সংকলন
মুক্তা থেকে মারইয়াম
প্রতিযোগিতা-২

নীড়ে ফেরার গল্প -১৭ | মুক্তা থেকে মারইয়াম

আমি মারইয়াম!

মুক্তা থেকে মারইয়াম।

মারইয়াম নামটার পিছনে বিশাল একটি গল্প আছে, আর আমি আজ সেই গল্পটিই আপনাদের জানাতে চাই।

আমি ছোটবেলা থেকে প্রচন্ডরকম দুষ্টু ছিলাম।

আর এই দুষ্টু হওয়ার কারন হচ্ছে অতিরিক্ত আদর আহ্লাদে মানুষ হওয়া। আমি ছয় ভাই বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ট ছিলাম তাই সবার আদরে  আদরে উচ্ছন্নে যাওয়া ছিলাম আমি।

Tijarah Shop

আমার আব্বু ছিলেন প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক আর এলাকার বেশ নামকরা মানুষ।

এলাকায় নাম যষ খ্যাতি খুব ভালো ছিল আমাদের।  আব্বুর অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হওয়ার কারনেই লোকে আমাদের আলাদাভাবে সম্মান করতো। এককথায় সব দিক দিয়ে পরিপুর্ন ছিলাম আমরা। কিন্তু একটা দিকেই অভাব ছিল শুধু, আমাদের রবের সান্নিধ্য।

আমাদের অর্থ প্রতিপত্তিই ছিল আল্লাহর পথ থেকে আমাদেরকে গাফেল করার অন্যতম কারণ। আমরা অত্যন্ত আধুনিকভাবে মানুষ হইছি,   তাই ছোটবেলা থেকে ইসলাম সম্পর্কে জানার কোন মাধ্যম খুজে পাইনি। মুসলিম পরিবারে জন্মেছি বলে নিজেকে মুসলমান ভাবতাম। আর ইসলাম সম্পর্কে ধারনা ছিল এতটুকুই।দুই ঈদে আব্বু, ভাইয়াদের নামাজ পড়তে যাওয়া, কুরবানী ঈদে গরু জবাই করা। কোন কোন শুক্রবারে দেখতাম আব্বু মসজিদে গিয়ে জুমআর নামাজ পড়েন।

আর দেখতাম রমজান আসলে হয়তো কেউ কেউ রোজা রাখতো। ইসলাম যে আমাদের একটি পরিপুর্ন জীবন ব্যবস্থার নাম এব্যাপারে আমার জ্ঞান ছিল শুন্যের কোটায়।

আস্তে আস্তে দিন গড়িয়ে আমি প্রাইমারী শেষ করে হাইস্কুলে গেলাম। তখনও পুরো পৃথিবী জুড়ে আমার অবাধ চলাফেরা ছিল৷  স্কুলে বন্ধু বান্ধবীদের সাথে হৈ-চৈ করা৷ খেলাধুলা গাছে উঠা। সময় সুযোগ মত স্যারদের  সাথেও দুষ্টুমিতে মেতে উঠতাম আমি। আমার অতিরিক্ত দুষ্টুমি আর চঞ্চলতার জন্য স্কুলে ছাত্র -শিক্ষক সবার কাছে আমার আলাদা একটা কদর ছিল৷

হয়তো কত-শত ভুল করেছি, অন্যকে অপমান -অপদস্ত আঘাত করেছি কিন্তু আমায় শোধরানোর বা বোঝানোর কেউ ছিল না। স্যারেরাও আমার আব্বুর ভয়ে আমায় কিছু বলতো না। স্কুলের সব ছেলেমেয়েরা ড্রেস পরে গেলেও আমি জিন্স -টপস পরেই যেতাম, কিন্তু তারপরও কোন স্যার আমায় কিছু বলতো না। আমার বড় ভাইয়ের একটি স্টুডিও ছিল।  সেখানে আমার কত শত ছবি ছিল তার সংখ্যা আমার অজানা ছিল।

এভাবেই দিনগুলো যাচ্ছিল আমার৷

কিন্তু আমার কেন জানি মনে হত,  আমার সব পাওয়ার মধ্যেও একটা বিরাট কিছু না পাওয়া আছে। কিন্তু সেই না পাওয়া জিনিসটি কি,  সেটা খুজে পাইনা।

আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। আমাদের স্কুলের একজন ধর্মস্যার  ছিলেন।  স্যারের ক্লাসগুলো আমি কখনো সেভাবে মনোযোগ দিয়ে করিনি।

তো একদিন ক্লাসে স্যার আমাদের এক সহপাঠি বান্ধুবীকে একটি সুরা তেলাওয়াত করতে বললো, সে সুরা আদ-দ্বুহা তেলাওয়াত করলো। তার তেলাওয়াত এত সুন্দর আর মধুর ছিল সেটা যেন আমার কর্নকুঠিরে মধুর বানির মত লাগছিল। মনে হচ্ছিল এ যেন এক অমিয়সুধা।

আমি কিছুক্ষন নিজের মধ্যে হাড়িয়ে গেলাম। আর ভাবতে লাগলাম, আচ্ছা ও কিভাবে এত সুন্দর করে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারে।অথচ আমি কোনদিন কুরআন খুলেও দেখিনি। কিভাবে পড়ে তাও জানিনা। আমি নিজের মধ্যে একটা প্রবল তাগিদ অনুভব করলাম  কুরআন পড়ার। কিন্তু কোথায় পড়বো? বাসার আশেপাশে কোন মাদ্রাসাও নেই। আমাদের এলাকার এক মসজিদের মুয়াজ্জিন সকালে বাচ্চাদের কুরআন শিখায় কিন্তু সেখানে আমার মত বড় মেয়ে  একটাও ছিল না। তাই আমিও লজ্জাতে যেতে পারিনি। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে আমার কুরআন শেখার আগ্রহটাও তত বাড়তে থাকছে। একদিন স্কুলে এসে আমার ওই বান্ধুবীকে ধরলাম৷ তাকে এত সুন্দর করে কুরআন পড়া কে শিখিয়েছে, সে বললো তার মা তাকে ক্লাস থ্রীতে পড়তেই কুরআন পড়া শিখিয়েছে।  এরপর আমি ওকে বললাম যে তুই কি আমায় কুরআন পড়া শিখাবি?? সে বললো কিভাবে শিখাবো তোর আর আমার বাড়ির দুরত্বতো চার কি.মি। প্রতিদিন কিভাবে যাওয়া আসা করবো। আমি ওকে বললাম যে তুই আমাদের টিফিন প্রিয়ডে যে আধা ঘন্টা সময় দেয় তখনই পড়াবি।  তারপর শুরু হলো আমার জীবনের নতুন পথচলা। যেই আমি টিফিন দিলে খেলাধুলা, হাসি, তামাশায় মেতে থাকতাম। সেই আমি প্রতিদিন টিফিনের সময় আলিফ, বা, তা পড়ি।  বন্ধু বান্ধুবীরা অনেকেই মশকরা করা শুরু করা দিল। হুজুরানী বলে খেপাতে লাগলো। কিন্তু আমি আমার জায়গায় অনড় থাকলাম।

এভাবে যেতে যেতে আমি ক্লাস নাইনে উঠলাম।এবং ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ আরো বেড়ে গেল।  এবার আমার ওই বান্ধুবী কুরআন পড়ার পাশাপাশি আমায় একটি বই দিল। সেই বইটা ছিল ওর মায়ের “ওয়াজে নিসওয়ান বা মহিলাদের ওয়াজ” নামের বই। আমি বইটি পড়া শুরু করলাম, এক একটি পৃষ্টা পড়ছি আর যেন আমার জীবনের করা একেকটি ভুলের জন্য অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছি। বইটি পড়া শেষ করে আমি একটি মেয়ের ইসলাম মানার ব্যপারে মুল যে বিষয়বস্তু আছে সেগুলো সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারনা তৈরি  করে ফেললাম। এদিকে আমার কুরআন পড়াও মোটামুটি এগিয়ে গিয়েছে। কায়দা শেষ করে আমপাড়ার ১০ টি সুরা মুখস্ত করে ফেলছি। এরপর বান্ধুবীকে ধরলাম আমায় নামাজ পড়ানো শিখাতে হবে।  সে শিখিয়ে দিল। আমি বাসায় এসে নামাজ পড়া শুরু করলাম।  বাড়ির মানুষজন যেন আমায় দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠলো।  আমি নামাজ পড়ি বা পড়ছি এটা যেন তাদের কাছে একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। বাড়ির মানুষজন  ভাবছে যে আমি নামাজ পড়ছি অতিশয় আগ্রহে, যেটা কয়দিন পর হয়তো  শেষ হয়ে যাবে।  কিন্তু আমি ভাবছি, আমার নামাজতো ঠিকমত পড়ছি,  কিন্তু কোথাও একটা পড়ছিলাম

” ইন্নাছ -ছলাতা তানহা আনিল ফাহশায়িল মুংকার”

_নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে খারাপ ও অশ্লিল কাজ থেকে বিরত রাখে।

কিন্তু আমিতো এখনও স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সাথে কথা বলি, আমার উপর পর্দা ফরজ কিন্তু আমিতো তাও করিনা। তাহলে আমার নামাজ কি আল্লাহর দরবারে কবুল হবে? এরকম নিজের সাথে সারাক্ষন আমার একটা যুদ্ধ চলছে।  কি করবো কিভাবে করবো, কোন পথে চলবো। বাড়িতে যদি বলি যে আমি স্কুলে যাবোনা তাহলে তো আমায় নির্ঘাত বাড়ি থেকে বের করে দিবে। আবার স্কুলে গেলে পর্দা করবো কিভাবে। এভাবে নিজের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছি আর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাচ্ছি আমি।এরপর আমি জিন্স টপস আর স্টাইলিশ ড্রেসের বদলে সাদামাটা স্কুলের ড্রেসের সাথে স্কার্ফ পড়া শুরু করলাম। কিন্তু এভাবে স্কার্ফ পড়েও যেন আমি সস্তিতে থাকতে পারছিনা। বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে মেশা কমিয়ে দিলাম। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কোন ছেলে ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলি না। এভাবে চললো আরো কিছুদিন। এরপর ক্লাস টেনে উঠলাম এবার পর্দা করার অনুভুতিটা আমার আরো দৃঢ় হতে থাকলো, কিন্তু আমাদের স্কুলে বোরখা পড়া এলাও করা হতোনা৷ এজন্য আমি স্কুল ড্রেসের উপর একটা সাদা কালার এপ্রোন পড়া শুরু করলাম তার সাথে সাদা স্কার্ফ দিয়ে নিজেকে যতটুকু সম্ভব ঢেকে রাখার চেষ্টা করতাম। আমার এই পরিবর্তনে রীতিমতো পরিবার, আত্নীয়স্বজন, ফ্রেন্ডসার্কেল এমনকি টিচারদেরও অনেক কটু কথা শুনতে হচ্ছে, কেউ বলছে,  হুজুরানী কবে হলি, কেউ বলছে বয়ফ্রেন্ড ছেকা দিছে,  কেউ বলছে আমায় জ্বীন ধরছে। সবার সব কথা নিরবে হজম করছি আমি আর নামাজে আল্লাহর কাছে চাচ্ছি আল্লাহ আমার সবকিছু সহজ করে দাও। তারপর ভাইয়ার স্টুডিও আর বাড়িতে থাকা আমার যত ছবি ছিল সেগুলো খুজে সব পুড়িয়ে ফেললাম। আর মনে মনে দোয়া করলাম আল্লাহ তারাতারি আমার স্কুল-জীবন টা শেষ হোক৷।

এরপর কিছুদিনের মধ্যে আমাদের এস.,এস.সি পরিক্ষা শুরু হলো, আমি পড়াশোনার পাশাপাশি রাত জেগে তাহাজ্জুদ আদায় করে দোয়া করছি আল্লাহ আমার মনোবাসনা পুরন করে দাও। এই অব্দি বাসার মানুষজন আমার কার্যকলাপ দেখে যদিও তেমন ভাবে বাধা দেয়নি। কিন্তু এরপরেই শুরু হলো মুল বিস্ফোরণ। যখন এস.এস.সির রেজাল্টের পর আমার সব বন্ধুরা ভালো ভালো কলেজে ভর্তি হচ্ছে তখন আমি বায়না ধরলাম আমায় কোন মহিলা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিতে। আমার এমন আবদারে বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষই অবাক হলো। কেউ রাজি হলোনা আমায় মহিলা মাদ্রাসায় দিতে। আমার ফ্যামিলির মানুষতো একবারেই আল্ট্রামডার্ন, তাই তারা এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা।

কিন্তু আমিও নাছোরবান্দা। আমি আমার কথায় শেষকথা বলে জানিয়ে দিলাম বাড়িতে। এটা নিয়ে বাড়িতে কয়েকদিন ড্রামা চললো৷ এরপর আমার বড় ভাই আমাকে কলেজে ভর্তি করাতে নিয়ে যেতে চাইলে আমি যাবো না বললে ভাইয়া থাপ্পড় মারে, আর বলে তোকে কিছুতেই মাদ্রাসায় দিব না আমি। আমি মার খেয়ে আম্মুর পা ধরি মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেওয়ার জন্য। এরপর এক টানা  তিনদিন না খেয়ে থাকি। আর বাড়িতে বলে দিসি যতক্ষন না মাদ্রাসায় দিতে রাজি না হবে ততক্ষন আমি ভাত খাবোনা। এভাবে জেদ করার পর আমার জেদের কাছে সবাই হেরে গিয়ে আমায় নীলফামারীতে আয়শা সিদ্দিকা মহিলা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিল।

শুরু হলো আমার জীবনের আকাংখিত দিন পার করা। মাদ্রাসায় এসে প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো, এখানকার খাওয়া -দাওয়া এত নরমাল ছিল প্রথমদিকে এসব খাবার খেতে খুব অসুবিধে হতো আমার। আবার রাতে শোয়ার সময়ও খুব কষ্ট করে শুতে হতো,  ফ্লোরে ছারপোকা, মশার কামড়। বাথরুমে গোসলের জন্য বিশাল বড় লাইন। এতগুলা স্টুডেন্ট বাথরুম মাত্র দুইটা। ১০ মিনিটও সময় পাওয়া যেত না গোসল করার জন্য। আমি বাসায় ঘুম থেকে উঠতাম নিজের ইচ্ছেমত আর মাদ্রাসায় এসে তিনটেয় উঠে তাহাজ্জুদ আদায় করে কুরআন পড়তে হয়। এরপর ফজর পড়ে আবার ক্লাস করতে আমার খুব কষ্ট হত। যেখানে ছোটবেলা থেকে সোনার চামচ মুখে জন্ম নেওয়া আমি,  কষ্ট কি জিনিস বুঝিনি আজ সেই আমিই এত্ত কষ্ট সহ্য করছি শুধুমাত্র আমার রবের একটু সন্তুষ্টির জন্য।   আমি এত কষ্টে আছি সেটা বাসায় কাউকেই বলতাম না, আমার ভয় হত না জানি কষ্টের কথা শুনলে যদি আমায় আবার নিয়ে যায় মাদ্রাসা থেকে। সব কষ্টের মাঝে থেকেও যখন দেখতাম আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট ছোট বোনগুলো কুরআন হিফজ করছে, অসম্ভব সুন্দর করে তেলাওয়াত করছে মুহুর্তে আমি আমার সব কষ্ট ভুলে যেতাম।

রব্বে কারিমের দরবারে শুকরিয়া জানাতাম।

“নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি”

অসম্ভব ভালোলাগা কাজ করতো মনে, একদিন আমিও নিজেকে হাফেজা বলে পরিচয় দিব ইং শা আল্লাহ।

এখানে দুইবছর নুরানী, নাজরা কম্পিলিট করে।  তারপর  ভর্তি হলাম,

দারুস সুন্নাহ ক্যাডেট মহিলা মাদ্রাসা রংপুরে।

এখানে এসে হিফয বিভাগে ভর্তি হলাম।

দিনগুলো ভালোই কাটছিল, আমিও আমার স্বপ্নপুরনের একবারে দোরগোড়ায় এসে গেছি।  এইতো আর কিছুদিন গেলেই আমি আমার স্বপ্নগুলো পুরন করতে পারবো ইং শা আল্লাহ।

কিন্তু এই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হলো না, এরমধ্যে আব্বুর শরিরটা একটু খারাপ হওয়া শুরু হলো, আব্বু আমায় নিয়ে বেশ চিন্তিত।  বয়সও অনেক বেড়ে গেল আমার আব্বুর শরিরটাও ভালো যাচ্ছে না, আমার বিয়েটা দিতে পারলে হয়তো একটু স্বস্তি পেতেন তিনি। আমায় বাড়ি থেকে চাপ দেওয়া শুরু হলো বিয়ে করার জন্য। আমি প্রথম প্রথম রাজি না হলেও পরে আব্বুর শরিরের কথা ভেবে ছেলে দেখতে বললাম। আর সাথে আমার কন্ডিশন জানিয়ে দিলাম যে আমি দ্বীনদার ছেলে ছাড়া বিয়ে করবো নাহ। আমার জন্য ছেলে খুজলে আলেম/ হাফেজ এরকম কাউকেই খুজতে হবে।

এবার আমার এরকম সীদ্ধান্তের কথা শুনে পুরো বাড়ি আমার বিপক্ষে চলে গেল। সবাই বললো যে এতদিন তোর অনেক কথা শুনেছি আর না। যেখানে আমার বড় আপুর হাসবেন্ড কলেজের শিক্ষক, সেখানে আমায় কি করে একজন সামান্য হাফেজের সাথে বিয়ে দিবেন। কিন্তু তারা জানেনা, যে আমার কাছে এটা মোটেও কোন সামান্য ব্যপার না। হয়তো আমার বড় আপুর স্বামীর অনেক টাকা থাকতে পারে, কিন্তু আমার কাছে তা কোনো ম্যাটার না বরংং আমি এমন কাউকে আমার জীবনসঙি হিসেবে চাই, যে আমায় জান্নাতের পথে হাটতে শিখাবে। আমার জন্য অনেক বড় বড় ফ্যামিলি থেকে বিয়ের প্রপোজাল আসতে লাগলো কিন্তু আমি সব ক্যান্সেল করে দিতে লাগলাম। এক পযায়ে সবাই আমার উপর  রেগে গেলেন। আত্নীয় স্বজনেরা নানারকম গুজব রটাতে লাগলো আমার নাকি জ্বীনের আছড় আছে তাই বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিনা।

তাই আমি সবার আশা বাদ দিয়ে, আমার আশা, ভরসা, নির্ভরতার প্রথম আর শেষ আশ্রয়স্থল, সেই মহান রব্বুল আলামিনের নিকট চাইতে লাগলাম যিনি, আমাকে তার হিদায়াতের রঙে রঙ্গিন করিয়েছেন, দ্বীনের পথে প্রত্যাবর্তন করিয়েছেন, তার কাছে তাহাজ্জুদে আকুল ভাবে চাইলাম,

“রব্বানা হাবলানা মিন আজওয়াজিনা ওয়্যা জুররি-ইয়াতিনা কুররাতা আইয়ুনিও ওয়াজাআলনা লিলমুত্তাকিনা ইমামা”

এরপর আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করলেন,

আমার জন্য একজন উত্তম জীবনসঙ্গী মিলিয়ে দিলেন, যিনি হাফেজ এবং আলেম। ঢাকায় একটি মাদ্রাসার খিদমতে আছেন, এবং পাশাপাশি মসজিদের ইমাম।

আমি রাজি হলাম আর আল্লাহর দরবারে হাজারো শুকরিয়া আদায় করলাম ( আলহামদুলিল্লাহ)

যথাসময়ে আমাদের বিয়ের দিন ঠিক হলো, এবং আমার আর তার ইচ্ছেতেই সম্পুর্ন সুন্নাহ মোতাবেক বিয়ের কাজ সম্পাদনা হলো।

আলহামদুলিল্লাহ!!

সবকিছু যদিও ভালোভাবে মিটে গেল

কিন্তু আবার আমার  কপালে এত সুখ সহ্য হলোনা, আমায় বিদায় দেওয়ার পরেই আমার আব্বুর ষ্ট্রোক হয়, মেডিকেল নিয়ে যেতে ধরলে পথেই তিনি মৃত্যুবরন করেন।

ইন্না -লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন।

আমি শ্বশুরবাড়িতে না পৌছাতেই আব্বুর অসুস্থতার খবর পাই তারপর উনি আবার গাড়ি ব্যাক করে নিয়ে আসে আমায়।

এসে দেখি আব্বুর নিথর দেহখানা পড়ে আছে।

আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। অনেকে অনেক কথা বলে আমায়, আমি নাকি অপয়া।  আমার জন্য আমার আববুর আজ এমন হয়েছে। আমি সব শুনে শুধু আল্লাহকে বিচার দিয়েছি।

এরপর আব্বুর জানাজা আমার “উনি” করায়।

দাফন সম্পুর্ন  হয়ে গেলে আমায় আবার নিয়ে যাওয়া হয় শ্বশুরবাড়িতে।

এরপর শুরু হলো আমার সংংসার জীবন।

শ্বশুরবাড়িতে এসে অনেক কিছুই পারতাম না করতে, আবার পর্দা মেইনটেইন করার জন্য অনেক সময় রুমের বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারতাম না বলে,  শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিভিন্ন কথা শুনাতো। আমি সব শুনে যেতাম আর আল্লাহ কে বলতাম __

আল্লাহ আমায় ধৈর্যদান করো।

আর কেউ না জানুক তুমি তো জানো মাবুদ

আমি তোমার নৈকট্য লাভ করার জন্য সব দুঃখ কষ্ট হাসিমুখে মেনে নিতে পারি।

আল্লাহ তা’আলা এবারেও আমার সহায় হলেন,

আমায় বেশিদিন এই কষ্ট সহ্য করতে হলোনা।

আমার “উনি” ঢাকায় একটি বাসা ভাড়া নিলেন এরপর আমায় সেখানে নিয়ে গেলেন।

ঢাকায় গিয়ে দুজনের সংসার সুন্দরভাবেই চলছিল আল্লাহর রহমতে। আমরা একে অপরের পরিপুরক হয়ে থাকলাম৷ কিন্তু তারপরেও আমাদের মধ্যে আরেকটি অভাববোধ দেখা দিল, আর তা হচ্ছে একটি সন্তানের। বিয়ের অনেকদিন পার হয়ে গেল ঠিকই কিন্তু আমি একটি সন্তানের জন্ম দিতে পারলাম না। এটা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বললো, আমি শুধু আল্লাহর কাছে চাইলাম।এরপর আমার “উনি” আমায় নিয়ে একজন গাইনি চিকিৎসকের কাছে গেলেন, ওনার চিকিৎসা নিয়ে আল্লাহর রহমতে আমার কনসেপ্ট হলো, যেদিন এই খবরটা পেলাম সাথে সাথে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম দুই রাকআত নফল সালাত আদায় করে।

কিন্তু এই খুশিও বেশিদিন স্থায়ী হলো না।

আমার বাচ্চাটা মিসকারেজ হয়ে গেল। সেদিন আমি এত কষ্ট পাইলাম  যেন কাদতে ভুলে গেলাম। কিন্তু সব সময়ের মত আমার “উনি” আমায় সবর করার উপদেশ দিলেন আর সুরা আল-বাক্বারাহ এর ১৫৩ নং আয়াতের কথা স্মরন করিয়ে দিলেন__

       হে ঈমানদারগণ ! তোমরা সাহায্য চাও সবর ও সালাতের মাধ্যমে। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ সবরকারীদের সাথে আছেন 

আমি ধৈর্য্যধারন করলাম। এরপর আবার কন্সেপ্ট করলো, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে এবারেও আমার বাচ্চাটাকে দুনিয়ার আলো দেখাতে পারলাম না।

পরপর দুবার এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মিসকারেজ হওয়ার পর আমি মানুষিক ভাবে খুব ভেঙে পড়লাম। মনে হতে লাগলো আল্লাহ কেন আমার এত পরিক্ষা নিচ্ছেন, খুব কান্নাকাটি করতাম৷ কিন্তু আমার উনি মানষিক ভাবে খুব দৃঢ় ছিলেন, আমায় বুঝাতেন, যে  আল্লাহ  হযরত ইবরাহিম (আঃ) কে ৮০ বৎসর পর সন্তান দান করতে পারেন, তিনি অবশ্যই আমাদের দোয়া কবুল করবেন।

সত্যি সত্যি ওনার কথা ঠিক হয়েছে, আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করেছেন, আমি আবার সন্তানসম্ভবা। এবার উনি পুরো সময়টা জুড়ে আমাকে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে সাহায্য করেছেন। সম্পুর্ন বেডরেষ্টে রেখে সাতমাস যখন অতিবাহিত হলো তখনই হঠাৎ একদিন আমার পেইন শুরু হলো, উনি আমায় ক্লিনিক নিয়ে গেলেন, ঢাকায় তেমন কোন পরিচিত আত্নীয় না থাকায় পাশের ফ্লাটের এক খালাম্মাকে নিয়ে গেলাম আমরা।

ডক্টর আমাকে দেখে বললো যে,  বাচ্চার অবস্থা ভালো না, ওনাকে এক্ষুনি সিজার করাতে হবে।

এই কথা শুনার পর আমি খুব ভেঙে পড়লাম।

আমি মোটেও সিজার করতে রাজি হলাম না।

তখন আমার উনি আমায় বুঝাতে লাগলো যে, অন্তত আমাদের বাচ্চাটার কথা ভেবে রাজি হয়ে যাও। আমি ওনার মলিন মুখ আর একটা সন্তানের জন্য হাহাকার ভরা চোখ দেখে রাজি হলাম।

দুপুর ২ টায় আমার সিজার। আমার উনি নামাজে গেছেন, এরমধ্যে একজন নার্স এসে বলে গেলেন, ও.টি তে যাওয়ার জন্য রেডি হন।

আমার সাথের খালাম্মা আমায় তাড়া দিচ্ছিলেন, আমি খালাম্মাকে বললাম খালাম্মা আমায় যোহরের ৪ রাকআত ফরজ সালাত আদায় করার সময় দিন, উনি আমায় ধরে বাথরুমে নিয়ে গেলেন আমি অযু করে এসে সালাতে দাড়িয়ে গেলাম। অনেক পেইন নিয়ে সালাত শেষ করলাম,

সালাত শেষে দোয়া করতে লাগলাম।

আল্লাহ আমার মনের আশা পুরন করে দাও

আমার সন্তানকে সুস্থভাবে পৃথিবীর আলো দেখাও।

ও ইজ্জতের মালিক তুমি আমায় কোন বেইজ্জতি করিও না। অনেক কান্না করলাম দোয়ায়।

এরপর প্রচন্ড পেইন অনুভব করলাম।

খালাকে বললাম খালা আমায় একটু ধরুন।

খালা আমায় ধরলেই আমার বাচ্চা প্রসব হয়ে গেল খুব তারাতাড়ি। আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম।(আলহামদুলিল্লাহ)

কোন সিজার অপারেশন ছাড়াই আমার আল্লাহ সুন্দর ফুটফুটে একটা ছেলে দান করলেন আমায়।

বর্তমান আমি__

আল্লাহর অশেষ রহমতে অনেক ভাল আছি নিজের পরিবার নিয়ে।

পাশাপাশি, একটি মাদ্রাসার খেদমতে আমায় আল্লাহ কবুল করেছেন। আর মাদ্রাসার প্রত্যেকটা বাচ্চার কাছে আমি যেন তাদের হাসিমুখ। আমার নাম মুক্তা, যার অর্থ হচ্ছে মুল্যবান বা অহংকারী বস্তু। কিন্তু আমার নামের সাথে আমার কোন মিল নাই। আমি একদম নিরহংকার একটা মানুষ। সবার সাথে মিলেমিশে হাসিখুশি থাকি। তাই তারা আমার নাম দিয়েছে,

মারইয়াম।

মুক্তা থেকে মারইয়াম।

Facebook Comments

Related posts

নীড়ে ফেরার গল্প-১ | মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ 

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প -১৯ | নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-৪৮ | সিলভিয়া সিলভি

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!