সংকলন
প্রতিযোগিতা-২

নীড়ে ফেরার গল্প-৪২ | পার্থ (ছদ্মনাম)

আসসালামু আলাইকুম  ওয়ারহমাতুল্লাহ।

“আলহামদুলিল্লাহ” -সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ’তালার, তার হেদায়েতেই আমি আজ নন প্রাকটিসিং মুসলিম বা সেক্যুলার চিন্তাধারা থেকে একজন প্রাকটিসিং মুসলিম হতে পেরেছি। আমার অতীতের সাথে বর্তমানকে যখন আমি মেলানোর চেষ্টা করি, আমার কাছে সত্যিই অবিশ্বাস্য লাগে। কিন্তু ওই যে চিরন্তন সত্য, “অসম্ভবকে সম্ভব করতে আল্লাহর ১ সেকেন্ডও লাগে না”।

Tijarah Shop

আমি পার্থ। আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। একটা শহুরে পরিবারে আমার জন্ম, তাই গ্রামের যৌথপরিবারের স্বাধ হতে আমি বঞ্চিত। মা-বাবার কাছেই আমি মানুষ। আমার মা-বাবা ছিল নন-প্রাকটিসিং মুসলিম বা নামমাত্র মুসলিম। ছোটবেলায় আব্বুর হাত ধরে শুধু ঈদের নামাযে যেতাম। ব্যাস এইটুকুই ছিল আমার পরিবার থেকে প্রাপ্ত ধর্মশিক্ষা। আমি প্রচুর পরিমাণে দুনিয়ামুখী হয়ে বেড়ে উঠছিলাম। পড়াশুনার প্রতিযোগিতার জন্য মা-বাবা আমাকে বন্ধুদের সাথে জুম্মার নামায পর্যন্ত যেতেও অনুতসাহিত করত। আমিও বেড়ে উঠেছিলাম বস্তুবাদী হয়ে।

আস্তে আস্তে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে উঠলাম। ঢাকার সবচেয়ে নামি-দামি কলেজে এডমিশন নিলাম। যার ফলে এই প্রথম পরিবার থেকে আলাদা থাকতে বাধ্য হলাম। অনেক খারাপ লাগতো মা-বাবা ছাড়া থাকতে। কিন্তু আস্তে আস্তে নিজেকে মানিয়ে নিলাম নতুন পরিবেশের সাথে। কলেজে লাইফে গিয়ে আমার ভিতরে উলটো আরো নাস্তিক্যবাদী মনোভাব জন্ম নেয়। ধর্মের নাম শুনলে নাক শুটকানি ভাব আরকি যাকে বলে। তখন সো কল্ড বন্ধুদের সাথে গিটার হাতে, কখনো বা উদ্যানের মুক্তমঞ্চে ব্যস্ত থাকতাম। বন্ধু মহলে খুব খ্যাতিও ছিলো। কিন্তু এতো কিছুর সত্ত্বেও চরম হতাশায় কলেজ লাইফ অতিবাহিত করলাম। এইচএসসি ‘র রেজাল্ট চরম বিপর্যয় হলো। এডমিশনেও ইঞ্জিনিয়ারিং-মেডিকেল কোথাও হলো না। ঢাবিতে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের একটা সাব্জেক্টে ভর্তি হলাম। পরিবারের লোকজন গালমন্দ করলেও আমার কি আর এসব কথা গায়ে লাগানোর সময় ছিলো,  ডানামেলা উড়ছিলাম অন্ধকার পাপের রাজ্যে। কিন্তু আল্লাহর কি অশেষ রহমত তখনই আমার সাথে পরিচয় হয় রিফাতের (ছদ্মনাম)। রিফাত আমার ডিপার্টমেন্ট এর ফ্রেন্ড।ও ছিলো প্রচুর পরিমাণে ধার্মিক। কিভাবে যেনো রিফাতের সাথে সাথে থাকতে থাকতে আমিও মাঝেমাঝে নামায পড়া শুরু করলাম। বাট ততোদিনেও ধর্ম-কর্ম এসব সিরিয়াস্লি নিই নি। কিন্তু সেই তারুণ্যের চঞ্চলতায় মিথ্যা মরিচিকায় আকৃষ্ট হয়ে স্বীয় প্রবৃত্তির চর্চার চরম পর্যায়ে যখন নিজের কৃত কাজের জন্য তীব্র অনুশোচনা হতে লাগলো, নিজেকে কেমন যেনো অসহায় লাগতো। হতাশার সমুদ্রে খেই হারাচ্ছিলাম প্রায়।

একদিন  রিফাত আমাকে একটা বই পড়তে দিলো, বইটার নাম “লা তাহযান”, লেখক:ড. আয়েয আল কারনী। বইটা আমাকে খুবই আকৃষ্ট করলো। আমার জন্য ঐ মুহুর্তে ওই বইটারই প্রয়োজন ছিলো। আমার মনের খবর রিফাত কিভাবে জানলো আল্লাহই ভালো জানেন। আমি রিফাতের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। ওই একটি মাত্র বই আমাকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করে, আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখতে শেখায়। তারপর অনুপ্রাণিত হয়ে এরকম টাইপের আরো কিছু বই দিতে বললাম রিফাতকে। ও আমাকে আরিফ আজাদ ভাইএর বইগুলো এবং জাকারিয়া মাসুদের ” তুমি ফিরবে বলে” বইটি পড়তে দিলো। আমি একটানা পড়ে শেষ করে ফেললাম।আমি সূরা ফাতিহা টাও ঠিক মতো বলতে পারতাম না। তখন আমি হলের এক বড় ভাই এবং অনলাইনের সহায়তায় কোরান তিলাওয়াত শিখে নিলাম। যতোই আমি ইসলাম সম্পর্কে জানতে শুরু করলাম, আমার আগ্রহ ততোই বাড়তে থাকলো। যেনো আমি জীবনের স্বাদ পেয়ে গেছি। ইসলাম আমাকে এতোই আকৃষ্ট করলো যে, আমার কাছে ইসলাম মানে আর কোনো আনুষ্ঠিকতা না,শুধু ঈদ আর জুম্মা না। প্রায় সবকাজেই আমি রাসুল (স) এর সুন্নাত অনুসরণ করে চলার চেষ্টা করা শুরু করে দিয়েছি ইতোমধ্যে। হলফ করে বলছি, এখন আমি দৈনন্দিন  প্রতিটা পদক্ষেপে যেরূপ আত্মতৃপ্তি পায় তা বর্ণনাতীত। আমলের পাশাপাশি আমি ইলম নিয়ে পড়াশুনাও চালিয়ে গেলাম। আলহামদুলিল্লাহ কমিউনিস্ট মনোভাব থেকে কখন যে তাওহীদের কালেমাকে মনে প্রানে অন্ধভাবে ভালোবেসে ফেলেছি টেরও পায় নি।

দ্বীনের পথে চলতে গিয়ে পাহাড়-সম বাধা জয়ঃ আমার ইসলামের প্রতি ভালোবাসা এতোটাই প্রবল হয়ে গেছিলো যখন গোল আড্ডায় বন্ধুরা ধর্ম নিয়ে কটুক্ত করত, হৃদয় ভেঙে চুড়ো টুকরো টুকরো হয়ে যেতো। এজন্য সকল বন্ধু সার্কেল ত্যাগ করলাম।

তখন সবথেকে বড় বাধা তৈরি হলো সোশ্যাল মিডিয়া। ওই যে বললাম,  ইসলামের প্রতি তীব্র ভালোবাসা সৃষ্টি হওয়াই আল্লাহর রহমতে সকল বাধাই আমার কাছে তুচ্ছে হয়ে গেল। ফেসবুকের সকল ফ্রেন্ড যারা খামখেয়ালী পোস্ট বা অনলাইন এক্টিভিটি করে, সবাইকে অনফ্রেন্ড করলাম। বাকিদের অনফলো। সকল অপ্রোয়জনীয় পেইজ এবং গ্রুপ থেকে লিভ নিলাম। ফেসবুকে রাখলাম রিফাতের মতো কিছু দ্বীনি বন্ধুদের। আর সাথে সাথে যুক্ত হলাম বিভিন্ন ইসলামিক গ্রুপ এবং পেইজে। নরকের কীট ফেসবুককে বানিয়ে ফেললাম দ্বীন চর্চার আরেকটি প্লাটফর্ম।

তারপর যখন ছুটিতে বাড়ি গেলাম আমার এই পরিবর্তন দেখে আব্বা আম্মা নাক শিটকাতে লাগলো। মামা তো রীতিমতো জেএমবি, জামাত-শিবির, বখে গেছে ইত্যাদি ট্যাগ দিতে লাগলো। আম্মা কান্না শুরু করে দিলো এই বলে যে একমাত্র ছেলে ভারসিটিতে গিয়ে উচ্ছন্নে গেছে। আমি খুবই কষ্ট পেলাম। আম্মা আব্বাকে খুব করে বোঝাতে লাগলাম। এখনো বুঝাই। আআলহামদুলিল্লাহ  আম্মা এখন প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামাযই পড়ে।  আব্বু আগে ধর্ম কর্ম নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করলেও এখন মাঝে মাঝে তাকেও নামাযের পাটিতে দেখে আমার চোখ আনন্দে অশ্রুসজল হয়ে যায়। আসলে আমার ঈমানিশক্তি, ইসলামের প্রতি অনুরাগ এতোটাই তীব্র হয়েছিলো যে আমার কাছে সকল বাধাই তখন তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ আমি দেড় বছরের প্রচেষ্টায় একজন প্রাকটিসিং মুসলিম।  আল্লাহ তা’লা রিফাতকে হয়তো আমার হেদায়াতের উছিলায় পাঠিয়েছিলেন। এই ছিলো আমার প্রত্যাবর্তনের কাহিনী।

শেষে একটা কথা বলেই শেষ করছি। যখন আমি আবেগের নৌকায় করে হতাশা, উচশৃঙ্খলার সমুদ্রে খেই হারাচ্ছিলাম তখন আল-কোরানের যে আয়াতটি আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে, সেটি হলো ঃ-

“লা তাহযান ইন্নাল্লাহ মা’আন”। (অর্থ- হতাশ হয়ো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে রয়েছেন)। [সূরা আত-তাওবাঃ৪০]

Facebook Comments

Related posts

নীড়ে ফেরার গল্প-৩৩ | নাজমুস সাকিব

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-৩২ | মারইয়াম শারমিন

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-২০ | সাবেক কিংকর্তব্যবিমূঢ়

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!