আমার মনের কোণে উঁকি দেয়া চারটি মাত্র প্রশ্ন ও একটি বাক্যের সমন্বয় আমার দ্বীনে ফেরার অন্যতম কারণ। শুনতে অদ্ভুত শোনালেও এটাই সত্য। একজন সত্যান্বেষী মানুষের সত্যের সন্ধান পেতে হলে সবার আগে এই প্রশ্ন গুলোর সঠিক উত্তর অনুধাবন প্রয়োজন। এই প্রশ্নগুলো নিয়ে গভীর ভাবনার ফলে আমাদের শরীরে যেমন কাঁটা দিয়ে ভিন্ন এক অনুভূতির যোগান দেয়, ঠিক তেমনি ভাবে আমাদেরকে পৌঁছে দেয় শাশ্বত সত্যের দ্বারপ্রান্তে। মানবজাতির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা আবশ্যক। আজ আমি নিজে থেকে প্রশ্নগুলোর কোন উত্তর দেব না, কারণ আমি চাই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রত্যেকেই তার নিজ বিবেক বুদ্ধি খাটিয়ে উপলব্ধি করুক; যেমনটা আমি নিজে করেছিলাম। ফলাফল হিসেবে বিশ্বাসের বন্ধদ্বার খুলে যাবে ইন শা আল্লাহ্। প্রশ্নগুলো হচ্ছে,
- কোথায় ছিলাম?
- কোথায় আছি?
- কেন এসেছি?
- সর্বশেষ, কোথায় যাব?
আর যে সাধারণ বাক্যটির কথা বললাম, সেটার ভিত্তিতেই এই প্রশ্নগুলোর যথার্থ উত্তর উপলব্ধি সম্ভব। কেউ যদি সেই বাক্য ব্যতিরেকে প্রশ্ন চারটির সঠিক ও গ্রহণযোগ্য উত্তর উপলব্ধি করতে পারে কিংবা প্রশ্নগুলোর মধ্যে নিহিত গভীরতা অনুধাবন করতে পারে তবে তার দ্বীনে ফেরা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই চারটি প্রশ্নের অভিভাবক বাক্যটি হচ্ছে,
“প্রত্যেকটি কর্মের পেছনেই সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বিদ্যমান।”
এই বার আমাদের কাজ হচ্ছে, প্রশ্ন গুলো পুনরায় একবার পাঠ করা। প্রশ্ন পাঠ শেষ করে বাক্যটির মর্মার্থ উপলব্ধির চেষ্টা করা। মূলত এই বাক্যটিকে সামনে রেখেই আমাদের নিজেদের নতুন ভাবে খুঁজে পেতে হবে। আরেকবার গভীর ভাবে ভাবতে হবে প্রথম প্রশ্নটি। কোথায় ছিলাম আমি? এই প্রশ্নের মধ্য থেকে আরও কিছু পরস্পর সম্পর্কযুক্ত প্রশ্নের জন্ম হয়। সেগুলো হচ্ছে, যেখানে ছিলাম সেখানে আমার অস্তিত্ব কেমন ছিল? সেখানে কী অন্ধকার নাকি আলো? সেখানে কি সময়ের অস্তিত্ব আছে? সেখানেও শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়? এই প্রশ্ন গুলোর মাধ্যমে মূল প্রশ্নটির গভীরতা উপলব্ধি ও অনুধাবন করতে হবে।
একই ভাবে দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে, এখন আমি কোথায় আছি? এখানেও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত কিছু প্রশ্নের উদ্ভব হয়। এই নশ্বর পৃথিবী কী? এই নশ্বর পৃথিবীর পেছনের উদ্দেশ্য কী? এমন সুগঠিত, সুনিয়ন্ত্রিত পৃথিবীর সৃষ্টির রহস্য কী? তৃতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে, কেন এসেছি? এই দুই দিনের দুনিয়ায় আমরা কেন এসেছি? আমাদের এখানে আসার পেছনে মূল উদ্দেশ্যই বা-কী? এখানে আমাদের কাজ কী? আমারা কী কারও কাছে দায়বদ্ধ? সর্বশেষ এবং চতুর্থ প্রশ্নটি হচ্ছে, শেষমেশ আমরা কোথায় যাব? পৃথিবীর জীবনাবসানের পর আমাদের অবস্থান কী হবে? পৃথিবীতে জন্মের আগে যেখানে ছিলাম মৃত্যুর পর যেখানে যাব দুটো কী একই স্থান? কেমন সেই স্থান? কেমন সেখানের পরিবেশ? কিংবা সেখানে কি আমাদের অস্তিত্ব আছে? তবে সেই অস্তিত্বের ধরন কেমন? প্রথম প্রশ্নটির ন্যায় সেখানেও কী আলো না অন্ধকার? সেখানে কী সময়ের অস্তিত্ব আছে? সেখানে কী প্রাণ আছে নাকি অন্যকিছু? এই সবগুলো প্রশ্নের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্বের স্বরূপ উপলব্ধি করতে হবে। অনুধাবন করতে হবে নিজেকে, নিজের জন্মের পেছনের সুগভীর উদ্দেশ্যকে।
একজন সত্যান্বেষী মানবের জন্য উপরোক্ত প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর সঠিক ভাবে অনুধাবন ও উপলব্ধি তাকে বিশ্বাসী করে তুলতে সক্ষম। এই প্রশ্ন গুলো আমাদেরকে দুনিয়ার সকল মোহ ভুলিয়ে স্রষ্টা ও তার সৃষ্টি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করবে। একজন মানুষ যদি অবিশ্বাসীও হয়, তাকে একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে যেতে হয়। তার ভাবনা সেখানে সম্পূর্ণ রূপে স্থবির হয়ে যায়। সেখানে সে খুঁজে পায় এক অতীব শক্তিশালী সত্ত্বার অস্তিত্ব। যে সত্ত্বার অস্তিত্ব ভিন্ন সম্পূর্ণ নভোমণ্ডলকে কল্পনাও করা যায় না। আজকের আধুনিক বিজ্ঞান পর্যন্ত সেই সুপার পাওয়ারের স্বরূপ বাতলে দিতে অপারগ। এই সুপার পাওয়ারের বিষয়ে বিজ্ঞান শুধুমাত্র অনিশ্চিত কিছু ধারণা দিতে পারে। সেই সুপার পাওয়ারকে নিত্য নতুন নামে নামকরণ করতে পারে; কিন্তু এর পেছনের রহস্য বলতে পারে না।
বলা-বাহুল্য, আজকের বিজ্ঞান নয় কিছু পথভ্রষ্ট বিজ্ঞানী উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে স্রষ্টাকে নাকচ করার জন্য যে সকল থিয়োরির অবতারণা করে সেগুলো কেবল এক একটা থিয়োরি। কোনটাই প্রমাণিত প্রতিষ্ঠিত সত্য নয়। যেমন পৃথিবী সৃষ্টির রহস্য হিসেবে বিগ ব্যাং থিয়োরির কথা বলা হয়। এই থিয়োরির অগণিত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্যেও তারা সেই সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করে না। এটাকেই সর্বেসর্বা হিসেবে প্রচার করে এবং এর মাধ্যমেই স্রষ্টার অস্তিত্বকে নাকচ করে। একই শ্রেণীর বিজ্ঞানীরাই আবার স্রষ্টার অস্তিত্বকে নাকচ করে দেয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে না পারার অজুহাতে। অথচ বিজ্ঞানের অনেক থিয়োরি ক্যাবল একটি ধারণা যা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। আমি বলছিনা সব কিছুই মিথ্যা, মূলত একটি বিষয়কে সামনে এনে অগণিত সত্যকে লুকিয়ে রাখা অবশ্যই অন্যায়। সেই সকল বিজ্ঞানীর থিয়োরি গুলো এক একটা ধারণা কিন্তু স্রষ্টার অস্তিত্ব একটি বিশ্বাস। কোনটা বেশি শক্তিশালী ধারণা নাকি বিশ্বাস?
এক শ্রেণীর মানুষ স্রষ্টাকে না দেখে বিশ্বাস করার জন্য বিশ্বাসীদের ধর্মান্ধ কিংবা অন্ধবিশ্বাসী হিসেবে অবহিত করে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিজ্ঞান মনস্ক সেই একই শ্রেণী কি তাদের সেই সকল থিয়োরিকে ল্যাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করতে পারে? যদি না পারে তবে তারা কি বিজ্ঞানের অন্ধ ভক্ত নয়? আধুনিক বিজ্ঞানের এই সকল তথ্য উপাত্ত একজন নিরপেক্ষ ও সঠিক বিবেকবোধ সম্পন্ন সত্যান্বেষী মানুষকে কোন ভাবেই সন্তুষ্ট করতে পারে না। একজন মানুষ উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর অনুধাবন ও নিরপেক্ষ ভাবে উপলব্ধি করতে পারলে ইন শা আল্লাহ্ আশা করা যায় সে হিদায়াতের মতো অমূল্য সম্পদ প্রাপ্ত হবে। মানুষের মধ্যে সৃষ্ট গোমরাহি নেতিবাচক ভিন্ন কখনই ইতিবাচক কিছু দিতে পারেনা। সত্য চোখের সামনে উন্মুক্ত হওয়া সত্যেও তা অস্বীকার করাই গোমরাহি ও প্রকৃত অন্ধবিশ্বাসী।
উপরোক্ত প্রশ্নগুলো আমাকে দ্বীনে ফিরতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। অগণিত ফিতনার এই যুগে দ্বীনে ফেরাটাই শেষ কথা নয়। দ্বীনে ফেরার সাথে সাথে শুরু হয় এক ভিন্ন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ দ্বীনের উপর অটুট থাকার যুদ্ধ, বিশ্বাসকে অধিকতর শক্তিশালী করার যুদ্ধ। এই যুদ্ধ ঈমান ও আমলের। আমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ ভাবে নিজের মধ্যে ধারণ করার যুদ্ধ। আমি দ্বীনে ফেরার পর থেকে যত ধরনের প্রতিবন্ধকতায় পতিত হয়েছি সেগুলোকে প্রথমত দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
- সামাজিক প্রতিবন্ধকতা
- আমল কেন্দ্রিক বিভাজন সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতা
সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে পরিবার, বন্ধুমহল, সমাজ ও দেশ। বর্তমান সময়ে নবী (ﷺ)-এর সুন্নাতি লেবাস ধারণ করা অসম্মানজনক, ক্ষ্যাতের পরিচায়কও বটে। আজকের সমাজে টাকনুর উপর কাপড় পরিধান করা জঙ্গিবাদের লক্ষণ। আর এসকল সার্টিফিকেট বিলি করে বেড়ায় তথাকথিত মুক্তমনা ও সংস্কৃতি-মনা গোষ্ঠী। অন্যদিকে পরিবার সমাজ যে দ্বীনে ফেরাকে খুব ইতিবাচক ভাবে দেখে এমনটাও নয়। অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়, বর্তমান সময়ে দ্বীন পালনের ক্ষেত্রে সর্ব প্রথম এবং প্রধান বাঁধা আসে নিজ পরিবার থেকে। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই আমার জীবন রেখা নেতিবাচক দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে। ফ্রি মিক্সিং, ধূমপান, পরনিন্দা, পরচর্চা, গান বাজনা ইত্যাদি যা ইচ্ছে তা একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়। পহেলা বৈশাখের মতো অনুষ্ঠানের আয়োজক পর্যন্ত ছিলাম আমি। বিগত জীবনে যে আমি ধূমপানের গন্ধ সহ্য করতে পারতাম না সেই আমি ধূমপান পর্যন্ত করেছি। আল্লাহ্ সুবাহানাহু তাআলা আমার জাহিলিয়াত জীবনের গুনাহ গুলোকে মাফ করুক। যেদিন থেকে দ্বীন সম্পর্কে সচেতন হওয়া শুরু করেছি সেদিন থেকেই দাড়ি সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছিলাম। কারণ অল্পবিস্তর পড়াশোনায় জানতে পেরেছিলাম, দাড়ি ওয়াজিব পর্যায়ের ইবাদত। অর্থাৎ দাড়ি না রাখলে গুনাহগার হতে হবে। আমার দাড়ি রেখে দেয়ার পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অবশ্যই আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন। এই উদ্দেশ্যের পাশাপাশি কিছু গৌণ বিষয়ও জড়িত ছিল। তার মধ্যে অন্যতম ছিল, ধূমপান ত্যাগ করা। যা আমি শুরুই করেছিলাম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রঙিন ও স্বাধীন দুনিয়ায় পদার্পণের মাধ্যমে। একাধিক বার ধূমপান ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলাম। আমি আমার জাহিলিয়াতের সময়ে ধর্মীয় বিধিনিষেধ পরিপূর্ণ ভাবে পালন করলেও নীতি নৈতিকতার ব্যাপারে সদা সতর্ক ছিলাম। ফলে আমি ভেবেছিলাম, মুখ ভর্তি লম্বা লম্বা দাড়ি নিয়ে অন্তত জনসম্মুখে ধূমপান করার মতো ঘৃণ্য কাজ আমি করতে পারবো না। আমার বিবেক অবশ্যই আমাকে এমন কাজে বাঁধা দেবে।
এর বাইরে মূলত পরিপূর্ণ দৃষ্টির হেফাজত, মেয়ে বন্ধুদের থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে গুঁটিয়ে নেয়া, পরনিন্দা, পরচর্চা, গানবাজনা সহ যাবতীয় সকল হারাম ত্যাগ করে আল্লাহ্ প্রদত্ত হালালের দিকে ঝুঁকে যাওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। এই সকল হারাম থেকে নিজেকে রক্ষার জন্যই দাড়ি লম্বা করতে শুরু করি। আমার এই বিশ্বাস ছিল সমাজের সকলের সামনে মুখ ভর্তি সুন্নাতি দাড়ি নিয়ে এমন কোন হারাম কাজ আমি করব না যার ইসলামকে নেতিবাচক ভাবে প্রতিনিধিত্ব করে। ইসলামকে কলুষিত করার অধিকার আমার কেন এই পৃথিবীর কারও নেই। আমার এই ভাবনা শতভাগ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল। একমাত্র দাড়ির মর্যাদা রক্ষার জন্যই ধূমপান সহ বহুবিধ পাপাচার থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ্।
অল্প কিছু দিন অতিবাহিত হওয়ার পর দাড়ি মোটামুটি একটা পর্যায়ে চলে আসে। এরপর শুরু হয়, ভার্সিটির বন্ধুদের তির্যক মন্তব্য, ও কটাক্ষ করার এক বিকৃত প্রতিযোগিতা। এমন কাজ যে সবাই করেছে তা নয়। কাছের অনেক বন্ধু আমাকে আমার মতো থাকার সুযোগ করে দিয়েছিল। আমি তাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি। সকলের হিদায়াতের দুআ করি। এর বাইরে কেউ কেউ চাচা বলে পর্যন্ত সম্বোধন করত। এমনকি কেউ কেউ আমার এই পরিবর্তনের পেছনের উদ্দেশ্য খুঁজেছে। কোন সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছি কী-না জানতে চেয়েছে। আমার উত্তর ছিল, উদ্দেশ্য তো অবশ্যই আছে; অনন্ত কালের জন্য চির প্রত্যাশিত জান্নাত লাভের উদ্দেশ্যেই আমার এই পরিবর্তন। এই পরিবর্তন সময় থাকতে প্রতিটি মানুষের হওয়া উচিৎ। এখন মাঝে মাঝে চিন্তা করি, সংগঠনের ব্যাপারে তখন বলা উচিৎ ছিল, আমার পক্ষে যদি সম্ভব হতো তবে নবীজি (ﷺ)-এর হিলফুল ফুজুল অঙ্গীকার নামার অংশ হতাম। ভার্সিটির বন্ধুদের এমন বহুবিধ তির্যক মন্তব্য গাঁয়ে মাখাতাম না। শুধু আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করতাম অগণিত বিপথগামীর মধ্যে আমি তো সঠিক পথের সন্ধান পেয়েছি এই বা কম কীসে? আলহামদুলিল্লাহ্।
আমার জীবনে মূল সমস্যার সূত্রপাত হয় দ্বীনে ফেরার বেশ কিছুদিন পর। তখন আমার লম্বা লম্বা দাড়ি ও পোশাক পরিচ্ছেদ পরিধানের ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন চলে এসেছিল। রমজানের লম্বা ছুটিতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় ফিরি। সেদিন আব্বা আম্মা বেশ অবাক হয়েছিলেন, তবে তেমন কিছুই বলেন নি। হয়ত, এতদিন পর বাসায় ফেরাটাই তখন তাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছিল। আদতে এই কোন কিছু না বলার অভিপ্রায় একদম থেমে থাকেনি। দুদিন যেতে না যেতেই আব্বা বললেন, “এখন কি তোমার দাড়ি রাখার বয়স?” সরাসরি বলা সম্ভব না হলেও বারং বার চুল কাঁটার কথা কিংবা অন্যকিছু বলে ইনিয়ে বিনিয়ে দাড়ি কাঁটার দিকে ইঙ্গিত করতেন। আলহামদুলিল্লাহ্ কেউ আমাকে দাড়ি কাঁটার ব্যাপারে জোর করেননি। তারপরও আমি তাদের পরোক্ষ ইঙ্গিতে দমে যাওয়ার পাত্র নই। যত কিছুই হোক আমার পক্ষে আল্লাহ্ প্রদত্ত ওয়াজিব বিধান ত্যাগ করা সম্ভব নয়।
পিতামাতার মান্য করা তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করা আল্লাহ্ ও তার রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশ। মহান আল্লাহ্ তাআলার ইবাদত করা যেমন ফরজ তেমনি ভাবে পিতামাতার খেদমত করা, তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করাও ফরজ। আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে বলেন,
“আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল।[১]”
আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (ﷺ)-কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেন,
“হে আল্লাহ্র রাসূল, কোন ব্যক্তি আমার কাছে সর্বাধিক সদ্ব্যবহারের হক্বদার? তিনি বললেন, তোমার মা, লোকটি বলল তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা, লোকটি আবার বলল তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা, লোকটি পুনরায় বললেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার পিতা।[২]”
উপরোক্ত কোরআনের আয়াত ও হাদিস দ্বারা পিতামাতার মর্যাদা প্রমাণিত। এমনকি পিতামাতা যদি বিধর্মীও হয় তবুও তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ এসেছে। কোন অবস্থাতেই তাদের সাথে অসদাচরণ করা যাবে না। যেকোনো মূল্যে তাদেরকে তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। এই ফয়সালা আল্লাহ্ ও তার রাসূল (ﷺ)-এর।
পিতামাতাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের পাশাপাশি তাদের নির্দেশ উপেক্ষা করার বিধানও ইসলামে আছে। আমাদের পিতামাতা যখন দ্বীনের সাথে সাংঘর্ষিক এবং অনৈতিক কোন কিছু করতে বাধ্য করে কিংবা নির্দেশ প্রদান করে তখন তাদের অমান্য করাও বৈধ। আল্লাহ্ সুবাহানাহু তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন,
“তোমার পিতামাতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার অংশীদার স্থির করার জন্য যার জ্ঞান তোমার নেই, তবে তুমি তাদের কথা মানবে না। কিন্তু পৃথিবীতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করবে। যে আমার অভিমুখী হয় তার পথ অনুসরণ করবে। অতঃপর আমারই নিকট তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব তোমরা যা করছিলে।[৩]”
আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সৎ কাজের অনুসরণ ও অসৎ কাজের প্রসঙ্গে বলেন,
“অসৎ কাজে আনুগত্য নয়, আনুগত্য কেবল সৎ কাজের ক্ষেত্রেই হতে হবে।[৪]”
অনৈতিক কিংবা দ্বীনের সাথে সাংঘর্ষিক কর্মে আদেশ প্রসঙ্গে হাসান বসরী (রহ). বলেন,
“যদি মা সন্তানের প্রতি মায়া দেখিয়ে ঈশার জামাতে শরিক হতে বারণ করে তাহলে এ ক্ষেত্রে তাঁর আনুগত্য করা যাবে না।[৫]”
ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল,
“বাবা যদি সন্তানকে জামাতে নামায আদায় করা থেকে নিষেধ করে তাহলে কী করবে? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, এ জাতীয় ক্ষেত্রে বাবার কথা অমান্য করবে।[৬]”
তাঁকে আরও জিজ্ঞেস করা হয়েছিল,
“এক ব্যক্তি তাঁর সন্তানকে আদেশ করেছে যে, ফরয নামায ছাড়া কোনো নামায পড়বে না। এখন সন্তানের করণীয় কী? তিনি উত্তর দিয়েছেন, এই হুকুম অমান্য করবে এবং নফল পড়বে।[৭]”
এই আলোচনা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার সেটা হচ্ছে, দ্বীন ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কোন বিষয় যেমন ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত কিংবা নফল ইবাদাতও যদি পিতামাতা ত্যাগ করতে বলে তবে তাদের এই অনৈতিক আদেশ অমান্য করা জায়েজ রয়েছে। সেই সময় আমিও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলাম, দাড়ি রাখার ক্ষেত্রে আমি কোন প্রকার ছাড় দিবো না। এরফলে, বাসায় আসার কয়েকদিন যেতে না যেতেই আব্বা বুঝে গেলেন, কোন ক্রমেই আমি দাড়ি কাটব না। সেই সময় আমার সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব ততটুকু করে বাকিটুকু মহান রবের উপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। আল্লাহ্ কাউকে হতাশ করেন না; আমাকেও করেননি। এক আংকেলের সামান্য সমর্থনের ফলে আমার দাড়ি পাকাপোক্ত হয়ে যায়। আলহামদুলিল্লাহ্।
পরিবারের পর আমি সবচেয়ে বড় যে বাঁধার সম্মুখীন হয়েছিলাম নিজ এলাকার বন্ধুমহল থেকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যেকোনো বন্ধুমহল এমন পরিবর্তন সহজ ভাবে মেনে নিতে পারে না। এটা সত্য কেউ কেউ খুশি হয়, কিন্তু সেক্যুলার বন্ধুমহলে এই সংখ্যাটা নিতান্তই সামান্য। আবার এমন কেউ কেউ রয়েছে যারা খুশি হওয়ার অভিনয় করে যায়। এমনটা আমার ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। সময়ে অসময়ে খোঁটা দেয়া ছিল তাদের নিত্য দিনের ব্যাপার। “খুব হুজুর হইছো না? দেখব তোমার হুজুর-গিরি কতদিন থাকে?” এমন কথাবার্তা পর্যন্ত শুনতে হয়েছিল আমার বাল্যকালের বন্ধুদের কাছ থেকে। আমার বন্ধুমহলের অনেকেই দ্বীনে ফেরার পর ভিন্ন ভিন্ন নামকরণের মাধ্যমে আমার ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতে শুরু করে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেঃ হুজুর, ভণ্ড, দরবেশ, জঙ্গি, শিবির, পীর, আউলিয়া ইত্যাদি অনেক কিছু। সদ্য দ্বীনে ফেরার পর এই ব্যাপারগুলো আমার তীব্র মনঃকষ্টের কারণ হয়ে ওঠে।
এই সকল বিকৃত নাম কোন ভাবে হজম করে নিলেও একটি বিষয় কোন ভাবেই হজম করা সম্ভব হয়নি। একজন মুমিন মাত্রই গুনাহ কে ভয় পায়, আল্লাহ্র কাছে গুনাহর জবাবদিহিতাকে আরও অনেক বেশি ভয় করে। আমিও প্রতিনিয়ত এলাকার বন্ধুমহলের সাথে থেকে গুনাহর সাগরে ডুবে যাওয়া কোনক্রমেই মেনে নিতে পারছিলাম না। বলা-বাহুল্য, বর্তমান সময়ের বন্ধুমহলে আড্ডার নামে চলে নারী দেহের রসালো আলোচনার সমাহার। একে অন্যকে হেনস্থা করা কিংবা কথায় কথায় অকথ্য গালাগালের পসরা সাজিয়ে বসা যেন নিত্য দিনের ব্যাপার। এই সকল বন্ধুমহলের আড্ডা যেন গীবত, পরনিন্দা, পরচর্চা ছাড়া জমেই উঠে না। ব্যাপারটা এমন, কেউ যেন আমাকে ময়লার ভাগাড়ে নিক্ষেপ করেছে, আমি সেই ভাগাড়ে অবস্থান করেই নিজেকে নোংরা থেকে রক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা করছি। কয়েকদিন যেতে না যেতেই বুঝতে পারছিলাম আমি দিন দিন গুনাহর সাথে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছি।
আল্লাহ্ এমন সকল বন্ধুদের ব্যাপারে বলেন, শেষ বিচারের দিন অনেক মানুষ আফসোস করে বলবে,
“হায় আমার দুর্ভোগ, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। অবশ্যই সে তো আমাকে উপদেশ বাণী থেকে বিভ্রান্ত করেছিল, আমার কাছে তা আসার পর। আর শয়তান তো মানুষের জন্য চরম প্রতারক।[৮]”
অন্যত্র এক স্থানে মুত্তাকী অর্থাৎ আল্লাহ্ভীরু বন্ধু সম্পর্কে ঘোষণা এসেছে। তিনি বলেন,
“সেদিন বন্ধুরা একে অন্যের শত্রু হবে, মুত্তাকীরা ছাড়া।[৯]”
শেষ বিচার দিবসে এই সকল দ্বীন বিমুখ বন্ধুরা একে অন্যের শত্রুতে পরিণত হবে। কেউ কারও কাজে আসবে না; বরং ধ্বংসের কারণ হবে। কোন মানুষ জেনে শুনে এই দুর্ভাগাদের দলভুক্ত হতে চায় না। আমিও চাই না।
বন্ধুর দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার প্রসঙ্গে আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
“মানুষ তার বন্ধুর রীতি নীতির অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকের খেয়াল রাখা উচিত সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে।[১০]”
অর্থাৎ মানুষ আচার-আচরণ, বাহ্যিক ও আত্মিক সকল বিষয়ে ব্যাপক ভাবে বন্ধুর দ্বারা প্রভাবিত হয়। অন্য এক হাদিসে সৎ ও অসৎ বন্ধুমহল সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
“সৎ ও অসৎ বন্ধুর উদাহরণ আতর বিক্রেতা ও কামারের ন্যায়। আতর বিক্রেতা হয়তো তোমাকে একটু আতর লাগিয়ে দেবে, অথবা তুমি তার কাছ থেকে আতর ক্রয় করবে, অথবা তুমি তার কাছে আতরের ঘ্রাণ পাবে। আর কামার হয়তো তোমার দেহ বা কাপড় পুড়িয়ে দেবে নয়তো তার কাছ থেকে খারাপ গন্ধ পাবে।[১১]”
এই হাদিস দুইটির সত্যতা আমি আমার নিজ জীবনে অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। আমার বন্ধুমহলের অনেকেই জেনে অথবা না জেনে মোডারেট চিন্তা-চেতনা লালন করে করে। এমনকি, কেউ কেউ সংশয়বাদের অন্ধকার জগতেও ইতিমধ্যেই প্রবেশ করে ফেলেছে। কয়েকদিন যেতে না যেতেই আমি তাদের চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হতে শুরু করি কিংবা আমার বিশ্বাসের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা অনুভব করি। এর সাথে সাথে আমি উপলব্ধি করছিলাম, তাদের সাথে সময় দেয়ার ফলে না চাইতেও আমার দ্বারা অনেক গুনাহ সংঘটিত হয়ে যাচ্ছে। যা ছিল খুবই নেতিবাচক ও ভয়ংকর একটি বিষয়।
এই ভয়াবহ বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে সেদিন জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বলে রাখা ভালো, ব্যাপারটা এমন নয় আমি আমার বন্ধুমহলকে দ্বীনের দাওয়াত দেইনি। আসলে তারা আমার দ্বীনি বিষয়ের কোন কথাকে আমলেই নেয় না। বন্ধুমহলকে দ্বীনের পথে আনবো দূরের কথা বরঞ্চ আমার ধ্যান ধারণা ওদের দ্বারা প্রভাবিত হতে শুরু করেছিল। কারণ আমি ছিলাম একা, ওরা সংখ্যাধিক্য ছিল। পরিশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যেকোনো মূল্যে এই দ্বীন বিমুখ বন্ধুমহল সম্পূর্ণ রূপে ত্যাগ করবো। আসলে মুখে বলা যত সহজ করে দেখানো তার চেয়ে বহুগুণ কঠিন। আমি আমার বন্ধুমহল সম্পূর্ণ রূপে ত্যাগ করতে পারিনি, কিন্তু তাদেরকে দেয়া সময়ের পরিমাণ বহুলাংশে কমিয়ে এনেছিলাম। যা একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ছিল। যে সিদ্ধান্ত আমাকে দ্বীনের উপর অটুট থাকতে, বিশ্বাসকে মজবুত রাখতে ও বহুবিধ গুনাহ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে অনেক বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে, নিজেকে দেয়া সময়ের পরিমাণও বেড়ে গিয়েছিল।
দ্বীনে ফেরা নতুন পথিকের উদ্দেশ্যে একটি আহ্বান, যদি সম্ভব হয় বেদ্বীন বন্ধুমহল পরিবর্তন করে দ্বীনি বন্ধুমহলে যুক্ত হওয়া উচিৎ। যেমনটা আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুমহলের ক্ষেত্রে করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কেননা, একটি দ্বীনি বন্ধুমহল মানুষকে মহান আল্লাহ্ তাআলার নিকটবর্তী করে তোলে। তারা দ্বীন সম্পর্কিত নিত্য নতুন জিনিস শেখার উপলক্ষ হয়। অন্যদিকে একটি বেদ্বীন বন্ধুমহল আমাদেরকে মহান রব থেকে দূরে ঠেলে দেয়; বিপথগামী করে তোলে।
দ্বিতীয় যে প্রতিবন্ধকতা আমাকে এখনও তীব্র পীড়া দেয় তা হচ্ছে, আমল কেন্দ্রিক উম্মাহর বিভাজন। একটা সময় ছিল, যখন মুসলিমগণ বিশ্ব শাসন করত। আজ সময় পাল্টেছে, আজ বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে মুসলিম উম্মাহ শোষিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত। উম্মাহর এই ক্রান্তিকালে সকলের যেখানে উচিৎ ছিল একতাবদ্ধ হয়ে সকল অপশক্তিকে পরাস্ত করা সেখানে আমরা জোড়ে আমিন বলব নাকি আস্তে আমিন বলব এই নিয়ে বিবাদে লিপ্ত। আজ উম্মাহর মধ্যে শত শত মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে, সকলের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় রয়েছে। আফসোস আজ আমাদের মুসলিম পরিচয়টাই মাটিচাপা পড়ে গিয়েছে। আজ আমাদের অনেকের কাছে মুসলিম নয় হানাফি, আহলে হাদিস, মালেকী, শাফেয়ী কিংবা হাম্বলী পরিচয় মুখ্য হয়ে উঠেছে। এই নিয়ে দলাদলি ও বিবাদের জন্ম হচ্ছে। যা একপ্রকার বাড়াবাড়ি ভিন্ন কিছুই নয়।
আমল কেন্দ্রিক উম্মাহর বিভাজনের বিষয়টি সদ্য দ্বীনে ফেরা পথিক হিসেবে আমার কাছে অনেক বেশি উৎকণ্ঠার। আজ আমাদের মধ্যে অনেকেই দ্বীনকে নয় কিছু বাতিল মতবাদকে আঁকড়ে ধরে আছে। ক্ষেত্র বিশেষে, পূর্ণাঙ্গ দ্বীন থেকে যোজন যোজন দূরে তাদের অবস্থান। মাজার পূজা, পীর পূজার অন্তরালে চলে দ্বীনের নাম ব্যবহার করে কোটি টাকার ব্যবসায়। বর্তমান সমাজের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে না ধরলে বিষয়টি কখনই পরিষ্কার হবে না।
আমাদের সমাজে আজ ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের আলাদা আলাদা মসজিদের দেখা মিলে। আমাদের মধ্যে বিভাজন ক্রিয়া এতটাই প্রবল যে আল্লাহ্র ঘর মসজিদটা পর্যন্ত ভাগ বাঁটোয়ারা করা শেষ। সেই ভাগ বাঁটোয়ারা করা মসজিদের সাইনবোর্ডে অনেক সময় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা থাকে অমুক অমুক মতাদর্শীদের মসজিদে প্রবেশ নিষেধ। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, নবী (ﷺ)-এর সময় কি কোন মুনাফিক ছিল না? নাকি তিনি তাদের সম্পর্কে অবগত ছিলেন না? সেই মুনাফিকদের তো মসজিদে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়নি। অথচ আমাদের সমাজে শুধুমাত্র ভিন্ন মত নিয়েই এত শত বিপত্তির উৎপত্তি। যে বা যারা প্রকাশ্য কুফরে লিপ্ত তাদের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের এই সমাজে জোরে আমীন বলার মত গৌণ বিষয় নিয়ে মুসলিম ভাইয়ে ভাইয়ে সংঘাতের অন্ত নেই। একই ভাবে ভিন্ন মতাদর্শীদের হেয় করা, এমনকি গালাগাল দেয়া পর্যন্ত আজ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। অথচ গালাগাল মুনাফিকের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য [১২]। যা কাফের মুশরিক কাউকেই দেয়া জায়েজ নেই।। এই বিষয়গুলো আজও আমাকে তীব্র পীড়া দেয়।
আমাদের সমাজের অনেকেই পায়ের সাথে পা মিলিয়ে সালাত আদায় করেন। অথচ তারা পায়ের দিকে খেয়াল করতে গিয়ে কাঁধের কথা ভুলে যান। ফলে দুজনের কাঁধের দূরত্বের সমপরিমাণ দূরত্ব তৈরি হয় নিজের দুই পায়ের মাঝখানে। এই বিষয়ে তাদের কোন প্রকার ভ্রূক্ষেপ নেই বললেই চলে। এই সমাজেই আবার অনেকেই মুরুব্বীদের পায়ে পা লাগিয়ে দাঁড়ানোকে বেআদবি মনে করেম। ইয়া আল্লাহ্! নবী (ﷺ)-এর সুন্নাহ আজ তারই অনুসারীদের কাছে বেআদবি।
আমাদের মধ্যে গৌণ বিষয় নিয়ে বাকবিতণ্ডার কোন অন্ত নেই। কেউ বুকে হাত বাঁধার পক্ষপাতী তো অন্য কেউ নাভির নিচে। আজ জোড়ে কিংবা আস্তে আমীন বলা নিয়েও ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব। এই সমাজে রফউল ইয়াদাইন করার কারণে হেনস্থার স্বীকার হতে হয়। কারও কাছে ফরজ নামাজের পর সম্মিলিত মোনাজাত সুন্নাহ পরিপন্থী কাজ আবার কারও কাছে এটা প্রায় নামাজেরই অংশ। এই সমাজেই কেউ মিলাদকে মনে করে বিদআত আবার কেউ দেয় এর বৈধতার সার্টিফিকেট।
এই পরিস্থিতিতে সদ্য দ্বীনে ফেরা পথিক হিসেবে আমি কোন পথে হাঁটবে? কোন বিষয়ের উপর আমল করবো? অবস্থা এমন হয়েছে, কোন একটা বিষয়ের উপর আমল করলে যারা সেই আমল করে না, তাদের খোটা শুনতে হয়; তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের ট্যাগ খেতে হয়। আজ কিছু মানুষের কারণে দ্বীনে ফেরাও এক মহা মুসিবতে পরিণত হয়েছে। এমন তো না যে সদ্য দ্বীনে ফেরা নবীন পথিক নিজেই নিজের মতো আমল আবিষ্কার করেছে কিংবা প্রতিষ্ঠিত চার মাযহাবের বাইরে গিয়ে কিছু করছে। তবে আমলের ব্যাপারে কেন এত শত দ্বন্দ্ব? মুসলিম ইতিহাসের স্বনামধন্য চার ইমামের (রাহিমাহুল্লাহ) প্রত্যেকেই বলেছেন, “সহিহ শুদ্ধ হাদিস পেলে আমার মত (মাযহাব) ছুঁড়ে ফেলে সেই হাদিসের উপর আমল কর।”
অথচ আমরা একে অন্যের ভুল ধরতেই ব্যস্ত। কে জান্নাতে যাবে আর কে যাবেনা সেই হিসেব কষতে কষতে হাতের রেখা পর্যন্ত ক্ষয় করে ফেলছি। মুখ্য বিষয় (ঈমান, আক্বিদা, রিসালাত, বিদআত, শিরক, কুফর) ভুলে গিয়ে গৌণ বিষয় (জোড়ে আমিন বলা, বুকের উপরে হাত বাঁধা, পায়ে পা লাগিয়ে দাঁড়ানো) নিয়ে আমরা প্রচণ্ড রকম সংঘাতে লিপ্ত। এই সকল গৌণ বিষয়ের জের ধরেই আজ আমরা আল্লাহর ঘর মসজিদের ভাগ বাঁটোয়ারায় ব্যস্ত। এমনকি আমাদেরই কিছু মানুষ আল্লাহ্র ঘর মসজিদ ভেঙ্গে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করেনা। অথচ আমাদের উচিৎ ছিল উম্মাহর এই ক্রান্তিলগ্নে ঐক্যবদ্ধ ভাবে ইসলাম বিরোধী শক্তিকে প্রতিরোধ করা। আফসোস! আজ আমরা ঈমান-আক্বিদা রিসালাতে বিশ্বাসী হয়েও অগণিত দলে বিভক্ত।
সাধারণ মানুষের কথা বাদই দিলাম। এই সমাজের অনেক আলেম আজ নিজেরাই নিজেদের মধ্যেই কাঁদা ছুড়াছুঁড়িতে ব্যস্ত। গুরুর যখন এমন অধঃপতন তাহলে অনুসারীদের কি অবস্থা কল্পনা করতে পারেন? উম্মাহর মধ্যে এই বিভাজনের সুযোগ নিয়ে যে কেউ যখন তখন ইসলাম এবং নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে নিয়ে কটূক্তি করে অনায়াসে পার পেয়ে যাচ্ছে। আজ আমরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতির অন্যতম কারণ। বর্তমান পরিস্থিতি এমন হয়েছে নিজের যোগ্যতায় মানুষের ক্ষতি করতে না পারায় শয়তানও হয়ত আফসোস করে। আর কাফের, মুশরিক ও ইসলাম বিরোধী শক্তির আনন্দের কথা না হয় বাদই দিলাম।
এই সকল সমস্যার পেছনে একটাই কারণ। আজ সময়ের বয়ে চলার সাথে সাথে আমাদের মাঝে এক ভয়ানক ব্যাধির জন্ম হয়েছে। অধিকাংশ মানুষ একমাত্র নিজেদের মানহাযকেই হক্ব মনে করে আর বাদ বাকি সবাই বাতিল। শুধু তাই নয় কিছু সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত হক্ব আর বাতিলের সার্টিফিকেট বিলি করে বেড়ায়। যার যখন ইচ্ছা খারেজী অথবা ভয়ানক কাফের তাকফির করে বেড়ায়। অথচ এমন ঝুঁকি পূর্ণ তাকফির করার অধিকার কিংবা জ্ঞান কোনটাই তাদের নেই। যারা এমন চিন্তা লালন করেন তাদের উদ্দেশ্যে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই। একমাত্র আপনার মানহায হক্ব বাকি সবাই বাতিল এমন ধারণা পোষণ করার পরও আপনি যে জান্নাতের বাসিন্দা হবেন তার নিশ্চয়তা কি? কার কাছ থেকে পেয়েছেন জান্নাতের সার্টিফিকেট?
সর্বশেষে সমাজে প্রচলিত এই সমস্যার সমাধান কল্পে বলতে চাই, সর্বপ্রথম আমাদের নূন্যতম বাধ্যতামূলক দ্বীনি ইলম্ অর্জন করতে হবে। এরপর একমাত্র আমিই হক্ব বাকি সবাই বাতিল এই ধরনের চিন্তা আমাদের পরিহার করতে হবে। প্রত্যেকটি মাযহাবের স্বতন্ত্রতা মেনে নিতে হবে। প্রত্যেকটি মানুষ ও সহিহ মতবাদকে সম্মান করতে শিখতে হবে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে সকল মতকে সম্মান করি। প্রকাশ্য শিরক, কুফর, বিদআত ইত্যাদি ভিন্ন ব্যাপার। মাযহাবের স্বতন্ত্রতা ইসলামের সীমাবদ্ধতা নয়, এটাই ইসলামের বিস্তৃতি ও সৌন্দর্যের পরিচায়ক। অজ্ঞতাবশত একমাত্র বাপ দাদাদের আমলই সঠিক মনে করে সুন্নাহ্ ভিত্তিক আমলকে দূরে ঠেলে দেয়ার মত গোমরাহি করার পক্ষপাতী আমি নই। দ্বীনের গৌণ বিষয়গুলোকে কেন্দ্রে করে সকল প্রকার দ্বন্দ্বের ইতি টানতে হবে।
সমাজে প্রচলিত উপরোক্ত প্রত্যেকটি সমস্যা আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি এবং এখনও করছি। আমার ধারণা দ্বীনে ফেরার পর প্রত্যেকেই এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন। এমনকি এমন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে অনেকেই পুনরায় বিপথগামী হয়ে যায়। এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় হচ্ছে প্রথমত, যে সকল গোষ্ঠী প্রকাশ্য কুফর, শিরক কিংবা বিদআতী কার্যকলাপে লিপ্ত আছে তাদেরকে আলাদা ভাবে হক্বের পথে দাওয়াত দেয়া। যদি তারা সেটা মেনে না নেয় তাহলে তাদের সামাজিক ভাবে বয়কট করতে হবে। তবুও একে অন্যের সাথে তর্ক-বিতর্ক করে ইসলামের সৌন্দর্য নষ্ট করা যাবেনা। ইসলামের সৌন্দর্য নষ্ট করার অধিকার আমার আপনার কারও নেই।
সর্বসাধারণের তাকফির করার মত স্পর্শকাতর বিষয় সম্পূর্ণ রূপে নিরুৎসাহিত করতে হবে। এর ভয়াবহতা সকলকে উপলব্ধি করতে হবে। না জেনে, না বুঝে কাউকে কাফির বলে ফেললাম, সে যদি কাফির না হয়ে থাকে তবে সেই তাকফির নিজের দিকেই ফিরে আসে। এই ভয়ানক তাকফিরের পরিণতি উপলব্ধি করতে হবে। প্রত্যেকে মুসলিম হয়েও একে অন্যের মধ্যে ট্যাগাট্যাগির মতো বিকৃত মানসিকতা পরিহার করতে হবে। পরস্পর পরস্পরের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব ইসলামের সৌন্দর্য প্রকাশের পথে যে প্রধান অন্তরায় সেটা উপলব্ধি করতে হবে।
সর্বোপরি, উম্মাহর এই ক্রান্তিকালে আমাদের চিন্তার প্রসারতা, অহংবোধ, নূন্যতম দ্বীনি ইল্ম অর্জন এবং নফসের দাসত্ব থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে হবে। আরও মনে রাখতে হবে সময় এখন গৌণ বিষয়গুলো এক পাশে রেখে ঈমান-আক্বিদা ও রিসালাতের মতো মুখ্য বিষয়ে একমতের প্রেক্ষিতে ঐক্যবদ্ধ উম্মাহর পুনর্জাগরণের। আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এমন একটি সমাজ গঠনের চেষ্টা করতে হবে যেখানে থাকবেনা মুসলিম ভিন্ন কোন পরিচয় কিংবা নিজেদের মধ্যে দলাদলি আর রেষারেষি। সেই সমাজে প্রত্যেকেই প্রত্যেককে সম্মান করবে। আবারো বলছি, প্রকাশ্য কুফর, শিরক ও বিদআত ইত্যাদি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। মোটকথা, দলমত নির্বিশেষে একটি মাত্র পরিচয়ে আমাদের সকলকেই পরিচিত হতে হবে। সর্বাবস্থায় মনে রাখতে হবে আমাদের একমাত্র পরিচয় উম্মাতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
গ্রন্থপঞ্জী সমূহঃ
[১] সূরাঃ বনী-ইসরাঈল, আয়াতঃ ২৩
[২] সহিহ বুখারীঃ ৫৯৭১
[৩] সূরাঃ লুকমান, আয়াতঃ ১৫
[৪] সহিহ বুখারী ও মুসলিমঃ ৭১৪৫, ১৮৪০
[৫] সহিহ বুখারীঃ ১/২৩০
[৬] গিযাউল লুবাবঃ ১/৩৮৫
[৭] গিযাউল লুবাবঃ ১/৩৮৪
[৮] সূরাঃ আল-ফুরক্বান, আয়াতঃ (২৮-২৯)
[৯] সূরাঃ আয-ফুখরুফ, আয়াতঃ ৬৭
[১০] সুনানে আবু দাউদঃ ৪৯৩৩, আত-তিরমিযীঃ ২৩৭৮, সনদ হাসান
[১১] সহিহ বুখারীঃ ২১০১, সহিহ মুসলিমঃ ২৬২৮
[১২] সহিহ বুখারিঃ ৩৪
Facebook Comments