আলিমগণ হলেন উম্মাহর রাহবার ও পথপ্রদর্শক। দ্বীন ও শরিয়ত সংরক্ষণের দায়িত্ব নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের ওপর দিয়ে গেছেন।থানভি রহ. বলেন—“শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি রহ.-এর জীবদ্দশায় এক আলিম জনৈক সুফির বিরুদ্ধে রদ লেখেন। শাহ সাহেব সেই আলিমের বিরুদ্ধে পাল্টা রদ লেখার মনস্থ করেন। এমন সময় তাঁর কাছে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীর রুহানিয়্যাত স্পষ্ট হয় এবং বাধা অনুভব করেন। এরপর শাহ সাহেব লেখেন—খেয়াল করলাম, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেশি লক্ষ ছিল আলিমদের প্রতি। এর কারণ হলো—শরিয়তের হেফাযত এবং পৃথিবীর নেযাম প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব আলিমদের ওপরই অর্পিত। যারা নিরেট সুফি, তারা এসব দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত। যা-ইচ্ছা বলে দেয়। যেসব লোক তাদের কথার মূল হাকিকত বুঝতে পারে না, তারা গোমরাহিতে পতিত হয়। আর যেসব সুফি শরিয়তের ইলম রাখে না, তারা তো খোদ নিজেরাই গোমরাহ। এরা অন্যদেরকেও গোমরাহ করে”।(১)থানভি রহ. শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি রহ.-এর সূত্রে আলিমদের প্রতি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ নজরের যে-বিষয়টি তুলে ধরেছেন, তা অনুধাবন করা খুব জরুরি।
আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন—“আল্লাহ্ তাআলাকে ভয় করে তাঁর বান্দাদের মধ্যে একমাত্র আলিমগণ”।(২) উক্ত আয়াতে ‘ইন্নামা’ শব্দ ব্যবহার করে আল্লাহ্র ভয়কে আলিমদের সাথে বিশিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ্ তাআলার কথা থেকে যা বোঝা গেল তাহলো—আল্লাহ তাআলার ভয় ও খাশইয়াতের জন্য ইলম জরুরি। ইলম ছাড়া আল্লাহ্র প্রতি যথাযথ খাশইয়াত ও ভয় সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়। আলিমদের এই বৈশিষ্ট্যের একমাত্র কারণ হলো ইলম।
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও আলিমদেরকে তাঁদের ইলমের কারণে বিশেষ মর্যাদাবান ঘোষণা করেছেন। একদিনের ঘটনা। সাহাবায়ে কেরাম বসে আছেন নবিজির মজলিসে।সবাই চুপচাপ।মাথায় যেন পাখি বসেছে।কেউ সামান্য নড়ছেনা। নবিজি ইলম অন্বেষণকারীর ফযিলত বয়ান শেষ করে আলিমের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা বয়ান করছেন। বললেন, “পূর্ণিমা রাতে অন্য সব নক্ষত্রের ওপর চাঁদের যেমন অবস্থান, সাধারণ ইবাদতকারীর ওপর একজন আলিমের মর্যাদা ও অবস্থান তদ্রূপ। নিশ্চিত থেকো, আলিমগণ হলেন নবিগণের উত্তরসূরি। নবিগণ উত্তরাধিকার রূপে পয়সা-কড়ি রেখে যাননা; তাঁরা রেখে যান ইলম।সুতরাং যে ইলম অর্জন করবে সে যেন পূর্ণরূপে অর্জনকরে”।(৩) আলিমদের মর্যাদার মূল কারণ এখানেও তাঁদের ইলম।
সবচেয়ে অধিক মর্যাদা ও গুরুত্বের হলো এই কথাটি—“উলামায়ে কেরাম হলেন নবিদের ওয়ারিস। মিরাস হিসেবে নবিগণধন-সম্পদরেখেযাননা; তাঁরারেখেযানইলম”।(৪)
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছেন মুআল্লিম বা শিক্ষক হিসেবে। স্বয়ং নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন এভাবে—“নিঃসন্দেহে আমি প্রেরিত হয়েছি মুআল্লিম (শিক্ষক) হিসেবে”।(৫)
নবিজি আল্লাহ্ কর্তৃক প্রদত্ত ইলম শিক্ষা দিয়েছেন সাহাবিদেরকে। তারপর সেই উত্তরাধিকার দিয়ে গেছেন আলিমদেরকে। মুতাওয়ারাস বা যুগ-পরম্পরায় ধারাবাহিক সূত্রে যারা ইলম অর্জন করবেন, তাঁরা সেই উত্তরাধিকার লাভ করবেন। তাহলে নবিজির উত্তরাধিকার নির্বাচন থেকে যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো—শরিয়তের ইলম অর্জন করেছেন আলিমগণ; সুতরাং শরিয়ত সংরক্ষণ ও হেফাযতের দায়িত্বও তাঁদের। নিরেট সুফি কিংবা নন-আলিম কারও কাছ থেকে ইলম গ্রহণ বা তাদেরকে শরিয়ত সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
ইলম অর্জনের কোনো বয়স নেই। সাহাবায়ে কেরাম এবং সালাফ আকাবিরগণ সারা জীবন ইলম অর্জন করেছেন। তবে জরুরত পরিমাণ ইলম অর্জন করা সবার জন্যই ফরজ। শত ব্যস্ততার মধ্যেও এই পরিমাণ ইলম অর্জন করতেই হবে। সবার জন্য আলিম হওয়া জরুরি নয়; জরুরি হলো ফরজ পরিমাণ ইলম অর্জন করা। জরুরত পরিমাণ ইলম শেখার খুব চমৎকার একটা পদ্ধতি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলি থানভি রহ. বলে দিয়েছেন।
বলেছেন—“দৈনিক একটি করে মাসয়ালা জিজ্ঞেস করে নেবে। তাহলে মাসে ত্রিশটি মাসয়ালা জানা হয়ে যাবে। এভাবে বছরে মোট তিনশো ষাটটা মাসয়ালা জেনে যাবে। এভাবে যদি দশ বছর অতিবাহিত করা যায়, তাহলে এই পরিমাণ মাসয়ালা মুখস্থ হয়ে যাবে, যা একজন সাধারণ মৌলভিরও মুখস্থ থাকে না। এতে খুব বেশি পরিশ্রমও করা লাগবে না। যদি কোনোদিন মাসয়ালা বলে দেবার মতো কাউকে না পাওয়া যায়, তাহলে সেদিন কোনো একটা ডায়েরিতে সেই প্রশ্ন লিখে রাখবে। যেদিন মাসয়ালা বলে দেবার মতো কাউকে পেয়ে যাবে, সেদিন সবগুলো মাসয়ালা জেনে লিখে নেবে”।
নারীদের জন্যও থানভি রহ. সুন্দর পদ্ধতি বলে দিয়েছেন—“নারীদের জন্য মুনাসিব হলো—তারা ঘরের পুরুষদের ইলম অনুযায়ী জিজ্ঞেস করে-করে মাসয়ালা জানবে। আসল কথা হলো, মানুষের মাথায় কোনো বিষয়ের চিন্তা ঢুকলে সে নিজে-নিজেই ভেবে-ভেবে সেটির হাজারও পদ্ধতি বের করে ফেলে। মহিলাদের চিন্তা-ফিকির হলো স্বর্ণ-গয়না নিয়ে। লক্ষ করে দেখুন, এটা নিয়ে তারা কত গুরুত্বের সাথে চিন্তা-ফিকির করে। দূর-দূরান্ত থেকে চুড়ি, বালি ইত্যাদি অর্ডার দিয়ে বানিয়ে আনে। যদি একটা চুড়িও ভেঙে যায়, তাহলে তাদের মন খারাপ হয়। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো—দ্বীনের একটা মাসয়ালাও যদি জানা না থাকে, তাহলে এর জন্য তাদের কোনো আক্ষেপ দেখা যায় না। খোদ দ্বীন যেন অনুযোগ করে বলছে—যালিম তো সব যুগে বেঁচে থাকে না; কিন্তু তাদের নামে অভিশাপ ঠিকই জারি থাকে”।(৬)
থানভি রহ.-এর বলে দেওয়া এই পদ্ধতিটি খুবই সহজ এবং চমৎকার। এখানে মাসয়ালা দ্বারা কেবল ফিকহি মাসয়ালা উদ্দেশ্য নয়; বরং দ্বীনের বিষয়ে যেকোনো ধরনের প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা উদ্দেশ্য। জরুরি কিন্তু জানা হয়নি—এমন সব বিষয়ই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এর অন্তর্ভুক্ত হবে।
আলিমদের যেমন আলাদা ফযিলত আছে, তেমনি যারা ইলম অর্জনে সদা লিপ্ত থাকে, তাদের জন্যও নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুসংবাদ ঘোষণা করেছেন। “যে-ব্যক্তি ইলম অর্জনের জন্য কোনো পথ অবলম্বন করবে, আল্লাহ্ তাআলা তার জন্য জান্নাতের পথ করে দিবেন। আর, ফেরেশতাগণ তালিবুল ইলমের সন্তুষ্টির জন্য তাদের পায়ের নিচে নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেন”।(৭)
এই ফযিলত ও শ্রেষ্ঠত্বের অংশীদার হবার ক্ষেত্রে থানভি রহ.-এর পদ্ধতিটি যুগান্তকারী ও বাস্তবসম্মত। জীবনের শত ব্যস্ততায় আমরা ইলম অর্জনের জন্য আলাদা সময় বের করতে হয়ত পারি না। কিন্তু, এই পদ্ধতিতে খুব সহজেই নিজের নামটা তালিবুল ইলমের খাতায় লিখিয়ে নেওয়া সম্ভব।
সূত্রসমূহ :
(১) জাওয়াহিরাতে হাকিমুল উম্মত ২/৪০১, সংকলন-মুহাম্মাদ ইকবাল কোরেশি
(২) সুরাফাতির, আয়াত-২৮
(৩) সুনানেইবনেমাজাহ; হাদিসনং—২২৩; মান—সহিহ
(৪) সহিহবুখারি, তা’লিক, কিতাবুলইলম; সুনানুআবিদাউদ, হাদিস নং-৩৬৪১-৩৬৪২; সুনানুততিরমিযি, হাদিস নং-২৬৮২; সুনানুইবনিমাজাহ, হাদিস নং-২২৩
(৫) সুনানেইবনেমাজাহ, হাদিসনং-২২৯; মুসনাদেবাযযার, হাদিসনং-২৪৫৮
(৬) জাওয়াহিরাতে হাকিমুল উম্মত ২/৪৪৯-৪৫০, সংকলন-মুহাম্মাদ ইকবাল কোরেশি
(৭) সুনানু আবি দাউদ, হাদিস নং-৩৬৪১; সুনানুত তিরমিযি, হাদিস নং-২৬৮২; সুনানু ইবনি মাজাহ, হাদিস নং-২২৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-২১৭১৫
আরও পড়ুন..
Facebook Comments