সকালে অফিসে যাবেন হাতে সময় খুব অল্প। মাখনে মাখানো পাউরুটি অর্ধেক মুখে আর অর্ধেক হাতে নিয়ে ওয়ার্ড্রপের উপর হাত দিয়ে দেখেন বাইকের চাবিটি নেই! স্পষ্ট মনে আছে রাতে এখানেই রেখেছেন। শুধু তাইনা প্রতিদিন এখানেই রাখেন কিন্তু আজ পাচ্ছেননা। স্ত্রীকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন সে দেখেছে কি না। সেও দেখেনি। দুজন মিলে এদিক-সেদিক খুজে বেঁড়াচ্ছেন কিন্তু পাচ্ছেননা! অফিসে যেতে হবে দ্রুত। কি মহা মুসিবত!
রান্না ঘরের মস্ত ঝামেলা। একটানা কাজ করে যাচ্ছেন, নিঃশ্বাসটুকু ঠিক মতো নিতে পারছেননা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন শাশুড়ির ঔষুধের টাইম হয়ে গেছে। স্বামী অফিসে যাবে নাস্তার জন্যে টেবিলে আছে। কাজ সারতে হবে দ্রুত। ঔষধের বক্স আলমারিতে। চাবি বালিশের নীচেই আছে। রুটিটা তাওয়ায় দিয়ে দ্রুত রূমে আসলেন। এসে দেখেন চাবি নেই।
রান্নার চাপ, স্বামী অফিসে যাবে, শাশুড়ির ঔষধের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটি চাবির কারণে কিছুই হচ্ছেনা। কেমন সব গোছালো জিনিষ হজবরল হয়ে যাচ্ছে।
উপরের কথা দুটো উদাহরণ হিসেবে বললাম। কিন্তু কথাটা অনেকের জীবনের বাস্তববতা। কাজের সময় থেকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে, আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিষগুলো আমরা খুঁজে পাইনা। পাঁকের ঘরে প্রয়োজনীয় চামচটা এই কাছে থেকেও খুঁজে পাইনা। পেরেশানীর অন্ত থাকেনা। সেই সাথে ঘরে যদি ছোট কোনো বাচ্চা থাকে তাহলে তো আর কথাই নেই। বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে যায় মানুষ।
ছোট্ট একটি দোয়া হতে পারে ‘হারানো বস্তু’-র ঝামেলা থেকে আপনাকে উদ্ধার করার অন্যতম হাতিয়ার। বড় বুজুর্গ আলেম থেকে নিয়ে সাধারণ মানুষ প্রত্যেকেই এই দোয়াটি পড়ে পেয়েছেন তাৎক্ষনিক উপকার। তাদের জীবনে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র বিষয়ে দোয়াটির উপর আমল করে পেয়েছেন উপস্থিত ফলাফল। সেই অভিজ্ঞতার কথাও লেখে গেছেন অনেক বুজুর্গ।
কি বিশ্বাস হচ্ছেনা? আচ্ছা, দোয়াটি বলার আগে এই যামানা ও পূর্বের যামানার কয়েকটি ফলাফল ও আলেমদের ঘটনা আপনাদের বলি।
১.
নিজের ঘটনা দিয়েই শুরু করি। কিছুদিন আগে সফরে বের হবো। পুরো প্রস্ততি শেষ। হঠাৎ মোবাইল চার্জারের কথা মনে উঠলে বেগ থেকে শুরু করে পুরো ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজি আমি, আম্মা আর বড় আপু। নেই, কোথাও নেই!
রাগ-ক্ষোভ আর সময়ের সল্পতা সব মিলিয়ে কেমন পাগলের মত হয়ে যাওয়া অবস্থা তখন আমার। ভাগনিও আমাদের সাথেই ছিলো।এতক্ষণ আমাদের সাথে খুঁজে সেও ক্লান্ত। হঠাৎ আমায় বলে, ‘মামা! তোমার কি জানি এক দোয়া আছে, যেটা পড়লে খুব দ্রুত হারানো জিনিষ খুঁজে পেয়ে যান’।
কথাটা শুনে হঠাৎ যেনো দেহে প্রাণ ফিরে আসলো। ভাগনীকে জাযাকিল্লাহ বলে শুরু করলাম আবার খুঁজা। দোয়া মুখে পড়ছি আর এই রুম ঐ রুম খুঁজছি। সর্বোচ্চ মনে হলো ‘দুই মিনিট’। সামনের রুমের বইয়ের সেলফে দেখি চার্জার! যতটুকু মনে পরে এইখানেও কয়েকবার আমি আম্মা খুঁজেছি। কিন্তু, যুক্তিতে মাথা না ঘামিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে বের হয়ে গেলাম বাসা থেকে।
এরকম ঘটনা আমার নিজের সাথেই আছে একাধিক। আলহামদুলিল্লাহ।
২.
পুরান ঢাকার ‘রয় সাহেবের বাজার’ যেটাকে মানুষ ‘রায়শা বাজার’ বলে। চৌরাস্তা থেকে একটু ভিতরে গেলেই বিশিষ্ট মুহাদ্দিস মাওলানা জিকরুল্লাহ খান সাহেব দা বা-র জুম্মার মসজিদ। প্রতি রমজানে হুজুর নিয়মিত ই’তেকাফ করেন। একদিন ই’তেকাফের মজলিসে হুজুর এই দোয়াটি সকলকে শিখিয়ে তার অনেক ফাজায়েল বললেন। হুজুরের একটি বড়গুনই হলো যে কথাগুলোই বলেন সব সুত্র উল্লেখ করে বলেন।
সেদিন দোয়াটির সূত্র উল্লেখ করে আমাদের শুনালেন হুজুরের জীবনে এই দোয়ার অনেকগুলো পরিক্ষিত ঘটনা। হুজুরের স্বভাবসুলব মিষ্টি হাসিটি দিয়ে বললেন,
‘একদিন ঢালকানগরে আব্দুল মতিন সাহেবের খাস কামরায় আমরা কয়েকজন আলেম বসা ছিলাম। কিসের যেনো এক জরুরি এক জিনিষ খুঁজতে ছিলেন ঢালকানগরের হযরত। বেশ পেরেশান ছিলেন। খাদেমসহ রূমের অনেকেই খুঁজছিলো। কিছুতেও পাওয়া যাচ্ছেনা।
আমি তখন হযরতকে ইমাম নববীর হাওয়ালায় এই দোয়াটির কথা বললাম। হযরত, তার খাদেমসহ সেখানের সবাই দোয়াটি পড়ে আবার নতুন করে শুরু করলো। এক মিনিটও হয়নি ‘এতক্ষণ খুঁজতে থাকা’ বস্তুটি পেয়ে গেলো। হযরতওয়ালা তো মহা খুশি। ভাই! কি আজিব দোয়া এটা? মাশাআল্লাহ পড়ার সাথে সাথেই এরকম ফলাফল! আমি হযরতকে তখন বিস্তারিত খুলে বললাম’।
এরপর খাঁন সাহেব হুজুর আমাদের সকলকে বললেন, ‘দোয়াটা খুব উপকারী। ঘরের মহিলাদের সবাই দোয়াটা শিখাবি। তাদের টুকটাক জিনিষ পত্র হারাতেই থাকে। অনেক কাজে দিবে ইনশাআল্লাহ’।
৩.
এবার আসুন ইতিহাসের পাতা যামানার শ্রেষ্ঠ আলেম ও বুজুর্গদের থেকেও কয়েকটি ঘটনা শুনে নেই।
এক.
মুসলামানদের শহর বাগদাদে ছিলেন এক বুজুর্গ সুফী। জা’ফর আল-খুলদি নামেই সকলে তাকে চিনে। একদিন স্বপ্ন নগরি বাগদাদের পাশ দিয়ে চলা দজলার পারে মৃদ বাতাসে বসে আছেন তিনি। মুষ্টিভরে দজলার পানি নিচ্ছেন। একটি অপূর্ব বিকাল দাজলার পারে কাটিয়ে আসলেন। বেশকিছুক্ষণ পর খেয়াল করে দেখেন তার হাতের আংটিটি নেই। তন্নতন্ন করে সব খুঁজে দেখলেন নিজের কাছে থাকা সামানপত্র। কোথায় পেলেননা। একদম হতাশ হয়ে গেলেন। কারণ আংটিটি ছিলো তার মিরাছসুত্রে পাওয়া (১)। অতপর এক বুজুর্গের শিখানো পরীক্ষিত একটি দোয়া তার মনে পড়লো। বারবার তা পড়তে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর তার বইপত্রের ভিতর দেখেন আংটিটি অথচ এই জায়াগাগুলোও কিছুক্ষণ পূর্বে তন্নতন্ন করে খুঁজেছেন।
(তারিখে বাগদাদ ১৮/১৪, আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ ২/৫৩১।)
দুই.
ইমাম কুশাইরি রহ (মৃত্যু ৬৬৫হি) এই ঘটনা উল্লেখ করে লেখেন, ‘আবু নছর আসসাররাজ বলেন, ‘আমাকে আবুত তাইয়িব এক খণ্ড মোটা কিতাব দেখান যেখানে শুধু ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ ছিলো যারা এই দোয়াটি পড়ে তাদের হারানো বস্তু খুঁজে পেয়েছেন’। (আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ ২/৫৩১।)
তিন.
ইমাম নববি রহ (মৃত্যু ৬৭৬হি) বলেন,
‘আমি এই দোয়াটি অনেকবার পরিক্ষা করে দেখেছি হারানো বস্তু অল্প সময়ে অক্ষত অবস্থায় খুঁজে পেতে। এবং তা অধিকাংশ সময়েই তা বেশ কার্যকরী পেয়েছি এবং উপকৃত হয়েছি। আমার উস্তাদ শায়খ আবুল বাকা রহ ও এমনটিই বলতেন এবং তিনিই আমাদের দোয়াটি শিক্ষা দিয়েছেন। (বুস্তানুল আরিফিন পৃ ৪৫)
এবার শুনা যাক কি সেই দোয়া।
দোয়াটি একদম ছোট। তেমন কোনো কঠিন কিছুইনা বা বড় কোনো অধ্যবসারও প্রয়োজন নেই। শুধু প্রয়োজন শিক্ষা করা ও আমল করার একটু ইচ্ছে। যাক কথা আর বাড়িয়ে লাভ নেই। পাঠক হয়তো বিরক্ত হচ্ছেন দোয়াটি পাওয়ার জন্যে। কিন্তু কি করবো বলেন আমাদের কাজ হয়ে গেছে শুধু লাইক কমেন্ট আর শেয়ার। আর এটাকেই অনেক কিছু ভেবে বসে আছি…
থাক সে কথা। এবার দোয়াটি শুনে নেওয়া যাক। ছোট্ট সেই দোয়াটি হলো,
يَا جَامِعَ النَّاْسِ لِيَوْمِ لَا رَيْبَ فِيْهِ اِجْمَعْ عَلَيَّ ضَالَّتِيْ (২)
একদম ছোট্ট একটি দোয়া তাইনা। অফিস বা দোকানে যেকোনো কাজ থেকে নিয়ে প্রত্যেকটি স্থানেই এই দোয়াটি থেকে ইনশাআল্লাহ উপকৃত হবেন।
আসুন, দোয়াটি এখনি অল্পকিছু সময় নিয়ে মুখস্ত করে নেই। এবং আশপাশের মানুষগুলোকে মুখস্ত করিয়ে একে অপরের থেকে শুনে নিয়ে শুদ্ধ করে নেই।
বিশেষ করে আপনার ঘরে মা-বোন-স্ত্রী-মেয়ে সকলকে খুব গুরুত্ব দিয়ে শিখিয়ে দিন। এবং কিছুদিন পরপর খোঁজখবর নিন। দেখবেন এতে দুটি ফায়দা পাবেন। একটি হলো তাদের সাথে আপনারও দোয়াটি সর্বদা মনে থাকবে। আমলের পরিবেশ তৈরি হবে। দ্বিতীয়টি হলো, তাদের থেকেও শুনতে পারবেন হারিয়ে যাওয়া বস্তু খুঁজে পাওয়ার অনেক অনেক আশ্চর্য কিছু ঘটনা। আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুক।
টিকা
[১] তারিখে বাগদাদের এক রেওয়ায়েত (৭/২৩৬) আছে সেটা কোনো বুজুর্গ তাকে হাদিয়া দিয়েছিলো।
[২] তারিখে বাগাদাদে এই দোয়াটি ভিন্ন ভিন্ন শব্দে আছে। কিন্তু আর রিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ ও ইমাম নববি রহ ‘বুস্তানুল আরিফিন’এ এই শব্দতে উল্লেখ করেছেন।
তথ্যপুঞ্জি
[১] তারিখে বাগদাদ- খতিব বাগদাদি রহ (মৃত্যু ৪৬৩ হি)। দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, প্রথম প্রকাশ ১৪১৭হি।
[২] আর রিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ- আব্দুল আরিম ইবনে হাওয়াজিন আল কুশাইরি (মৃত্যু ৬৬৫ হি)। দারুল মাআরিফ মিশর।
[৩] বুস্তানুল আরিফিন- ইমাম মুহিউদ্দিন আন-নববি (মৃত্যু ৬৭৬ হি)। দারুর রাইয়্যান লিত তুরাছ।
Facebook Comments