আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ।
আমার গল্পটি হিদায়তের পথে কিভাবে এসেছি সে বিষয়ে নয়,বরং হিদায়াতের পথে চলে কি কি উপকৃত হয়েছি সে বিষয়ে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে চলার চেষ্টা করে আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জায়গায় প্রতিদান দেন,তাই বোনদের কে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে চলতে উৎসাহিত করা ই আমার এ লিখার উদ্দেশ্য। কেউ না কেউ অনুপ্রাণিত হবে ভেবেই বিষয় গুলো শেয়ার করছি।
শিক্ষা জীবনের প্রাপ্তি গুলো
আল্লাহ তায়ালার অসীম রহমতে ছোটো বেলা থেকেই আমি নামাজ,কুরআন, পর্দায়, ইসলামি সাহিত্য অধ্যায়নে মনোযোগী।এসব পালনে আমাকে কেউ কখনো জোর করতে হয়নি আলহামদুলিল্লাহ।১০ বছর বয়স থেকেই বাহিরে যেতে বোরকা পরার সাথে সাথে বাসায় ও খালাতো /মামাতো /ফুফাতো ভাই দের সাথে পর্দা করেছি। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কখনো কোনো নন মাহরাম কাজিনদের সাথে সম্পর্কের সীমা অতিক্রম করিনি আলহামদুলিল্লাহ। এস.এস. সি.পর্যন্ত গার্লস স্কুলে ছিলাম, ওখানে টিচার,দপ্তরি,ক্যান্টিন সুপার সবাই ই ফিমেল হওয়ায় কখনো পর্দা পালনে সমস্যা হয়নি।বিপত্তি শুরু হলো কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে। নিকাব পরে থাকার অজুহাতে কলেজে অনেক বার ই টিচার আমাকে ক্লাশ থেকে বের করে দিয়েছিলেন। অনেক অপমানজনক অপবাদ শুনতে হতো। নতুন পরিবেশে মানিয়ে চলতে কষ্ট হলেও সবর করেছিলাম। টিচারদের নিষেধ অমান্য করে বোরকা,নিকাব অব্যাহত রাখায় কয়েকজন টিচার আমার উপর খুব ক্ষিপ্ত ছিলেন। একবার বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতা চলছিলো, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে সহপাঠীদের খেলা দেখছিলাম,হঠাৎ এক জন টিচার এসে সবার সামনে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘মুসল্লিরা এখানে কি করে, যাও বাসায় গিয়ে তসবিহ টিপ ‘ আরও কিছু বলে সাথে সাথে কলেজ থেকেই বের করে দিলেন। সেদিন খুব মন খারাপ হয়েছিল কিন্তু কাউকেই কিছু বলিনি।
আরেকবার কলেজ থেকে শিক্ষা সফরে সবাইকে যেতে বাধ্য করতে টিচারগণ বলেছিলেন,’যারা যারা শিক্ষা সফরে যাবেনা তাদেরকে প্রেক্টিক্যাল এ নাম্বার দেয়া হবেনা।(বোর্ড পরীক্ষার নম্বরের সাথে এটা যোগ হয়) তবুও আল্লাহর উপর ভরসা করেছিলাম,মাহরাম ছাড়া সফরে যাওয়া নিষেধ তাই যাইনি। সে বছর কলেজ ম্যগাজিন এ “ইসলামে নারীর অধিকার ও মর্যাদা ” শিরোনাম এ একটি লিখা দিয়েছিলাম,ওটা প্রকাশ হয়েছিল, পরের বছর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে অনেক সিনিয়র ছাত্র/ছাত্রী সবার মধ্যে প্রথম স্থান লাভ করেছি আলহামদুলিল্লাহ। এ দুটো ঘটনার পরে টিচারদের মনে আমার প্রতি ক্ষোভ পরিবর্তন হয়ে স্নেহ, ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। এরপর আমার প্রেক্টিক্যাল নাম্বার পেতে এবং পর্দা মেইনটেইন করে চলতে আর কোনো সমস্যা হয়নি,এমন কি আল্লাহর রহমতে আমার টিচারগন সাপোর্ট করায় ভাইভা বোর্ড এ এক্সটার্নাল গণ ও নিকাব পরা নিয়ে কিছু বলেননি,আলহামদুলিল্লাহ। একাডেমিক শিক্ষা জীবনের শেষ বর্ষে unfortunately, আমাদের ডিপার্টমেন্ট হেড হিসেবে একজন কড়া স্যার জয়েন করেন, যিনি ছিলেন সেকুলারিজম এর স্ট্রং ফলোয়ার।উনার রুলস ছিল, উনার ক্লাশে বা বাসার কোচিং এ কোনো ছাত্রী নিকাব দিয়ে বসতে পারবেনা এবং উনার কাছে যারা প্রাইভেট পড়বে তারা ছাড়া আর কারো ভাইবা বা টিউটোরিয়াল এ উনি মার্কস দিবেন না। তো উনার সামনে এবং সহপাঠী ছাত্রদের সামনে নিকাব ছাড়া থাকার বিষয় টি এভয়েড করে আমি উনার কোচিং এর খাতায় নাম লিখিয়ে না পড়ে প্রতি মাসেই আমি উনার অনারিয়াম পাঠিয়ে দিয়ে বলতাম, আমার ছোট বেবী কে রেখে আসতে অসুবিধা এজন্য ক্লাশে বা কোচিং এ এটেন্ড করছিনা। (আসলে মেইন রিজন ছিল পর্দা লংঘনের আশংকা) After all ফাইনাল পরীক্ষায় আমি শতাধিক স্টুডেন্ট দের মধ্যে ৪থ স্থান অধিকার করি।যারা নিয়মিত ক্লাশ, কোচিং করেছে অনেক নিকাবধারীরা ও পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট এর আশায় সেই স্যারের নোট পেতে নিকাব ছেড়ে উনার কাছে পড়ে ও প্লেসে থাকতে পারে নি,তাদের তুলনায় আমার এ প্রাপ্তি আল্লাহর সীমাহীন অনুগ্রহে ই সম্ভব হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।
পারিবারিক জীবনের প্রাপ্তি গুলো
আমার ব্যতিক্রমী চলনে আমার মুরব্বি আত্মীয়গণ আমাকে অধিক স্নেহ করেন,ছোটো রা সন্মান করে আলহামদুলিল্লাহ।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় অধিকাংশ মেয়েদের কেই পাত্রী দেখা অনুষ্ঠানে অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়,অনেক ইন্টারভিউ এর মুখোমুখি হতে হয়।দয়াময় আল্লাহ আমাকে জীবনের এ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে ও রহম করেছেন।জীবনে একবার ই পুরুষের(পাত্র) সামনে গিয়েছি, বিয়ের উদ্দেশ্য পাত্র পাত্রী কে দেখতে আসা জায়িজ হলেও অধিক পর্দাশীলতার কারণে পাত্রের সামনে যেতে আন ইজি ফিল করেছিলাম,বোরকা ছাড়া ই এমন ঢেকে গিয়েছিলাম যে উনি আমাকে বিন্দু পরিমাণ ও দেখেন নি, উনি আমাকে কুরআন তিলাওয়াত করতে বললেন, আর ‘তাকওয়া’ সম্পর্কে অর্থসহ কুরআনের একটি আয়াত ও একটি হাদিস বলতে বললেন, আল্লাহর রহমতে সঠিক জবাব দিতে সক্ষম হয়েছিলাম।(পরে জেনেছি আমাকে না দেখলে ও পর্দাশীলতা এবং ধার্মিকতায় উনি আকৃষ্ট হয়েছেন)আলহামদুলিল্লাহ। শশুরবাড়িতে সবচেয়ে ছোটো সদস্য হওয়া সত্ত্বেও যথেষ্ট শ্রদ্ধা, ভালোবাসা,আন্তরিকতা পাচ্ছি আলহামদুলিল্লাহ, যদিও প্রথম প্রথম উনারা পর্দার বিষয়ে কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু এখন সবাই কল্যাণের পথ টি কেই প্রাধান্য দিচ্ছেন আলহামদুলিল্লাহ।
সামাজিক জীবনের প্রাপ্তি গুলো
বান্ধবী, প্রতিবেশী, মুরুব্বী আত্মীয়দের কুসংস্কারে বিশ্বাস দেখে ব্যথিত হয়ে তাদেরকে শুধরানোর জন্য সময়োপযোগী কৌশল অবলম্বনের চেষ্টা করেছি।যারা পড়াশোনা করতে পারে তাদেরকে বিষয়ভিত্তিক বই পড়তে দিচ্ছি আর যারা পড়তে পারেনা বা পড়তে চায়না তাদেরকে বিনয়ের সাথে প্রচলিত ভুল-ভ্রান্তির অসারতা ও সঠিক তথ্য/করনীয় বুঝানোর চেষ্টা করছি।যেমন, বাচ্চাদের কপালের একপাশে কালো টিপ দেয়া প্রসঙ্গে মুরব্বিদের উদ্দেশ্যে বলেছি,আসলে আগে তো জ্ঞান চর্চা কম হতো, সহীহ হাদিস পড়ার সুযোগ ছিল না তাই মানুষ সঠিক নীতি বুঝতে অক্ষম ছিল,এখন তো জ্ঞান চর্চার অনেক সুযোগ সুবিধা হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ, তাই সহীহ হাদিস থেকে জেনেছি বদনজর থেকে হিফাজতের জন্য কি কি দুয়া পড়তে হয়,তাই টিপ না দিয়ে দুয়াগুলো পড়া ই তো ভালো তাইনা? এতে উনারা আরও জানতে আগ্রহী হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। সঠিক রেফারেন্স সহ বিভিন্ন কুসংস্কারের অপকারীতা তুলে ধরায় পরিচিত জন এবং মুরব্বিগণ খুশি হয়েছেন এবং দুয়া করছেন। আল্লাহর শুকরিয়া তিনি আমাকে সঠিক পথ,পন্থা অবলম্বনের তৌফিক দিয়েছেন,যদি আমি কুসংস্কার রীতি দেখে বিরক্তির সাথে বলতাম, এখনো সেকেলে রয়ে গেছেন,এ যুগে এসব চলবেনা, কি জানেন আপনারা -এরকম কথায় হয়তো উনারা বিব্রতবোধ করতেন,আমার উপর ক্ষুব্ধ হতেন,সংশোধিত না হয়ে নিজেদের মতের উপর দৃঢ় থাকতেন। এমন টি নিশ্চয়ই কারো জন্য ই কল্যাণকর নয়। তাই জ্ঞান অর্জন করা, নিজে সঠিক পথে চলার চেষ্টা করা, অন্যকেও এ ব্যপারে সহযোগিতা করা এবং সর্বদা সবার জন্য দুয়া করা আবশ্যক।
ফেসবুক অংগনে প্রাপ্তি গুলো
আগে ফেসবুক থেকে দূরে ছিলাম। ভাবতাম ফেসবুক ইউজ করা মানে সময় অপচয় করা, এটা থেকে বিরত থেকে নিজ আমল গুলো ঠিক রাখা ই ভালো। কিন্তু এখন ফেসবুকে এসে কিছু বোনদের দুরবস্থা দেখে মনে হচ্ছে,তাদের প্রতি তো আমার দায়িত্ব রয়েছে। আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করে আমাকে হিদায়ত দিয়েছেন, দ্বীনদার পরিবারে পাঠিয়েছেন, তাই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতেই আমি যতটুকু জেনেছি তা অন্যকে জানানোর চেষ্টা করা ও জরুরি। এজন্য ফেসবুক কে আমি দাওয়াহ এর একটি মাধ্যম মনে করি।যদিও পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে ফেসবুকে বেশি সময় দিতে পারিনা,তবুও আমি দুয়া করি, যতটুকু ই পারি, ফেসবুকের কাজ গুলো যেন আমার নাজাতের অন্যতম একটি উসিলা হতে পারে।
যখন আমার ফ্রেন্ড এবং কাজিনদের খাবারের পোষ্ট,ঘুরে বেড়ানোর ছবি, বার্থডে,মেরেজ এনিভার্সারির ছবি তে শতাধিক লাইক, কমেন্ট এর তুলনায় আমার নসিহাহ মূলক পোষ্ট গুলো নিঃস্ব,একাকী র মতো পড়ে থাকে, ফ্রেন্ড লিষ্ট এ প্রায় হাজার ফ্রেন্ড থাকলেও আমার দ্বীনি পোষ্ট গুলোতে তেমন সাড়া না পেলেও তখন আমি সন্তুষ্ট এই ভেবে যে,আমার কার্যাবলী তো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ই,তিনি ই এর প্রতিদান দিবেন। মাঝে মাঝে পরিবারের সদস্যবৃন্দ এই বলে নিরুৎসাহিত করে যে,’বন্ধ কর এসব! তোমার এগুলো কেউ পড়ছেনা’!,তখন কিছুটা লজ্জা পেলেও হাশরের মাঠে দাওয়াহ র কাজ করার প্রতিদান স্বরুপ সন্মানিত হওয়ার আশায় থাকি।
ফেসবুক অংগনে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো -দ্বীনদার সাথী পাওয়া।কারণ মানুষের জীবনে বন্ধুর প্রভাব অনেক।আমার মতো মনমানসিকতার কিছু বোন কে সাথী হিসেবে পেয়ে সত্যিই আমি অভিভূত। যাদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত আমি শিখার, জানার ও নিজেকে পরিশুদ্ধ করার সুযোগ পাচ্ছি আলহামদুলিল্লাহ।
প্রাপ্তির এমন অসংখ্য আরও উদাহরণ আছে, যা একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহে ই অর্জন হয়েছে।দুয়া করি আল্লাহ আমাকে রিয়া, ও অহমিকা থেকে হিফাজত করুন।
সবার উদ্দেশ্য পরামর্শ হলো-ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য বৃহৎ স্বার্থ কে ক্ষতিগ্রস্থ করবেন না প্লিজ।এ ক্ষনস্থায়ী দুনিয়ায় কিছু লাভের আশায় চিরস্থায়ী পরকালীন সাফল্য যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যপারে সচেতনতা জরুরি। আর যেকোনো সমস্যা কৌশলে মুকাবিলা করার চেষ্টা করতে হয়,অতি আবেগী হয়ে কিছু করা ঠিক নয়।আল্লাহ তায়ালা আমাদের কে দুনিয়া ও আখিরাতে তাঁর অসীম রহমতের ছায়ায় রাখুন,আমীন।
Facebook Comments