সংকলন
নীড়ে-ফেরার-গল্প
প্রতিযোগিতা-২

নীড়ে ফেরার গল্প-৩ | আবু মুসআব

নীড়ে_ফেরার_গল্প_সংকলন_২০২০

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা একটি সাধারণ মুসলিম পরিবারে।

ছোট বেলা থেকেই প্রকৃত ইসলাম কি সেটা জানতাম না। সলাত,সিয়াম,ঈদ এগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ একটি ইসলাম পেয়েছিলাম।ঈমানের চর্চা হত না,ইলমের চর্চা হত না। দ্বীনী শিক্ষা বলতে শুধু মক্তব্যে কিছু সূরা মুখস্ত আর নামাজ ট্রেনিং এটাই পেয়েছি।আট দশটা ছেলের মতই বস্তুবাদী চিন্তাভাবনা নিয়ে  বেড়ে উঠতে লাগলাম।মাধ্যমিক দিলাম,উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ভার্সিটিতে পদার্পণ । ভার্সিটিতে উঠে পুরোই বস্তিবাদী হয়ে গেলাম। ওই সময় ইসলাম শুধু নামাজেই সীমাবদ্ধ ছিল। নতুন রং বেরঙ এর হাওয়া মনে দোলা দিয়ে যাচ্ছিল। বন্ধুদের সাথে আড্ডা,রাজনীতি, উচ্চাবিলাসী স্বপ্ন নিয়ে ভালই যাচ্ছিল দিন। সময় টি ছিল ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর, কিছু বন্ধু,বড় ভাই এর মাধ্যমে সংশয়বাদের বীজ সুক্ষ্ণভাবে মনের মধ্যে বুনন  হয়ে গেল।এক সংশয়বাদী ভাই ইসলামের সত্যতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। তার প্রশ্ন গুলোর উত্তরনা জানার কারণে ইসলাম নিয়ে আমার মধ্যেও সংশয়ের বীজ থেকে গাছ বের হওয়া শুরু করে। এরপর আরেকজন বন্ধু সে ডারউইনের বিবর্তন সম্পর্কে আমাকে ধারণা দেয়।”বানর থেকে মানুষ হয়েছে”  বিবর্তন বলতে এর আগে শুধু এটাই জানতাম।  আর এটাকে হাস্যরসাত্মক ভাবে উড়িয়ে দিতাম।কিন্তু সে ছেলেটা খুব ডীপলি বিষয় টি উপস্থাপন করে। এমন কি প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে বস্তুবাদী জাগতিক একটি ব্যাখাও দেয়।ব্যাস,সংশয়  বাদের গাছ এর মাধ্যমে অনেক বড় হয়ে যায়।একটি পর্যায়ে আমি  এগুলোর সম্পর্কে জানার জন্য গুগলে সার্চ করি তখন নাস্তিক ব্লগারদের লেখা সামনে আসে। সেগুলো পড়ে ঈমান যা একটু ছিল সেটাও নাস্তিকতার সাগরের অতল গভীরে হারিয়ে যায়।  এরপর সামনে আবার আমার অনার্স১ম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা। একদিকে নাস্তিকতার মধ্যে ডুবে থাকা অন্যদিকে পরীক্ষা,এই দুটি বিষয় নিয়ে এত ডিপ্রেশনে ছিলাম যে কয়েকবার মনে হয়েছিল আমি মারা গেলেই ভালো হত।তবে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করি নি,কারণ আমি সত্য কি সেটা জানতে উদগ্রীব ছিলাম। “আল্লাহ নেই এটা সত্য হল সারাজীবন নাস্তিক থেকে যাব, আর আল্লাহ আছেন এটি প্রমানিত হলে  সারাজীবন উনার দাসত্ব করেই জীবন পার করে দিব” এই থীম নিয়ে শুরু করে দিলাম নেট ঘাটাঘাট, বই কেনা,বই ধার নেয়া ইত্যাদি। বিবর্তন,নাস্তিকতা টপিকে রাফান ভাই, আব্দুল্লাহ খান সাইদ ভাই,হামজা জর্সিস ভাই, এর কয়েকটি বই কিনলাম। আবার পাশাপাশি নেট থেকে লেকচার শোনাও শুরু করলাম। জাকির নায়েক এর is the Quran god’s word?

এই লেকচার টি শুনে কুরআনের সত্যতা সম্পর্কে মোটামুটি একটা  ধারণা পেলাম।পরবর্তীতে জাকির নায়েক এর  “Quran and bible in the light of science” এবং “Quran and the modern science” এই দুটি লেকচার মনযোগ দিয়ে শুনলাম। শুনে ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে আরও বেশি ধারণা লাভ করলাম। এরপর শুরু করলাম বিবর্তন নিয়ে  পড়াশোনা।  এর মধ্যে আমার পরীক্ষাও হাজির।পরীক্ষার পড়া একটু সামলিয়ে রিলিজিয়ন নিয়ে পড়তে শুরু করতাম।

এজন্য অবশ্য রেজাল্টও একটু খারাপ হয়েছিল কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড়। কারণ “ইসলাম যদি সত্য হয় কিন্তু একটু গাফিলতির জন্য যদি আমি নাস্তিক হয়ে মারা যাই তাহলে আখিরাতে অনন্ত জীবনে আমাকে আগুনে জ্বলতে হবে” । এই ভাবনা থেকেই আমি সিদ্ধান্তে কোন প্রকার ছাড় দেই নি।যাই হোক এরপর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে জানা শুরু করলাম। নাস্তিকরা উনার যে বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল সেগুলো নেটে সার্চ দিয়ে বা বই থেকে বিস্তারিত জানার  চেষ্টা করেছি।এক্ষেত্রে আমি নাস্তিকদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মিথ্যাবাদী ই পেয়েছি।আমি মূলত ৪টি পয়েন্টে ফোকাস করেছি।

 

১. মহাবিশ্বের সূচনা কি আপনাআপনি নিজে থেকে থেকে সম্ভব নাকি এটাকে একজন স্রষ্টা বানিয়েছেন।

২. মানুষের সৃষ্টি,সেটাকি বিবর্তনের মাধ্যমে পসিবল? 

৩. মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য নাকি মিথ্যা ছিলেন

৪. কুরআন কি মুহাম্মাদ সাল্লালাহু  আলাইহি ওয়াসাল্লাম  লেখা বা উনার নিজের বানী।

 

১ম পয়েন্টে পেলাম যে, আমাদের ইউনিভার্স এমন এক অসাধারণ ফাইন টিউনিং যা কোন ক্রমেই আপনাআপনি বা নিজ থেকে সৃষ্টি হতে পারে না।

২য় পয়েন্টে পেলাম বিবর্তনবাদ পুরোটাই ফাঁকা বুলি এই বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ আসা কখনোই সম্ভব নয়।কারণ বিবর্তনবাদীরা আজ পর্যন্ত প্রাণ কিভাবে এলো সেটারই ব্যাখ্যা দিতে পারছে না। আর বাদবাকি যা তারা বলে সেটার কোন প্রুফ তারা দেখাতে পারে না।

৩নং পয়েন্টের উত্তর পেলাম,উনি যদি মিথ্যা বাদী হয় তাহলে এই দুনিয়ায় কেউ সত্যবাদী নেই।প্রাচ্যবিদ,সেক্যুলার পশ্চিমারাও পর্যন্ত উনার সততার ব্যাপারে কোন প্রশ্ন তুলছে পারে নি।

সর্বশেষ,কুরআনের যে অসাধারণ সব মুজিযা পেলাম তা দেখে যে কোন সত্যান্বেষী এক বাক্যে স্বীকার করে নিবে কুরআনএকমাত্র বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহরই বানী।

আপনারা যদি কুরআনের যাস্ট শব্দগত যে মুজিযা আছে সেটা দেখতে চান,তাহলে নুমান আলী খানের ভিডিও গুলো দেখতে পারেন।সুবাহানাল্লাহ, এর পাশাপাশি  কুরআনের ভবিষ্যত বানীগুলো (যেমন ফিরাউনের লাশ) অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে।তাছাড়া কুরআনের যেসব বৈজ্ঞানিক আয়াত রয়েছে সেগুলোও একেকটা মিরাকল(মুজিযা)

১৪০০ বছর আগে আরবের একজন মরুচারীর পক্ষে এর যেসব বিজ্ঞানিক ফ্যাক্ট রয়েছে তা নিজ থেকে বলা কখনোই সম্ভব নয়।  সত্য বুঝার পর,নিজের মাথাকে সত্যের সামনে, বিশ্বপ্রতিপালকের সামনে অবনত করেছি।কারণ এই সত্যকে উপেক্ষা করার মত কোন উপায় কারও নেই।আর যে  সত্য বুঝতে পেরেও নিজেকে অহংকার বশত সত্য থেকে বিমুখ রাখে তার চেয়ে বড় জালিম আর হতে পারে??

একটা সময় ইসলামের প্রতি,সুন্নাহের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে এমন  বিভিন্ন বই কিনে, ডাউনলোড করে পড়তে শুরু করি।পরবর্তীতে একজন কাছের বড় ভাই থেকে কুরআন পড়া শিখেছি।আল্লাহ ভাইকে জাযা দান করুন।  এখন ইন শা আল্লাহ  কুরআনের তাফসির,হাদিস বিভিন্ন মাসয়ালা-মাসায়েল পড়ছি।  আলহামদুলিল্লাহ,সুন্নাহের প্রতি ভালোবাসার কারণে,প্রিয় মানুষটির পদাঙ্ক অনুসরণ করার প্র‍য়াসে পাঞ্জাবি,পড়া শুরু করি।প্রথম দিকে মা বাবা, আত্মীয় স্বজন  ব্যাচমেট,   অনেকে অনেক কথাই বলেছিল। হেসে বা মুখ বুঝে সহ্য করে গিয়েছিলাম।পরবর্তীতে যখন বাবরি চুল রাখার নিয়্যাত  করলাম। তখনই মানুষের বিভিন্ন ট্যাগ দেওয়া,আজেবাজে মন্তব্য করা শুরু হল। কেউ কেউ বলেছিল চট্টগ্রামে গিয়ে আমই নাকি মাইজভান্ডারি হয়ে গেছি। কেউ আমাকে পীরের মুরিদ ভাবা শুরু করেছে।ঘরে আব্বা আম্মার সাথে প্রায় বাদানুবাদ হত,এই চুল নিয়ে।৫ মাস  পর আর সহ্য করতে না পেরে বাবরি চুলের স্বপ্ন ত্যাগ করতে হয়েছিল। একটা সময় মা বাবা আত্মীয়স্বজনদের মাঝে অল্প পরিসরে দাওয়াহ’র কাজ করি। কাউকে বই হাদিয়া দিয়ে কাউকে অনুরোধের সুরে কথা বলে হালকা কিছু দাওয়াহ’র কাজ করেছি আলহামদুলিল্লা। এখন একটা স্বপ্ন আছে,ভবিষ্যতে নিজের ঘরের সামনের রুমে একটি ইসলামিক লাইব্রেরি বানানো।এতে বিভিন্ন ক্যাটাগরির বই থাকবে।কোনো যায়গায় থাকবে নাস্তিকদের প্রশ্ন খন্ডন,কোথাও  থাকবে আধুনিক ইসলামিক   রাইটার দের লেখা জনপ্রিয় ইসলামিক বই।আর অন্য একপাশে থাকবে কুরআনের তাফসির। অর্থসহ কুরআন, হাদিস,আর প্রয়োজনীয় কিছু ফিকহের বই।ইন শা আল্লাহ, আপনারা আমার জন্য দুয়া করবেন যেন আমার এই স্বপ্ন টি বাস্তবায়ন হয়। আর আমার পরিবার,আত্মীয় স্বজন এবং সামগ্রিকভাবে পুরো উম্মাহ’র জন্য  দুয়া করবেন যেন সবাই মিলে জান্নাতে যেতে  পারি ইন শা আল্লাহ।

Facebook Comments

Related posts

নীড়ে ফেরার গল্প-৪৫ | আবু তালেব (ছদ্মনাম)

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-২৭ | আবদুল্লাহ (ছদ্মনাম)

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-৪৪ | শ্বেত বামন

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!