সংকলন
fahim-amjad
প্রতিযোগিতা-২

নীড়ে ফেরার গল্প-৩৪ | ফাহিম আমজাদ

নিজের মন্দ অতীত কে স্মরণ করতে চায়? অধিকন্তু সেই অন্ধকার অতীত দ্বারা সাদা পৃষ্ঠাকে কালো করা তো অনেক দূরের কথা।তথাপি অনেক ভেবে চিন্তে সেই অন্ধকার দিনগুলোর কথা লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।সাথে সেই অন্ধকার থেকে আলোর পথে বেরিয়ে আসার গল্পটিও। হ্যাঁ,আমার নীড়ে ফেরার গল্প এটা।নিজের সেই বিষাক্ত অতীত স্মরণ করার অন্যতম কারণ হচ্ছে, হয়ত আমার নীড়ে ফেরার গল্প শুনে অন্য কেউ নীড়ে ফিরবে।যেমনটি আমার ক্ষেত্রে ঘটেছে।

প্রতিকূল পরিবেশে আমি

আমি রাকিব,(ছদ্মনাম)।পিতামাতার একমাত্র ছেলে সন্তান।একটি বোন আর আব্বু আম্মুকে নিয়েই আমাদের ছোট্ট পরিবার।

ভালো পড়া-লেখার জন্য আব্বু আম্মু আমাকে নানির কাছে রেখে আসেন।আর তাতেই কাল হল আমার।পড়া-লেখার জন্য সেখানে ভালো স্কুল ছিল ঠিক।কিন্তু পরিবেশ ছিল পাপাচারে অন্ধকারাচ্ছন্ন।আমাদের ছোট একটা দল ছিল, সবার বয়স নয় কি দশ বছর।কিন্তু তন্মধ্যে একজন ছিল প্রাপ্তবয়স্ক। সে সবকিছু আমাদের চেয়ে বেশি জানত।যদ্দুরণ আমরা ছিলাম তার প্রতি অনুরক্ত। তাকে দিয়েই শুরু হয়েছিল অন্ধকার জগতে পথচলা।সে আমাদের এমন বিষয় সম্পর্কে অবগত করত যা প্রাপ্তবয়স্করাও ভাবতে পারত না।অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও রগরগে অশ্লীল গল্প বলা ছিল আমাদের নেশা।এরকম অন্ধকারের মাঝে কেটে গেল তিনটি বছর।বয়সের চেয়ে বেশ পরিণত তখন আমি।এর কিছুদিন পর হাতে আসল মানবচরিত্র ধ্বংসকারী মোবাইল।শুরু হল আমার অধপতনের পর্ব।আমার চারপাশে এসে জুটে ছিল আমার মতই হতভাগ্য কিছু সঙ্গি।অন্ধকারের সাগরে সাঁতরাতে সাঁতরাতে কেটে গেল আরো কয়েকবছর ।এরপর বিধাতা আমার প্রতি দয়ার দৃষ্টি ফেললেন

Tijarah Shop

আলোর ছটা

কাকতালীয় ভাবে আজকের দিনটি আমার জন্য স্মরণীয় একটি দিন।নাহ,আজ বিজয় দিবস বলে দিনটি আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ব আছে তেমন নই,বরং আজকের এই দিনে আমার অন্ধকার হৃদয়ে আলোর ছটা এসে পড়েছিলে।সেই আলোর অঙ্কুর আজ হেদায়াতের বৃক্ষে রূপ নিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।

১৬ ডিসেম্বর,তার আগেরদিন প্ল্যান করে রেখেছিলাম কক্সবাজার যাব।প্রস্তুতিও নেয়া শেষ।রাতের শেষ ভাগে সঙ্গিদের নিয়ে বাসে চড়ে বসলাম।প্রথম কক্সবাজার যাচ্ছি বিধায় মনের ভেতর এক ধরণের পুলক অনুভব করছিলাম।কানে হেটফোন গুজে দিয়ে বাসের সিটে নিজেকে এলিয়ে দিলাম।কিছুক্ষণ পর মনে হল হঠাৎ নিচে কিছু একটা জিনিসের পতনের আওয়াজন হল।নিচু হয়ে দেখি একটি কলম পড়ে আছে আমার সামনে বসা যুবকটির পাশে।কলমটি উঠিয়ে নিতে গিয়ে খেয়াল করলাম সে একবার মাথা নিচু করছে, আবার তুলছে।প্রথমে বুঝতে পারিনি কি করছিল সে।পরে বুঝতে পারলাম নামাজ পড়ছে।এটা দেখে আমার হৃদয়টা কেমন জানি হাহাকার করে উঠল।সেদিন আমার প্রচণ্ড নামাজ পড়তে ইচ্ছে করেছিল।কিন্তু অজু না থাকায় পড়তে পারিনি।আশ্চর্যের ব্যাপার হল একটি বারের জন্যেও আমার তায়াম্মুমের কথা ম্মরণ হয়নি সেদিন।

তখন থেকে মনটা একরকম ছোট হয়ে গেল।যেই উদ্দীপনা আর উচ্ছাস নিয়ে কক্সবাজার যাচ্ছিলাম,তা মুহূর্তেই কোথায় উবে গেল।নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল।বারবার মনে হচ্ছিল,যদি এই গাড়িতেই এক্সিডেন্টে মৃত্যুবরণ করি।তাহলে আল্লাহ তাআলাকে কি জবাব দিব।এমন কল্পনা-জল্পনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।ঘুম থেকে জেগে দেখি কক্সবাজার চলে এসেছে।উদ্বিগ্ন আর চিন্তিত মনে দিনটি কক্সবাজার কাটিয়ে বাড়িতে ফিরে আসলাম।এরপর কদিন নামাজের প্রতি বেশ গুরুত্ববান ছিলাম।ফজরের নামাজও ক্বাজা হত না।গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকতে লাগলাম।কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অন্তরের মাঝে জ্বলে উঠা আলোর ছটাটি নিভে যেতে লাগল।আবার পিছু হটলাম।মন্দ সাথিদের পাল্লায় পড়ে সব যেন আগের মতো হয়ে গেল

নামাজের প্রতি মনোযোগও যেন কমে গেল।তবু নিভু নিভু হয়ে জ্বলছিল হেদায়াতের প্রদীপশিখা ।দ্বিধা-দ্বন্দ্বে কেটে গেল আরো কয়েকমাস।এরি মাঝে ফেসবুকের প্রতি ধাবিত হয়ে গেলাম আমি।ইসলামিক পোস্টগুলো এড়িয়ে চলতাম। পড়ার সুযোগ আমার কপালে জুটত না।

প্রত্যাবর্তন

ফুফাত ভাইয়ের বিয়েতে গিয়েছিলাম সেদিন।বিভিন্ন রকমের গিফ্ট এসেছে।আর এসেছে একটি মাত্র বই।আমার জন্য  হেদায়েতের বার্তা নিয়ে। কেন জানি ফুফাত ভাইয়ের থেকে বইটি আমি নিয়ে আসি।হয়ত এটাই তাকদিরের লিখন ছিল।কয়েকদিনপর বইটা পড়া শুরু করি।

কিছুদূর পড়ার পর অকস্মাৎ আমার অন্তরটা গুমরে গুমরে কেঁদে উঠে।সামনে অগ্রসর হতে পারছিলাম না।সেদিনের অনুভূতি আমি কি করে বুঝাই! যেন আমার হৃদয় চুরমার হয়ে যাবে।এত বড় পাপের বোঝা আমি বহন করছি! চিন্তার ঝড় বইতে শুরু করল আমার হৃদয়ে।এমনকি আত্মহত্যার মতো ঘৃণ্য কাজ করার কথাও অন্তরে এসেছিল।আমি তখন সইতে পারছিলাম না।এত পাপের বোঝা পাহাড়ও বহন করতে পারবে না,সেখানে আমার মতো দুর্বল ইমানদারের অবস্থা কেমন হবে!অনেক কষ্ট করে বইটা শেষ করলাম।কয়েকদিনপর আবার পড়লাম।আবার অশ্রুর প্রস্রবণে বালিম ভেজালাম।আল্লাহর রহমতে আবার ইসলামের প্রতি মনোযোগী হলাম।মনোযোগী হলাম সালাতের প্রতি।বিরত থাকতে লাগলাম গুনাহের কাজ থেকে।খারাপ সঙ্গিদের এড়িয়ে চলতে শুরু করলাম।কিন্তু আমি অনুভব করতে পারছিলাম —সত্যের যেই স্তম্ব আমার বুকে স্থাপিত হয়েছে,তার ভিত খুব নড়বড়ে।যেকোনো সময় সেটা ভেঙে পড়বে।আমি আবার সটকে পড়বে হকের রাস্তা থেকে।যে কোনো ভাবে সেই ভিত আরো মজবুত করতে হবে।কিন্তু কি করব আমি বুঝতে পারছিলাম না।ডিপ্রেশনের চাপে মুখটাও সবসময় মলিন হয়ে থাকত।আব্বু-আম্মু আমার অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন।একদিন কেন জানি মনে হল মোবাইলটা আমার বিক্রি করে দেয়া দরকার।এটা আমাকে যেকোনো সময় পূর্বের পথে নিয়ে যেতে পারে।যেই ভাবা সেই কাজ।মোবাইলটা বিক্রি করে দিলাম।তাতে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল।কিছুদিনপর অসুখে পড়লাম।প্রচণ্ড জ্বরে অবস্থা আরো কাহিল।কিন্তু মনোবল আমার দৃঢ়।অসুখ সেরে বাসায় ফেরার কদিন পর মামা বিদেশ থেকে একটা মোবাইল আনল আমার জন্য।আবার মোবাইল ব্যবহার শুরু করলাম।কিন্তু এখন ভালো কাজেই সময় ব্যায় করতাম।ফেসবুকে ইসলামিক পোস্টগুলো নিয়মিত পড়তাম। তখন কম-বেশি সবাই ইসলাম নিয়ে লেখালেখি করছিল।অধিকন্তু সুন্দর সুন্দর সব ইসলামিক বই প্রকাশ পাচ্ছিল।দ্বিতীয় বই পড়লাম ২০১৮ তে দ্যা রিভার্টস।তিন- চারবার পড়ে ফেললাম বইটি।যতই পড়ি, মনে হতো আমার হৃদয়ে হকের ভিতটা মজবুত হচ্ছে।নওমুসলিমদের নীড়ে ফেরার গল্পগুলো আমার হৃদয়ে প্রবল রেখাপাত করে।

আমার চারপাশ

ব্যক্তিগত ও মানসিকভাবে আমি মোটামুটি প্রাক্টিসিং মুসলিম এখন।কিন্তু আমার চারপাশের অবস্থা অত্যন্ত করুণ।পাপাচারে নিমজ্জিত আমার আশপাশ প্রতিনিয়ত ব্যথা দেয় আমাকে। ছোট বোনের বিয়েটাও ইসলামি পদ্ধতিতে হল না।অনৈসলামি সব কার্যক্রম পালিত হল।বাধা দিতে গিয়ে অনেক আত্মীয় রাগান্বিত হয়ে কটু কথা শুনিয়ে বিবাহ অনুষ্ঠান ত্যাগ করল।এরজন্য আব্বু-আম্মুর কাছেও ছোট হতে হল।পাশের বাড়িতে প্রায়শ উঁচু ভলিউমে গান বাজনা চলে।একদিন বুঝাতে গেলে মারমূখী হয়ে তেড়ে আসে আমার দিকে। সেদিন থেকে তাদের সাথেও সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল।অনেকবার চেষ্টা করেও সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারিনি। তার উপর ক্ষমতাসীন নেতাদের মসজিদ নিয়ে দূর্নীতি, অসামাজিক কার্যকলাপ নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে আজও।ব্যক্তিগতভাবে আমি ইসলামের সাধারণ বিধানগুলো পালন করতে পারলেও প্রতিকূল পরিবেশ আমাকে দিন দিন বিপর্যস্ত করে তুলছে।আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি —তিনি আমার মতো আমার এলাকায়ও যেন হেদায়াতের বৃষ্টি বর্ষণ করে।

Facebook Comments

Related posts

নীড়ে ফেরার গল্প- ৩৮ । ইতকান বিন সারওয়ার

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-৪৩ | নুসাইবাত আইশা

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-২৯ | মুহাম্মদ ইবরাহিম খলিল সিরাজী 

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!