আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা ঠিক রাখতে হবে। অর্থাৎ বন্ধুত্ব ও শত্রুতা উভয়টিই আল্লাহর জন্য। মুমিনদের সাথে সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব থাকবে। আর কাফিরদের সাথে আন্তরিকতার সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। কেননা, দ্বীনের শত্রুদের সাথে সম্পর্ক রাখলে ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ
নিঃসন্দেহ তোমাদের বন্ধু হচ্ছেন কেবলমাত্র আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূল, আর যারা ঈমান এনেছে, আর যারা নামায কায়েম করে, আর যাকাত আদায় করে, আর তারা রুকুকারী।
(সূরা মায়িদা ৫৫)
আজ আমাদের বন্ধুর অভাব নেই। প্রিয় মানুষের তালিকাটাও বেশ লম্বা। আমরা কোনো গায়ক বা নায়কের বন্ধু হতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করি। বইমেলায় সেলিব্রেটি লেখকদের পিছু ঘুরঘুর করি। তাঁর সাথে যদি একটা সেলফি তোলা যায়, তাহলে তো কথাই নেই। স্যারের সাথে আজ দেখা হলো, স্যার একজন মহান মানুষ।
অথচ কথিত এই স্যার তাঁর রবের অধিকার আদায়ে সচেতন নয়। সে তাঁর রবের সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখেনি। আমরা সেসব ভাবি না। নেককারদের সাথে বন্ধুত্বে আমাদের বড় অনীহা। নেককার মানুষগুলোকে মনে হয় আনস্মার্ট, গেঁয়ো। আল্লাহর দুশমনদের ব্যাপারে আমাদের কারো কারো বেশ মুগ্ধতা কাজ করে। মনে হয়, স্যার বেশ চমৎকার মানুষ। তিনি কত জানেন। কত বিস্তৃত তাঁর চিন্তার আকাশ। কত উন্নত তাঁর মানসিকতা। অথচ এসবই ধোঁকা। যে ব্যক্তি তাঁর রবকে চিনেনি, এখনো হাটছে জাহান্নামের পথে, তাঁর চেয়ে বোকা আর কেউ নেই। যে নিজে দাঁড়িয়ে আছে অতল গহ্বরের কিনারে, তাঁর কাছে যে যাবে সেও ঝুঁকির মধ্যেই থাকবে।
আমাদের চোখে লেগে গেছে কালো চশমা। আমরা ভাবি তাঁর সাথে ভাল সম্পর্ক রাখলে কী সমস্যা। আমি তো তার মত হতে যাচ্ছি না। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই সম্পর্কগুলোর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। প্রভাব পড়ে আকিদায় ও আমলে। হ্যা যারা দাওয়াহর নিয়তে তাদের কাছে যান তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু যারা কাফির ও ফাসিকদের গুনমুগ্ধ হয়ে তাদের সাহচর্যে যায় তারা ক্ষতির মুখোমুখি হয়। হয়তো সে নিজেও টের পায় না কত তুচ্ছ জিনিসের বদলে সে কত উত্তম জিনিস বিকিয়ে দিচ্ছে।
জীবনে চলার পথে কতো মানুষের সাথে পরিচয় হয়। গড়ে উঠে সখ্যতা। ধীরে ধীরে বাড়ে বন্ধুত্ব। কিন্তু সম্পর্কগুলো পরিবর্তনশীল। ফলে নানারকম মনোমালিন্যও দেখা দেয়। বাড়ে দূরত্ব। কখনো আবার দূরত্ব রুপ নেয় শত্রুতায়। শেষ হয়ে যায় মানসিক প্রশান্তি।
ইবনুল জাওযি (র) এসবের একটা সহজ সমাধান বলেছেন। তিনি বলেন, মানুষ সাধারণত তিন ধরণের লোকজনের সাথে চলাফেরা করে।
এক- নিছক পরিচিত। এদের সাথে দেখা হলে কুশল বিনিময় হয়। এর বেশি ঘনিষ্ঠতা তৈরী হয় না।
দুই- বাহ্যিক বন্ধু। এদের সাথে বাহ্যিকভাবে সুসম্পর্ক থাকে। ঘনিষ্ঠতা থাকে।
তিন- আন্তরিক বন্ধু। এদের সাথে কোনো কৃত্রিমতা ও লৌকিকতা ছাড়াই আন্তরিক সম্পর্ক থাকে।
যদি কেউ আন্তরিকতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয় তাহলে তার সাথে শত্রুতা বা মনোমালিন্য তৈরীর দরকার নেই। তাকে আন্তরিক বন্ধু থেকে সরিয়ে বাহ্যিক বন্ধুর তালিকায় নিয়ে এলেই হবে। যদি তারা এটারও যোগ্য না হয় তাহলে তাদের সাথে আচরণ হবে নিছক পরিচিতের মত। অর্থাৎ সম্পর্ক ছিন্ন না করে প্রত্যেককে যার যার অবস্থানে রাখলেই সমস্যা অনেকটা মিটে যাবে। আশাহত হবার বেদনাও থাকবে না, আবার মনোমালিন্যও হবে না। (হৃদয়ের দিনলিপি, মাকতাবাতুল হাসান থেকে অনূদিত)
বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা ভুল করে বসি। কারণ এক্ষেত্রে আমরা শরয়ী মাপকাঠির অনুসরণ করি না। বন্ধু নির্বাচনের প্রকৃত মাপকাঠি হলো দ্বীনদারি। এই মাপকাঠি অনুসারে বন্ধু নির্বাচন করলে আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে আসে।
মুখে সমতার কথা বলা সহজ। কিন্তু বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা একটু কঠিনই হয়ে যায়। কেতাদুরস্ত ফিটফাট পোষাক পরা একজনের দিকে আমরা যে দৃষ্টিতে তাকাই সাধারণ পোষাক পরা, মলিন চেহারার কারো দিকে সে দৃষ্টিতে তাকাই না। প্রথমজনের দিকে তাকানোর সময় মনে সমীহ জাগে। পরের জনের ক্ষেত্রে প্রকাশ পায় অবজ্ঞা বা বিরক্তি। এই ভালোলাগা বা বিরক্তির সূচনা হয় স্রেফ বাহ্যিকতার বিচারে। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো এই ভালোলাগা কখনো কখনো ঈমান ও কুফরের সীমাও অতিক্রম করে ফেলে। নিছক বাহ্যিকতা ও পোষাক দেখে কাউকে বিচার করা মারাত্মক ভুল।
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
‘অনেকে এমন আছে যাদের চুল এলোমেলো। মানুষের দরজা থেকে তারা বিতাড়িত। কিন্তু তারা আল্লাহর নামে কোনো কসম করলে আল্লাহ তা পূর্ণ করে দেন’। (মুসলিম, ৬৪৪৩)
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী লিখেছেন,
‘তারা যদি কোনো কিছু ঘটার ব্যাপারে কসম করে ফেলে, তাহলে আল্লাহ তাদের সম্মানে তা সংঘঠিত করে দেন। মানুষের দৃষ্টিতে তারা তুচ্ছ হলেও আল্লাহর কাছে তারা সম্মানিত’।
–
চলার পথে কত ধরনের মানুষের সাথেই দেখা হয়। সবাই এক ধরণের নয়। কাউকে কাউকে দেখে অতি তুচ্ছ মনে হয়। অশ্রদ্ধা জাগে। এই হাদিসটা স্মরণ রাখতে পারি। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দিক। আমিন।
১ comment
জাযাকাল্লা।
ইমরান রাইহান ভাইয়ের লেখা পড়লে দিলে অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করে।