সংকলন
নীড়ে ফেরার গল্প
প্রতিযোগিতা-২

নীড়ে ফেরার গল্প-২ | সবুজ পাতা (ছদ্মনাম)

আসসালামু আলাইকুম,
সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহু তায়া’লার জন্য।যিনি পথভোলা পথিককে আপন করে নিয়ে সকালে বের হয়ে যাওয়া পাখির মতো করে সন্ধ্যায় ঠিকই-ইই নীড়ে ফিরিয়ে আনে। আমি স্বভাবতই একটি নামমাত্র মুসলিমের ঘরেই জন্ম নিয়েছিলাম।আমার বাবা-মা দুজনই অত্যন্ত ধর্মভীরু মুসলিম।আসলে প্রকৃত মুসলিম নয় তারাও সমাজের জাহিলিয়াত ও বাঁধ ভাঙ্গা শিরক ও কুফরে নিমজ্জিত ছিল। শুধুমাত্র জুমু’আ মোবারকের নামাজের তাগাদা পেয়েছি তাদের থেকে। অবশ্য ছোট বেলা থেকেই আম্মু মক্তবে কুরআন পড়তে অনেক শাসন করতেন।আমি নয় বৎসর বয়স পর্যন্ত অনেকটাই মসজিদ কেন্দ্রিক বালক ছিলাম। হয়তো মহান আল্লাহুর পরিকল্পনাটাই ছিলো ভিন্নতর এবং উত্তম।কারণ ঐরকম দ্বীন থেকে ছিটকে গিয়ে আবারও দ্বীনকে ফিরে পেয়ে দ্বীনের প্রতি জীবনের চেয়েও বেশী মহব্বত ও ভালোবাসা বেড়েছে।বুঝেছি,”দ্বীনবিহীন জীবন পশুর জীবন থেকে একটুও ভিন্ন ও দামী নয়।”

তিজারাহ শপ

আমি তখন ক্লাস সেভেন এ পড়াশোনা করি।বিভিন্ন অশ্লীলতা,নোংরামি এবং বন্ধুদের দেওয়া(বন্ধুদের শিখানো,সঙ্গে ঘটিত অনেক গুনাহ্) অভিশাপ মিশ্রিত গুনাহ্ আমাকে পেয়ে বসে।তখন থেকেই শুরু হয় আমার ইসলাম বিহীন এক কালো জীবন। জুমু’আর নামাজ ব্যতীত খুব বেশী নামাজ আদায় করা হয়নি সেই সময়টায়। দূর দূরান্তে গিয়ে গান-বাজনা,ড্যান্স-কনসার্ট আর পাপের আড্ডায় খুব বেশী মনোযোগী হয়ে গেলাম।আমার গানের গলাটা ছিলো খুব ভালো;যার দরুণ বন্ধুদের আড্ডাতে মিস হতো না উপস্থিত হওয়া।কুরআন শরীফ পড়তে পারতাম কিন্তু তিলাওয়াত করা হতো না প্রায় অনেক বছর। এভাবেই অনেক গুনাহের যাপিত জীবন আমাকে দূর্বিষহ যন্ত্রণায় ফেলে গেলো।

এভাবেই দিন যায় আসে রাত আবার রাত গিয়ে আসে দিন। মহান রবের অশেষ দয়ায় তিনি আমাকে তাবলীগের কয়েকজন দ্বীনপ্রিয় ও রহমদিল ভাইদের মেহনতে আবারও তার দ্বীনের পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী। এবার শুরু হয় প্র্যাকটিসিং মুসলিম হবার যুদ্ধ।যে যুদ্ধে শত্রু অনেক বাট সৈনিক আমি একাই।যুদ্ধ চলছে পরিবার,সমাজ,রাষ্ট্র এবং লিডার ইবলিশের বিপক্ষে।আমি নিয়মিত সালাতে শরীক হবার চেষ্টায়রত।মুখে অল্পকিছু দাড়ি উঠছিলো আবার আমি সেগুলো নিয়মিত কাটছিলামও।এবার এক বক্তার বয়ানে দাড়ির প্রতি দরদ অনুভব করলাম।শক্ত প্রতিশ্রুতি নিলাম;”দাড়ি রেখে দিবো,ঈনশাআল্লাহ্।” সমাজের থেকে হেয়প্রতিপন্ন,অবজ্ঞা এবং বিদ্রুপাত্মক কথাশোনা শুরু হয়ে গেলো।একজন বলছে জঙ্গি হয়ে গেলি নাকিরে? তো অন্যজন বলছে ছাত্রশিবিরে নাম লিখেছিস মনে হয়।সমাজের মুরুব্বীরা বাঁকা চোখে তাকানো শুরু করলো।মহিলারা বলতে লাগলো বাবার আগেই তুমি বুইড়া হইলে।তোমাকে তো আর বিয়ে দেয়া যাবেনা।কোন ভালো মেয়ে তোমাকে বিয়েই করবে না।বন্ধুবান্ধব আর আগের মতো খোঁজ খবর নেয় না,কাছে আসে না।বাবা-মা যারা ছিলো সমস্ত রকমের বিপদের বান্ধব তারাও এখন দাড়ি নিয়ে বাজে বকে যায়;এতো টাকা দিয়ে পড়াশোনা করাচ্ছি দাড়ির জন্য তোমার কোন চাকরীই হবেনা।দিলেতো আমাদের সকল প্ল্যান ভেস্তে।তো ভাই তারপরও আমার ওয়াদা আমি অটুট রেখেছি।কারও নিন্দার পরোয়া কখনও করিনি।কারণ সমস্ত মানুষেরা মিলেও যদি আমাকে সব দিয়ে দেয় তারপরও আমার মন অতৃপ্ত থাকবে আর আমার মহান রব্বে-কাবা যদি সামান্য কিছু আমাকে দান করে সেটাই পারবে আমার অতৃপ্ত আত্মা এবং মনকে পরিতৃপ্ত করতে।কারণ আত্মার খোরাক স্বয়ং আল্লাহু সুবহানা তায়া’লা তার হাতেই রেখেছে।আলহামদুলিল্লাহ আমি আমার নবীর সুন্নত তথা সিরাতের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি এখনও।দাড়ি রেখে আমি নিজের কাছেই বিশ্বস্ত এবং ওয়াদা রক্ষাকারী হিসেবে সন্তুষ্ট রয়েছি।সমাজের কাছে হয়তো আমি খুব সাধারণ কেউ কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আমার রবের নিকট আমি একজন মুত্তাকী এবং পরহেজগার হিসেবে পরিগণিত হবো,ঈনশাআল্লাহ্।আমিতো পৃথিবীর কারও নিকট কিছু পাওয়ার আশা রাখি না;সবই পাবো মহাক্রান্তিকাল কঠিন বিচারের দিন আমার রবের নিকটে।

কলেজে সবেমাত্র পা রেখেছি।কয়েকদিন ক্লাস করছি নিয়মিত।একদিন একটা ক্লাস চলাকালীন সময়ে যোহরের আজান পড়ছিলো;কানে লাগতেই নামাজের দিকে মন চলে গেলো।সিট থেকে দাড়িয়ে স্যারকে বললাম আমি নামাজে যাবো।একথা শোনা মাত্রই ক্লাসে হাসির একটা রোল পড়ে গেল।তারপরও মনকে শক্ত করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে কলেজ জামে মসজিদে চলে গেলাম।নামাজ আদায় করলাম।আর খুশি হলাম এই কথা ভেবে যে আমি আল্লাহুর জন্য যা কিছু ছেড়ে দিবো আলাহু সুবহানা তায়া’লা তার থেকেও অনেক অনেক বেশী আমাকে দিবেন।ভাইয়া,তুমি আমি হয়তো বড়োজোর ৬০ কিংবা ৬৫ বৎসর বা আরও কিছু বেশী বৎসর বাঁচবো কিন্তু মরতে তো হবেই।সেটা আজ না হয় কাল।মরতে আমাদের হবেই।একটু ভাবো;মরার পর কাউকে কী তুমি পাশে পাবে? বাবা-মা,ভাই-বোন,আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব কাউকেই তুমি পাশে পাবে না।হাঁ,তোমার করা বদ-আমল বা তোমার করা নেক-আমল এটাই তোমার চির একাকী সফরের সঙ্গী হবে।তো মনকে এটাই বোঝাও পরিবার,সমাজ আর মানুষেরা কে কী আমাকে বলবো সেটা বড় কোন বিষয় নয় আল্লাহু আমাকে,তার রসূল আমাকে কি বলবে আর আখেরাতে আমার কোনটা কাজে দিবে সেটাই আমাদের মূখ্য বিষয় হওয়া চাই।

এই জাহিলিয়াত পূর্ণ ব্যবস্থায় মুসলিম হতে অনেক বাঁধার পথ তোমাকে হেঁটে আসতে হবে।ভাই আমার এ পথে চলা থামিয়ে দিওনা,এ পথ ছেড়ে চলে যেওনা।এটাই আমার চূড়ান্ত সফলতার কাঙ্খিত পথ।এ পথ যে চলতে হবেই।

আমার চাকরী জীবনে এসে অনেক ধাক্কা খেঁতে হয়েছে।দাড়ি ছিলো বলে তারা চাকরীতে নিলোই না।আর আমিও তাদের বলে দিয়েছি;”রিজিকের বন্টন আকাশে হয়,জমিনে নয়।” আমার দয়াময় রব আমাকে সৃষ্টিকরার আগেই আমার খাবারের তথা রিজিকের ব্যবস্থা করেছেন।

সুন্নতী পোশাক পরিধান করা শুরু করলাম।গ্রাম থেকে অনেক ডাকনাম পেয়ে গেলাম।আরে তুইতো দেখি পুরাই কাঠমোল্লা হয়ে গেছিস।কেউ ওয়াহাবী বলে ডাকতে শুরু করলো।আবার অনেকে জঙ্গি,হুজুর এবং মুন্সি ডাকতে লেগে গেলো।ছুম্মা আলহামদুলিল্লাহ আমি তারপরও দমবার পাত্র নই।আমার সাহস বৃদ্ধি পেতে লাগলো কারণ আমি সমাজে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একজন নগণ্য অনুসারী হতে পেরেছি বলে।আমি আশা রাখি আমার কমজোর কে আল্লাহু ক্ষমা করবেন।আশা রাখি হাউজে কাওসারে মায়ার নবী তার অনুসরণ করার দরুণ আমাকেও এক চুমুক পান করাবেন সেই “হাউজে_কাওছার” থেকে।তখন আর আমি তৃষ্ণার্ত হবোনা কখনো।

আগে গান শোনা হতো অনেক।এখন আর গান শুনি না।এরজন্যও অনেকের গালাগাল,বিদ্রুপ শুনতে হয়।পরতে হয় নানা রকম চাপের মুখে।

অধম জেনারেল লাইন থেকে পড়াশোনা করেছে।আমার পুরোপুরি ত্যাগ-তিতিক্ষা লিখতে পারবো না।আল্লাহু গোপনের গুনাহ সমূহ গোপনেই ক্ষমা করুন।আর হেদায়াতের পথে অটল-অবিচল রাখুন।সমস্ত প্র্যাকটিসিং মুসলিম ভাই-বোনদের কবুল করুন এই স্বিরাতে মুসত্বাকীমের রাস্তায়।

আমিন ঈয়া রব

ঈয়া মুক্বাল্লিবাল ক্বূলব।ছাব্বিত ক্বলবি আলা দ্বীনিক

Facebook Comments

Related posts

নীড়ে ফেরার গল্প-১৪ | সাদিয়া আলম রিফা

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-৪৭ | আল হুসাইন

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-২৭ | আবদুল্লাহ (ছদ্মনাম)

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!