সংকলন
সৈয়দ ইব্রাহিম আনোয়ার শিবলী
প্রতিযোগিতা-২

নীড়ে ফেরার গল্প-২১ | সৈয়দ ইব্রাহিম আনোয়ার শিবলী

∞ হঠাৎ ঘুরে দেখা 
(নামকরণের ব্যাখ্যা :- ফিরে দেখা আর ঘুরে দেখার মধ্যে পার্থক্য অনেক। আমরা ফিরে দেখি সাধারণত ঘাড় বাঁকা করে পিছনে তাকিয়ে। সেক্ষেত্রে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা বা স্থির থাকা যায় না, কিন্তু আমরা যদি পুরোপুরিভাবে ঘুরে তারপর দেখি সেক্ষেত্রে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি। ঠিক তেমনি এই ক্ষুদ্র জীবনে অনেকবারই মহান রবের দিকে ফিরে দেখেছি কিন্তু বেশি সময় স্থির থাকতে পারিনি তাই এইবার না হয় পুরোপুরি ঘুরেই তাকাই যেন আমৃত্যু মহান রবের দিকেই শুধু তাকিয়ে থাকতে পারি। এটাই আমার নামকরণের উদ্দেশ্য।)

তিজারাহ শপএইবার মূল কথায় ফিরি ↓

সময়টা ছিল ২০১৭। আমার বয়স তখন ২৫। মোটামুটি শুক্রবারের নামাযের প্রতিই ভালোবাসাটা বেশি ছিল আর অন্যদিনের নামাযগুলো খুব একটা বেশি পড়া হত না তবে রমযানের রোজাগুলো আলহামদুলিল্লাহ্ কখনো মিস হত না জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কিন্তু ওই যে নামাযটা অনিয়মিত ছিল!! কেমন জানি সব জানতাম বুঝতাম, অন্যকেও মাঝে মধ্যে বুঝাতাম কিন্তু নিজে সবসময় তা ধরে রাখতে পারতাম না। হুট করে নামায সব পড়ব সিদ্ধান্ত নিতাম কিন্তু কিছুদিন পরেই আবার আগের জায়গায় আর এটাই ছিল আমার ফিরে দেখা যা কিনা স্থায়ী ছিল না। যাই হোক এরপর হঠাৎ একজনের সাথে পরিচয় তারপর অনেক ঘাট পেরিয়ে বিয়ে। সেও আমার মত ছিল ধর্মের বিষয়ে। তারপর আমাদের মাঝে আসতে যাচ্ছিল নতুন মেহমান। অবশ্য এর কিছু আগে থেকেই আমরা প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামায পড়া শুরু করি কিন্তু অতটুকুতেই শেষ আমাদের ধর্ম পালন। আমার বিবি (স্ত্রী) ধিরে ধিরে নামাযে ঝুঁকতে থাকে। নামাযের পর মোবাইলে কুর’আন তেলাওয়াত করত (বাসায় রাখার জায়গা ছিল না বলে “কুর’আন মাজীদ” ছিল না) আর আমাকে বলত যেন আমিও একটু তেলাওয়াত করি। আর ঠিক তখনই আমার মাথায় পড়ত আকাশ ভেঙ্গে কেননা সর্বশেষ ৮-১০ বছর কুর’আন পড়াই হয়নি যার জন্য প্রায় সব ভুলেই বসে ছিলাম। তাই তখন আমার উত্তর থাকত যে আমার পড়াগুলো তুমিই পড়ে দাও আর তার রিপ্লাই ছিল বিরক্তি মাখা মুখ। যাক তাও তো বেঁচে যেত ইজ্জত। তখন মোবাইলের প্রতি আসক্তিটা ছিল যা এখনও আছে। আমি আমার হেয়ার ট্রিমার নিয়ে যখনই দাড়ি ছোট করার জন্য বের হতাম তখনও তার বিরক্তি মাখা মুখ আর ফিরে আসার পর দীর্ঘক্ষণ কথা না বলা এভাবেই চলতো। তার চাওয়া ছিল আমি যেন দাড়ি রেখে দেই তাহলে সেও সম্পূর্ণ পর্দানশীন হয়ে যাবে শুধুমাত্র হিজাব পড়া ছেড়ে দিয়ে। নতুন মেহমান আসার পূর্বের শেষ ৩ মাসে চলে অনেক কিছু। দীর্ঘ লকডাউনের জন্য দুজনে ৫ ওয়াক্ত নামায একসাথে বাসায় আদায় করা, তাহাজ্জুদ পড়া আলহামদুলিল্লাহ্ সব ভালোই চলছিল। এর মাঝে আমার এক সহকর্মীর কোভিড-১৯ শনাক্ত হওয়ার ফলে আমাকে হোম কোয়ারেন্টাইনে যেতে হয়। তখন শুধু সারাক্ষণ তারা কান্না আর কান্না। আমি তাকে বলি সে যেন আমার থেকে দূরে থাকে কিন্তু সে উল্টো আমার বুকের ভেতর ডুকে কান্নাকাটি করত। মানে এমন একটা অবস্থা যেন আমি আর বেশি দিন বাঁঁচবো না। যাক পরবর্তীতে আমার পরীক্ষায় করোনা নেগেটিভ আসলে তার চোখে মুখে আনন্দটা আমি দেখতে পাই যদিও আমাকে বুঝতে দিতে চাইত না। এমন অনেক কিছু ছিল যেমন সে চাইত আমি যেন দাড়ি রেখে দিয়ে পাঞ্জাবী-টুপি পড়া শুরু করি আর আমি ভাবতাম এই বয়সেই?? আরো কিছুটা সময় যাক-

অতপর তার এতো বলার পর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে মেহমান আসার পর থেকেই দাড়ি আর কাটা হচ্ছেনা ইনশাআল্লাহ্, পুরোপুরি ইসলামী আকিদায় চলে আসব ২ জন মিলে। এরপর হঠাৎ একদিন রাত আনুমানিক ১১ টায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করি আর সারারাত আমি পায়চারি করতে থাকি হাসপাতালেই, পরদিন সকাল ৮.৪০ মিনিটে আমাদের দুজনের আদরের কন্যা সন্তান “সৈয়দা সুবাইতা জাহান আরওয়া” পৃথিবীতে আসে। তার পূর্বের ইচ্ছানুযায়ী বাচ্চাকে আমার কাছে বাহিরে পাঠিয়ে দেয় তার দুই কানে আযান আর ইকামাত দেয়ার জন্য। এর ৩০ মিনিট পরেই সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে আর আমার সামনেই ৪ ঘন্টা ৫০ মিনিট মৃত্য যন্ত্রনা ভোগ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। আমি নিজেও পেশায় একজন ডিপ্লোমা ডাক্তার কিন্তু সেদিন আমি অসহায় ছিলাম। তখনই আমার মাথায় এলো যে এই দুনিয়া আসলেই আরাম আয়েশের চিরস্থায়ী জায়গা না। আমার চোখের সামনেই আমার কলিজার একটা টুকরো, আমার প্রিয় মানুষগুলোর একজন যে গর্ভবতী অবস্থায় সবচেয়ে সুস্থ একজন মানুষ ছিল, কিছুক্ষণ আগেও যার নিজের এবং কাছের মানুষের মাথায় ছিল না এই বিষয়টা যে আর কিছুক্ষণ পরেই তাকে চলে যেতে হবে- চলে গেল ঠিক দুপুর ১.৩০ এ আমাকে ছেড়ে তার আদরের মেয়েকে ছেড়ে। যেই মেয়ের লাথিতে সে রাতে ঘুমাতে পারত না কিন্তু তারপরও বিন্দুমাত্র অভিযোগ ছিল না। আর তখন আমার মাথায় প্রথম যে চিন্তা আসে সেটি ছিল – আমি খারাপ হয়ে যাব। একদম খারাপ। সব খারাপ অভ্যাসে নিজেকে ডুবিয়ে দিব। কিন্তু আমার মহান আল্লাহর রহমত ঠিক তখনই আমার মনে হল যে এতে কি লাভ?? আমার বিবির সাথে আমি দুনিয়ার জীবনে থাকতে পেরেছি ২ বছর ১ মাস ১৫ দিন মাত্র যেখানে দুজেনরই ইচ্ছে ছিল অনেকটা সময় একসাথে থাকার। তাই আমি ভাবলাম যে আমাকে মহান রবের দিকে আসতে হবে, আসতেই হবে আর তাতেই আমি আমার বিবির সাথে ইনশাআল্লাহ্ অনন্তকাল থাকতে পারব জান্নাতে। তার দেয়া আমানতটাও তো আমাকে রক্ষা করতে হবে নাকি!!আলহামদুলিল্লাহ্ সে যেটার জন্য খুব রাগারাগি করত আজ আমি তাই

সে চলে যাওয়ার আজ ৯৮ দিন (১৫.১২.২০২০)। আজ পর্যন্ত আমি আমার দাড়িতে হাত দেয়নি ছোট করার জন্য। তাকে দাফনের আগে যেই পাঞ্জাবী পড়া শুরু করেছি আলহামদুলিল্লাহ্ আজ পর্যন্ত তা চলমান আর সাথে টুপিও। আমার মহান রব যদি আমাকে কবুল করেন এখন এই একটাই চাওয়া। আর আফসোস আজ আমার এই চলা ফেরার ভিন্ন ধরন সে দেখে যেতে পারল না। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন আমার জানটাকে শহীদের মর্যাদা দান করে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন। তার এই হঠাৎ চলে যাওয়ায় আমার মনে হল আমার আল্লাহ্ আমাদের দুজনকেই পছন্দ করেছেন তাই তাকে শহীদি মৃত্যু দিয়ে আমাকে ফিরিয়েছেন শ্বাশত সেই পথে। যেই পথই আসল পথ অথচ আমরা দুনিয়ার টানে তা ভুলে থাকি।

তাই শিরোনাম দিয়েছি এটাই – “হঠাৎ ঘুরে দেখা”।

তার হঠাৎ চলে যাওয়ার ফলেই হঠাৎ ঘুরে দেখেছি মহান রবের দিকে, তাই ধন্যবাদ আমার প্রিয়তমাকে আমার কন্যার আম্মুকে। ইনশাআল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন আমাদের আবার এক করবেন অনন্ত জীবনে।

আসসালামু আলাইকুম।

Facebook Comments

Related posts

নীড়ে ফেরার গল্প- ৪০ | উজায়ের আহমদ

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-৮ | উম্মে যুহাইর

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-৩২ | মারইয়াম শারমিন

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!