সংকলন
শ্বেত বামন
প্রতিযোগিতা-২

নীড়ে ফেরার গল্প-৪৪ | শ্বেত বামন

আমায় যদি প্রশ্ন করো, জীবনের সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি টা কি?

অকপটে আমি উত্তর দেব, “আমার বাবার মৃত্যু! ”

বাবা মারা গেছে আজ দুই বছর।কোন সন্তান তার বাবার মৃত্যুতে খুশি হতে পারে কি? তবে আমি বেজায় খুশি।

আজ থেকে যদি দুূ’দশক পিছনে ফিরে দেখানো যায়,তাহলে দেখবে,আমি তখন ছোট্ট! খুবই ছোট্ট! একেবারে হাতের ফাঁক দিয়ে গলে পরার মতোন ছোট্ট! আম্মো বলত কুতকুতে চোখে তাকিয়ে থাকতাম।তো বিশ বছর আগের আমার সেই কুতকুতে চোখ দিয়ে আজকের আমায় তাকিয়ে দেখো।না!  না! আমায় নয়,এই মাঝের সময়গুলোতে তাকিয়ে দেখো!কি দেখলে? অবাধ্যতা,অবৈধতা,অরাজকতা,এসবই তাইনা?হ্যা আসলেই তাই। সব বেখাপ্পা, বিশৃঙ্খল, ফাঁপা!

Tijarah Shop

ঘটনার শুরু বোধহয় সেদিন থেকেই যেদিন বিকালে আমি রেডি হচ্ছিলাম সরবের সাথে ঘুরতে যাব বলে।সরব কে জানো না?সরব ছিল আমার প্রেমিক।এখন অবশ্য প্রাক্তন। আয়নার সামনে দাড়িয়ে ভাবছিলাম, কি রংয়ের লিপস্টিক লাগাব?রেড অর পিংক?

এরই মধ্যে অচেনা নাম্বার থেকে কল আসল,জানাল আব্বু বাইক এক্সিডেন্ট করেছেন। দিকবিদিকশুন্য হয়ে ছুটতে লাগলাম। ছোটচাচ্চু,আম্মো আর খালাতো ভাইকে নিয়ে বের হয়ে গেলাম।ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে পারি বাইক এক্সিডেন্ট করে নি,বরং বাইক থামিয়ে যখন চা খাচ্ছিল তখন হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। নিয়ে ছুটলাম হাসপাতালে। রাতের বেলা খবর আসল দাদু মারা গেছেন। ইন্না-লিল্লাহ! অসুস্থ আব্বু,আর মারা গেল দাদু! দিনদশেক পরে দাদুর কবরের পাশে আরো একটা কবর খোড়া হল। আব্বু ও চলে গেলেন দাদুর কাছে। ।পাশাপাশি দুটো নতুন কবর!

স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম,

প্রবল শুন্যতা গ্রাস করছে যেন,

তবু ও কিছু ভালো লাগে না।কেমন শুন্য শুন্য মনে হয়।

আব্বুকে খুব মনে পরে।কেমন আছে সে?

ওপারে কি ভালো আছে?

ভালো থাকা কি খুব সহজ?

তাহলে আমি কেন ভালো থাকি না?

ইদানীং সরব ও খুব ব্যস্ত হয়ে গেছে।তবে তাতে অখুশি ছিলাম না। ওকে ও খুব অসহ্য লাগত!

“মনা,একটু আমার কাছে আসবি মা?একটু কাছে আয় না ”

এতো আব্বুর গলা!

আব্বুই তো তাকে আদর করে মনা বলে ডাকত!

 

বসার ঘরের দরজা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দিল শ্যামলা একটা মেয়ে। হ্যা,আব্বু বসে আছেন টুলের উপর।খালি গায়ে পরনে একটা লুঙ্গি। তীব্র গরমে আব্বু বাজার থেকে আাসার পর গরমে গায়ের জামা খুলে রান্নাঘরে টুল নিয়ে আম্মোর পাশে যেমন বসে থাকতো, তেমনিভাবে বসে আছেন।কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে গেলো মেয়েটা।

“তুমি বেঁচে আছো আব্বু? ওরা যে বলে তুমি মরে গেছো?”

তার আব্বু জবাব দিলেন না শুধু একটু হাসলেন।

“তোমার হাতটা ধরি আব্বু? একটু ছুই?”___কান্নার দমকে কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল।

জবাব না দিয়ে নিঃশব্দে হাসিমুখে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন রহমান সাহেব।

সেই মেয়েটি হাতটা ধরে কি যে কাদলো!

অনেকক্ষন কাদলো!

কতটা সময় গড়ালো সে জানে না।

 

” তুমি কি আবারও চলে যাবে আব্বু?” ___কোনরকমে গলা দিয়ে স্বর বেরোলো তার।

এবারও জবাব এলো না।চোখের পানি মুছে সামনে তাকায় মেয়েটি।

আব্বু কই?

কেউ নেই এখানে।কেউ না।

সে একাই….

.

.

.

 

দপ করে চোখ মেললাম!

স্বপ্ন!

এটা স্বপ্ন ছিলো?

টপটপ করে ঘামতে লাগলাম।

স্বপ্ন এতো অনুভূতিপূর্ণ কিভাবে হয়!মেয়েটা ছিলাম আমি।

তার তো স্পষ্ট মনে আছে সে তার বাবার হাত ধরে বসে ছিল।

স্বপ্নের কথা মনে পরে ।হাসিমুখে আব্বু  সামনে বসে ছিল।হাসিটা কেমন কাঠ কাঠ ছিল।যেন কত কষ্ট তার আড়ালে!

সারাদিন স্বপ্নের কথা মথায় ঘুরতে লাগল।

.

“★রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,

তিন ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম।

১.মদ প্রস্তুতকারক

২.পিতা মাতার অবাধ্য সন্তান

৩.দাইয়ূস [যার পরিবারের মহিলাগন বেপর্দায় চলে]

মুসনাদে আহমাদ,৫৮৩৯”

 

ফেসবুক স্ক্রোলিং এর সময় পোস্টটাতে চোখ পরে হঠাৎই ।পরক্ষণেই তাকাই ফোনের স্ক্রিনে আমার প্রোফাইলের হাসিমাখা ছবির্টির দিকে।নিজের ছবি ফেসবুকে দিয়েছিলাম,সবাই-ই তো দেয়।হিজাবের বালাই নেই,খোলা চুলে কি সুন্দর আমার মুখখানা!নিজেই নিজের উপর ক্রাশ খাই!মুহূর্তে বিজলি খেলে যায় শরীরে।এই কি তবে কারন?এর জন্যই কি আব্বু ভালো নেই? তার হাসিটা ওমন কাঠ কাঠ!

আমার বেপর্দাই কি আব্বুর কষ্টের কারন।

বুকটা কেপে ওঠে !

আব্বু যে আমার কি!

অথচ তাকেই এতো কষ্ট দিচ্ছি!

আরো ডিটেইলস জানার জন্য ইসলামিক কিছু বই কিনলাম।বিস্ময়ে সপ্তম আকাশে ওঠার অবস্থা আমার।আরো বই কিনলাম,আরো।এবার তো বুঝতে পারি,।হ্যা ভালোভাবেই সব বুঝতে পারি!

শুরু হয় আমার লড়াই। নিজের সাথে নিজের,প্রত্যকের সাথে নিজের।এ যুদ্ধে আমিই প্রতিপক্ষ। আমিই সৈনিক। আমিই শত্রু।আমিই যোদ্ধা। আমি ই ঢাল, আমিই তরবারি। আঘাত আমিই করি।এ যুদ্ধের আরাম নেই।বিরাম নেই।শুধুই যুদ্ধ! যুদ্ধ! আর যুদ্ধ!

চারিদিকে তলোয়ারের ঝনঝনানি!

প্রথম যুদ্ধটা শুরু হয় সরবের বিরুদ্ধে। রিলেশন রাখা হারাম _তা আমি জানি।তো কেন রাখব এমন সম্পর্ক?রাখলাম না।টুপ করে ব্রেকআপ করে দিলাম। কয়েক বছরের সম্পর্ক আমাদের, সরব মানবে কেন?নাহ! সে মানে নি।কতো বুঝালো,  কিন্তু বুঝলাম না আমি।রাতের পর রাত বাসার সামনে দাড়িয়ে কাটাল।বাইরে ও কাঁদে আর ঘরের ভিতর আমি।খুব কষ্ট হচ্ছিল ওকে ছাড়া। এখনো আমি কাঁদি। তবে ওর জন্য নয়,রব্বের জন্য!তাঁর প্রেম গ্রহণ করিনি সেইজন্য।

যাই হোক,সরব অবশ্য বেশিদিন কান্নাকাটি করে নি,আমাকেই কান্না করিয়েছে। প্রথম প্রথম আলগোছে বোঝাতে চাইলেও এখন রীতিমতো ব্ল্যাকমেইল শুরু করে দিল।আমার সাথে কনভার্সন ও পিক নেট এ পাব্লিক করে দিবে।কষ্ট লাগল না,কেন লাগবে? এই সরবকে তো আমি চিনি না।তবে রাগ লাগল সাথে ভয় ও। কি হবে?কি হবে ভাবতে ভাবতে দিন পার করলাম।মস্তিষ্কের অর্ধেকটা যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তবু শক্ত হলাম।সোশ্যাল মিডিয়া থেকে তাহাকে ব্লক করলাম।দিনের ভিতর ১০/১৫ টা নাম্বার থেকে কল দিত। সব ব্ল্যাক লিস্টে। সব। ওর হুমকি গায়ে লাগাই নি। যা হোক।আই ডোন্ট কেয়ার!

সরবের কিচ্ছা আপাতত এতোটুকু।তবে এ যুদ্ধের রেশ কাটতে না কাটতেই নতুন করে বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। কোন দিকে বাজছে বলো তো?পশ্চিমে?নাকি পুবে? বোধহয় উত্তরে নাকি?আরে না।এ তো দক্ষিণের দামামা। আরে আরেএ এতো চারিদিক জুড়ে বাজছে।আকাশ -বাতাস প্রকম্পিত করে বাজছে।

যুদ্ধ কর!যুদ্ধ কর! যুদ্ধ কর!

সবার মুখে একই রব!

প্রথম প্রথম বোরকা পরা শুরু করলাম।ইশ! কি লজ্জা করছে! শায়লা,মিম,শ্রাবনী __ওরা কি বলবে।ফাউ ফাউ ই এতো চিন্তা করলাম।ওরা কিছুই বলে নি,তবে হেসেছিল প্রচুর।মনটা এতো টুকুন হয়ে গেল!চুপচাপ চলে আসলাম। একদিন ক্লাস ছুটির পর অপুর সাথে একসাথেই ফিরছিলাম,তনু দেখে মুখ ভেংচালে,

“ইশ!বোরকা পরা ম্যাম,সরব এতো ভালোবাসে তা বুঝলে না।অথচ এখন তো ঠিকই ছেলে বন্ধুর সাথে ঘুরো।”

রিংকু বলল, “মনের পর্দাই বড় পর্দা।”

আরেএ!তাই তো! আমি কি করছি?আমার মনই তো আগে ঠিক করতে হবে।প্রোফাইল থেকে সব বিপরীত লিঙ্গের বন্ধুদের আনফ্রেন্ড করলাম।একজন ও না।সব।সব।সকলের কাছে গিয়ে অনুরোধ করিয়ে তাদের ফোন থেকে নিজের ছবি ডিলেট করিয়েছি। কেউ কেউ বুঝাল, এতো ভাব ভালা না।আর কয়েকজন তো রাগের চোটে পটাপট ডিলেট করে দিল।

সেই মাসটা জুড়ে বন্ধু মহলে কেবল আমাকে নিয়েই আলোচনা হলো।

নাম্বার ওয়ান বেইমান!

বন্ধু নামের কলংক!

এমন ফ্রেন্ড না থাকাই ভালো!

আমার মনে কেন যেন সুখ সুখ দোলা লাগল,

বাহ! বাহ! বাহ! ১২ বার বছরের বন্ধুরা আমার!

 

ততোদিনে পর্দায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি আলহামদুলিল্লাহ!।কি শান্তি!কি স্বাধীনতা!

ঢোলা বোরকার আড়ালের রাজ্যটা আমার!আমার!আমার!

এখানে আমার হুকুম চলবে,এই রাজ্য শাসন করবো আমি!

বাইরে তো ঠিকঠাক পর্দা করছিলাম।তবে বিপত্তি বাঁধল ঘরে পর্দা নিয়ে।হুট করে খালাতো ভাই রুমে ঢুকে যায়,দুলাভাই, মামাতো ভাই,কেউ কথা শোনে না।ফুপা তো রেগেই আগুন।ফুপা বাপের মতো, তার সাথেও ঢং!

“আসছে কি আমার পর্দানশীন!”

উফফ ডিসগাস্টিং!

তবে ডিজগাস্টিং ভাবটা বেশিদিন রইল না।  আম্মো আর ভাইয়া এতো এতো সাহায্য করল যে অন্য কেউ আর পাত্তাই পেল না!সব প্রতিকূলতায় আমার জন্য ঢাল হয়ে রইল তারা।বুঝলাম। এখানে আমি একাই সৈনিক নই।আমার ও সহযোদ্ধা আছে!

ইশ!কত ক্লান্ত আমি!

পর্দা নিয়ে সমস্যার সুরাহা হয়েছে।এখন আর কেউ ঘাটায় না আমাকে।আমি ও বিন্দাস আছি।ভাবলাম এই ই সুযোগ। এই ফাঁকে একটু জিড়িয়ে নেই।দরজা -জানালা ভিড়িয়ে হালকা ব্যাকগ্রাউন্ডের একটা গান ছেড়ে একটু শুয়ে থাকি।

ওয়েট,ওয়েট,ওয়েট!

কি বললে? গান শুনবে?কিন্তু তা তো হারাম!

এইরেএএ! ভুলে গেছি। গান,টিভি,সিনেমা সব হারাম।সব।দলা পাকিয়ে কান্না এলো ।গান শুনতে আমার বয়েই গেলো!তবে আমি যে এ্যানিমেশন মুভির পোকা! এরই মাঝে হলিউডে নতুন কিছু এ্যানিমেশন মুভি মুক্তি পেয়েছে। ভেবেছিলাম দেখে ফেলব।কিন্তু! একটু দেখিই না।কি হবে?দোনোমনা করতে করতে শেষমেষ আর দেখলাম না।তবে ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড ডিপ্রেশনে পরে গেলাম।আল্লাহ মাফ করুক সামান্য ক্ষোভ ও ছিল।গান শুনতে পারব না,টিভি দেখতে পারব না,বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে পারব না__তো পারবটা কি শুনি?কি করবটা কি অবসরে?

আমার চিন্তা যেখানে ফুরায়,মহামহিমের কর্ম সেখানে জুড়ায়!

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা মিলিয়ে দিলেন।বই পড়ার পরিমান বাড়িয়ে দিলাম, আল্লাহ হিফয করার তৌফিক দিলেন, আলিমে ভর্তি হলাম,নবীজী সাঃ এর সুন্নাহের দিকে দৃষ্টি দিলাম, ক্যালিগ্রাফি শিখলাম,অবসরে টুকটাক লিখালিখি করি। এখন আর সময় পাই না।বিশ্বাস করুন।এতোটুকু ও পাই না।সারাদিন দুয়া করি, “হে আল্লাহ, আমার সময়ে বারাকাহ দিন। ”

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার নিয়ামত অস্বীকার করার ক্ষমতা আমার কই?

আমি যে একজন পরিপূর্ণ তরুণী! এই নিয়ামাহ কিভাবে অস্বীকার করি?কিভাবে একে দাবিয়ে রাখি?

মাঝে মাঝে খুব শূন্যতা বিরাজ করে।মনটা খা খা করে। “একান্ত ব্যক্তিগত একজন মানুষ ” এর খুব অভাব বোধ করি।খুব! খুব!তবে আশায় থাকি।  আল্লাহ ই তো উত্তম বিনিময় দিবেন।

এতো বছরের বন্ধুরা আমার কেউ নেই।নিদেন পক্ষে কথা বলার ও মানুষ নেই।বেস্টির সাথে তো আরো আগে বনে না।কতবার দাওয়াত দিয়েছি।উল্টো আমারই খবর করে দেয়। উল্টো নির্নয়ের উস্তাদ ওরা।আল্লাহর কাছে দুয়া করলাম, “ইয়া রব্বী আমি একা হয়ে পরেছি।আমাকে দ্বীনি বোনের সঙ্গ দান করুন।”

সুবহানাল্লাহ! কতোগুলো বোন আমার এখন!চারিদিকে মৌমাছির ঝাঁকের মতো কিচিরমিচির করে তারা। দ্বীনি চেতনায় মশগুল থাকে।তাদের প্রতিটা স্টেপে থেকেই শেখার কতো কিছু আছে! নিগার তো বলেই বসল, “খালামনির এখন অনেক ভাই-বোন! ”

গত কয়েকদিন হলো ভাইয়া সুর ধরেছে গ্রামে যাবে।আব্বুর কবর জিয়ারত করবে।আম্মো ও সায় দিলাম। কিন্তু আমি যাব না গ্রামে।

না! না! না! একদমই যাবো না।গেলেই তো ওরা….!

গতবছর গ্রামে যাওয়ার একমাস আগেই চুলে কালার করিয়েছিলাম। আত্মীয়রা প্রচুর ফিসফাস করেছিল মেয়ের ঢং দেখে।আমি অবশ্য ওদের কথা  পাত্তা দেই নি। স্টাইলের ওরা কি বোঝে?

আজ অবশ্য আমি বুঝতে পারছি না আপাদমস্তক বোরখা পরে গেলে ওরা ব্যাপারটা কিভাবে নেবে?যদি আমাকে খোঁটা দেয়? ইশ! মরেই যাব!না না গ্রামে যাওয়া যাবে না।

অবশেষে আমাদের যাওয়াই ঠিক হলো।মাথা নিচু করে চলছিলাম। চোখদুটো আগেই পানি জমিয়ে টইটম্বুর করে রেখেছিলাম, যে-ই কেউ খোঁটা দিবে  অমনি আমি কেঁদে দিব!

অনেকক্ষণ পরও যখন কেউ কিছু বলল না তখন মাথা তুললাম। ছোট মামি সালাত আদায় করছে , ওমা! রুকু সিজদাহ্ কিছু ঠিক নাই।কিরাতেও অসংখ্য ভুল। মামিকে বলব?কিছু মনে করে যদি?দূর করুক। আমার দায়িত্ব শুধু সত্যিটা জানানো। মনে সাহস নিয়ে বলেই ফেললাম, ‘ মামি আপনার সালাত ঠিক মতো হচ্ছে না।আপনি এইভাবে পড়ুন।’

ব্যস বলতে দেরি,কিন্তু আমার ওপর ঝাপিয়ে পরতে তাদের দেরি হয় না।

তারপর থেকে শুরু, যখনই কোথাও যাচ্ছি, আশেপাশের সবাই কানাঘুষা করতো।ঠেস মেরে মেরে কত কি যে বলতো! তখন আমার মনের অবস্থা যে কি ছিল!

আমি আমার বিশ বছরের জীবনে কখনো এতোটা কষ্ট পাইনি!এতো বিভীষিকাময় দিন ছিলো ওইগুলো! এতো কাঁদতাম! এতো!

হিদায়াতের সবচেয়ে কষ্টকর বিষয় হলো অতীত স্মৃতি মনে করা।ইশ! এতো অকৃতজ্ঞ আমি!এতোটায় বিশৃঙ্খলায় কেটেছে জীবন! নিজেই নিজের কাছে অনুতপ্ত থাকি দিনভর।তার উপর ওদের খোঁটা!

হৃদয় চুরমার হতে আর কি লাগে?

আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতাম। তিনিই সহজ করে দিয়েছেন। এখন আমার চামড়া মোটা হয়েছে,  এসব আর এখন গায়ে লাগে না। যা খুশি বলুক না।আগে ও বলত।এখনো বলে।ভবিষ্যতেও বলবে।

সেবার যখন চাকরির অফারটা প্রত্যাখান করি, তখন বাইরের পরিবেশ সুনসান থাকলেও আমার দু’কান জুড়ে তীব্র সুনামী বয়ে গেল,

“পর্দা করেও তো সব করা যায়”

আমি এই যুক্তি খন্ডন করতে পারি নি।প্রচলিত একটা প্রবাদের কথা মনে পড়ে গেল,

“ঘুমিয়ে থাকা মানুষকে জাগানো যায়, কিন্তু যে জেগে আছে তাকে জাগানো যায় না।দেখা গেল যে আমার ক্যারিয়ার নিয়ে তাদের খুব মাথা ব্যাথা!চাকরী না করলে  ভবিষ্যতে কি হবে? এই ভেবে ভেবে কারো ঘুমই হচ্ছিল না। এত মানুষের কথার ভিতর পরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম।আম্মো আর ভাইকে পাশে পেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ! চুপ করে নিজের কাজ করে গিয়েছি।এখন আর কেউ কিছু বলে না।বলতে বলতে মুখ ব্যাথা হয়ে গিয়েছে বোধহয়!

বেশকিছু দিন আরামে কাটাচ্ছিলাম।এর ভিতরেই নতুন সমস্যা হাজির।তারা বোধহয় ভাবলো,মেয়ে যেহেতু চাকরি করবে না,তো বিয়ে দিয়ে দেই।ব্যস শুরু হলো ছেলে খোঁজা! জানিয়ে দিলাম আমি দ্বীনদার কাউকে বিয়ে করতে চাই,হোক তার যেকোন সমস্যা।তবে আমি দ্বীনদারিকেই প্রাধান্য দিব। শুরু হলো নতুন যুদ্ধ। অবশেষে তাদের বুঝাতে সক্ষম হলাম।মাসখানের ভিতরই একজন স্থির হলো।আলহামদুলিল্লাহ যেমন চেয়েছিলাম তেমনই।কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিল। আমি জেনারেল ব্যাকগ্রাউন্ডের দেখে সে হতাশ হলো। প্রায় সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পর একসময় সে না করে দিল, কারন মেয়ের আরেকজনের সাথে সম্পর্ক ছিল!

কিছু সময়ের জন্য মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল।পরক্ষণেই আছড়ে পরি জায়নামাজে।

হায় আল্লাহ, সবচেয়ে নিকৃষ্টতম পাপ করেও তোমার কাছে ক্ষমা চাইলে, তুমি তা ও ক্ষমা করে দাও! তাহলে আমরা কেন পারি না?

যদি নাই বা পারি ক্ষমা করতে,তাহলে তোমার কাছেই বা কিভাবে ক্ষমা চাইবো?

দুঃখকে ভালোবাসি আমি।দুঃখের মধ্য দিয়ে আল্লাহকে পাওয়া যায়।মনে কষ্ট থাকলে ইবাদতে স্পৃহা আসে,চোখ দিয়ে পানি পরে।আহ!কাঁদতে ও সুখ!

এর ভিতরে ঘটলো আরেক ঘটনা।হঠাৎ করে সরব এলো।বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাল।আবারও দেখলাম ওকে।বুকের রক্ত ছলকে উঠলো!

সময় কতোটা কেটেছে?

দু’বছর বোধহয়!

আগের বার বিয়ে ভাঙ্গায় সবার মনোভাব ছিল এমন, যেমনি হোক পার করতে পারলে বাঁচি। তাই সবাই রাজি হয়ে গেল।অবশ্য রাজি না হওয়ারও কোন কারন ছিল না,তারা যেমন চাইছিল সরব তেমনই ছিল।তবে আমি যেমন চাই তেমন নয়।

তাই রাজি হলাম না।আবারও শুরু হলো গৃহযুদ্ধ! আমি ক্লান্ত! ইয়া রব! আমি অসহায় আমাকে সাহায্য করো।সেবারের মতো সরব চলে গেল। তবে প্রচন্ড শাসিয়ে গেল,আমাকে দেখে নেবে!

আমি চক্ষু মুদলাম, আল্লাহ ভরসা!

এতদিনে বেশ ঝানু হয়েছি আমি।মেধা হয়েছে দীপ্ত। সম্ভাব্য সমস্যাগুলো আঁচ করতে পারি। সহজে ঘাবড়াই না, আগের মতো অল্পেই মুষড়ে পরি না।কিছু সমস্যার সমাধান করেছি।আর কিছু করিনি। আমি বুঝতে পেরেছি সব সমস্যার সমাধান হয় না।কিছু ক্ষত তো আজীবন কষ্ট দেয়।এইতো সেদিনের কথা খালাতো বোনের গায়ে হলুদে গেলাম না বলে মেঝ খালা শুনিয়ে দিল,

“আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে যাবে না”

আমার গলা শুকিয়ে এলো। ধর্ম-কর্ম তারাও জানে, কোরআন-হাদিস তারাও মানে।

সপ্তদশবর্ষীয়া পাড়ার এক ছোট বোনকে হারাম রিলেশন ছাড়তে বলায় তার উত্তর,

“আমার আব্বু-আম্মু হজ্জ করে আসছে।

তাদের কোন সমস্যা না থাকলে মানুষের

এতো জ্বলে কেন?”

আমি চুপ হয়ে গেলাম। তাকে হালাল হারামের নসীহা বোঝানোর ক্ষমতা আমার কেন আপাতত কারো নেই।

পথিক আমি।চলছি গন্তব্যের উদ্দেশ্য। আমার রাস্তায় বাঁধা পরে,বন্ধুর হয় পথচলা।ক্ষত-বিক্ষত হয় চরন!

আমার গতিকে রোধ করে দেয়! আমি থামি না।

যাত্রাপথে যে সমস্যা হয় সমাধান করি।আাবার চলি।কখনো খুব দ্রুত, কখনো বা গতি হয়ে যায় মন্থর! কিছু আমার গতিকে রোধ করতে পারে না।আমার পথচলাকে থামাতে পারে না।আমি কাউকে ভয় পাই না। আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করা আমার জন্য ঠিক হবে না।অবশ্য ছাগলের  ভয় নেকড়েকে।

আমার জীবনে আগে এতোটা সমস্যা ছিল না যতটা হিদায়তের পরের জীবনে হয়েছে। কখনো হেসেছি, কখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে সারাক্ষন কেঁদেছি,আবার কখনো ধৈর্য হারাতে বসেছি।

এবং প্রতিটা সমস্যায় ও এমন ভাবে আল্লাহ বাঁচিয়েছেন, যেমনটা আমরা বলি ” এইসব শুধু সিনেমায়ই হয়!”  বুকজুড়ানো প্রশান্তি আগে কখনো ছিল না। “No risk, No gain”  একটা লাইফ ছিল।

আমরা পায়ের উপর পা তুলে দ্বীন পালন করতে চাই।ফেসবুকে দুয়েকটা নীতিবাক্য পোস্ট করে ভাবি “আহা!ইসলাম কি সহজ!”

এভাবেই দিনের পর দিন আমরা আরামসে দ্বীন পালন করি এবং দিনশেষে “আমাদের দিন যায় দ্বীন বেচে….!”

আসলেই কি সহজ? নারে ভাই।এতো সোজা না।বহুত কিছু ত্যাগ করতে হয়েছে। কিছু ত্যাগ করেছি হাসতে হাসতে। আবার কিছু করতে গিয়ে দ্বিধা করেছি,কেঁদে ভাসিয়েছি বুক___যতদিন নশ্বরকে ভালবাসতাম।

এখন আর কাঁদি  না,দ্বিধা জাগে না।আল্লাহ চাহে তো পোক্ত হয়েছে ঈমান।কিন্তু মাঝের সময়টা ছিল বড় যন্ত্রণার!

কেটেছে বহুদিন। এভাবেই আছি।সবই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার ইচ্ছা। উনি চাইলে এই পরীক্ষা আমাকে আজীবন দিতে হবে। আবার উনি চাইলে এই পরীক্ষা ক্ষনিকের মাত্র! ভয় কি?শিখে গেছি সঞ্জীবনী মন্ত্র!

 

হতাশ হই না,

ধৈর্য্য হারাই না।

এই কষ্ট বেশি দিনের নয়।

একদিন নিশ্চয়ই আমার রব চোখের পানি মুছে দেবেন!

অন্তরের মালিক অন্তরে প্রশান্তি দান করবেন!

জানেন তো,রাব্বে কারীম কারো উপর তার সামর্থ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপান না।

প্রতিদান তো রাব্বে কারীমের কাছে!

আর আমার রবের ওয়াদাই তো সত্য!

এ প্রত্যাখান পবিত্র!

এ প্রতিকূলতা শাশ্বত!

Facebook Comments

Related posts

নীড়ে ফেরার গল্প-১ | মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ 

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-২৬ | প্রাকৃতজন (ছদ্মনাম)

সংকলন টিম

নীড়ের ফেরার গল্প-১৮ | মিজানুর রহমান সাব্বির

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!