আমার বয়স যদিও কম , তবুও আজ থেকে কয়েকবছর আগের আমি’র সাথে বর্তমান আমি’র কোনো মিল নেই। পরিবর্তন গুলো একদিনে হয়নি। আধুনিকতার নামে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার এই যুগে নিজের চরিত্র ঠিক রাখা, নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নাহ অনুযায়ী চলা, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামকে টেনে আনা, খারাপ কাজে নিষেধ, ভালো কাজের আদেশ করা এগুলো কোনো সহজ বিষয় নয়। অন্তত আমার মত জেনারেল লাইনে পড়াশোনা করা যেকারো পক্ষেই এইসব বিষয় খুবই কঠিন।
প্রতিদিন মনে হয় আল্লাহর দেয়া সরল পথে আজও হয়তো চলতে পারিনি। তখন মনে পড়ে যায় প্রতিদিন ৫ওয়াক্ত সালাতে আমরা আল্লাহর কাছে সরল পথে পরিচালিত করার জন্য অনুরোধ করি। আল্লাহু কি আমাদের অনুরোধ ফিরিয়ে দিবেন? অবশ্যই না। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া যাবেনা। তাই আল্লাহর নাম নিয়ে লেখা শুরু করলাম আমার নীড়ে ফেরার গল্প।
[২]
এখন ২০২০ সাল। দুইবছর আগেও ইসলাম সম্পর্কে বিস্তারিত তেমন কোনো ধারনাই ছিলোনা। ছোট বেলায় আব্বু-আম্মু, জুমার খুতবা, স্কুলের ধর্ম বই ও মক্তবে যা শিখেছি তা খুবই সামান্য।
আর ১০টা মুসলিম পরিবারের মতই রোজা, নামাজ, ঈদ, মিলাদ, জানাজা এগুলোকেই ইসলাম মনে করতাম। ইসলামকে সীমাবদ্ধ মনে করতাম শুধু মসজিদের মধ্যেই।
আর ১০টা ছেলের মত আধুনিক হওয়ার চেষ্টা কে না করে? আমিও ব্যতিক্রম ছিলাম না। চুল বড় রাখতাম,হেয়ার জেল ব্যবহার করে চুল উপরে উঠাতাম। দুই পাশে ছোট করে উপরের দিকে বড় রাখতাম। চুলের কাহিনীটা বলার মূল কারণ হচ্ছে এই চুলই আমার দ্বীনের পথে ফেরার অন্যতম কারণ। ব্যাপারটা হাস্যকর হতে পারে। তবে আমার সাথে তাই হয়েছে।
ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তির পর কলেজে ক্লাসের পাশাপাশি স্যারদের বাসায় ব্যাচে পড়তাম। আমি যার কাছে ইংরেজি পড়তাম তার মাথায় চুল ছিলোনা কিন্তু আমার চুল নিয়ে তিনি কয়েকবার মন্তব্য করেছিলেন। চুল বড় রাখলে তো জানেনই একটু পর পর ঠিক করতে হয়। সেই জিনিসটা স্যার কয়েকদিন দেখেছিলো। একদিন বললো ওর(আমার) মাথায় এত চুল যে ওর মাথা একদিকে ঝুলে পড়ছে। চুল ছোটো করার জন্যও বলেছিলেন। আরো বলেছিলেন যাদের মাথায় বেশি চুল তারা পড়াশোনায় অনেক খারাপ হয়( মাথায় গোবর থাকে বলেছিলেন)। এই কথাগুলো আমার কাছে খারাপ লাগতো। এছাড়াও আমার আব্বু বড় চুল রাখা দেখতে পারেননা। এটাও একটা কারণ। আব্বু তো বলতেন লাগলে প্রতি মাসে চুল কাটবি, বড় রাখবি কেনো?
আমি তখন বলেছিলাম আর কিছু দিন পর কাটবো,স্মার্ট কার্ডের জন্য ছবি তুলতে হবে, তার পরেই চুল কাটবো। আমি কথা রেখেছিলাম। যেদিন ছবি তুলি ঐদিনই চুল একদম ছোট করে কাটাই। সেই তখন থেকে আজ পর্যন্ত চুল ছোট করে কাটি।
[৩]
চুল ছোটো করার পরে একটি সমস্যা হলো।
প্রাইমারিতে থাকা অবস্থায় দৌড়াদৌড়ি করার সময় বাসার লোহার গেইটে মাথায় আঘাত পেয়েছিলাম। সেখানে আর কোনোদিন চুলই উঠেনি। চুল ছোট করার কারণে যায়গাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বাধ্য হয়ে মাথায় ক্যাপ পরা শুরু করি। একটা কথা বলে রাখি ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন বয়সে সালাত আদায় করলেও কখনও নিয়মিত সালাত আদায় করতাম না। বিভিন্ন পরীক্ষার আগে আগে শুরু করতাম, পরীক্ষা শেষ হলে নামাজও শেষ হয়ে যেত। এখন বুঝতে পারি জীবনে অনেক ভুল করেছি।
নামাজ আস্তে আস্তে শুরু করি। প্রথমেই পাঁচ ওয়াক্ত পড়তে পারতাম না। তিন-চার ওয়াক্ত নিয়মিত হওয়ার পরেই পাঁচ ওয়াক্ত শুরু করতে পেরেছিলাম। এখনও মাঝে মাঝে এদিক-সেদিক হয়ে যায়।
নামাজ শুরু করার পর চিন্তা করলাম , নামাজ যখন পড়াই লাগে তখন আবার ক্যাপ পড়বো কেনো, নামাজের জন্য টুপি পড়লেই তো হয়।
এই চিন্তা থেকেই মাথায় উঠিয়ে নিলাম টুপি। সেইদিন থেকে এখন পর্যন্ত বাসা থেকে বের হলেই টুপিই যেন আমার সঙ্গী। আশেপাশের মানুষের থেকে এরকম হঠাৎ পরিবর্তনে অনেক কথাই শুনতে হয়েছে। সাথে তখন থেকে দাড়ি বড় করাও শুরু করি। কেউ বলেছে- এইতো হুজুর কয়দিন পর আবার খেজুর হয়ে যাবে, জঙ্গি, প্রেম করে ছ্যাকা খাইছে, গার্লফ্রেন্ড নামাজ পড়তে বলছে?
এই টাইপের অনেক কথা। কিন্তু কখনও এসব কথায় কান দেইনি। যারা এসব কথা বলেছিল তারাও হয়তো মাঝে মাঝে সালাত আদায় করতেন! আল্লাহ তাদের হিদায়াত দান করুক।
আস্তে আস্তে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা শুরু করি, ফেসবুক থেকে আগের ছবি,পোস্ট গুলো ডিলেট করে দেই, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া বাদ দেই, মেয়েদের সাথে কথা বলা, গান শোনা, মুভি দেখা, নাটক দেখা বাদ দেই। যদিও কোনোটাই আমার নেশা ছিলোনা যে না দেখলে থাকতে পারবোনা। তাই এসব ছেড়ে দিতে খুব কষ্ট হয়নি। এসবের জন্যও কথা শুনতে হয়েছে।
কিন্তু সবসময় মনে হতো কোনো এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে পরিচালনা করছেন, খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখছেন, খারাপ কাজ হয়ে গেলেও অনুশোচনা হয়। হয়তো কোনো এক মহান কাজের জন্য আমাকে আমার রব প্রস্তুত করছেন।
[৪]
একটা সময় ছিল বাজারে যে এত ইসলামী বই আছে জানতামই না। বাসায় আমার বোনের কিছু ইসলামী বই ছিল কিন্তু কখনো পড়া হয়নি।
কলেজের এক স্যারের কাছে বাংলা পড়তাম। তিনি একদিন ‘প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ’ বইয়ের এ্যাপ আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই শুরু। আরিফ আজাদ নামের একজন লেখক আছে সেটা যদিও আরো আগেই জানতাম। কিন্তু তার কোনো বই তখনও পড়া হয়নি। প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ থেকে শুরু। এরপর লেখকের জনপ্রিয় আরেকটি বই ‘বেলা ফুরাবার আগে’ পড়েছি। এভাবে ইসলামী বইয়ের জগতে প্রবেশ। এবছরই ৩০-৪০টির মত বই পরে শেষ করেছি। এবং এই যাত্রা এখনো অব্যাহত আছে। নিজে বই পড়ার পাশাপাশি অন্যরাও যেন বই পড়তে উৎসাহি হয় এজন্য নিজের পড়া বই অন্যকে পড়তে দেই। ইচ্ছা আছে একটি ছোট লাইব্রেরি করার বা ইসলামী বইয়ের দোকান দেয়ার।
[৫]
হয়তো অনেকেই আছেন আমার পূর্বের অবস্থার মত চুল বড় রাখেন কিংবা ইসলাম নিয়ে তেমন কিছুই জানেন না এবং মানেন না, সালাত আদায় করেন না। তাদের জন্য আমার এই লেখাটি।
তারা যদি আমার মত আস্তে আস্তে একটু সময় নিয়ে ইসলাম নিয়ে জানার চেষ্টা করে। ছোট ছোট সুন্নাহ যা আমরা চাইলেই করতে পারি সেগুলো করা শুরু করে তাহলেই সম্ভব আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থায় নিজেদের জীবন পরিচালনা করা।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে তৌফিক দান করুক।
আমিন।
Facebook Comments