৬শ শতক)। তিনি তার রচিত “সয়ফুলমূলক” প্রণয়কাব্যের জন্য বিখ্যাত। তাঁর কাব্যের একটি ভণিতা থেকে জানা যায় যে, তাঁর বাসস্থান ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ‘দোল্লাই’ (বর্তমান ধোলাই) নামক স্থানে।
কবি শাহ বারিদ খান (১৬শ শতক)। কেউ কেউ তাকে ‘সাবিরিদ খান’ নামেও উল্লেখ করেছেন। বিদ্বান পরিবার থেকে ওঠে আসা এই কবি যথেষ্ট প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। “বিদ্যাসুন্দর”, “রসুল বিজয়”, “হনিফা ও কয়রাপরী” নামে তাঁর প্রসিদ্ধ তিনটি কাব্যগ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিদ্যাসুন্দর মধ্যযুগের একটি প্রণয়কাব্য। বিদ্যা ও সুন্দরের প্রণয়কাহিনী এর উপজীব্য। কাব্যটির উৎস এগারো শতকের সংস্কৃত কবি বিলহনের চৌরপঞ্চাশিকা। বাংলা ভাষায় কবি শাহ বারিদ খানই সর্বপ্রথম এ বিষয়ে কলম ধরেছিলেন। পরবর্তীতে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর সহ আরও অনেকেই এই বিষয়ে কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তোলেন।
মুঘল যুগ (১৫৭৬—১৭৫৭) :
মুঘল শাসকরা পারিবারিকভাবেই ছিলেন সংস্কৃতমনা। তাছাড়া সে সময় শিক্ষা–দীক্ষার প্রসারও ঘটেছিল বেশ। যার দরুন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য এ সময়টায় তর তর করে উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি উপমহাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় ও এশিয়ার দেশগুলোর সাংস্কৃতিক প্রবাহ এ সময়টায় বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনকে প্রভাবান্বিত করেছিল। ফলে বাঙালিদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে নতুন ভাবধারার আগমন হয়। এসব চিন্তাধারা বাংলার কবিদের নিকট বিষয়বস্তু আকারে যথেষ্ট উপাদান সরবরাহ করে। এ সময়টায় হিন্দুদের মধ্যেও বাংলা সাহিত্যের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী কবির আবির্ভাব ঘটেছিল। এছাড়া বৈষ্ণব পদাবলী এবং বাউল সাহিত্যের মর্মস্পর্শী কাব্য ও গানচর্চার ভরা যৌবন ছিল এ সময়টা। আমি এখানে কেবল প্রসিদ্ধ কয়েকজন মুসলিম কবির আলোচনা করছি।
মুঘল আমলের সবচেয়ে প্রাচীন কবি হিসাবে ধরা হয় মহাকবি সৈয়দ সুলতান (১৫৫০—১৬৫৮) কে। সিলেটের হবিগঞ্জ জেলায় জন্ম নেয়া এই কবির কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি হল— নবীবংশ, জ্ঞানপ্রদীপ, জ্ঞানচৌতিশা, জয়কুম রাজার লড়াই, শব—ই—মিরাজ, রসূল বিজয়, ওফাত—ই—রসূল, ইবলিসনামা এবং বেশ কিছু সংখ্যক পদাবলী ও মরমি সঙ্গীত। তন্মধ্যে “নবীবংশ” তার সবচেয়ে বড় ও শ্রেষ্ঠ কীর্তি। প্রায় পঁচিশ হাজার পংক্তির এই মহাকাব্যে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সহ আঠারো জন নবীর কাহিনী বর্ণনা করেছেন। ড. এনামুল হকের মতে, বিষয়বস্তুর ঐতিহ্য ও রচনার তাৎপর্যে এই গ্রন্থ এমনকি রামায়ণ মহাকাব্যকেও ছাড়িয়ে গেছে এবং এই গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যে এক বিরাট মহাকাব্যের আদর্শ তুলে ধরেছে। তিনি মূলতঃ মরমি ভাবধারার কবি ছিলেন। তাঁর বৃদ্ধ বয়সে রচিত “জ্ঞানপ্রদীপ” ও “জ্ঞানচৌতিশা” যার সাক্ষ্য বহন করে। এছাড়াও তার “রসূল বিজয়” ও “জয়কুম রাজার লড়াই” ঐতিহাসিক গ্রন্থের মর্যাদা রাখে।
সৈয়দ সুলতানের সমসাময়িক চট্টগ্রামের আরেকজন কবি ছিলেন শেখ পরাণ (১৫৫০—১৬১৫)। “নূরনামা” ও “নসিহৎনামা” নামক তার দু’টি রচনা পাওয়া যায়। ‘নূরনামা’ মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় কাব্যধারা। হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও বিশ্বব্রহ্মান্ডের জন্মরহস্য এর মূল বিষয়। এই বিষয়ে আরও কয়েকজন কবি কাব্য রচনা করেছেন। আর “নসিহৎনামা”য় কুরআন হাদীসের বিভিন্ন উপদেশাবলী তিনি কাব্য আকারে সংকলন করেন। সাধারণ মুসলমানদের মাঝে দ্বীনি শিক্ষা ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই মূলতঃ তিনি এসব গ্রন্থ রচনা করেন।
হাজী মুহম্মদ (১৫৫০—১৬২০) ছিলেন সে সময়কার আরেকজন প্রসিদ্ধ কবি। তার রচিত “নূরজামাল” ইসলামী মূলনীতির উপর একটি তাৎপর্যপূর্ণ গ্রন্থ। গ্রন্থটিতে তিনি ‘ওয়াহদাতুল ওজুদ’ ও ‘ওয়াহদাতুশ শুহুদ’ প্রসঙ্গে আলোচনা করে সুফীবাদের আদর্শ ও কার্যপ্রণালী তুলে ধরেছেন। এখান থেকে মুজাদ্দিদে আলফে সানীর চিন্তাধারার বিস্তৃতি লক্ষ্য করা যায়।
চট্টগ্রামের আরেকজন খ্যাতনামা কবি ছিলেন কবি নসরুল্লাহ খাঁ (১৫৬০—১৬২৫)। এ পর্যন্ত তার চারটি কাব্যগ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলো হচ্ছে “জঙ্গনামা”, “মুসার সাওয়াল”, “শরীয়ত নামা” ও “হিদায়েতুল ইসলাম”। তিনি ধর্মীয় ও পৌরাণিক বিষয়ে কবিতা লিখতেন।
সৈয়দ সুলতানের শিষ্য মুহম্মদ খান (১৫৮০—১৬৫০) ছিলেন আরেকজন প্রসিদ্ধ কবি। তিনি তার পীরের মতই মরমিবাদী কবি ছিলেন। তার “আসহাবনামা”, “কিয়ামতনামা”, “দাজ্জালনামা” ও “হনিফার লড়াই” মূলতঃ ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যেই রচিত। সে সময় শীয়াদের আগমনে মুসলমানদের মাঝে মহাররমের কাহিনী ব্যাপক পঠিত হত। মুহম্মদ খানের “মকতুল হোসেন” এই বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এছাড়াও হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীর উপর রচিত তার “সত্যকলি সম্মাদ” এ সত্য মিথ্যার চিরন্তন লড়াই ও পরিণামে সত্যের জয় বর্ণিত হয়েছে।
মুর্শিদাবাদের সৈয়দ মুর্তজা (১৫৯০—১৬৬২) ছিলেন বৈষ্ণব পদ সাহিত্যের একজন দিকপাল। তিনি বাংলায় বেশ কয়েকটি গান রচনা করেন। তার “যোগ কলন্দর” সে যুগের শিথিল সুফিবাদের পরিচয় বহন করে।
শেখ পরাণের পুত্র কবি শেখ মুত্তালিব (১৫৯৬—১৬৬০) ইসলামী শিক্ষার উপর “কিফায়েতুল মুসাল্লিন” নামে একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন। “কায়দানি কিতাব” নামে তার আরেকটি কাব্যগ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়।
হাজী মুহম্মদের শিষ্য মীর মুহম্মদ শফি (১৫৫৫—১৬২০) এর “সায়াৎনামা” কাব্যে জ্যোতিষশাস্ত্রের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তার “নূরকন্দিল” ছিল নূরনামা কাব্যধারার একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
সন্দ্বীপের অধিবাসী আবদুল হাকিম (১৬২০—১৬৯০) ছিলেন সে সময়কার একজন প্রতিভাশালী শক্তিমান কবি। খাঁটি বাঙালি এই কবি তার ‘বঙ্গবাণী’ কবিতার জন্য অধিক পরিচিত। নিজ মাতৃভূমির প্রতি তার ছিল অগাধ ভালোবাসা। বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তিনি তার “নূরনামা” কাব্যে তার অমর পংক্তিগুলো লিখে গেছেন। এখানে কয়েকটি পংক্তি তুলে ধরছি—
যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ ত্যাগি কেন বিদেশ ন যায়।।
বাংলা ভাষার প্রতি তার প্রেম যেমন ছিল তেমন লিখেছেনও অনেক। ইউসুফ–জুলেখা, লালমতি, সয়ফুলমুলুক, শিহাবুদ্দিননামা, নসীহতনামা, কারবালা, শহরনামা, নূরনামা ও চারি মোকাম ভেদ নামে তার মোট নয়টি কাব্যগ্রন্থ পাওয়া যায়। আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষায় তার বিশেষ দক্ষতা ছিল। এছাড়াও তার রচনা থেকে কুরআন, হাদীস, ফেকাহ প্রভৃতি শাস্ত্র এবং রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণ সম্পর্কে তার গভীর পাণ্ডিত্য উপলব্ধি করা যায়।
মুঘল আমলের আরেকজন প্রখ্যাত ও অন্যতম কবি ছিলেন চট্টগ্রামের কবি নওয়াজিস খান (১৭শ শতক)। “গুল—ই—বকাওলী” বাংলা সাহিত্যে তার শ্রেষ্ঠ অবদান। এছাড়াও তিনি আরও রচনা করেন “গীতাবলী, বয়ানাত, প্রক্ষিপ্ত কবিতা, পাঠান প্রশংসা ও জোরওয়ার সিংহ কীর্তি”। “পাঠান প্রশংসা” ও “জোরওয়ার সিংহ কীর্তি” ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ।
‘কানু ফকীর’ নামে পরিচিত চট্টগ্রামের একজন কবি ছিলেন কবি আলী রেজা (১৮শ শতক)। “সিরাজ কুলুব”, “জ্ঞানসাগর”, “আগম”, “ধ্যানমালা”, “যোগকালন্দর” এবং “ষট্‌চক্রভেদ” তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্য কর্ম। আলী রেজা অনেক পদও রচনা করেছিলেন। সুফি ও মরমি ভাবধারায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ড. আহমদ শরীফ কর্তৃক সম্পাদিত ‘মুসলিম কবির পদসাহিত্য’ গ্রন্থে তার বত্রিশটি পদ সংকলিত হয়েছে।
চট্টগ্রামের মির্জাপুরে জন্ম নেয়া আরেকজন কবির পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি হলেন সৈয়দ নূরুদ্দীন (১৮শ শতক)। তাঁর মোট চারটি কাব্যগ্রন্থের সন্ধান মিলে। ইমাম গাযালীর আরবি কিতাবের ভাবানুবাদ করে রচনা করেন “দাকায়েকুল হাকায়েক”। সুফিতত্ত্বের উপর রচিত হয় “বুরহানুল আরেফিন” ও “মুসার সওয়াল”। আর কিয়ামত সম্পর্কে লিখেছিলেন “রাহাতুল ক্বালব”।
রংপুরের সন্তান প্রতিভাবান একজন কবি ছিলেন কবি হায়াত মাহমুদ (১৬৯৩—১৭৬০)। সুফি সাধক এই কবি বাংলা সাহিত্যের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্য রচনা করেছিলেন। কারবালার করুণ কাহিনী নিয়ে লিখেছেন “জঙ্গনামা”, নীতিশাস্ত্রের উপর লিখেছেন “সর্বভেদবাণী” এবং ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে রচনা করেছেন “হিতজ্ঞানবাণী” ও “আম্বীয়াবাণী”। তাঁর বহুল প্রচলিত একটি আধ্যাত্মিক বাণী তুলে ধরছি—
“যার বিদ্যা নাই সে জানে না ভাল মন্দ,
শিরে দুই চক্ষু আছে তথাপি সে অন্ধ।”
মুহম্মদ মুকিম ছিলেন আঠারো শতকের আরেকজন উল্লেখযোগ্য কবি। তাঁর কাব্য “গুলে বকাওলী” তে চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসনের কথা আছে। “কালাকাম” ও “মৃগাবতী” তার রোমাঞ্চধর্মী দুইটি কাব্য। “ফায়দুল মুকতাদি” ও “আইয়ুব নবীর কথা” কাব্য দুটি তার রচিত ধর্মীয় কাব্যের অন্তর্ভুক্ত।
এছাড়াও সে সময়কার আরও কয়েকজন কবি ও কাব্যগ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। সুফি রচিত ‘দাস্তান—ই—আমীর হামযা’ অনুসরণ করে আব্দুল নবী ১৬৮৪ সালে রচনা করেন “আমীর হামযা” কাব্য। চট্টগ্রামের মুহম্মদ উজীর আলী ১৭১৮ সালে রচনা করেন “শাহনামা” কাব্য। এটি “নসল—ই—ইসলামাবাদ” নামেও পরিচিত। ১৭২২ সালে কুমিল্লার অধিবাসী শেখ সাদী রচিত “গদা মল্লিকার পুঁথি” নামক কাব্যটিও ছিল বেশ চমৎকার। এছাড়া গরীবুল্লাহর “ইউসুফ জোলেখা”, “সত্যপীর” এবং “মকতুল হোসেন” ও শাহ্ মনসুরের মরমি ভাবধারার কাব্য “সিরনামা” সে কালের উল্লেখযোগ্য সংকলনগুলোর অন্যতম। ফকির গরীবুল্লাহ ও তার শিষ্য সৈয়দ হামযাকে পুঁথি সাহিত্যের পথিকৃৎ গণ্য করা হয়।

Related posts

ইতিহাস পাঠ-প্রয়োজন নির্বাচিত অধ্যয়ন | ইমরান রাইহান

সংকলন টিম

হাজিব আল মানসুর | যে সেনাপতি পরাজিত হননি একটি যুদ্ধেও

সংগ্রামী সাধক আবু মুসলিম খাওলানী রহ. | মঈনুদ্দীন তাওহীদ

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!