সংকলন
প্রতিযোগিতা-২

নীড়ে ফেরার গল্প-১০ | আইশা সিদ্দিকা ( ছদ্মনাম)

আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি কখনই ইসলাম বিদ্বেষী ছিলাম না। তবে ইসলাম বলতে জানতাম শুধু নামাজ রোজা হজ্জ এতোটুকুই। আমি জেনারেল লাইনের একজন ছাত্রী হওয়ায় ইসলামের ব্যাসিক জ্ঞানটুকুও ছিলো না আমার। নামাজে কখনই নিয়মিত ছিলাম না , যখন কোনো সমস্যায় পরতাম অথবা ভীষণ মন খারাপ থাকতো আমি নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতাম। ব্যাস এতোটুকুই।তারপর যখন সব ঠিক হয়ে যেতো আবার নামাজ ছেড়ে জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরতাম। এমনই গাফেল বান্দা ছিলাম আমি। আমার পরিবারের অবস্হা আরো খারাপ। দুঃখজনক ভাবে আমার পরিবারের কেউ ই দ্বীনদার নয়, দ্বীন সম্পর্কে নূন্যতম ধারনাও নেই এমন পরিবারেই আমার বেড়ে উঠা৷ মডারেট মুসলিম পরিবার যেমন হয় অনেকটা তেমন। ইসলাম নিয়ে বিদ্বেষ না থাকলেও ইসলাম নিয়ে আগ্রহও তেমন একটা নেই বললে চলে। বর্তমান সমাজের অন্য ৮-১০ টা মডারেট মুসলিম পরিবারের মতো আমার পরিবারের কাছে ইসলাম কেবলই নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাতে সীমাবদ্ধ। কেউই নামাজে নিয়মিত নয় শুধু আমার বাবা ছাড়া।

এমন পরিবারে বেড়ে উঠা এই আমার বিভিন্ন কারনে ছোটোবেলায় কুরআন পড়াটাই শেখা হয়নি ঠিকমতো।  অবশ্য এই ব্যাপারে কেউ সেভাবে কোনোদিন গুরুত্ব দেইনি৷ তবুও যতোটুকু শিখেছিলাম তাই দিয়েই কুরআন পড়তাম মাঝে মাঝে। কুরআন বুঝতাম না তবুও কেনো জানি ভালো লাগতো পড়তে।  নাচ- গান,ডিবেট সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমার খুব আগ্রহ ছিলো। এইসব নিয়েই সময় কাটাতাম। আমি ছোট থেকে শুধু যে দ্বীনহীন পরিবারে বড় হয়েছি কেবল এমনটাই নয় জীবনের অনেক খারাপ সময়ের মুখোমুখিও হতে হয়েছে আমাকে। আর, তার কারন হলো আমারই বাবা- মা। আমি যখন নবম শ্রেনীর ছাত্রী তখন আমার বাবা মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার মতো অবস্হা তৈরী হয়। সামনেই ছিলো আমার পরীক্ষা অথচ বাসায় সারাদিন অশান্তি লেগেই থাকতো এতোটা খারাপ অবস্হা ছিলো যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আর এই ছাড়াছাড়ির কারন ছিলো  তাদের সব বিষয়ে মত পার্থক্য,কেউই সহনশীল ছিলো না কারো ব্যাপারে। তাই ছোট ছোট বিষয়েও খুব ঝামেলা হতো।  সম্পর্ক এতোটাই তিক্ত হয়ে গিয়েছিলো যে তাদের পক্ষে একসাথে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব ছিলো না।  যদিও মহান আল্লাহর দয়ায় সেইবার আমার পরিবারটা ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পায় ।

Tijarah Shop

আমার বাবা মা আমাদের কথা ভেবে শেষপর্যন্ত সমঝোতা করে নেয়৷ কিন্তু সেই দুঃষহ স্মৃতি সেই যন্ত্রনার কয়েক বছর এখনো আমাকে ভীষন ভাবে পীড়া দেয়৷ এমন কতো রাত কেটেছে আমার একাকী শুধু মনে চাপা কষ্ট আর চোখে জল নিয়ে। কতো রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি অথচ কেউ সাহায্যের হাত বাড়ায়নি, সাহায্য দূরে থাক আমার খারাপ থাকার গল্পগুলো শোনার মতো কেউ ছিলো না। তখন প্রথম উপলব্ধি হয় দুনিয়াতে যার যার জীবন কেবলই তার। আপন জনের অপরিচিত মুখের কাছে দুনিয়ার সব তুচ্ছ হয়ে যেতে পারে এক নিমিষেই। বাবা- মা আর আশেপাশের মানুষ এবং জীবনের প্রতি চরম বিদ্বেষ নিয়ে জীবন কাটতে থাকলো আমার। শুধু যতোটুকু পারতাম আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতাম। কারন আমি জানি সেই একাকী প্রতিটি নির্ঘুম রাতের কান্না  আমার আল্লাহ ছাড়া আর কেউ দেখেনি। আমাদের তিন ভাইবোনের মধ্যে বাবা মায়ের এইসব সমস্যার জন্য সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয়েছি আমি৷  একটা সময় তো আমি নিজেকে শেষ করে দিতেও চাইতাম তবু আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু এতোটাই অকৃতজ্ঞ আমি ছিলাম যে, সব যখন ঠিক হয়ে গেল তখন আল্লাহকেই ভুলে গিয়েছিলাম।রবের সাহায্য পাওয়ার পরও বারবার অকৃতজ্ঞ বান্দার মতো, আমার রব থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম আমি। এভাবে দ্বীনহীন অবস্হায়  কেটে গেছে আমার জীবনের বাইশটি বছর।

অতঃপর…

করোনার কারনে সব বন্ধ, লকডাউন শুরু হয়ে গিয়েছিলো। মনে একটা ভয় ঢুকলো এক অদৃশ্য ভাইরাসে কাবু গোটা বিশ্ব। এই ভাইরাসের সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতা তাহলে কতোটাই না বিশাল৷ নিজেকে নিয়ে জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবা শুরু করলাম।  রমজান মাস এলো। রোজা রাখা শুরু করলাম। এমনিতেই রোজার মাসটা আমার ভীষণ ভালো লাগতো। এছাড়া ঘরে বসে এবার হাতে অনেক সময় ঠিকমতো রোজা,  নামাজ আদায় করার৷ আমি নিয়মিত সঠিক সময়ে নামাজ আদায় শুরু করলাম। ফেইসবুকে বিভিন্ন ওয়াজ,  ইসলামিক লিখাগুলো আমার সামনে আসতো আমি মন দিয়ে দেখতে লাগলাম। কেনো জানি ভালো লাগতো অনেক। তারপর একদিন হঠাৎ করেই মোবাইলে আল কুরআনের এপস নামালাম। শুরু করলাম অনুবাদ পড়া৷ এই প্রথম প্রতিটি আয়াত যেনো আমার সাথে কথা বলা শুরু করলো। এতোটা প্রশান্তির বাণী আমি যেনো আগে কখনও শুনিনি৷ যা শুনি সব মিলে যাচ্ছিলো। মনে হলো আমার রব সরাসরি আমার সাথে কথা বলছেন। এমনিতে আমি চাপা স্বভাবের, মন খুলে সহজেই কাউকে দুঃখবোধ কিংবা সুখবোধ খুলে বলতে পারতাম না৷  আমার হারাম সম্পর্ক ছিলো তবুও আমি সুখী ছিলাম না৷ সবসময় একটা গাইডলাইন অথবা এমন কোনো বন্ধুত্বের প্রয়োজন অনুভব করতাম যা আমাকে সঠিক পথ দেখাবে। মোটকথা আমার জীবনটা বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো পাশে কাউকে চাইতাম কিন্তু কখনোই পাইনি৷ সবাই ভুল পথ দেখাতো যার দরুন বারবার পাপের দিকে ধাবিত হয়েছি৷ কিন্তু হঠাৎ এক দুপুরে, সৃষ্টিকর্তার প্রেরিত এই বাণী আল কুরআন আমার সব এলোমেলো করে দিলো। মনে হলো এই প্রথম আমি এমন একজন অভিভাবক পেলাম এই জীবনটা সঠিক ভাবে বয়ে নিয়ে যাওয়ার, এই প্রথম কেউ আমাকে হয়তো বুঝলো। আকস্মিক এক দুপুরে আমাকে স্বয়ং আল্লাহ ই শেখালেন জীবনের মানে। হঠাৎ আমার মনে হতে লাগলো আমি যেনো সব পেয়ে গেছি যা আমি এতোদিন ধরে খুঁজেছি।

যে ব্যক্তি রাত্রিকালে সিজদাবনত হয়ে এবং দাঁড়িয়ে ইবাদত করে, পরকালকে ভয় করে এবং তাঁর প্রতিপালকের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে, (সে কি তার সমান, যে তা করে না?)বল, ‘যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান? বুদ্ধিমান লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে। (সুরা যুমার- আয়াত ৯)

সুরা যুৃমারের আয়াত গুলো আমার ভিতরে আলোড়ন তৈরি করেছিলো সেদিন। আমি আরো বেশি কুরআন পড়া শুরু করলাম, আরো জানা শুরু করলাম৷ অতঃপর আমি পেয়ে গেলাম  আল্লাহর দেয়া সবচেয়ে বড় নিয়ামত তার প্রদত্ত হিদায়াত, তার রহমত৷ আচ্ছা যে আল্লাহকে পেয়ে যায় তার কি আর কিছু পাওয়ার প্রয়োজন থাকে? যে বন্ধুত্ব চায়, বন্ধুত্বে আল্লাহই যে তার জন্য যথেষ্ট।

আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন উত্তম বাণী সম্বলিত এমন এক গ্রন্থ, যাতে পারস্পরিক সাদৃশ্যপূর্ণ একই কথা নানাভাবে বার বার বলা হয়েছে। এতে যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে। তাদের চামড়ার (লোম) খাড়া হয়, অতঃপর তাদের দেহ-মন আল্লাহর স্মরণের প্রতি নরম হয়ে যায়।এটিই আল্লাহর পথনির্দেশ, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দিয়ে পথপ্রদর্শন করেন। আল্লাহ  যাকে বিভ্রান্ত করেন, তার কোন পথপ্রদর্শক নেই।( সুরা যুমার- আয়াত ২৩)

এই আয়াত গুলো পড়ার পর  আনন্দ অশ্রুতে সিক্ত হয়েছিলাম আমি।  এতোদিন শুনতাম কুরআন মানুষকে বদলে দেয়৷ আর সেদিন নিজে প্রত্যক্ষ করলাম কিভাবে কুরআন আমাকে বদলে দিয়েছে। স্বয়ং আল্লাহ আমার অন্তরকে তার স্মরনে সাহায্য করেছে। যখন মহান আল্লাহ ই সাহায্যকারী হয়ে যায় সেই মুহুর্ত প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই৷ শব্দের আর কতোটুকু ক্ষমতা আছে এই ভালোবাসা প্রকাশ করার!

তারপর থেকে কেটে গেছে সাতটি মাস। আমি আলহামদুলিল্লাহ নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করেছি, সব ধরনের হারাম  থেকে বের হয়ে এসেছি তওবা করে, পর্দা শুরু করেছি, ইবাদাত,ইলম অর্জনে নিজেকে নিয়োজিত রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।  আমার পরিবার যেহেতু মডারেট, তাই পর্দা কিংবা ইবাদাতে খুব একটা উৎসাহ পাই না। পরিবার চায় আমি তথাকথিত উচ্চ ডিগ্রীধারী মর্ডাণ হই যাতে সবাই প্রশংসা করে৷ তারা চায় অনেক পড়ালেখা করে বড় ব্যাংক কর্মকর্তা যেনো হই, যেনো নিজেকে পর্দা আবৃত না করে মর্ডাণ তরুনীদের মতো সাজিয়ে রাখি যাতে সবাই দেখে প্রশংসা করে। একসময় আমিও তাদের মতো করে ভাবতাম৷ আর আজ এইসব চাইনা বলে প্রতিনিয়ত কথা শুনতে হয়।নিকাব পরতে গেলে হতে হয় বাধার সম্মুখীন৷ সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পরি যখন কোনো অনুষ্ঠান কিংবা বিয়ের দাওয়াত পাই তখন, কারন পরিবার চায় আমি পর্দা না করে অনুষ্ঠান গুলোতে অংশ নেই এভাবে শুরু হয় বাসায় ঝামেলা। পরিবার চায় এতো অল্প বয়সেই যেনো আমি নিজেকে এভাবে সবকিছু থেকে গুটিয়ে না ফেলি। তাদের ধারনা

আমি জীবনকে উপভোগ করার সব রাস্তা বন্ধ করে ফেলেছি অথচ এটাই যে এখন আমার কাছে সফলতার একমাত্র পথ তা আমি কি করে বুঝাই! বিয়ের পাত্র দেখার সময় পর্যন্ত তারা চায়  পাত্রের সামাজিক প্রতিপত্তি অথচ আমি যে কেবলই একজন দ্বীনদ্বার মানুষ চাই যার সাথে থাকলে আমরা রবের কথা স্মরণ হবে। তাদের ছুড়ে দেয়া কথার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হই বারবার। সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগে কাছের মানুষদের গাফেল অবস্হা দেখে! আমি চাই তারা তাদের ভুলগুলো বুঝে নিয়ে ফিরে আসুক। ক্ষতবিক্ষত অন্তর নিয়ে আমি রবের দুয়ারে হাত তুলি বারবার।আমি জানি যিনি আমাকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন তিনিই সকল সমস্যার সমাধান করে দিবেন। আমাকে যে সেই পর্যন্ত সবর করে যেতেই হবে। এভাবে জীবনের মহৎ উদ্দেশ্যের পানে হেঁটে চলেছি কারন আমি যে মহাসাফল্য অর্জন করতে চাই, দুই দিনের দুনিয়ার মোহে আটকে পরতে চাইনা কোনোভাবেই। আমি অনুধাবন করেছি জীবনের যাবতীয় সমস্যা, পারিবারিক কলহ, জীবন নিয়ে হতাশা সবকিছুর মূল কারন আমরা ইসলাম থেকে দূরে সরে গেছি। যতোদিন না আমরা কুরআন এবং সুন্নাহ কে আঁকড়ে ধরতে পারবো ততদিন আমরা কোনোভাবেই ভালো থাকতে পারবো না। সাত মাসেই বুঝেছি এই সফলতার পথে হাটার রাস্তাটা মসৃণ নয়, পদে পদে বাঁধার সম্মুখীন হতে হয় তাও আবার নিজেরই কাছের মানুষ হতে। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু,কাছের মানুষরা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে, দূরে সরে যাচ্ছি আমিও। তবু ভেঙে পরিনা, দ্বীনের স্বার্থে রবের নিকটবর্তী হওয়ার প্রয়োজনে এইসব বাঁধা তুচ্ছ হয়ে যায় আমার কাছে। এই একাকীত্বও যে নিয়ামত কারন তা আমাকে রবের নিকটবর্তী হতে সাহায্য করে। এখন কেবল একটাই চাওয়া আমার রবের সন্তুষ্টি৷ রবকে সন্তুষ্ট করে মৃত্যুবরণ করতে পারাটাই আজ আমার কাছে  পরম  সৌভাগ্য।  কুরআনের আয়াতে আমি এতোটাই মানসিক শক্তি পেয়েছি যাতে আর কোনো বাঁধাকেই  কঠিন মনে হয়না আমার। রবের নিয়ামতে যে নীড়ে আমি ফিরেছি, তাই আমার কাছে জগতের সবকিছুর চেয়ে মূল্যবান৷ ইনশাআল্লাহ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই নীড়ের ছায়াতলে আমার রবের ইবাদাত করতে করতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে চাই। সাথে এটাও চাই আমার পরিবার, আমার প্রিয়জন সকলকে নিয়ে এই নীড়ের বাসিন্দা হওয়ার। এই নীড়ের সুশীতল ছাঁয়ায় ধন্য করতে চাই নিজেকে ইসলামের খিদমত করে। সবার কাছে দুআ প্রার্থী। সকল প্রশংসা এই বিশ্বজগতের প্রতিপালকের জন্য যিনি তার বান্দাকে স্বীয় রহমতে পথ প্রদর্শন করে থাকেন।

 

Facebook Comments

Related posts

নীড়ে ফেরার গল্প-৪৭ | আল হুসাইন

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-৪২ | পার্থ (ছদ্মনাম)

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-১৬

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!