কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গিয়েছি। ছোটবেলা হারিয়ে গেছে বড় হওয়ার ফাকে। হারানো দিনের দুঃসহ স্মৃতিগুলো আজও মাঝে মাঝে মনের ক্যানভাসে কালচে রংতুলির আঁচড় লাগায়। খিল এঁটে দেয়া দরজায় ফের ঠকঠক কড়া নাড়ে। কিন্তু, দরজা উদোম করে আমি যে আর পাড়ি দিতে চাইনা সেই পঙ্কিলতার পাহাড়ে! পাপের সাম্রাজ্যে। তবে, ভাবনার মোহনায় বসে ভাবি সেইসব দিনরাত্রির কথা।…
ছোটবেলা থেকেই ছিলাম নিরব প্রকৃতির। অপরিচিত কারো সাথে কথা বলতে গেলে রাজ্যের লজ্জা এসে ভর করতো তনুমনে। লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে ক্লাসের পড়া পেরেও থাকতাম নিশ্চুপ হয়ে। এহেন স্বভাবের জন্য কতবার যে স্যারদের হাতে বেড়ধঁক পিটুনি খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। আমি ছিলাম আর দশটা নিম্ন-মধ্যবিত্ত ছেলের মতো একবারেই সাধারণ। আলাদাভাবে নজর কাঁড়ার মতো আমি কিম্বা আমাদের তেমন কিছুই ছিলনা৷ দাদাকে দেখিনি। আমার বুঝ হওয়ার আগেই কবরবাড়িতে পাড়ি জমিয়েছেন। বাবা বিদেশ-বিভূঁইয়ে ছিলেন সেসময়৷ আমি, মা, বড় ভাই আর দাদুকে নিয়েই ছিল আমাদের ছোট্ট সংসার।…
আমার শৈশব মানেই ছিলো দিনভর ক্রিকেটে মেতে থাকা। ক্রিকেটের জন্য নাওয়া-খাওয়া ভুলে স্কুল ফাঁকি দিয়ে, কতবার যে কলেজের করিডোরে টিভি দেখার জন্য নিভৃতে ঢু মেরেছি তার ইয়ত্তা নেই। প্রাইমারির গন্ডি পেরিয়ে একসময় হাইস্কুলে নোঙর করি। আমার নীরবতার দরুন বেশিরভাগ ছেলেপেলেই আমাকে নিপাট ভদ্র ছেলে হিসেবে জানতো। সামনাসামনি সাধুর বেশ ধরলেও আমার ভেতরটায় ছিল ভালো-মন্দ উভয়েরই মিশেল। জেএসসি পরীক্ষার পর যেইনা নাইনে উঠেছি। তখন, মনে একরাশ অভাবনীয় আবেগের উত্তাল ঢেউ এসে পাড়ি জমালো। একদিন, কোন এক অজানা কারণে একজনকে মনে ধরলো। পরক্ষণেই ভাবি, পাহাড়সম লজ্জা নিয়ে তাকে কিছু বলার সাহস যে আমার একদম নেই। তারপরও, লজ্জার লাকড়ি ভেঙে দিনকয়েক তার পিছে হন্যে হয়ে ছুটি। একসময়, বন্ধুদেরকে দিয়ে প্রপোজালও পাঠাই। বহু চড়াই-উতরাই পার হওয়ার পর প্রপোজাল নাকচ হয়৷…আমি দমে যায়। এরপর রিলেশনশিপ নামক ধূম্রজালে আর কোনোদিন পা বাড়াইনি! এভাবে, আশা-নিরাশার দোলাচলে নিত্যদিন কাটতে লাগলো আমার। শান্তি পেতাম না। মাঝে মাঝে হতাশার হল্কা আষ্টেপৃষ্ঠে ধরতো। বুকের পিঞ্জরে কেমন যেন শূন্যতা, হাহাকার বিরাজ করতো। পাষাণ হওয়া হ্রদয়ের প্রাচীরে ঠেকতো অদ্ভুত সব প্রশ্ন!
আর দশটা ছেলের মতো মুসলিম ঘরেই জন্ম আমার। মুসলিম হিসেবে আমার ইবাদত সীমাবদ্ধ ছিল—জুমুআর সালাত আর মসজিদের মকতবখানায়৷ মা অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা আর কখনো সখনো নামাজের জন্য তুখোড় বকাঝকা করতেন। মায়ের কথা মোটেও কানে তুলতাম না৷ নিজের মর্জিমতোই চলতাম। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটতো বাংলা সিনেমা আর অডিও গানে বুঁদ থেকে। সিনেমা দেখে তো কোনো কোনো সময়ে গাল বেয়ে বেয়ে অঝোরে চোখের পানি ঝরতো৷
বড় ভাইয়া, তিলোত্তমা নগরী থেকে আসতেন মাঝে মাঝে। ভাইয়ার, অগোচরে মোবাইল খুলে স্কিন ভিউ করে আইটেম সং দেখতাম৷ ফ্যান্টাসির নীল জগতে হারিয়ে যেতাম৷ খানিক সময় মনের কোণে কিছুটা সুখের ছোঁয়া লাগলেও পরক্ষনেই বিষােদের অগ্নিদগ্ধে জ্বলে, পুড়ে ছারখার হতাম!
দিনে দিনে আমার দুষ্টমি বাড়তে থাকে। বন্ধুদের নিয়ে সারাদিন দলবেঁধে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানোই যেন আমার প্রধান কাজ হয়ে দাড়িয়েছে। প্রতিবেশীর ছেলেকে সজোরে থাপ্পড় মেরে কাঁদানো, অন্যের এটা-সেটা নষ্ট করার দরুন মাকে ঝাড়া শুনতে হতো। আমার কৃতকর্মের সমস্ত ঝাল বাবা মায়ের উপর ঝাড়তেন। যেন, এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দোষী মানুষটা আমার মা৷
স্কুলে নিয়মিত যেতাম। ক্লাসে, স্কুল ক্যাম্পাসে বন্ধুদের অনুপস্থিতে আমার চোখের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল মেয়েদের শরীর। কুনজরে, লোলুপ দৃষ্টিতে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতাম৷ বন্ধুদের আড্ডায় মেয়েদের ফিগার, আর নীচু দিক নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হতো।…এ বিষয়ে আমি অতটা এক্সপার্ট না হলেও মেয়েদের নিয়ে রসালো, রগরগে আলোচনাগুলো খুব কমই মিস করতাম।
একসময়, জীবনের পালাবদলের মাহেন্দ্রক্ষণ ধরা দেয়। হাত ফসকে বেরিয়ে যাওয়া নীল নাটাই ফের আসে হাতের নাগালে। পরিবর্তনের জোয়ার আসে হ্রদয় অলিন্দে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলা গন্তব্যহীন যাত্রার মোড় ঘুরে সরল পথের দিকে। অচেনা এক নওমুসলিম আলেমের মনের মাধুরী মেশানো বয়ানে টনক নড়ে আমার। মুহূর্তেই অজানা ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠে হ্রদয়ের অন্দরমহল। অনুতপ্ত অশ্রুতে ভিজে জবজবে হয়ে যায় দু চোখের পাতা।…কি করছি আমি? স্রষ্টাকে ভুলে এ কোন অচেনা পথে অহর্নিশ ছুটছি আমি?
আমার জীবনের ঝুলিতে যে ভুরিভুরি পাপ। অজস্র পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে, হ্রদয় বিগলিত বদনে হু হু করে কেঁদে মুনাজাতে আর্জি জানাই রবের কাছে। দৃঢ়ভাবে তাওবা করি, প্রতিজ্ঞা করি আর কোনোদিন পাপের সাগরে পাড়ি না দিবার৷
পরদিন থেকে জামাআতে সালাত পড়া শুরু করি। হ্রদমাঝারে স্হান দিই মসজিদকে। সিজদায় অবিরত লুটিয়ে থেকে রবের কাছে অনবরত দুআ করি। সেদিন থেকে বুঝি, সত্যিকারের প্রশান্তি পেতে স্রষ্টার স্মরণ ছাড়া আর কিছুই উত্তম হতে পারে না।
একসময়, যেই আমিটা মেয়েদের দেহবল্লরী নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করতাম। ফ্যান্টাসির অন্ধকার কুঠুরিতে বেওড়া হয়ে খুজতাম এক টুকরো মাংসপিণ্ড। আজ সেই আমি সেগুলো থেকে যোজন যোজন দূরে। একসময়, যেই আমিটা আড়ালে আবডালে মেয়েদের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম, আজ সেই আমি চোখকে ১৮০° অ্যাঙ্গেলে নীচে নামিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটি, এড়িয়ে চলি পত্রিকার প্রকোষ্ঠে থাকা অহরহ বেপর্দা মেয়ের ছবি। একসময়, যেই আমিটা অশ্লীল গান-মুভিতে দিব্যি মত্ত থাকতাম, আজ সেই আমার কাছে গান-মুভির আওয়াজ বিষাক্ত নিনাদের মতো লাগে। শুনলেই, ভৌঁ দৌড় দিয়ে হুড়মুড় করে পালাতে মন চায়৷
অফুরন্ত আফসোস! মুসলিম পরিবারের ছেলে হয়েও জীবনের বহু বসন্ত মাড়িয়েছি অন্ধকারের অতল গহ্বরে। যে সুমহান সত্ত্বার হাতে আমার প্রাণ, তার কাছে ফিরতে তাকে চিনতে বেশ দেরিই হয়ে গেল বটে। আমি জানি, দ্বীনের পথে আমাকে আরো বহুল কণ্টকাকীর্ণতায় ঘেরা গিরিপথ পাড়ি দিতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে, সে পথ দুর্গম হলেও দিনশেষে অনিন্দ্য আনন্দের। পরম প্রাপ্তির। আশ্চর্যের বিষয় হলো, রবের দিকে আমার এই কিঞ্চৎ পরিবর্তনেও বিদীর্ণ হওয়া এই সমাজের মানুষগুলো থেমে থাকেনি। মুখ ভেঙচিয়ে বেদনার বিষাক্ত তীর সজোরে নিক্ষেপ করেছে।
> ইস! হুজুরানা দেখাতে আসেছে।
> কেমন নামাজিরে!
> তুই এক্টা শ্রেষ্ঠ বেয়াদব!
পঁচে গলে যাওয়া এই সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে…আজও নির্বিকার হেঁটে চলি। মনে খানিক কষ্ট পেয়েও নেইনা। ভাবি, নবি-সাহাবীরা তো দ্বীন কায়েম করতে, দ্বীনের পথে চলতে গিয়ে আরো সীমাহীন কষ্ট সহ্য করেছেন! সেই তুলনায় আমার এই যৎসামান্য কষ্ট কতই না নস্যি-নস্কর!
যে মহান মালিক তার অসীম দয়ায়, অফুরন্ত রহমতে আমার জন্য শত প্রতিকূলতার পারদ গুঁড়িয়ে একটুখানি হেদায়েতের প্রশস্ত রাস্তা খুলেছেন, তার কাছে আজও অবিরত শুকরিয়া করে বেড়াই। হেদায়েতের পথে অটল থাকতে আজও অনবরত ডুকরে কাঁদি।
‘হে আমার রব! হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী৷
আমার অন্তরকে দ্বীনের পথে অটল-অবিচল রাখুন’ [তিরমিজি, ৩৫২২]
ইয়া রব!
জীবনপথে হাঁটতে গিয়ে পদে পদে শুনতে পাই, ফিতনার বজ্রধ্বনি! হে মালিক! বর্তমান ফিতনার জঞ্জালময় দিনে যৌন সুড়সুড়ির অবগাহনে আমার ঈমানকে মজবুত রাখিও। আমাকে নিরন্ধ্র অন্ধকারের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করিও না৷ চিরতরে বিলীন করোনা আধুনিকতার নিকষকালো আঁধারে।
ইয়া রব! এই জীবনের যমীনে বিলাসিতার বর্নিল বাতায়ন চাইনা৷ তোমার দোহাই, বসন্তের দেশের নেশা আমার গায়ে লাগিওনা। আমাকে কেবল তোমার হেদায়েতের আলোকঘরে পরম যতনে রাখিও৷ আমার এ জীবন-মরণ সব যে তোমার সমীপেই নিবেদন।
‘নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন এবং আমার মরণ সবকিছু কেবল বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার জন্য।’ [আল কুরআন, ৬ঃ১৬২]
Facebook Comments