সংকলন
ফারিহা
প্রতিযোগিতা-২

নীড়ে ফেরার গল্প-৩১ | ফারিহা (ছদ্মনাম)

দ্বীন পালনে যখন পরিবার বাধা

হেদায়েত সব সময় আল্লাহর পক্ষে থেকে আসে আল্লাহ যাকে চান তাকে হেদায়েত দান করেন । নীড়ে ফিরতে পারলেও সবাই টিকে থাকতে পারেনা এর জন্য রিতীমত যুদ্ধ করতে হয় পরিবার, আত্মীয়স্বজন, আশে পাশে মানুষদের সাথে। গোবরেই পদ্ম ফুল ফুটে তেমনি ভাবে বেদ্বীন পরিবারে পাক্কা দ্বীনদারি কেও উদয় হতেই পারে আল্লাহর রহমত থাকলে। তবে সে সহজে সেই পরিবারে টিকে থাকতে পারেনা  এর জন্য তাকে অনেক কাঠ খর পোড়াতে হয়।সয়তে হয় কষ্ট বেদনা লাঞ্চনা।

Tijarah Shop

তেমনি আমিও এমন একটি পরিবারেই বড় হয়েছি। যুদ্ধ করেছি দ্বীন নিয়ে রব্বের দয়ায় নীড়ে ফিরেও টিকে থাকা আমার জন্য কষ্টের ছিল।

আমি ফারিহা  আমার বড় হওয়া একটা বেদ্বীন পরিবারে।

ধরতে গেলে আমার পরিবারে দ্বীনের রেশ মাত্র ছিলনা।

একটা উশৃংখল পরিবার ছিল নামাজ কালামের ধার ধারেনা সারাক্ষণ ঝগরা জাটি লেগেই থাকতো।

আমার বড় ভাই আর বাবা সর্বদা হাড়াম কাজে ব্যাস্ত থাকতো অশ্লীল বাক্য ছিল তাদের পেশা। এগুলো ছিল আমার ভিষন্নতার কারণ।   আমাদের অভাব অনটনের সংসার ছিল।

আমি মকতব থেকে কুরআন শিখেছি আমাকে দ্বীন শিক্ষা দেয়ার মত তেমন কেও ছিলনা।

আসলে আমার হেদায়েত কারো হাত ধরে হয়নি। মহান রব্বের পক্ষ থেকে অলৌকিক ভাবে হয়েছে।আলহামদুলিল্লাহ রব্ব আমার ভাল চেয়েছে। আমার পরিবার বেদ্বীন থাকলেও আমি আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ছি। আমার সাপোর্টার বলতে বাড়িতে ছোট ভাইটা ছিল তবে আমাকে হিজাবের ব্যাবস্হাটাও করে দিতে পারেনি । সে একটু একটু দ্বীনের পথে ছিল তবে বর্তমানে সে আর নেই দ্বীনের সুশীতল ছায়াতলে। মাঝে মধ্যে দুই  এক ওয়াক্ত সালাত আদায় করে এখন। বর্তামানে আমার সাপোর্টার বলতে কেও নেই।

আমার ছোট থেকেই দ্বীনের প্রতি অন্যরকম একটা টান ছিল তবে ততটা না। আমার ছোট ভাইটা আমাকে নামাজের জন্য বলতো মাঝে মাঝে পিটুনিও দিতো।সে আমাকে দ্বীন সম্পর্কে বলতো একটু একটু আর মাদ্রাসায় পড়া লেখা করেছি এই দুইটা মিলেই হেদায়েতের পথে আসা আমার।

দ্বীন পালনের জন্য আমার বাড়িতে তেমন কোন ব্যবস্হায় ছিলনা। আমি ছোটবেলা তেমন হিজাব করতে পারিনি আলহামদুলিল্লাহ এখন পারি শত বাধার পরেও।

তবে এখন ও আমাকে কাথার নিচে সহ আরো কত জায়গায় লোকাতে হয় হিজাব রক্ষার জন্য।

আমার বাবা আর বড় ভাইটা সব সময় হাড়াম কাজে ব্যাস্ত থাকতো। তারা ভুলেও কখনো ভাবেনি বাড়িতে পর্দার ব্যবস্হা করতে হবে। আমি যদি কখনো বলতাম বাড়িতে পর্দার ব্যবস্হা করতে  আমাকে অনেক কথা শুনাতো এমন এ কথা ও বলতো ভাল না লাগলে বাড়ি থেকে চলে যা আমার ইসলামিক বইগুলো ফেলে দিতে চাইতো। তাদের যদি কখনো ইসলাম নিয়ে কিছু বলতাম আমাকে তারা উপহাস করে বলতো বাড়িতে কোন হুজুরনীর জায়গা নেই এখানে হুজুরগিরি দেখানো যাবেনা । এরকম অনেক কথায় বলতো আমি শুধু কান্না করতাম আর রব্বের কাছে দোয়া করতাম আমাকে যেন একটা দ্বীনি পরিবেশ দান করেন।

আমার হাড়াম হালাল বুঝার পরিপূর্ণ জ্ঞান হয়েছে তখন আমি তাদের এমন কাজে কখনো সন্তুষ্ট ছিলাম না।

হারামে আমি অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম।

তাদের হাড়াম উপার্জন আমি খাবোনা এটা ভেবে কত রাত কত দিন আমি অনাহারে থেকেছি হিসাব নেই জেনে বুঝে বা আমি খায় ই কি করে । তবে উপায় নেই আমার জীবন বাচাতে বাধ্য হয়েই খেতে হয়েছে।

আমি যখন ক্লাস নাইনে তখন আমি দর্জি কাজ শিখি পড়া লেখার পাশাপাশি এই কাজটা করতাম। কেননা তারা আমাকে পড়ালেখার খরচটাও দিতোনা আমার বড় ভাইকে অন্যায়  কাজের জন্য টাকা দিলেও আমাকে দিতো না। বাড়িতে তেমন হিজাব করতে পারিনি তখন কেননা সে পরিবেশ ছিলনা তাছাড়া আর আমার তখন এই জ্ঞানটা ছিলনা যে চাইলেই যেকোন পরিবেশে হিজাব করা যায়। মাদরাসায় বোরকা পড়ে গেলেও নিকাব করে যেতাম না। অশালীন পরিবারে থেকেও আলহামদুলিল্লাহ শালীন থাকার চেষ্টা করতাম উগ্রভাবে চলাফেরা করতাম না কোন ছেলেদের সাথেও মিশতাম না। আমার যখন দাখিল এক্সাম তখন আমার আরেকটু জ্ঞান হয় আমি ভাবি এক্সামের প্রথম দিন থেকে আমি পরিপূর্ণ হিজাব করে যাবো আলহামদুলিল্লাহ তাই করেছি। দাখিল এক্সামের প্রথমদিন আমি নিজেকে পুরো কালো কাপড় দিয়ে আবৃত করে  নিয়েছি। তবে এমন বেদ্বীন পরিবারের মেয়ে এমনটা দেখে কেওতো আর চুপ থাকতে পারে না শুরু হয়েগেল হুজুরনী,জঙ্গি, ভাব,ভুত আরো কত কি। কিন্তু এতে আমার কিছু করার ছিলনা আসলেই তো আমার পরিবারটা এমনি।

পরিক্ষার প্রথম দিন যখন হলে প্রবেশ করি আমি ছাড়া হলে কেও এত হিজাব করেনি। শিক্ষিকা এসেই আমাকে বলছে নিকাব খুলতে তখন আমি শুধু কান্না করেছি উপায় না পেয়ে।আমার দাখিল পরিক্ষা শেষ হলো এর মধ্যেই বিয়ের প্রপোজ আসতে শুরু করলো তবে কেও ই দ্বীনদারি ছিলনা।  বিয়েতে আমি মোটেও রাজি ছিলাম না কেননা আমি চাইনা আমার জীবনে আবার এমন একটা বেদ্বীন পরিবার আসুক। যেভাবেই হোক আমাকে বিয়েতে রাজি করাতে পারেনি। আমি আলিমে ভর্তি হয় নিয়মিত ক্লাস করতামনা মাঝে মাঝে ক্লাস করতাম। এদিকে আমি বড় হচ্ছি আর দ্বীনের বিষয়ে আমার জ্ঞান বাড়ছে আর তার কারন হলো বাড়িতে প্রচুর ইসলামিক বই পড়তাম আর ভাইয়ার ফোন থেকে ওয়াজ শুনতাম ইসলামিক ভিডিও  দেখতাম।  আলিমে ক্লাস নিয়মিত করিনি তবে যতদিন ই করেছি কোন ছেলের সাথে ভুলেও কথা বলেনি। কিন্তু টেস্ট এক্সামের সময় কি করে যেন ২ টা ছেলের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমার আর আমার বান্ধবীর তবে এর জন্য দায়ী মোবাইল, ফেসবুক। তবে সত্য বলতে আমি কখনো রিলেশন করিনি আলহামদুলিল্লাহ  এখনো করিনা ওরা আমার জাস্ট ফ্রেন্ড নামের দুইটা শয়তান ছিল। আমার নিজস্ব কোন মোবাইল ছিলনা আমার ভাইয়ের ফোন থেকে চুরি করে ফেসবুক চালাতাম। আমি হেদায়েতের পথে এসেও আবার অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিলাম জাস্ট ফ্রেন্ড নামের শয়তানদের পাল্লায় পরে । এমনিতেই পরিবার বাধা আবার এ যেন আমার হেদায়েতের পথে নতুন বাধা।

তবে আল্লাহ আমার মঙ্গল চেয়েছেন আমার ফ্রেন্ডদের থেকে একজন আমার বাড়িতে বিয়ের প্রপোজ করে এই খবরটা শুনে আমার মাথায় আগুন ধরে। আমার তখন যেন হুশ ফিরে আসলো আমি কোন পথে হাটছিলাম এটাতো শয়তানের পথ। সব বাদ দিয়ে দিলাম নিজেকে আবার গুটিয়ে নিলাম সব থেকে।চলতে শুরু করলাম হেদায়েতের পথে। তবে আমার পরিবারকে বুঝাতে পারিনি এ পথের মর্ম আজ পর্যন্ত । তারা আজ ও আমাকে এপথে চলতে কোন প্রকার সাহায্য করেনা উল্টো বাধা প্রদান করে। আলিম এক্সাম শেষ হলো আমি ফাজিলে ভর্তি হলাম তখন আমার ছোট ভাইটা বিয়ে করলো বিয়ের পর সে যতটুকু হেদায়েতের পথে ছিল তা থেকে যেন সরে গেল আমি একা হয়ে গেলাম আমার বাড়িতে আমার সাপোর্টার বলতে আর কেও রইলো না।

আমার বিয়ের প্রপোজ আরো আসে শুধু দ্বীনদারি নয় বলে আজ ও আমি রাজি হয়নি কোন বিয়েতে। পাত্র পক্ষ দেখতে আসা নিয়েও আমি সংগ্রাম করেছি আমি পাত্র ছাড়া কারো সামনে যেতে চাইতাম না।তবে এটা মেনে নিতে পারতোনা সবাই কেননা এটা আবার কেমন ভাব দেখতে আসছে এখানে না যাওয়ার কি আছে। শত সংগ্রামের পরেও আমার ইচ্ছাটার ই মূল্য দিয়েছেন রব্ব  আমি না করে দিয়েছি পাত্র ছাড়া কারো সামনে যাবোনা তাই হয়েছে । আমার পরিবার দ্বীনি নয় বলে দ্বীনি পাত্র দিয়ে কোন সমন্ধ আসেনা আমার জন্য। তবে আমি বেদ্বীন কারো সাথে বিয়ের  বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইনা যাই হোকনা কেন।

আমি ফাজিলে ভর্তি হয় এমনকি  বই  ও কিনি তবে এখন আমি আর পড়া লেখা করতে চাইনা দুনিয়াবি পড়ালেখা আমার প্রয়োজন নেই । আমার কোন সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই। আমি চাইনা আর বাহিরের পরিবেশে যেতে নিজেকে মানুষদের সম্মুখে প্রেজেন্ট করতে। এই ভেবে পড়া লেখা ও বাদ দিয়েছি। শত ইচ্ছা শত সপ্ন থাকা সত্যেও আমি পারিনি কওমি মাদ্রাসায় পড়তে যেখানে আমাকে কেয়ার করে দ্বীন শিখাবে আমল করাবে  ইলম বুঝাবে।সব আল্লাহর ইচ্ছা তিনি চেয়েছেন  আমার নীড়ে ফিরা হোক তাই হয়েছে । আমার পরিবার কে আমি শত বুঝিয়েও পারিনি নীড়ে ফিরাতে। আমার সাপোর্টার ভাইটাও আর আজ নেই আমার সাপোর্টার কি করে থাকবে সে নিজেইতো আর নেই নীড়ে।

জানিনা আমার নীড়ে ফিরে টিকে থাকা কতটা যুদ্ধ মনে হয়েছে সবার তবে আমি পারি দিয়েছি দিনগুলো আমার কাছে যুদ্ধই মনে হয়েছে। আমি নীড়ে ফিরেও তেমন ভাবে পারিনি রব্বের আনুগত্য করতে কেননা আমার সেরকম পরিবেশ, পরিস্হিতি, পরিবার কোনটাই ছিলনা। তবে ইচ্ছা থাকলে এর মধ্যে দিয়েই পারা যায় আল্লাহর রহমত থাকলে। হয়তো এই রহমতটাই আল্লাহ আমাকে দান করেছিলেন যার জন্য নীড়ে ফিরতে পেরেছি। এখন আমি নিজেকে  মানিয়ে নিয়েছি এই পরিবারে, এই পরিবেশে  এখানে থেকেই যতটুকু পারি দ্বীনের পথে আছি আলহামদুলিল্লাহ।

Facebook Comments

Related posts

নীড়ে ফেরার গল্প-৩৯ | লাবণ্য

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-২৯ | মুহাম্মদ ইবরাহিম খলিল সিরাজী 

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-৩ | আবু মুসআব

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!