“আপনি যাকে পছন্দ করবেন, তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না, তবে আল্লাহ তা’য়ালা যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন।” (সূরা কাসাস আয়াত ৫৬)
“হিদায়াত” এটি নিছক কোনো শব্দ নয়, এটি হলো একজন মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ কাকে হিদায়াত দিবেন আর কিভাবে দিবেন আল্লাহই জানেন। কাউকে আল্লাহ হিদায়াত দেন হঠাৎ করে, আবার কাউকে দেন ধীরে ধীরে। আমার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা’য়ালা দিয়েছেন ধীরে ধীরে। হঠাৎ করে একদিন টেলিভিশনে ড. জাকির নায়েকের লেকচার দেখা এবং নিয়মিত নামাজ পড়ো না তাহলে দাড়ি রেখেছ কেন এই প্রশ্নের মাধ্যমে আমার হিদায়াতের সূচনা।
এক.
ছোটবেলায় নিয়মিত নামাজ আদায় করতাম কিন্তু খুব সসম্ভবত ৪র্থ শ্রেণিতে থাকতে আমাদের বাসায় টেলিভিশন আনা হয়, আর আমার বিপথে যাওয়ার শুরু সেই সময়টা থেকেই।প্রথমে একটা একটা করে ওয়াক্ত কাযা হতে থাকা, এরপর ধীরে ধীরে নামাজ এমনকি জুমার নামাজ পড়া থেকেই দূরে সরে গিয়েছিলাম আমি।পড়াশোনা আর খেলাধুলার পাশাপাশি টিভিতে খেলা দেখা & সিনেমা দেখাটাই ছিল আমার নিত্যদিনের রুটিন।
বলতে গেলে ইসলামী লাইফ স্টাইলের কিছুমাত্র আমার নিকট ছিল না।আম্মু প্রথমে নামাজের জন্য অনেক কিছু বললেও আমার মধ্যে পরিবর্তন না দেখায় পরবর্তীতে আর তেমন কিছু বলেন নি।এভাবেই আমার দিন কাটতে থাকে।
দুই.
সপ্তম শ্রেণীতে উঠার পর একদিন আমার নানা বাড়িতে বেড়াতে এসে টিভিতে ড.জাকির নায়েকের (হাফিজাহুল্লাহ) লেকচার দেখতে চাইলেন।প্রথমবারের মতো ড. নায়েকের লেকচার দেখে পুরোপুরি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আমি।উনার লেকচারে এত বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলাম যে, টেলিভিশনের যেকোনো অনুষ্ঠানের চেয়ে সেটা আমার ভালো লাগতো। এরপর থেকে প্রতিদিন নিয়মিত উনার লেকচার দেখা শুরু করি। ইসলাম যে নিছক কোনো ধর্ম নয়, বরং পরিপূর্ণ জীবন বিধান সেটা আগে থেকে জানলেও প্রথমবারের মতো অনুভব করেছিলাম। উনার লেকচার দেখেই।ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার সেই শুরু।আবার পুনরায় নামাজ পড়া শুরু হয় তখন থেকেই, যদিও নিয়মিত পড়তে পারতাম না। সেই সময় থেকেই ইসলামের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে আমার খুবই ভালো লাগতো।
এই প্রসঙ্গে একজন মানুষের কথা না বললেই নয়, আমার স্কুলের ইসলাম শিক্ষার শিক্ষক।হয়তো দেখা যেত, ড. জাকির নায়েকের লেকচার দেখেছি কিন্তু কিছু জিনিস বুঝতে পারি নি অথবা অবাক লেগেছে। ক্লাসে স্যারকে সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে স্যার খুবই চমৎকারভাবে উত্তর দিতেন, যদিও সেটা বইয়ের সাথে সম্পর্কিত হতো না।এটা আমাকে আরো বেশি মুগ্ধ করতো।(আল্লাহ স্যারকে উত্তম প্রতিদান দান করুন)
তিন.
দাড়ির প্রতি আমার ছোটবেলা থেকেই একটা আগ্রহ কাজ করতো।দাড়িওয়ালা মানুষদেরকে দেখতে ভালো লাগতো আমার কাছে। তাই দাড়ি রাখার ইচ্ছেটা আমার ছোটবেলার। প্রথম যখন দাড়ি উঠে আর কাটতে চাই নি।কিন্তু আপত্তি ছিল আম্মুর। উনার কথা ছিল যেহেতু আমি নিয়মিত নামাজ পড়ি না তাই আমি যেনো দাড়ি না রাখি।যদি দাড়ি রাখতে চাই তাহলে নিয়মিত নামাজ পড়তে হবে।এজন্য আমার দু একবার বাধ্য হয়ে দাড়ি কাটতেও হয়েছে।কিন্তু এটা ছিল আমার হিদায়াতের ২য় ধাপ।
তখন থেকেই চেষ্টা করতে থাকি নিয়মিত নামাজ পড়ার।উদ্দেশ্য, দাড়ি নিয়ে বকা খাওয়া থেকে বেঁচে থাকা। কিন্তু আল্লাহর রহমতে পরবর্তীতে নিয়মিত নামাজ পড়া কন্টিনিউ হয়ে যায়। যখন কন্টিনিউ হয়ে গেলো মোটামুটি, এরপর আর আমার দাড়ির ব্যাপারে আম্মু কিছু বলেন নি।বরং কোনো আত্মীয় দাড়ির ব্যাপারে কিছু বলার চেষ্টা করলে আমাকে সাপোর্ট দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ।
[এ প্রসঙ্গে একটি কথা আমার মনে হয়, অনেক ভাই মনে করেন, আমি তো অনেক ধরনের গুনাহ করি,এখন যদি দাড়ি রাখি তবে সেটা দাড়ির অপমান হবে।তাই আগে গুনাহ ছেড়ে দিব তারপর দাড়ি রাখব। এর উল্টোটাও কিন্তু সম্ভব।দাড়ি রেখে দেয়াটাও গুনাহ ছাড়ার মাধ্যম হতে পারে।আমি আমার ২ জন বন্ধুকে চিনি যারা শুধুমাত্র দাড়ি রেখে দিয়েছে বলে অনেক ধরনের গুনাহ থেকে বেচে থাকতে বাধ্য হচ্ছে।মনে চাইলেও দাড়ির সম্মানার্থে তারা সেগুলো করতে পারে না।]
এভাবে এস এস সি পরীক্ষা শেষ হয়।মাঝখানে পীস টিভি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর ড. নায়েকের লেকচার দেখা হয় নি।ইসলাম সম্পর্কে আমার ধারণা পুনরায় কেমন যেনো নামাজ রোজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
চার.
এস এস সি র পর স্কুলের একজন সিনিয়র ভাইয়া আমাকে প্যারাডক্সিকাল সাজিদ বইটি পড়তে দিয়েছিলেন। সেটা পড়ার পর ইসলামি লাইফ স্টাইলের আগ্রহটা পুনরায় কয়েকগুণ বেড়ে যায়।এরপর পড়া হয় ফেরা বইটি।পড়ার পর প্রথমবার অনুভব করি, আমি কত শান্তিতে আছি, আমার জন্য ইসলাম পালন করা কতটা সহজ, তারপরও কেন করছি না।কিয়ামতের দিন কিভাবে জবাব দিব আমি?? সিদ্ধান্ত নিই পুরোপুরিভাবে ইসলাম পালন করার।কিন্তু ইসলাম পালন করাটা তখনও পুরোপুরি হয়ে উঠেনি।
পাঁচ.
এরপর চলে এলাম কলেজে।প্রথমবারের মতো আম্মু আব্বুর থেকে এতো দূরে চলে আসলাম।এবার আমার নতুন বাসস্থান হলো কলেজের আবাসিক।আমাদের কলেজে আবাসিক কে হাউজ নামে ডাকা হয়।এই হাউজটিই ছিল হিদায়াতের পথে আমার নিকট আল্লাহ প্রদত্ত অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামত।হাউজে ইসলামের ব্যাপারে আমি যেমনটা আশা করেছিলাম আল্লাহ তার থেকে অনেক বেশি নিয়ামত রেখে দিয়েছিলেন।
তিনজন ভাইয়া ছিলেন যারা হাউজে তাবলীগ & নামাজের কক্ষ পরিচালনা করতেন।উনাদের চমৎকার জীবনাচরণ অনেক বেশি পরিমাণে মুগ্ধ করেছিল আমায়।কিভাবে পরিপূর্ণভাবে ইসলামের পথে চলতে হয় সেটা উনাদের মাধ্যমে প্র্যাক্টিক্যালি দেখেছি।বেশকিছু সুন্নাহসহ অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি শিখেছি উনাদের কাছে।
সেই তিনজন ভাইয়ার একজন ছিলেন আমার স্কুলের সিনিয়র। অবশ্য উনার সাথে আমার পরিচয় কলেজে গিয়েই।সঙ্গত কারণেই উনার সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল এবং এখনো আছে।অনেক বেশি পরিমাণে উপকৃত হয়েছি ভাইয়ার কাছ থেকে।এখনো প্রতিনিয়তই হচ্ছি।আমার ইসলামী জীবন চর্চার ক্ষেত্রে ভাইয়া যে সাহায্য করেছেন তাতে উনার জন্য শুধু দোয়াই করা যায়।আল্লাহ উনাকে নেক হায়াত দান করুন।এছাড়াও বেশ কয়েকজন চমৎকার রুমমেট পেয়েছিলাম যারাও আমার হিদায়াতের উসীলা।
ছয়.
সীরাতুল মুস্তাকিমের পথে চলতে গিয়ে তেমন কোনো বাধার স্বীকার হতে হয় নি আলহামদুলিল্লাহ। যদিও দাড়ির ব্যাপারে কেউ কেউ কিছু বলার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সেগুলো কোনো বাধা বলে অনুভূতই হয় নি।কেননা, আমাকে এসকল ক্ষেত্রে আম্মু আব্বু পরিপূর্ণ সাপোর্ট দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ।
দাড়ির ব্যাপারে সবচেয়ে বড় বাধাটা পেয়েছিলাম কলেজে ১২শ শ্রেণিতে উঠার পর। নতুন একজন প্রিন্সিপাল আসেন এবং ঘোষণা দেন যে দাড়ি লম্বা রাখা যাবে না।খাটো করে রাখতে হবে।ব্যাপারটা ওই সময়ে আমার জন্য খুবই কষ্টকর ছিলো।হাউজ মাস্টার & হাউজ টিউটর মহোদয় প্রথম প্রথম দাড়ি কাটার জন্য চাপ দিতেন।কিন্তু আল্লাহর পথে চলতে চাইলে আল্লাহ যে রাস্তা সহজ করে দেন সেটার প্রমাণ আমি ওই সময়টাতে খুব ভালোভাবে পেয়েছিলাম।
সে সময়ে যদি উনারা শক্ত করে ধরতেন হয়তো আমার দাড়ি কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকতো না।তখনও ঈমান এতটা শক্ত ছিল না যে দাড়ির জন্য হাউজ ছেড়ে দিব! কিন্তু আল্লাহই আমার রাস্তা সহজ করে দিয়েছিলেন তখন। প্রথমে হাউজ কর্তৃপক্ষ দাড়ি কাটার জন্য চাপ দিলেও পরবর্তীতে উনারা প্রিন্সিপালের আদেশের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাকে যেভাবে সহায়তা করেছিলেন সেটা অবিস্মরণীয়।
আমার সেইদিনটির কথা মনে পড়ে যেদিন প্রিন্সিপাল স্যারের হাউজ পরিদর্শন ছিলো।আমি যেনো প্রিন্সিপাল স্যারের সামনে বিব্রতকর অবস্থায় না পড়ি সেজন্য উনি হাউজে প্রবেশ করার পূর্বমুহূর্তে হাউজ মাস্টার & হাউজ টিউটর মহোদয় আমাকে ডেকে বললেন হাসপাতালে চলে যেতে।উনারা বলবেন আমি অসুস্থ তাই অনুপস্থিত। আল্লাহ তা’য়ালা উনাদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
প্রকৃতপক্ষে আমার হিদায়াতের ব্যাপারটা আল্লাহ তা’য়ালা হঠাৎ করে দেন নি।ধীরে ধীরে বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিভিন্ন উসীলায় আল্লাহ তা’য়ালা উনার অপূর্ব সব নিয়ামতের মাধ্যমে আমাকে হিদায়াত দান করেছেন।এর মধ্যে একটি বড় নিয়ামত ছিল বয়েজ স্কুল & বয়েজ কলেজে পড়তে পারাটা।যেটা ছিল আমার হিদায়াতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উসীলা।
এখন চিন্তা করলে অবাক লাগে, কিছুদিন আগেও আমার কাছে আলোচনার জগৎ ছিলো মাশরাফি – তামিম- মেসিরা, তারও আগে বলিউডের তথাকথিত নায়কেরা, সেখান থেকে কিভাবে যেনো ধীরে ধীরে আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহ. – আব্দুল মালেক হাফি. এর জগতে এসে পড়েছি, আল্লাহু আ’লাম।আলহামদুলিল্লাহ। তিনিই আমার জন্য রাস্তা করে দিয়েছেন।
কিন্তু এত সব নিয়ামতের মধ্যেও পুরোপুরি নীরে ফিরতে পেরেছি বললে সম্ভবত ভুল হবে। সর্বোচ্চ এটুকু বলতে পারি, জাহেলিয়াতের নদীতে সাঁতার কেটে নীড়ের দরজায় এসে কড়া নাড়ছি।আল্লাহর কাছে দোয়া করি, যেনো তিনি আমাকে পরিপূর্ণভাবে তাঁর নীড়ে প্রবেশ করান।আল্লাহুম্মা ইহদিনাস সিরাতল মুস্তাকিম।
Facebook Comments