সংকলন
ইসরাত-জাহান
প্রতিযোগিতা-২

নীড়ে ফেরার গল্প-২৫ | ইসরাত জাহান মুনিরা

ছোট থেকেই ধর্মের প্রতি বেশ আগ্রহ আমার। কখনো মাথা থেকে কাপড় সরতোনা। যতটুকু জানতাম ততটুকুই মানতাম। অবশ্য তেমন পড়ুয়া ছিলাম না, কেবল একাডেমিক পড়া আর ভালো ফলাফল অর্জনই ছিল আমার একমাত্র লক্ষ্য৷ আমাকে যে বড় হতে হবে (বাস্তুবাদী চিন্তা), আমাকে যে ভাল পজিশনে যেতে হবে (দুনিয়াবি পজিশন)। ধর্ম সম্পর্কে যা জ্ঞান ছিল আমার তা সব ই ছিল আমার আব্বুর থেকে জানা৷ আব্বু বরাবরই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, মাথায় কাপড় আর কুরআন পড়তে তাগাদা দিতেন। মনে আছে ফজরের নামাজে না উঠলে বেত দিয়ে বাড়ি দিতেন, মাথায় কাপড় না থাকলে মাথায় বাড়ি দিতেন। ধর্ম সম্পর্কে ব্যস শুধু এইটুকুই বুঝতাম। ইসলাম পালন মানে নামাজ পড়া, রোজা রাখা, কুরআন পরা আর পর্দা বলতে মাথায় কাপড় দেয়া৷ পাঠ্য বইয়ের বাইরে বই পড়ার অভ্যাস একদমই ছিলো না।  অন্যদিকে ইসলাম এর ব্যপকতা সম্পর্কেও কখনো কেউ বলেনি।   ইসলাম সম্পর্কে তাই নামাজ রোজার বাইরে কখনো জানা হয়নি।

Tijarah Shop

২০০৯ 

তখন আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি। পর্দা সম্পর্কে কিভাবে কার থেকে শুনেছিলাম (সম্ভবত আম্মু): দুই হাত কবজি পর্যন্ত, পায়ের পাতা আর মুখমন্ডল ব্যতীত বাকি সব ঢেকে রাখতে হবে। ব্যস তখন থেকেই আর হাফ হাতা জামা কখনো বানাই নি। সর্বদা ফুল হাতা জামা পড়তাম আর বড় সুতি ওড়না ভাল করে মাথায় দিতাম। জীবনে খুব কমই চুল বের করে বাইরে বের হয়েছি (হাতেগোনা ২/৩ বার) (আল্লাহ মাফ করুক)। ছোট থেকে বাসায় ডিসের লাইন না থাকায় মিডিয়া জগৎ সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। তবে দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় চুপিসারে আব্বুকে না জানিয়ে ডিসের কানেকশন দেয়া হয়। তখন খুব সিরিয়াল আসক্ত হয়ে পড়ি যা পরবর্তীতে বরিশাল যাবার পর ঠিক হয়ে যায়।  নামাজ ৫ ওয়াক্ত না পড়লেও ২/৩/৪ ওয়াক্ত পড়তাম। মাঝে মধ্যে  ৫ ওয়াক্তও পড়তাম।

২০১১

আমি আবার খুব বাবা-মা ভক্ত ছিলাম, মানে তারা যা বলতো তাই অক্ষরে অক্ষরে শুনতাম। মন চাইলও তাদের বিপরীত করতাম না,  পাছে তারা কষ্ট পায়। আমার একাডেমিক পড়ালেখায় ভালো   ফলাফল ও ভালো পজিশন তারা আশা করতো। তাই মন থেকে চাইতাম তাই হোক। কিন্তু যখন এস এস সি রেজাল্ট দিলো এবং কাংখিত এ+ পেলাম না তখন আব্বু আম্মু(বিশেষ করে আব্বু) খুব কষ্ট পেলো৷ তখনই প্রতিজ্ঞা করলাম ভালো করে পড়বো। তখন থেকে হিজাব শুরু করি এবং নিজেকে নিজে খুব ধার্মিক মেয়ে মনে করতাম। অবশ্য নিকাবও শুরু করেছিলাম। কলেজে এপ্রোনের উপর সাদা স্কার্ফ দিয়ে নিকাব করতাম, অন্য সময় থ্রি পিসের উপর সিম্পলি হিজাব পড়তাম।  মহিলা কলেজ ছিলো, ক্লাসে নিকাব খুলে রাখতাম। পরিপূর্ণ পর্দা করা কোন মেয়ের সাথে আমার তখনও পরিচয় হয়নি এবং আমি তখন অব্দি জানতাম ও না যে আমার পর্দা অপরিপূর্ণ। অবশ্য নিজে থেকে আমি কখনোই জানতে চাইনি। সবই দয়াময় মহান আল্লাহর দয়া। আলহামদুলিল্লাহ।  নইলে আমার মতো একটা জ্ঞানহীন মেয়ের পক্ষে এ জানা সম্ভবও ছিলো না।

চাপ তো দূরে থাক, কেউ আমাকে  কখনো  বোরকা পড়তেই বলেনি । আর আমি নিজ থেকেও কখনও বোরকা পড়তে চাইনি ।  এর পিছনে কারন হিসেবে আমার সবসময় দুইটি ভাবনা মাথায় আসতোঃ

১. স্কুল/ কলেজে থাকতে যাদের দেখতাম বোরকা পড়ে ক্যাম্পাসে আসছে,বাইরে বের হচ্ছে ।ঠিক তাদেরকেই  আবার দেখতাম কোনো প্রোগ্রাম হলেই ভীষণ রকম সাজুগুজু করে আসতো৷ একদম বোরকা বোরকা না পড়া মেয়েটার মতোই। এই ব্যাপার টা আমাকে সবসময় ভাবাতো,কারন আমি তখনো জানতাম না পর্দা কিভাবে করতে হয় বা পর্দা কেন! তবে আরো ভাবাতো তাদের এমন দুই নীতি।কেমন একটা ছলনার মতোন  লাগতো। মানতে পারতাম না এমনটা। এই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেত, আমি নিজেকে পুরোটা সময় সবার কাছ থেকে আড়ালে রাখছি অথচ সে আমিই নিজেকে একদম মেলে ধরছি!  এমনটা কেন? কি তার উদ্দেশ্য?  ততদিনেও পর্দার ফরজিয়াত ব্যপারটা না জানায় এমন প্রশ্ন নিজের মনেই আসতো। অনুষ্ঠান শেষে আবার ভুলেও যেতাম আমি আমার মতোনই  চলতে থাকলাম। এই ব্যপারে জানারও চেষ্টা কিংবা ইচ্ছেরা অবশ্য মাঝে মাঝে হামাগুড়ি দিতোনা এমন না, তা কেবল মনের কুঠিরেই আটকে থেকে দম বন্ধ হয়ে মারা যেত।

২. ছোটবেলা থেকে আম্মু,নানী কিংবা দাদী ফুফিদেরকে পড়তে  দেখতাম  ঢিলেঢালা আলখেল্লার মতো বোরকা কিন্তু; নতুন স্টাইলের আঁটোসাটো পোষাকটাকে আমার ঠিক কখনোই বোরকা মনে হয়নি। এমন থ্রি পিছ মার্কা বোরকা বরং আমার কাছে  বেশ বিরক্তিকর লাগতো।  যদিও আমি জানতাম না পর্দার অন্যতম শর্ত যে, ঢিলেঢালা পোষাক পড়া।  এই ধরনের শরীরে লাগানো ড্রেস  আর সাধারণ থ্রি পিছে খুব একটা পার্থক্য খুঁজে পেতাম না।  ভাবতাম বোরকা, হিজাব, একই কথা। তবে এই সময়টা নিয়ে আফসোস একটাই কাউকে জিজ্ঞেস করার মতো পাইনি। আর আমিও ভাবতাম মাথায় পেচানো এক টুকরো কাপড়ই পর্দা।তাই এই ভাবনাও খুব একটা ডালপালা মেলার সুযোগ পায়নি।

২০১৩ 

ভাবতে ভাবতে হিসেব মেলানোর আগেই দিয়ে ফেললাম এইচএসসি। তারপর? তারপর আর কি সচারাচর আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে যা হয় আর কি!

আব্বুর এক কথা পাবলিকে চান্স না পেলে আর পড়াবে না৷ তাই তাদের আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে জিপিএ ৫ পেলেও, আমার আশা পরে গেল শংকায়। আমাকে যে সুযোগপেতে হবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। শংকা নিয়েই শংকিত বেশে জায়গা পেতে ব্যর্থ হলাম স্বপ্নের ঢাবিতে । বাসার সবাই হতাশ, সাথে একগাদা কথার স্রোত সমানে চলেছে। হতাশ মনেই বাবার ডানা খামচেই ববিতে (বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে)  পরীক্ষা দিতে চলে গেলাম। এরপর  ইচ্ছে ছিল রাবিতেও (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে)  পরীক্ষা দেওয়ার, তার আগেই ববিতে চান্স পেয়ে যাই  প্রিয় ইংরেজিতে। গ্রামের বাড়ি বরিশাল হওয়াতে আর আব্বুর অনেক পরিচিতজন থাকায়  আম্মুর পিড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে ভর্তি হয়ে যাই ববিতে। আলহামদুলিল্লাহ,  জানতাম না এই ববিই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। ববির ক্যাম্পাসের কটা দিনই হয়ে উঠবে  আমার সঠিক পথের দিশা।

২০১৪

নতুন বিশ্ববিদ্যালয়। আমার কাছে আরো নতুন।  এতোটা বছর বাবা-মায়ের সাথে কাটিয়েছি। এখন অচেনা এক জগতে পুরাই একা। আমরা ছিলাম ৩য় ব্যাচের।  তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাসই হয়নি। তাই হলের চিন্তাও মাথায় আনার সুযোগ ছিলো না। এইক্ষেত্রে আমার জন্য সুবিধারই ছিল বলতে হবে, কেননা হলে থাকার বিন্দুমাত্র  ইচ্ছেও ছিল না। ক্যাম্পাসের  প্রথম দিনেই  পরিচয় হলো আমার বিভাগের ফাতেমা, আইনের মিনারা, হিসাব বিজ্ঞানের রুমির সাথে। এবং সৌভাগ্যের মতোই এরা  তিনজনই আমার রুমমেট হয়ে ওঠে (আমরা একটা ৩ রুমের ফ্লাট ভাড়া নেই এবং সেখানে একেক রুমে ২ জন করে মোট ৬ জন থাকি, একসাথে রান্না করে খাই)। বাকি ২ জন, অর্থনীতির শারমিন এবং হিসাববিজ্ঞানের অন্তরা (হিন্দু)।

আমরা সবাই একই ব্যাচের হওয়ায় খুব দ্রুত আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। সবাই একসাথে অনেক মজা করতাম বিশেষ করে আমরা ৪ জন (আমি, ফাতেমা, রুমি, অন্তরা)। তবে রান্না বান্নায় আমরা যেন অথৈ সাগরে পড়লাম। সমস্যা ছিলো কেউই ভাল রান্না পারতাম না।  আমাদের সবার আব্বুরা এসে মাসে একবার বাজার করে দিয়ে যেত । বাড়িওয়ালার ফ্রিজে রাখতাম। সেই রান্না করা খাবারের কথা মনে পরলে এখনো গা শিউরে ওঠে।  প্রথম বছরের রাতগুলো ছিলো আমার জন্যে প্রচন্ড বিভীষিকাময়। সারাদিন হই হুল্লোড়ের মাঝে কাটলেও, প্রতিটা রাতই কাঁদতে কাঁদতে ঘুমাতাম। আব্বু-আম্মুকে ছাড়া থাকাটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারতাম না।

তখন শুধুমাত্র মিনারাই বোরকা পরতো । আমি হিজাব পড়তাম আর শারমিন বড় ওড়না মাথায় দিয়ে যেত। আমি আর ফাতেমা সব জায়গায় এক সাথে যেতাম। যেখানেই যাই একসাথেই যেতে হবে। তাই  অনেকেই আমাদের বিভিন্ন নাম দিত, মানিক জোড়, জমজ ইত্যাদি। অনেক জায়গায় দুই বোনও বলতো। ফাতেমার ইসলামের প্রতি আগ্রহ ছিল অনেক। ঐখানেও আমি ২/৩ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার চেষ্টা করতাম।  সারাদিন ফেসবুক, চ্যাটিং নিয়ে পড়ে থাকতাম। মাঝেমধ্যে গান, মুভি দেখা হতো।হাসি ঠাট্টার মাঝেই কাটছিলো দিন। পড়াশুনা করে কিছু একটা হব, এমন চিন্তা মাথায় বয়ে বেড়াবার সাথে হাসি ঠাট্টার মাঝেই কাটছিলো দিনগুলো।

ফেসবুকে পোস্টিং, চ্যাটিংয়ের মাঝে একটাই ভালো কাজ করতাম! ইসলামি যত পেইজ আছে তাতে লাইক দিতাম, বিভিন্ন গ্রুপে একটিভ থাকতাম, পোস্ট পড়তাম। বিশেষ করে নসীহাহ (সিস্টার্স অনলি), নারীদের আমল ঘর(জুমানা আপুর গ্রুপ), বিবাহ একটি উত্তম ইবাদাত, বেক্রুন.কম, হুজুর হয়ে ইত্যাদি তে নিয়মিত একটিভ ছিলাম।  এই গ্রুপ গুলোর পোস্ট নিয়মিত পড়তে পড়তেই প্রথম জানতে পারলাম  পর্দার প্রধান শর্তগুলোঃ

১. ঢোলাঢালা হতে হবে

২. পুরু হতে হবে যাতে ভিতরের পোশাক দেখা না যায়

৩.অনাকার্ষণীয় হতে হবে

৪.অমুসলিমদের মতো হওয়া যাবেনা

৫. সমস্ত শরীর ঢাকতে হবে

৬.পুরুষের মতো হওয়া যাবেনা।

 

এদের মাধ্যমেই ধারন করতে শিখি পর্দার গুরুত্ব, পর্দার উদ্দেশ্য।

এরপর নিজেকে সেভাবেই পরিবর্তন করতে সচেষ্ট হলাম। আসলে এই পর্দার মাধ্যমেই আমার হেদায়াতের পথে চলা শুরু, আলহামদুলিল্লাহ। এখনো সেই পথের একজন প্রাথমিক পর্যায়ের ছাত্রী মাত্র।

২০১৪ এর মাঝামাঝি সময়ে অনুভব করতে শুরু করলাম বোরকা পড়ার প্রয়োজনীয়তা। অনুভবের সাথে বোধও জাগ্রত হওয়ায় খুব দ্রুতই বোরকা পড়া শুরু করি। তবে এখানে নিজেকে পুরোপুরিভাবে শুভঙ্করের ফাঁকি থেকে মুক্ত করতে পারিনি, কারন ক্লাসে বোরকা  পড়তাম না।

আমাদের সময়ই ছিল শেষবারের মতোন ঢাবিতে ২য় বার এডমিশন টেস্ট দেয়ার সুযোগ। আমি ববিতে ক্লাস করে যাওয়ার পাশাপাশি ২য় বার এডমিশন টেস্ট দেওয়ার প্রস্তুতিও চালিয়ে যেতে থাকি।চান্সও পেয়ে যাই, তবে সাব্জেক্ট পাই উর্দু। তাই বাড়িতে  থেকে পড়াশোনা করার ইচ্ছেটা ইচ্ছেতেই আটকে থাকে। আলহামদুলিল্লাহ,  এতেই যে আল্লাহ কল্যাণ রেখেছেন তা কে জানতো.? এটাই যে ছিলো মহান রবের মহান পরিকল্পনা, এখন বুঝতে পারছি।

২০১৫ 

ফাতেমার সাথে ইসলাম, পর্দা নিয়ে রোজই কথা হতো। অন্তরা আর রুমি দুজনেই যখন বাসা শিফট করে তারপর থেকেই মূলত আমাদের (আমি আর ফাতেমা)  প্রত্যাবর্তনের শুরু। আমাদের দুজনেরই সত্যকে মেনে নিতে কখনোই আপত্তি থাকতোনা। এরপর আমি  ক্লাসে গেলেও বোরকা + নিকাব পড়ে যেতাম তবে ক্লাসে মুখ খুলে রাখতাম। ফাতেমাও ততদিনে হিজাব শুরু করে দিয়েছে তার কিছুদিন পর ও বোরকাও পড়া শুরু করেছে।

২০১৫ এর মাঝমাঝি সময়ে,একদিন ফাতেমা কে বললাম আমাদের তো ক্লাসেও নিকাব পড়ে থাকা উচিৎ যেহেতু নিকাব পর্দার অন্যতম অংশ (মুখমন্ডল ঢেকে রাখাই অধিকতর উত্তম)। ও বল্লো, হ্যা চল, ঢেকে রাখা শুরু করি। আমি বললাম, একবার ঢাকলে তো আর খুলে রাখতো পারবোনা, কষ্ট হবে মনে হয়। ও বল্লো তবুও চেষ্টা করবো হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। এইভাবেই তখন থেকে নিকাব দিয়ে মুখ ঢেকে চলার শুরু। সারাক্ষণ মুখ ঢেকে ক্লাস করে বাসায় এসে মাথা ব্যাথায় অস্থির হয়ে যেতাম। এই অবস্থায় বারবার নিজকে বুঝাতাম, এই কষ্ট সাওয়াবের খাতা পূর্ণ করে চলেছে নিশ্চয়ই ইনশাআল্লাহ।  বের হলে প্রচন্ড গরম,ঘামে চুপচুপে হয়ে যাওয়া, মাঝে মাঝে অনেক কষ্ট দিলেও   আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাই। তখনো পুরোপুরি গান,সিনেমা বন্ধ করতে না পারলেও আস্তেধীরে কমিয়ে দিচ্ছিলাম এবং আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর সাহায্যে বেশ অল্প সময়েই গান, মুভি, টিভি দেখা একদম বাদ দিতে পেরেছিলাম।

পর্দায় আসার পর এবার আল্লাহর দেয়া পরীক্ষা শুরু। সামনে আসতে থাকলো একের পর এক বাঁধা। ক্লাস কিংবা পরীক্ষায় শুরুতে তেমন কোন সমস্যা হয়নি তবে ২০১৭ থেকে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে শুরু করি। ক্লাসে নিকাব করলে   মাঝে মাঝেই স্যার-ম্যাডামরা  কটাক্ষ করে যেত। এইভাবে ঢেকে রাখলে চিনবো কি করে,এই ক্লাসের কি না, অন্যের হয়ে ক্লাস করছো কিনা বুঝবো কি করে?  এমন সব ঝাঝালো শ্লেষ চলতো প্রায়ই। আর যখন প্রেজেন্টেশনের সময় আসতো একেবারে ভয়ে চুপসে যেতাম। কখন তাদের রোষানলে পরতে হয়,কখন না জানি ক্লাস থেকে বের হতেই বলে। কারন স্যার-ম্যামেরা প্রায়ই বলতেন এত সংকুচিত মন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কি দরকার ছিলো? মাদ্রাসায় গেলেই পারতে! মন বড় কর।  নিয়মিত তাদের কথা শুনানো চলছিলোই, কি ক্লাসে, কি প্রেজেন্টেশনে, কি এক্সামে। সবখানেই  চুপচাপ শুনতাম, কিছু বলতাম না যদিও অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করতো। তবে বেশিটা সময়ই অনেক স্যারেরা হেল্প করেছে পর্দা করতে, তারা সাপোর্ট করতো আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু; আমাদের প্রচলিত সামাজিকতা,ক্ষমতা,চাটুকারিতার জয়জয়কার নিয়ে অল্প দুই একজনের সামনে পুরো ডিপার্টমেন্টই নীরব থাকতো।  তাই পক্ষে বেশিরভাগের অবস্থান সত্ত্বেও, ন্যায় কোনঠাসা হয়ে থাকতো।

বাসা থেকে অনেক  দূরে ছিলাম,সুযোগ ছিলো বখে যাওয়ার। আল্লাহ রহম করেছেন,সামনে সত্যটা শুধু প্রকাশই করেননি, সেই পথে, আলহামদুলিল্লাহ তাড়িয়ে নিয়েছেন। এর শুকুর আদায় করা পুরোপুরিভাবে কোনভাবেই সম্ভব না। পুরোপুরিভাবে পর্দায় আসতে শুরু করেছি বাসায় প্রথমে জানতোনা। আর বাসায় জানানোর সময় বলছিলো, এতো সুফী সাজার দরকার নাই, যেটুকু করতেছিলা তাই তো যথেষ্ট ছিলো। তাই পর্দার ব্যপারে কোনো সমস্যায় আমি কাউকেই সাপোর্টার হিসেবে পেতাম না, বাসার কাউকেও না। এই সময়টায় একমাত্র ফাতেমাই সব অবস্থায় সমর্থন দিয়ে গিয়েছে। পরে অবশ্য রেজাল্ট ভালো হওয়ায় বাসা থেকে পর্দা নিয়ে ভালোই সহযোগিতা পেয়েছি,আলহামদুলিল্লাহ।

একদিন একজন শ্রদ্ধেয় স্যার প্রেজেন্টেশন নিতে আসলেন। বলে রাখা ভাল, আমাদের ক্লাসে মোট ৫ জন নিকাব করি, সবার আগে আমার রোল তাই আমার সিরিয়াল আগে। তো ওরা সবাই আমাকে বল্লো, তুই কিন্তু সবার আগে, তোর উপর সবকিছু, তুই মুখ খুললে কিন্তু আমাদের ও খুলতে হবে। বললাম দরকার হলে প্রেজেন্টেশন দিবনা, তাও মুখ  খুলবো না। ভয়ে ভয়ে গেলাম সামনে, তারপর স্যার বল্লো, মুখ ঢেকে রাখার কি দরকার বুঝলাম না? এইখানে কি বাইরের কেউ আছে? এই খানে যারা তারা সবাই তোমার ক্লাসমেট। আর আমি তোমার সম্মানিত টিচার। আর আমরা তোমার সম্মানিত স্যার, বাবার মতোন। আর এইভাবে ঢেকে রাখা একপ্রকার ধর্মীয় গোড়ামি। This is too much extremism! ইসলাম কি তোমাকে বলেছে এভাবে প্রাচীন যুগের মতোন করে আবদ্ধ থাকতে?? আমিও তো একজন মুসলিম, সালাত পড়ি, কোরআন পড়ি। এটুকুই কি যথেষ্ট না??

আমি সম্মান দিয়ে শুধু এতটুকুই বললাম, স্যার! তারা কেউ আমার মাহরাম না।  যদিও মনে মনে অনেক প্লান ছিল পর্দার ব্যপারে স্যারকে অন্তত এইটুকু বলার যে,  স্যার! আমরা মুসলমান হিসেবে ইমান আনি, সালাত পড়ি, সাওমের মাসে সাওম পালন করি,সামর্থবানরা যাকাত আদায় করি এবং হাজ্জ্ব পালন করে থাকি। এই ইবাদত যেমন অবশ্য পালনীয় (ফরজ) ঠিক তেমনিভাবে পর্দাও অবশ্য পালনীয়।  তবে এখানে অন্য ইবাদতের সাথে পর্দার পার্থক্য হচ্ছে, সালাত, সাওম,যাকাত,হাজ্জ্বের নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকলেও পর্দা সবসময় পালন করতে হয়। এমন কিছু একটা যে ঘটবে তা কিছুটা আচ করতে পেরেছিলাম। তাই প্রস্তুতি স্বরূপ  পর্দা সংক্রান্ত দুইটি আয়াত এর অর্থ মুখস্ত করে যাই।

১. ‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী গনকে, কন্যাগনকে ও মুমিনদের নারীগনকে বলুন,তারা যেন তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের উপর টেনে দেয় (যখন তারা বাড়ির বাইরে যায়)। এতে করে তাদের চিনতে সহজ হবে।ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ‘ সূরা আহযাবঃ ৫৯।

এবং ২. ‘ হে নবী! বিশ্বাসী  নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে, লজ্জাস্থান রক্ষা করে।তারা যা সাধারণত প্রকাশমান, তা ব্যতীত তাদের সৌন্দর্য্য যেন প্রদর্শন না করে,তারা তাদের বক্ষস্থল কাপড় দ্বারা আবৃত রাখে…..।’ সূরা নূরঃ৩১।

আর স্যার আপনি অবশ্যই বাবার মতোন কিন্তু; বাবা নন।  তাই আপনার সামনেও আমাকে অবশ্যই পর্দা রক্ষা করতেই হবে। এমনই আরো অনেক কিছুই ভাবছিলাম বলি। মাথায় ঝড় উঠলেও কিছুই মুখ দিয়ে বের হচ্ছিলনা।যেন বোবা হয়ে গিয়েছি ঐটুকু বলার পরে। এর পিছনে কারন ছিলো আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান তা-ই  আমাকে দ্বিধাগ্রস্ত ভাবেই দাঁড়িয়ে রাখে।  যাই হোক তারপর বাকি ৪ জনকেও দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করে, কেন এমন করি আমরা?  ওরা চুপচাপ। পুরো ক্লাসের সবাইকে জিজ্ঞেস করে, সবাই বলে থাক স্যার ওরা এভাবেই দিক। এরপর স্যার বল্লো তাহলে তোমাদের প্রাপ্ত মার্ক ২ নাম্বার  থেকে কেটে নেওয়া হবে (মনে কষ্ট পেলেও মেনে নিলাম কারণ আল্লাহর সন্তুষ্টির কাছে সব তুচ্ছ আর আমার কাছে এটা আল্লাহর তরফ থেকে একটা ছোট্ট পরীক্ষা মনে হচ্ছিল আর মন বারবার বলছিলো এই পরীক্ষায় আমাকে পাশ করতেই হবে)। যদিও আমি অনেকটা নিশ্চিত ছিলাম স্যার এইটা বলেছে কিন্তু স্যার মার্ক কাটবেন না এবং পরে তাই হয়েছিলো।

৪র্থ সেমিস্টার পরীক্ষা চলছে,খুব সম্ভবত এপ্রিল মাসে, ২০১৭সাল। ২ টা কোর্সের পরীক্ষা দিয়েছি, ৩য় কোর্সের পরীক্ষা চলছে।  প্রশ্ন হাতে পেলাম। আলহামদুলিল্লাহ, দেখছি সব কটা প্রশ্নই কমন এসেছে, লিখছি, প্রায় অর্ধেক লেখা সম্পন্ন হয়েছে। এমন সময় একটা অস্পষ্ট কথা কানে এলো, যারা মুখ ঢেকে পরীক্ষা দেবে তাদের খাতা নিয়ে নেওয়া হবে।  আমি পরীক্ষা হলের মাঝখানে থাকায় আর লেখায় মনোযোগী থাকায় স্পষ্ট শুনতে পাইনি। হঠাৎ ঘোষণার ৫ মিনিট পর শ্রদ্ধেয় ম্যাম এসে বলেন খাতা দেও, আমি কি হলো না হলো কিছুই বুঝলাম না। আবার চাইলো, দিয়ে দিলাম। এবার সব স্পষ্ট লাগলো, বুঝতে পারলাম আমার সাথে কি হচ্ছে । আমি ভেবেছি শুধু আমিই মনে হয় মুখ খুলিনি তাই খাতা নিয়ে গেছে (পরে শুনলাম মোট ৩ জনের খাতা নিয়েছে, বাকি দুজন ভয়ে নিকাব খুলে ফেলেছে)। তারপর আর কি? আমার হাত পা কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছে। ভাবতে লাগলাম কি করবো? অনেকটা নিশ্চিত হয়ে ভাবলাম চলেই যাই পরীক্ষা দেবোনা। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, আমি পরীক্ষা না দিয়ে চলে গেলে বাসায় খুব ঝামেলা হবে, অনেক কথা শুনতে হবে। মাথায় ভাবনার ঝড় বয়ে যেতে লাগলো। চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে উঠেছে। আমি একটা মুসলিম প্রধান দেশে বাস করেও ইসলামের বিধান ঠিকভাবে মানার জন্যে কথা শুনতে হবে, নিজের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হবে। এমনটা না যে, আমি অপরাধ করছি, এইসব ভেবে প্রচন্ড কান্না পাচ্ছিলো। আমি চাইলেও এই পর্যায়ে এসে পড়াশোনা ছাড়তে পারবোনা। আর এবার পরীক্ষা না দিলেও জুনিয়র দের সাথে পরীক্ষা দিতে হবে, তখন তো সেই  একই ঝামেলা। মনের সাথে যুদ্ধ চলছিলো, সামনে আসছিলো একেক রকমের যুক্তি। এভাবেই কখন যে  ২০ মিনিট পার করে ফেললাম বুঝতেই পারিনি। একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, যাই হোক বের হয়েই যাব। কিন্তু; তার আগে একবার ম্যামকে বললাম ম্যাম! খাতা টা?  ম্যাম বল্লো এদিক আসো। আমি গেলাম সামনে দেখি ফাতেমাও আসছে তখন বুঝলাম ফাতেমার খাতাও নিয়েছে। তারপর স্যার ম্যামরা মিলে বুঝালেন সেই আগের কথাই, সাথে জুড়লেন –  নিকাব পড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মের বাইরে, নিয়ম ভাংগলে তো পরীক্ষা দিতে দিবোনা বাবা।  বল্লো মুখ ঢেকে পরীক্ষা দেয়া যাবেনা। তখনো ভাবলাম বের হয়ে যাই। কিন্তু ; বাসার কথা ভেবে বাধ্য হয়ে বললাম সিটে বসে মুখ খুলবো। গেলাম সিটে বসে নিকাব থুতনী পর্যন্ত খুলে বাম হাত দিয়ে মুখ যতোটা পারা যায় ঢেকে ডান হাত দিয়ে লিখতে লাগলাম। যদিও এক হাতে পরীক্ষা দিতে অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে নিকাব লাগিয়ে রাখতাম। আবার টিচার দেখলে খুলে হাত দিয়ে ঢেকে রাখতাম৷ পরীক্ষার চেয়ে টেনশন কাজ করতো বেশি। সেদিন পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে এতো কান্না আসছিলো। না কেউ ছিল না আমার এ কষ্ট শুনার, না কেউ ছিলোনা সান্ত্বনা দেয়ার৷ আর খুব বেশি কষ্ট হচ্ছিল এই ভেবে যে আমি পারলাম না আল্লাহর হুকুম পালন করতে, দুনিয়াবি কারণে আমি আল্লাহর হুকুম অমান্য করলাম। এই ক্ষত এখনো সেরে উঠেনি, মনে পড়ল ঠিক সেদিনের মতোই কষ্ট লাগে।আলহামদুলিল্লাহ, তবুও অই কোর্সে কাঙ্ক্ষিত ৩.৫০ পাই৷

এরপর আলহামদুলিল্লাহ বাকি পরীক্ষায় আর তেমন কোন সমস্যাই হয়নি। স্যার, ম্যামরা তেমন কিছুই আর বলতোনা। যদিও পরীক্ষার পুরোটা সময় ভয়ে ভয়ে থাকতাম।নানা মানুষের নানা কথার বানে জর্জরিত হতাম। পাত্তা দিতাম না। মনকে প্রবোদ দিতাম সব কিছুই আল্লাহর জন্য, বাকী সব তুচ্ছ।

আলহামদুলিল্লাহ বাসায় সবাই জেনেছে আমার পর্দার কথা তবে বাধা তেমন দেয়নি। কিন্তু মাঝে মধ্যে টুকটাক বলতো তবে তা মানিয়ে নেয়ার মতো। আস্তে আস্তে নন মাহরামের সামনেও নিকাব কিরা শুরু করলাম। ভয়ে ছিলাম বাসায় কি বলবে কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে সবাই ব্যাপার টা  মেনে নিয়েছে এবং নন মাহরাম কেউ আসলেই আব্বু আম্মু, বোন সবাই আগেও সাবধান করে দিতো এবং পর্দা করতে সাপোর্ট করতো।

২০১৮

বিয়ের সময় পর্দা করাটা একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। পরিবারের লোকেরা বুঝবে বা তাদের বুঝানো যায় কিন্তু সব আত্মীয়রা তো আর বুঝবে না। তেমনিভাবে শ্বশুরবাড়ির পরিবার বুঝবে, সকল আত্মীয়রা তো বুঝবেনা।

বিয়ের আগে হলুদ করতে নিষেধ করেছি কিন্তু লাভ হয়নি আটকাতে পারিনি। তবে অনেক যুদ্ধের পরে এইটুকু রাজী করাতে পেরেছিলা। হলুদ + বিয়েতে কোন নন- মাহরাম পুরুষ আসতে পারবেনা, ছবি তোলা যাবেনা, আমি পার্লারে যাবনা।

ছবি কেন তুলবো না সেই প্রসঙ্গে প্রথমে নানীকে বুঝিয়েছি,  দেখেন নানু, ছবি দিয়ে আজকাল কতো খারাপ কিছু করা যায়, আপনি তো বুঝেন আম্মুকে বলেন যাতে কাউকে ছবি তুলতে না দেয়৷ নানীকে অনেকক্ষন ছবির অপব্যবহারের নানাদিক বুঝানোর পরে কাজ হয়। বাসার সবাইকে নানী টোপ  দিয়ে আব্বু-আম্মু, ভাইয়া আর  বোনকে রাজি করাই। কিন্তু;   এরপর  হলুদের জন্য  আমাকে স্টেজে বসতে বলেছে সেখানেও যুদ্ধ করতে হয়েছে সবার সাথে। সবার এক কথা একদিনই তো,কি আর এমন হবে। আমার এক কথা আমি  রুমেই থাকবো। কেউ ছবি তুলতে পারবেনা৷ এই নিয়ে অনেক আত্মীয় স্বজন রাগ করেছে। বড় মামী তো আমার সামনে রাগ করে ফোন টা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, ”বলছে তাইলে ফোন কিনলাম কিসের জন্যে? যদি ছবিই না তুলতে পারি ”।এর জবাব অবশ্য বড় খালা দিয়ে দিয়েছে বলেছে ” তুমি কি ওর বিয়ে না হলে ফোন কিনতেনা?ওর বিয়ের ছবি তোলার জন্যেই কি ফোন কিনেছো? কেনোনি। ” অতঃপর মামী মুখ কালা করে বলছে আমার মণির বিয়ের ছবি এখনো আছে ফোনে, এইটা তো স্মৃতি৷ আমি কিছু বলিনি উপেক্ষা করে গেছি। গান বাজনা স্বভাবতই হয়নি যেহেতু আমার আব্বু গান বাজনার ঘোর বিরোধী  এবং টিভি তার খুব অপছন্দনীয়।  তবুও আব্বুকে বললাম গান বাজনা যেন তাহমিনা (বোন), ভাইয়া ফোনেও না চালায়। আব্বু বলে চালাবেনা৷ নানী পক্ষের লোকজন নামমাত্র মুসলিম। তারা বলছে, গান ছাড়া বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি মনে হয়না, ছবি তুলতে দেয়না, মেয়ে ছেলে আলাদা, এ কেমন বিয়ে? এমন বিয়ে তো তারা দেখেই নি। তাদের ভাষায় এ এক অদ্ভুত বিয়ে। আগে জানলে আসতোই না ভাবটা এমন।  আলহামদুলিল্লাহ, এই পর্যন্ত মহান রবের সাহায্যে পর্দার পুরোটা ঠিক রাখতে পেরেছি।

বৃহস্পতিবার রাতে এশার নামাজ পরে নিজে সেজে রুমে বসলাম, ভাই-বোন মিলে  রুম সাজালো। এই পর্যায়ে এসে আমার কার্যকলাপে প্রচন্ড রেগে থাকা বোন  অনেক হেল্প করলো,আল্লাহ আরো সহজ করে দিলেন হলুদের ( এই হলুদের জন্য আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন!) পর্বটা (আল্লাহ ওকে হেদায়েতের পথে কবুল করে নিক)। কাউকে ছবি  উঠাতে  দিতোনা, রুমে পুরুষ আসতে দিতোনা। ১.৩০ ঘন্টায় অনুষ্ঠান শেষ।

বরের বাড়িতে হলুদ হয়নি, বর স্পষ্ট ভাষায় না করেছে, এতে অনেক আত্মীয় র মন খারাপ হয়েছে(!)।

বিয়ের দিন

দুপুরের সালাত পড়ে বোন আমাকে সাজাতে শুরু করে দিলো কিন্তু পরক্ষণেই শুনতে পেলো বর এসে গেছে তাই বাধ্য হয়ে নিজে নিজেই সাজলাম। সাজার আগেই পাশের বাসার ভাবী, আপুরা রুমে এসে হাজির। খুব লজ্জা করছিলো সবার সামনে সাজতে। এইদিকে আবার খেয়ালও রাখতে হচ্ছিলো  যাতে কেউ ছবি উঠাতে না পারে। সেজন্য খুব সতর্ক ছিলাম, এমনকি একজন ছবি উঠাতে আসলে প্রচন্ড রাগ করে  বসলাম। যার কারণে অনেকেই আড়ালে আমাকে বেহায়া ভাবতে লাগলো, বলতেও লাগলো। কেউ বলতে লাগলো আমরা তো পুরুষ না, আমাদের তুলতে দাও!! তাদের চোখে আমি এক আজব নতুন বিয়ের কনে  যে,  পটর পটর কথা বলে, নিজে নিজে সাজে, লাজ লজ্জার বালাই নেই। তবে কাউকে পাত্তা না দেয়া আমার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হওয়ায় তেমন কোন সমস্যা হয়নি। বরপক্ষ থেকে পুরুষরা রুমে আসতে চাইলে ভাইয়া বাধা দিয়েছিলো, পরে শুনেছিলাম। উনি বলেছেন, আমি তো বর উনাদের তো আবার বলতে পারিনা তোমার ভাইয়া না করেছে খুব ভাল হয়েছে। এইভাবে যখন বিদায়ের সময় হয়েছে তখন শাড়ির উপরে জিলবাব পড়ে রওয়ানা দিয়েছি৷

শ্বশুর বাড়িতে এসে আবার একই সমস্যা যদিও উনি হাজার বার বলে দিয়েছে আমার পর্দার কথা, তবে কে শুনে কার কথা। সবাই নতুন বউ দেখবে। আমিও বড় করে ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিয়ে রইলাম যাতে নন মাহরাম কেউ না দেখতে পারে।বড় ফুফু শ্বাশুড়ি রাগ করে রইলেন কারণ ফুফা শ্বশুর আমাকে দেখতে পারেনি তাই। পরে শ্বশুর বুঝিয়ে বললেন আপনার সাথে দেখা দেয়া জায়েজ নাই। এইভাবে অনেকে অনেক কথা বলে, বউ না দেখার কষ্ট পেয়ে চলে গেলো। আর এই কষ্ট দেয়াটা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তাই এ নিয়ে একটুও ভাবছি না।

বিয়ের আগে যখন মাহরাম, নন মাহরাম জ্ঞান ছিল না, তখন একটা পোষ্ট পড়েছিলাম যেখানে বউটা বাসায় দেবর থাকার কারণে বোরকা পড়ে রুম থেকে বের হয়েছিলো যাতে তার পর্দা ঠিক থাকে৷ এই পোস্ট পড়ার পর নিজের কাছে পর্দার বাড়াবাড়িই মনে হয়েছিল এবং কখনো ভাবিনি আমিই একদিন ঠিক এই কাজটিই করবো।

আলহামদুলিল্লাহ, বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির সবাই আমাকে পর্দা করতে সাহায্য করছে, বিশেষ করে আমার স্বামী। আমার দেবর বাসায় থাকলে, উনিই(স্বামী) আমাকে খাবারসহ প্রয়োজনীয়  সব কিছু আমার রুমে  নিয়ে এসেছে। এছাড়াও আমার দেবর ও কখনো আমার সামনে আসেনা। ড্রইং,  ডায়নিং রুমে থাকলে আওয়াজ করে আসে। প্রয়োজন হলে আড়াল থেকে বলে। শ্বশুর-শ্বাশুড়িও অনেক সাহায্য করেন,আলহামদুলিল্লাহ।

অবশেষ বলতে চাই, আমি দ্বীনের পথে এসেছি প্রায় ৫ বছর হতে চললো  তবে দ্বীনের ব্যাপারে আমি তেমন কিছুই জানিনা বলতে গেলে আমার অগ্রগতি পিপড়ার চলাচলের চেয়েও মন্থর। এর কারণ ২ টিঃ

১. আমি অনলাইনে মাধ্যমে নিজে নিজেই হিদায়ার খুঁজে বেড়াচ্ছি, আল্লাহর ইচ্ছেয় এগুচ্ছিও। বাস্তবে হাই লেভেলের প্রাক্টিসিং মুসলিমা বোনদের সাহায্য পাইনি, যাদের দেখে বাস্তবে আমি শিখবো।

২. আমি অত্যন্ত একজন ইন্ট্রোভার্ট মেয়ে, সহজে কারো সাথে মিশতে পারিনা৷ আমি মিশতে চাই কিন্তু পারিনা৷ এর কারণে কোন দ্বীনি বোনকে খুঁজে তার কাছ থেকে শিখতে পারিনি।

আমার আলোর পথে চলার পথ ৫ বছর হলেও আমি হিদায়াতের রাস্তায় এখনো নতুনদের মতো, এখনো অনেক কিছু জানার বাকি, সবাই আমার জন্য দুয়া করবেন। ও হ্যাঁ, আমার একটা উমার আছে ২০২০ এর প্রথম মাসেই আল্লাহ আমানত হিসেবে দান করেছেন।  ওর জন্যও দুয়া করবেন যাতে সে উমার(রা) এর মতো হতে পারে!

ইসরাত জাহান মুনিরা

ইংরেজি বিভাগ,বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

Facebook Comments

Related posts

নীড়ে ফেরার গল্প-৫০ | আমাতুল্লাহ

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-৩৯ | লাবণ্য

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-৪৯ । নোমান আব্দুল্লাহ

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: