সংকলন
silvia-silvi
প্রতিযোগিতা-২

নীড়ে ফেরার গল্প-৪৮ | সিলভিয়া সিলভি

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন

মনের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে আমি মানুষটা একেবারেই কাঁচা।কখনোই গুছিয়ে কাউকে কিছু বলতে পারি না। এই সুন্দর উদ্যোগ টা সম্পর্কে জানতে পারার দুইদিন কাটিয়ে এক গাদা সাহস জমিয়ে ভাবলাম এখন একটু না হয় লিখি।

আমি আমার পরিবারের বড় মেয়ে।আমার বাবা মা দুইজনের ই ছেলে সন্তানের শখ ছিলো,আর আমার মায়ের ছিলো ছেলে সন্তান নিয়ে আলাদা ফ্যান্টাসি। সেই ফ্যান্টাসি থেকেই ছোট বেলা থেকেই আম্মু আমায় ছেলে সাজিয়ে রাখতো।ছেলেদের মতোন সেজেগুজে প্যান্টের পকেটে হাত রেখে ভাব নেওয়া ছিলো আমার অন্যতম শখের একটা কাজ।আর নানু বাড়িতে থাকার কারণে আমার মেলামেশা ও ছিলো আমার সব মামা-চাচা দের সাথেই।আমার আচার আচরণ সবকিছুতেই নারী ভাব টা ছাপিয়ে পুরুষ ভাব টাই বেশী  ফুটে উঠতো।সহজ ভাষায় বলতে গেলে নিজেকে রীতিমতো গুণ্ডা ভাবতাম।ইচ্ছে করে ছেলেদের সাথে ঝগড়া, মারামারি ছিলো আমার ফ্যান্টাসি।কার বাড়িতে কোন গাছে কি ফল,কোন মুরগীর বাচ্চা হলো এইসব জেনে জেনে ওগুলো চুরি করে নিয়ে আসা আমার কাছে মজা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। কথায় কথায় মিথ্যা বলা আর নানান রকম গল্প বানিয়ে অভিনয় করা তো ছিলো আমার নিত্যদিনের সাধারণ ঘটনা।

এইতো গেলো আমার গাফেল জীবনের কথা।এবার আসি আমার পরিবারে! আমার বাবা-মা দুইজনকেই মডারেট মুসলিম ই বলা যায়।যদিও এখন আমার বাবা কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা হিদায়ত দান করেছেন আলহামদুলিল্লাহ। আমার ক্লাস থ্রী তে পড়াকালীন ই বাবা দেশের বাইরে চলে যান রিজিকের সন্ধানে।আর আমি বড় হতে থাকি আমার মা এর আন্ডারে।আমার মা এর কাছে মূলত নামাজ আর রোজা টাই  ছিলো ইসলাম ।আমায় নামাজ পড়তে বলতেন,হুজুর বাসায় রেখে কোরআন মাজীদ ও পড়তে শেখালেন কিন্তু আমার ভেতরে দ্বীনের বীজ টা দিতে ভুলে গেলেন।আমি তখন পুরোপুরি দুনিয়া মুখী একজন।রোজা ছাড়া নামাজ,কোরআন কিছুই পড়া হতো না।আর নিত্যদিনকার অবাধ্যতা তো আমায় দিনদিন তলিয়ে নিচ্ছিলো।এমন গাফেল হয়েই জীবনের প্রায় ২০ বছর কাটিয়ে দিলাম!আস্তাগফিরুল্লাহ! বোরকা পড়েও উশৃংখল চলাফেরা,মিথ্যা,গীবত,হারাম সম্পর্ক সহ নানান রকম পাপে ডুবে থাকলাম।

এর মধ্যে কোনো একদিন ফেসবুকের  “ পর্দা The Sign Of Modesty ” গ্রুপের একটা  পোস্ট সামনে আসলো।লিখাটা ছিলো একটা ভয়ংকর স্বপ্নের মাধ্যমে একজন মেয়ের নামাজে খুশু খু্যূ অর্জন করার লিখা।লিখা টা পড়ে আমি ভাবছিলাম আমার সাথে কেন এমন কিছু ঘটে না!আল্লাহ কেন আমায় কোনোভাবে একটু আলো দেখাচ্ছেন না!কেন আমায় একটু সাহায্য করছেন না!

তখন ছিলো রমজান মাস।সাহরী শেষ করে নামাজ পড়ে মাত্র শুয়েছিলাম।আম্মু আর ছোট বোন তখন কথা বলছে।হঠাৎ আমার কেমন যেন অদ্ভুত লাগা শুরু হলো।মনে হচ্ছিলো দরজা ভেদ করে এক্ষুণি কেউ আসবে।নাকে একটা অদ্ভুত বাজে গন্ধ এসে লাগছিলো।আমার তখন হুট করে মনে হয়ে গেলো, আমি কোথাও একটা পড়েছিলাম যে বদ লোকের প্রাণ নিতে যখন আজরাইল আসেন তখন অনেক বাজে গন্ধ নিয়ে আসেন।আমার তখন মনে হচ্ছিলো এই গন্ধ আমার মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে আসছে।এই গন্ধ আমার সকল প্রকার খারাপ কাজের গন্ধ।এক্ষুণি আমি মারা যাবো।অথচ আমি নিজেকে শোধরানোর কোনো সুযোগ পেলাম না! আমি কোনো রকমে আম্মুকে বললাম যেন আমার উপর কোনো রাগ না রাখেন।এই টুকু বলার পর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে থাকে আর আমার বুকের ভিতরে হাতুড়ি পেটার মতো হচ্ছিলো।এরপরে আমি চেষ্টা করেও কোনো কথা বলতে পারছিলাম না,আমি খুব করে চাচ্ছিলাম আম্মুকে ডাকতে,বোন কে ডাকতে,ওদের সাথে কথা বলতে।কিন্তু পারছিলাম না।আমি শুধু কান্না ই করে যাচ্ছিলাম কিন্তু কোনো কিছু করতে পারছিলাম না।বারবার মনে মনে বলছিলাম,আল্লাহ আমায় একটা সুযোগ দাও।আমায় নিজেকে শোধরানোর সুযোগ দাও।আমায় ক্ষমা করো আল্লাহ।আমায় ক্ষমা করো।অনবরত কাঁদছিলাম আর বারবার ক্ষমা চেয়ে যাচ্ছিলাম শুধু।আল্লাহর কাছে বারবার বলছিলাম, আল্লাহ আমায় একটা মাস সময় দাও।এক সপ্তাহ সময় দাও,অন্তত একটা দিন সময় দাও।আমি যেন মাফ চেয়ে নিতে পারি।মনে হচ্ছিলো এক্ষুণি জাহান্নামের ফেরেশতারা আমায় দুর্গন্ধ মাখা কাফন পড়িয়ে নিয়ে যাবে।কিন্তু আমি মরতে চাচ্ছিলাম না।আমি সুযোগ চাইছিলাম অনবরত।কিছুক্ষণ এমন শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতির পর হঠাৎ মনে হলো আমার ভেতরে যেই নিঃশ্বাস আটকে থাকা অনুভূতি টা সেটা একটু কমে গেছে।আমার বুক থেকে ভারী একটা পাহাড় নেমে গেছে।আমি কথা বলতে পারছি। তখন একমনে শুধু আমার রবকে ধন্যবাদ দিয়ে যাচ্ছিলাম আমাকে একটু সুযোগ দেওয়ার জন্য।সেই সময় টা যে কতটা অসহ্য দমবন্ধকর অনুভূতি ছিলো,আর আমার হৃদস্পন্দন যে কতটা দ্রুত হচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো যেন আমি প্রত্যেকটা শব্দ নিজে শুনতে পাচ্ছি।তখন খুব করে চাচ্ছিলাম যেন আমার হৃদস্পন্দনের শব্দ টা লুকিয়ে ফেলি।যেন কেউ জানতে না পারে,আমায় যেন নিতে না পারে।কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেলাম!

ঘুম থেকে উঠার পরেই বুঝলাম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আমার ইচ্ছার কথা শুনেছেন,আমার ইচ্ছা কবুল করে আমায় বোঝার মতো অনুভূতি দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ।আস্তে আস্তে আমি আমার রব কে চিনতে শিখলাম,জানতে শিখলাম।ইসলামের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলাম।ইসলামিক বই পড়া শুরু করলাম।আমার মনের মধ্যে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা অনেক প্রশ্নের সমাধান পেলাম “ প্যারাডক্সিকাল সাজিদ ” বই টা তে। “ ফেরা ”, “ অনেক আঁধার পেরিয়ে ” এই বই গুলো আমায় নাড়িয়ে দিচ্ছিলো।আমি অস্থির হয়ে আমার রবের কাছে সেজদায় লুটিয়ে যাচ্ছিলাম,মাফ চাচ্ছিলাম। এভাবেই আমার জীবনের সর্বোত্তম সময় টা তে আসা,আলোর পথে আসার শুরু।

যেই আমি গান শোনা ছাড়া কিছুই বুঝতাম না সেই আমি আমার ফোনের সকল গান এক বসা তে ডিলিট দিলাম। ফেসবুকের সকল গান এর পেইজ,গ্রুপ আনফলো করা শুরু করলাম।এক সময় ছবির ব্যাপারটা বুঝতে পারার পর আমার সাধের সব ছবি ডিলিট দিলাম।প্রায় ৪৫০০+ ছবি।ব্যাপার টা সহজ ছিলো না যদিও,কিন্তু আমার রবের জন্য করে ফেললাম।নিজেকে তো পালটে নিলাম,কিন্তু আমার আশেপাশে যেই পরিবেশ?সেটা কিভাবে পাল্টাবো? হঠাৎ এভাবে নিকাব করে,হাত মোজা পড়ে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার কারণে আশেপাশের মানুষের কম কথা শুনতে হয় নি।ক্বারী সাহেব,জঙ্গি, হুজুরনী,ভঙ, ভাব, নাটক সহ আরো অনেক কথা শুনতে হচ্ছিলো।নতুন নাটক শুরু করেছি,বিয়ের জন্য নিকাব করছি,বয়ফ্রেন্ড এর কথায় নিকাব করছি,কোনো খারাপ কাজ করেছি কিনা সহ আরো অনেক হাবিজাবি কথা হজম করতে হয়েছে।বান্ধবী দের কিছু বলতে গেলে উল্টো তাদের কথায় কষ্ট পেয়ে ফেরত আসতাম।তাদেরকে কড়াভাবে  আমার ছবি ডিলিট করতে বলায় অনেকেই ক্ষুণ্ন হলো আমার উপর।সরে যেতে লাগলো আমার থেকে।

আস্তে আস্তে একা হয়ে যাচ্ছিলাম। এরপর তো আসলো নিজের ঘরের ব্যাপার।ছোট বোন রুমে গান শুনে,আমি নিষেধ করতে গেলে ঝগড়া হয়ে যায়।আম্মু ও এসব ঝগড়া দেখতে দেখতে এতো টাই বিরক্ত হয়ে যান যে আমায় ই দোষারোপ করতে থাকেন।আমি নাকি বাড়াবাড়ি করছি।আমি নাকি সংসারে অশান্তি করছি।অন্যদের নিয়ে কথা বলতে নিষেধ করতাম,গীবতের কথা বোঝাতাম,নামাজে তাড়াহুড়ো না করার কথা বলতাম।এই সব গুলো কথা কেই আমার মা ভাবতো আমি উনাকে অপমান করছি।এক পর্যায়ে আমার মা ও আমার সাথে বাজে বিহেইভ করা শুরু করেন।আমি বেশী বেশী করছি,হুট করে বেশী মুসল্লী গিরি করছি,অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী, নতুন নতুন জেনে উনাদের শেখাতে আসছি টাইপ অনেক ধরনের কথা বার্তা।একটা সময় আমার বোনের সাথে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায় পুরোপুরি। আর আম্মুর সাথেও দরকার ছাড়া কথা হতো না।আম্মু কথা বলতেন ই না।এক ই ঘরে থেকেও আম্মু আর বোন নিজেদের মতোন থাকতেন আর আমি একা একা মোবাইল আর বই নিয়েই থাকতাম।কি অসহ্য দিন যে ছিলো! সুইসাইড করার চিন্তা ও মাথায় চলে আসছিলো।আস্তে আস্তে আল্লাহর দিক থেকেও মনোযোগ কমে আসছিলো।এরকম ভাবে অনেকদিন চলে যাওয়ার পরে আবার আমার রব আমায় আরেকটা সুযোগ দিলেন।নতুন করে উনার নিকটবর্তী হওয়ার সুযোগ করে দিলেন আলহামদুলিল্লাহ আলা কুল্লি হাল। তখন জানলাম, আল্লাহ তার বান্দাকে নিজের নিকটবর্তী করতে চাইলে বাকী সবাই কে তার থেকে দূরে সরিয়ে দেন। একাকীত্বের কষ্ট টা ভুলে গেলাম।আস্তে আস্তে আমার রব আমার জন্য সবকিছুই সহজ করে দিলেন।হয়তো সব ঠিক হয় নি,তবে সহ্য করার আর হজম করে নেওয়ার মনোবল টুকু দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ।

আমায় ভীষণ রকমের আনন্দের অনুভূতি দিয়ে আমায় একটা ইসলামিক অনলাইন মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ ও করে দিলেন আলহামদুলিল্লাহ। আমার আল্লাহ চেয়েছেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। আর আমার বাবা আমার থেকে দূরে থেকেও আমায় সাপোর্ট করে গেছেন আলহামদুলিল্লাহ।আমি এখনো নিজেকে শুধরে নিচ্ছি,নিজেকে গড়ে তুলছি আস্তে আস্তে আমার রবের জন্য। এখন সৃষ্টিকর্তার কাছে একটা ই প্রার্থনা, আমায় যেন আমৃত্যু তিনি উনার ইবাদত করে যাওয়ার সুযোগ দেন।কখনো যেন আমার কাছ থেকে সেজদা দেওয়ার সুযোগ টা কেড়ে না নেন।আমার ভবিষ্যৎ জীবন টা কে যেন ইসলামের আলোয় আলোকিত করে রাখেন।

আলহামদুলিল্লাহ,আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমায় শুধু একদিন না,পুরো এক মাস হয়ে গেলো এখনো সুযোগ দিয়েই যাচ্ছেন। আমি যেন আমৃত্যু এই রাস্তায় ই থাকতে পারি ইন শা আল্লাহ।

Facebook Comments

Related posts

নীড়ে ফেরার গল্প-৪ | মালিহা (ছদ্মনাম)

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-২৩ | রেজাউল ইসলাম

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-১৪ | সাদিয়া আলম রিফা

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!