সংকলন
মারইয়াম শারমিন
প্রতিযোগিতা-২

নীড়ে ফেরার গল্প-৩২ | মারইয়াম শারমিন

এইতো ক’টা বছর আগেও, ঘনায়মান কাজল মেঘের ন্যায় প্রবল তমসাচ্ছন্ন একটা জীবন ছিল আমার। পার্থিব রূপ জৌলুশে বিভোর হয়ে দুনিয়া নামক মরিচীকার পেছনে রূদ্ধশ্বাসে ছুটে চলেছি জীবনের অনেকগুলি বসন্ত। কিন্তু হঠাৎ একদিন থমকে দাঁড়াই; আঁধার কেটে মেঘের ফাঁক গলে এক চিলতে সোনালী আলো এসে ঠিকড়ে পড়ে আমার ওপর। অতঃপর হিদায়াতের নূরে নিজেকে মুড়িয়ে নিলাম; দ্বীন ইসলামের নীড়ে প্রত্যাবর্তন করে সঁপে দিলাম আমার সমস্ত সত্তাকে কেবল তাঁরই তরে।

হিদায়াতের গল্পটা বলে নিজের গোপন পাপের স্বরূপ উন্মোচন করা আমার উদ্দেশ্য নয়। বরং হিদায়াত পরবর্তী জীবনটা কীভাবে আমূল পাল্টে গেল এবং পরিচিত মহলে এর কীরূপ প্রতিক্রিয়া ছিল, রবের অশেষ কৃপায় কীভাবে আমি প্রতিনিয়ত সবটা সামাল দিচ্ছি; সেই গল্পটাই আজ শোনাতে এসেছি। লেখাটি পড়ে কারো যদি বিন্দুসম অনুপ্রেরণা মিলে, সেটাই আমার পরম পাওয়া।

হৃদয় দ্বারা দ্বীন অনুধাবন করার পরপরই যেন আমার নবজন্ম হলো। আমি ভেবেছিলাম হিদায়াত পরবর্তী জীবনটা খুব সুখকর হবে, বাবা-মা জেনে আনন্দিত হবেন। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। আমার জন্মদাত্রী মা ব্যাপারটা একদমই মেনে নিতে পারেননি। তিনি চাইতেন, বান্ধবীদের মতো আমিও সঙ সেজে ‘টিপটপ’ হয়ে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করি। কিন্তু এর বিপরীতে আপাদমস্তক কালো কাপড়ে আবৃত কন্যাকে দেখলে অখুশিই হওয়ার কথা। মনে মনে বেশ অসন্তুষ্ট হতেন, কিন্তু বেশি কিছু বলতেন না। মেয়ে বড় হয়েছে তো!

তবে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করল যখন ঘোষণা দিলাম– আমি চাকুরী করব না। মা এসে সশব্দে আমার বা গালে কষে একটা চড় লাগালেন। ফণীমনসার মতো ফণা তুলে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন, “এতো টাকা খরচ করে লেখাপড়া করিয়েছি এসব শোনার জন্য? চাকরী করবি না তো আগে বলতি। মেট্রিক-এর পর বিয়ে দিয়ে দিতাম।” আমার মুখ দিয়ে রা বেরুল না। বাম গালে হাত রেখে অস্ফুটস্বরে বললাম, “আমার দুইজন মাহরাম পুরুষ তো ইনকাম করছে মা। আমার তো ইনকাম করার প্রয়োজন নেই।” মা এবার দৌঁড়ে এসে দ্বিতীয় চড়টি দিতে উদ্ধত হলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে বললেন, “হা, চাকরী করবা কেন? বাপ ভাইয়ের ঘাঁড়ে বসে খেতে তো খুব মজা। তোমার ধান্দা আমি বুঝি না ভেবেছো? আজ থেকে একটা পয়সাও হাত খরচা পাবা না।” একদমে কথাগুলো বলে পাশের ঘরে গিয়ে বিলাপ শুরু করে দিলেন। আমার ভারি অবাক লাগল– বিগত ৪/৫ বছর ধরে আমি হাত খরচা বাবদ একটা পয়সাও নিই না। অথচ মা এটা বেমালুম ভুলে গেলেন?

কষ্টের আতিশয্যে টিকতে না পেরে জেঠুকে কল দিলাম। বিশ্বাস ছিল, জেঠু অন্তত আমার কষ্টখানি বুঝবেন। অথচ জেঠু কী-না বললেন, “তোমার একটা সিভি পাঠাবা আমাকে। একটা প্রাইভেট ব্যাংকে তোমার জবের ব্যাপারে কথা বলেছি।” এবার আমি আশ্চর্য না হয়ে বরং ব্যথিত হয়েছি খুব। মস্তিষ্ক যদি আমায় ধোঁকায় না ফেলে, তবে আমার ঠিক ঠিক মনে আছে, জেঠু আলিয়া মাদরাসায় পড়েছেন। ব্যাংকে চাকরী করা হারাম, তিনি কি সেটা জানেন না?

এবারে বাঁধ সাধলো আমার বিয়ে নিয়ে। বিয়ের কথাবার্তা চলছিলো তখন। বাসায় পুরুষ ঘটকের নিত্য আনাগোনা। একদিন মাকে ডেকে পরম যত্নে বুঝালাম, “ঘটকদের কেউ তো আমার মাহরাম নয়, আমি তাদের সামনে যাব না।” প্রতিউত্তরে মা নিরবতা অবলম্বন করেছিলেন। আমি ভেবেছিলাম মেনে নিয়েছেন। কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম দ্বীনের পথটা কুসুমকোমল নয়। দুদিন বাদে মায়ের ঘনিষ্ঠ এক বান্ধবী, একজন পুরুষ ঘটক সমেত হাজির হলেন। যথারীতি মা জানালেন, আমায় যেতে হবে। কত কেঁদেছি, অনুনয়-বিনয় করেছি, রাগ দেখিয়েও বলেছি– কাজ হয়নি। বুকের মধ্যে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন হয়েছিল শুধু, “আমার রব, খুব বেশি অভিমান জমা হচ্ছে কিন্তু!”

সেদিন মাঝরাত, জায়নামাজে অশ্রুরা বাঁধ ভেঙেছিল। নিবিষ্ট মনে চেয়েছি আমার ভাইয়ের হিদায়াতটা– “ইয়া রব। আমার জন্য সবটা সহজ করো। আমার ভাইটাকে হিদায়াত দাও। দ্বীনের পথে অবিচল থাকতে খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে আমার। ভাইয়ের সাপোর্ট পেলে কিছুটা কমবে হয়তো।” কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম কুরআনের সেই আয়াত– “তুমি চাইলেই কাউকে হিদায়াত দিতে পারবে না। বরং আল্লাহ যাকে চান তাকেই হিদায়াত দেন।” [১]

প্রায় চার মাস পর কলেজে এলাম। আমাকে দেখে সবাই কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছে। ছেলে সহপাঠীরা রীতিমতো হামলে পড়ল, প্রতিপক্ষ উকিলের ন্যায় জেরা শুরু করল– তাদের কেন আনফ্রেন্ড করে দিলাম, কেন তাদের মেসেজের রিপ্লাই দিই না, কল রিসিভ করি না৷ একজন তো বিলক্ষণ শাসিয়ে দিল, “শিবিরে নাম লিখিয়েছো না? তোমাকে আমি এক হাত দেখে নিব।” আমার অপরাধ– তার প্রেমের প্রস্তাব নাকচ করেছিলাম। একটু ভয়ও পেয়েছিলাম অবশ্য, ছেলেটা ছাত্রলীগের সক্রীয় কর্মী। এখন অব্দি আমি তার চোখের কাঁটা।

দিন কয়েক বাদে, বান্ধবী জানাল সে শপিং এ যাচ্ছে। একটু আবদারের ভঙ্গিতেই বলেছিলাম, “আমার জন্য কিছু মেকাপ কিট আনিস প্লিজ।” সে অবজ্ঞারস্বরে উত্তর করেছিল, “তুই না হুজুর? হুজুররা এই সব ব্যবহার করে? বোরখার নিচে শয়তানি না?” আঘাত পেয়েছিলাম বটে, তবে দমে যাইনি। আমিও শুনিয়ে দিয়েছি, “পর পুরুষকে নিজের সৌন্দর্য দেখিয়ে বেড়ানো হারাম। কিন্তু সাজগোজ তো ইসলামে নাজায়েজ নয়।”

বছর খানেক পরের ঘটনা, একটা অনুষ্ঠান উপলক্ষে  গ্রামে গেলাম। আত্মীয়-স্বজনরা আমার পরিবর্তনের ব্যাপারটা ঠিক হজম করতে পারল না। বড় মামী ফোড়ন কেটে বলল, “পর্দা বাপু আমরাও করি। এ কেমন পর্দার নমুনা?” মাদরাসায় ভর্তির ব্যাপারটা উন্মোচিত হবার পর, রীতিমতো হাসির রোল পড়ে গেল– বুড়ো বয়সে ভীমরতিতে পেয়েছে। আশেপাশের মানুষ, জ্বীনে ধরা রোগীর মতো আমায় দেখে যায়, দুঃখ প্রকাশ করে– মেয়েটা রসাতলে গেল।

অনুষ্ঠানের দিন, সারাটা দিন ধরে না খাওয়া আমি। কোণার একটা রুমে গুটিশুটি মেরে বসে আছি। দয়াপরবশ হয়ে এক কাজিন বলল, “আপনার জন্য এখানে খাবার নিয়ে আসি? আপনি তো ছেলেদের সামনে গিয়ে খাবেন না।” শুনে ভীষণ পুলকিত হয়েছিলাম । কিন্তু সেই খুশি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। মা সাফ জানিয়ে দিলেন, সবার সামনে গিয়েই আমায় খেতে হবে। অগত্যা বাধ্য হয়ে যেতে হলো। জানেন, সেদিন আমার গলা দিয়ে খাবার নামেনি। মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করেছিল। আন্টি আমায় কথা দিয়েছিলেন, গ্রামে গেলে আমার পর্দা নষ্ট হবে না। তবুও যেন যাই। অথচ সেদিন আমি আন্টিকে ঘটনাস্থলের ত্রিসীমানায় দেখিনি। অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরেছিলাম নামের পাশে “অহংকারী” খেতাব সমেত।

যে-ই মেয়ে ছেলে কাজিনদের সাথে আড্ডা দেয় না, খালুদের সামনে গিয়ে কুশল জিগ্যেস করে না, ভগ্নীপতিদের সাথে ঠাট্টা মজাক করে না– সে-ই মেয়ে অহংকারী নয়তো কী!

মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়, দম আটকে আসে৷ “ইয়া মাবুদ, আর তো পারছি না।” পরক্ষণেই মনে পড়ে সাহাবীদের কথা; বিলাল (রা), সুমাইয়া (রা), আবু যর (রা), আমের বিন ফাহিরা (রা), মুসয়াব বিন উমাইর (রা) প্রমুখদের কথা। তাঁদের কষ্টের কাছে তো আমার কষ্টগুলো কিছুই নয়। আমি কীভাবে আকাঙ্খা করি সেই একই জান্নাতে থাকার, যেই জান্নাতে এই মহান মানুষগুলো থাকবেন? অথচ আমার ঈমানের পরীক্ষাগুলো, তাঁদের পরীক্ষার ধারের কাছেও নেই। এতো অল্পতে ভেঙ্গে পড়া আমি, কীভাবে মুখোমুখি হব নারী সাহাবীদের (রা)? আমি ভেঙ্গে পড়ি না, দাঁতে দাঁত চেপে সবর করি। যে-ই অন্তর রবকে চিনেছে, সেখান-টাতে হতাশারা হানা দেয় কী করে?

দ্বীনের এই কণ্টকাকীর্ণ রাহে, আপনি একাই কিন্তু মুসাফির নন। নিভৃতে, লোকচক্ষুর অন্তরালে কতশত আল্লাহর বান্দা/বান্দী নিত্যদিন সংগ্রাম করে যাচ্ছে। নিজের চারপাশটায় সবরের মজবুত এক ভিত গড়ে তুলুন। লোকের অবজ্ঞাসূচক কথামালা যেন সবরের সেই পাহাড়টিকে টপকে, আপনার অন্তর অব্দি পৌঁছাতে না পারে। অন্তরকে বরং আল্লাহ স্মরণে ব্যস্ত রাখুন; তার যে সেটাই কাজ। আর হিয়ার মাঝে গেঁথে নিন, “অতঃপর সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।” [২]

তথ্যসূত্রঃ
[১] সুরা কাসাস -৫৬
[২] সুরা বাকারাহ -১৫৫

~ মারইয়াম শারমিন

 

Facebook Comments

Related posts

নীড়ে ফেরার গল্প-২৪ | ফাহিম দানিয়াল

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-১১ | আমাতুল্লাহ মেহেরুন্নেসা

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-৮ | উম্মে যুহাইর

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!