সংকলন
নীড়ে-ফেরার-গল্প
প্রতিযোগিতা-২

নীড়ে ফেরার গল্প-৭ | নুসরাত নওরীন নিদ্রা

ছেলেবেলায় রচনা লিখতাম,”My aim in life is to be a doctor” আহ! ডাক্তার হওয়ার সেই স্বপ্ন…পা রাখলাম স্বপ্নের মেডিকেল কলেজে,কত উচ্ছ্বাস, কত আয়োজন!আমার সেই অধরা স্বপ্ন.. আজ সত্যি প্রায়!আর চিন্তা কী! চারিদিকে যেন সবুজ বসন্ত, প্রশংসার বন্যা;আমি ভেসে যাই সাদা তুলোর মত,দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়া একমুঠো বালির মত…. শুরু হল ক্লাস,পড়াশোনা,সাদা অ্যাপ্রোন গায়ে দিয়ে আমার পথচলা;কলেজে আসি,যাই,ক্লাস হয়,পরীক্ষা দিই;হই-হুল্লোড়,ঘুরতে যাওয়া,রুমমেটদের সাথে খেতে যাওয়া….এইতো চলছে জীবন……

ধীরে ধীরে উচ্ছ্বাসের দিনগুলি শেষ হয়ে আসে,একঘয়ে লাগে কেমন যেনো,ঘোরাঘুরিতে আর তেমন আনন্দ পাই না…সব থেকেও কী যেনো নেই!মনের ভেতর প্রশ্ন জাগে,”এই কি জীবন?করছিটা কী?লক্ষ্য কী আমার??”উত্তর আসে,”ডাক্তার হওয়া।” ভেতর থেকে কেউ একজন প্রশ্ন করে,” কিন্তু সে তো পূরণপ্রায়! তারপর?” আমি উত্তর দিতে পারি না। নিজেকে মনে হয় ছেলেবেলার রচনার সেই হালবিহীন নৌকার মত ” A life without ‘aim in life’ is like a rudderless boat”

Tijarah Shop

আমি খুঁজে ফিরি এই প্রশ্নের উত্তর….পাইনা কোথাও।

এদিকে হোস্টেলের তিনতলায় তালিম হয় প্রতিদিন;৮ঃ১৫ থেকে ৮ঃ৩০;যাই মাঝে মাঝে।আমার রবের বাণী,অমিয় সুধা;তার হাবীব (সঃ) এর জীবনাচরণ,…হৃদয় শান্ত হয়,ঘোর লাগে,কিন্তু পরক্ষণেই আবার মিলিয়ে যাই….আবার যেই আমি সেই….

ডেইলি রুটিন ঠিক করে দেয়া এই মেডিকেল লাইফে,ক্লাস-পরীক্ষা,আইটেম,কার্ড,টার্মের ভীড়ে সেই জেগে ওঠা প্রশ্নগুলো যেন হারিয়ে যেতে থাকে,,মাঝে মাঝে উঁকি দেয়, নদীতে হঠাৎ জেগে ওঠা শুশুকের মত….

গণরুমে থাকি আমরা প্রায় ২০ জন।হাসি-ঠাট্টা,গল্প-তামাশা,বিজ্ঞান,সাহিত্য বা রাজনীতি, নানা বিষয়ে চলে আলোচনা; কিন্তু ধর্মের বিষয় আসলেই কেমন যেন ম্রিয়মান আমি,তাল মেলাতে পারি না,জাকির নায়েক ছাড়া তেমন কারো নাম জানি না,জানাশোনাও বেশি না,তার লেকচারই সম্বল;ক্লাস নাইন-টেনে পিস টিভি দেখে যেটুকু জেনেছি,জানি কিয়ামত হবে,জান্নাত -জাহান্নাম আছে;২-১ জন একটু আলাদা,ভালোই জানে,বেশিরভাগই আমার মত না জানার দলে,(সময়ের পরিক্রমায় এখন বেশির ভাগই দ্বীনের বুঝ পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ)হুটহাট জিগ্যেস করে বসি,”মুফতি মানে কী?গাইরে মাহরাম?তাফসীর??কিছুটা বিরক্ত হয় হয়তো!চোখে তাচ্ছিল্যের ভাব;এই নরমাল জিনিসগুলোও জানে না!!অবান্তর প্রশ্নে এমনই স্বাভাবিক,তারপরও খারাপ লাগে কেমন যেনো….

সারাজীবন মোটামুটি ভদ্র,ভালো মেয়ে বলেই পরিচিত আমি। মাহরাম-গাইরে মাহরাম বুঝি না, তবে বাইরে গেলে বোরখা পরি অথবা সালোয়ার কামিজ-হিজাব,রমজানে রোজা করি, নামাজও পড়ি তবে সব ওয়াক্ত ঠিকঠাক হয় না,লম্বা সিজদায় পড়ে কান্নার মজা বুঝি না;দীর্ঘ রূকুতে গুণাহ ঝরে পড়ার আনন্দ জানি না; ইসলাম মানে শান্তি জানি কিন্তু তার স্বাদ এখনও পাই নি,আত্মসমর্পণটা তখনও বুঝি না…..

এদিকে রুমে নতুন একটা মেয়ে আসে,শিরিন(ছদ্মনাম) নাম,সব বিষয়ে নাক গলায়,বিরক্তও লাগে মাঝে মাঝে;সৎকাজে আদেশ আর অসৎকাজে নিষেধ এর ব্যপারে খুব কঠোর।নাটক-গান-সিনেমা নিয়ে কথা বলতে দিবে না,দাঁড়ায়ে পানি খেতে দিবে না,….রাত ১০ টার মধ্যে ঘুমায় যায়,আর আমরা সব ২-৩ টায় ঘুমায়,৮ টার সময় পড়িমরি করে উঠে ঢুলুঢুলু চোখে ক্লাসে যায়;ফজর নিয়ে অত মাথাব্যথা নেই,এক ওয়াক্ত না পড়লে এমন আহামরি কিছু হয় না!!

ডাইনিংয়ে রাতের খাবার দেয় সন্ধ্যার আগে আগে,মাগরিবের টাইমে খেতে বসছি একদিন ৪-৫ জন মিলে,গরম গরম খেয়ে নিব,ঠান্ডা হলে ভালো লাগে না,রাতে ক্ষুধা লাগলে না হয় নুডুলস করে খাব;নামাজ পড়ে আসল শিরিন,খাওয়া প্রায় শেষ আমাদের,পাশে বসল,সরল ভাষায় কিছু কথা,দুনিয়া কত ক্ষুদ্র, নামাজ কত গুরুত্বপূর্ণ, কিছু হাদীস আর কুরআনের আয়াত;আমার অন্তরে নিভু নিভু সেই নূরের আলো যেন দপ করে জ্বলে উঠলো।কেউ তো এভাবে বুঝায় নি কখনো!এত দরদমদখা স্বর!হাতে একটা বই ধরিয়ে দিল”সাহাবীদের চোখে দুনিয়া” আর সেই উদাত্ত আহ্বান “দিনের শুরুটা নাহয় ফজর দিয়েই হোক” বলালম,”ডেকে দিস তো আমাকে……

পাশের বেডটা নীতুর(ছদ্মনাম),ভালো মেয়ে,৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে,আমার স্টাডি পার্টনার।সেদিন দেখি কী একটা ভিডিও দেখে ফোনে,পাশে বসলাম, বাসীরা মিডিয়ার(Baseera media)” জীবন-মৃত্যু-জীবন”;১ম পর্ব শেষ,কথাগুলো যেন সূঁচের মত বিধে যায়,আমার অলিন্দ-নিলয় হাহাকার করে ওঠে,তারপর আরেকটা পর্ব,আরেকটা,একে একে সবগুলো শেষ,আমার চোখে শ্রাবণের বর্ষণ;নিজেকে খুঁজে পেলাম ব্যর্থদের দলে,সেই হতভাগা বামদিকের দলটায়;কিন্তু আমার রব,পরম করুণাময় মালিক হয়তো চাননি আমি ব্যর্থ হই,রহমতের চাদরে আবৃত করে নিলেন আমাকে…….টার্মের আগের রাত,,প্রচন্ড পড়ার প্রেশার,অধিকাংশই বাকী;ভয়ে, হতাশায় দম বন্ধ লাগে,নামাজ রুমে যাই,সাজদা থেকে মাথা তুলি,চোখ পড়ে দেয়ালে টাঙানো এক হাদীসে,”হে আদম সন্তান,এ পৃথিবীর সবকিছু আমি সৃষ্টি করেছি তোমার জন্য,আর তোমাকে তো আমি সৃষ্টি করেছি আমার জন্য। তাই তুমি কেন এত হতাশ হচ্ছো?ভয় পাচ্ছো?তুমি যদি আমাকে ডাকো,তাহলে তো আমি তোমারই হয়ে যাব,আর আমি যদি তোমারই হয়ে যাই,তাহলে তো সবই পরিপূর্ণ হয়ে গেল,কোনো অপূর্ণতা রইলো না।আর তুমি যদি আমাকে হারিয়ে ফেল,তাহলে তো তুমি সবই হারিয়ে ফেলবে।আমি যেন হই তোমার নিকট সর্বাধিক প্রিয়।”আমি পেয়ে গেলাম আমার সব প্রশ্নের উত্তর আর তৈরী করে নিলাম আমার প্রায়োরিটি লিস্ট…….

হাতে পেলাম কুরআনের এক কপি বাংলা অনুবাদ,এক খন্ড আবেগ,এক পৃথিবী ভালোবাসা ;অনুবাদক হাফেজ মুনির উদ্দিন আহমেদ, শুরু করলাম পড়া,ডুব দিলাম নিদর্শনে ভরপুর মহিমান্বিত এক কিতাবে,শুরু হল আমার স্বর্ণালী দিনের ইতিহাস, আমার রবের সাথে কথোপকথন;একান্ত কাছের কেউ,পরম মমতায় যেন আমাকে দিকনির্দেশনা দেন,ভুল হলে শুধরিয়ে দেন,”ধুর বোকা মেয়ে, এটা এভাবে করে না,এভাবে করতে হয়।ভুল করেছ?তাতে কী?এখন থেকে আর করো না।” আমি বুঁদ হয়ে থাকি,মনে হয় আগে কেনো তাঁর সন্ধান পায় নি!পরক্ষণেই ভাবি দেরীতে হলেও পেয়েছি তো!!

এইতো এভাবেই শূন্য হতে পূর্ণ হলাম আমি,রিক্ত হতে সিক্ত হলাম রবের মহিমার বারিধারায়;শুরু হল মেহনত,নিজেকে ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ে নেয়ার,তাঁর রশিকেই শক্ত করে আঁকড়ে ধরার,বুঝলাম সমর্পণেই সন্তুষ্টি।

শুরু হল নতুন অধ্যায়,,জেনে-বুঝে দ্বীন পালন করা!খুব বেশিদিন না, এইতো বছর দেড়েক হবে…..আস্তে আস্তে পরিচয় হয় ইসলামিক বই-পত্রের অদেখা এক জগতের সাথে;শরৎ,হুমায়ুন আর রবীন্দ্রনাথ থেকে পাড়ি জমাই তাফসীর,সীরাত,খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর(রহঃ),শাইখ মুসা জিব্রীল,আরিফ আজাদ আর ডা.শামসুল আরেফীন শক্তির দুনিয়ায়;তাজবীদটা ঝালিয়ে নিই আরেকবার,সাথে চলমান আরবি ভাষা শিক্ষা; আর আমার উম্মাহর বোনেদের সেবায় ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ  মেডিকেল ফিক্বহ…..

হারাইনি তেমন কিছুই,কিছু কটুকথা,চোখ রাঙানি, এগুলো তো থাকবেই।যে তার রবকে চিনেছে তার জন্য এ আর এমন কী!মাঝে মাঝে পা পিছলে পড়ি,হোচট খাই,কোনো এক অদৃশ্য হাত যেনো আমাকে টেনে তোলে,”ঐ যে জান্নাত,ঐ যে লোকগুলো,ওদের দুপাশে নূর;সামনে আর ডানে,হতে হবে না ঐ দলে শামিল???আমি শক্ত পায়ে উঠে দাঁড়াই।

আজ যখন পেছন ফিরে তাকাই,ঠিক কোথা থেকে পথচলা শুরু?সেই ক্লাস থ্রি তে জোর করে কুরআন পড়তে শিখলাম?ক্লাস সেভেন এ আরেকবার?নাকি ক্লাস  নাইন এ ডা জাকির নায়েকের লেকচার?হুট করে যে বোরখা কিনে নিয়ে আসলাম?সেই থেকে? নাকি আরও পরে?শিরিনের নসীহা,বাসিরার ভিডিও আর আমার রবের কালাম??বুঝে উঠতে পারি না ঠিকঠাক,আসলে আমার রব তো জড়িয়েই রেখেছিলেন আমাকে,তাঁর রহমতের চাদরে,সেই প্রথম থেকেই,চিনতে পারিনি শুধু;তিনি আমাকে কখনোই ছেড়ে যাননি,পরিত্যাগও করেননি আর দিয়েছেন অনিন্দ্য সুন্দর,অনাবিল প্রশান্তির এক জীবন….

এই হলো আমার নীড়ে ফেরার গল্প;আমার আমিকে ফিরে পাওয়ার;”My aim in life is to be a doctor” থেকে “My aim in life is going to Jannah” হওয়ার গল্প।

 

Facebook Comments

Related posts

নীড়ে ফেরার গল্প-১ | মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ 

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-২৮ | বায়েজিদ বোস্তামি

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প- ৩৮ । ইতকান বিন সারওয়ার

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!