১.
সা’দ ইবনে উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু। আনসারি সাহাবি। ইমাম বুখারি রহ. (২৫৬ হি.) বলেন, সা’দ ইবনে উবাদা বদরযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছেন। খাযরাজের নেতা। বাইআতুল আকাবার রাত্রে যে-কজন ‘নকিব’ ছিলেন মদিনার, সা’দ ইবনে উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁদের অন্যতম। কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আনসার বাহিনীর পতাকা থাকত সা’দ ইবনে উবাদার হাতে। নবীজির বড় প্রিয় সাহাবি তিনি।
হাফেজ যাহাবি (৭৪৮ হি.) রহ. বলেন, সা’দ ইবনে উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন সম্ভ্রান্ত সরদার। সবার আনুগত্য পাবার মতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর আনসাররা তাঁর হাতে বাইআত হওয়ার জন্য জড়ো হয়। সা’দ তখন নবীজির ওফাতের ব্যথায় ব্যথিত। পরে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু ও সকল সাহাবিরা এসে আনসারদের এই সিদ্ধান্ত থেকে বিরত করে।[১]
সা’দ ইবনে উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রচণ্ড আত্মর্যাদাবোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। একবার সা’দ ইবনে উবাদা মন্তব্য করেন—“যদি কোনোদিন ঘরে এসে আমার স্ত্রীর সাথে অন্য কোনো পুরুষকে দেখি, তাহলে নিঃসন্দেহে এক কোপে তার কল্লা ফেলে দিব।” হযরত সা’দের এই বক্তব্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুনতে পেয়ে বলেন, “তোমরা সা’দের গাইরাত দেখে আশ্চর্য হচ্ছো? অবশ্যই আমার গাইরাত সা’দের চেয়ে বেশি। আর আল্লাহ তাআলার গাইরাত আমার চেয়েও বেশি”।[২]
২.
গাইরাত কিংবা আত্মসম্মানবোধ—যে শব্দেই বলি না কেন; একজন মুমিনের জন্য থাকা অপরিহার্য। একজন মুমিনের গাইরাত থাকবে না—তা হতে পারে না। গাইরাত স্বয়ং আল্লাহ তাআলার গুণ। আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাদিস। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—“নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার গাইরাত আছে। আল্লাহর গাইরাত হলো— মুমিন যেন হারাম কোনো কাজে লিপ্ত না হয়”। [৩]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গাইরাত সকল মানুষের চেয়ে বেশি। আর আল্লাহ তাআলার গাইরাত নবীজির চেয়েও বেশি। মাত্রই যার উদাহরণ গেছে।
গাইরাত কাকে বলে? প্রথমে এর পরিচয় জানা যাক।
কাজি ইয়ায (৫৪৪ হি.) রহ. গাইরাতের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন—“স্বামী-স্ত্রী হলো একে-অপরের একান্তজন। এই ঐকান্তিকতার ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী অন্য নারী বা পুরুষের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে অন্তরে যে পরিবর্তন ও ক্রোধের উদ্রেক হয়; স্বামীকে অন্য নারী থেকে ফিরিয়ে রাখা এবং স্ত্রীকে অন্য পুরুষ থেকে রক্ষার যে মানসিকতা—এটাই হলো গাইরাত।”[৪]
কাজি ইয়াযের পরিচয়টিকে আরেকটু সার্বিকভাবে দিয়েছেন হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. (৮৫২ হি.) ফাতহুল বারিতে। ইবনে হাজার লেখেন—“গাইরাত হলো—যা-কিছু একান্ত নিজের, তাতে অন্যের অংশীদারত্বের কারণে অন্তরের অবস্থার পরিবর্তন এবং ক্ষোভ জেগে ওঠা”।[৫] অর্থাৎ, এককথায় যার বাংলা হলো—আত্মমর্যাদাবোধ। ‘আত্মমর্যাদাবোধ’ শব্দটি প্রতিশব্দ হিসেবে মোটামুটি উপযুক্ত হলেও গাইরাত শব্দের সম্পূর্ণ প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না।
একজন মানুষের গাইরাত কখন এবং কোথায় জাগ্রত হয়? এই প্রশ্নেরও উত্তর দিয়েছেন স্বয়ং ইবনে হাজার আসকালানি রহ.। “মানুষের মধ্যে এই গাইরাত জাগ্রত হবার বিষয়টি সবচেয়ে কঠিনভাবে ঘটে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে”। [৬]
স্বামী এবং স্ত্রী—দুজন একে-অপরের। দুজনের মাঝে যখন অযাচিত কেউ আসে, কথায়, উপস্থিতিতে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে—তখন তাঁদের মাঝে গাইরাত ও আত্মমর্যাদাবোধ জেগে ওঠে। ক্রোধ ও ক্ষোভ জেগে ওঠে। সা’দ ইবনে উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহুর বক্তব্য শুনে নবীজি তাই বিরূপ মন্তব্য করেননি। বরং এই গাইরাত নবীজির পছন্দ হয়েছে। তাঁর উম্মতকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন—সা’দের চেয়ে তাঁর গাইরাত আরও বেশি; আর আল্লাহর গাইরাত নবীজির চেয়েও বেশি।
মুমিনের মাঝে গাইরাতের গুণ থাকতে হবে। স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন সেই কথা। “নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার গাইরাত আছে। নিশ্চয় মুমিনও গাইরাতওয়ালা হবে।”[৭] অন্য হাদিসে নবীজি তিনবার বলেন—“নিশ্চয় মুমিন গাইরাতওয়ালা হবে, নিশ্চয় মুমিন গাইরাতওয়ালা হবে, নিশ্চয় মুমিন গাইরাতওয়ালা হবে।” চতুর্থবারে বলেন—“আল্লাহর গাইরাত সবচেয়ে কঠিন।”[৮]
৩.
ইমাম বুখারি রহ. “বাবুল গাইরাহ” নামে আলাদা এক পরিচ্ছেদই রচনা করেছেন সহিহ বুখারিতে। উক্ত পরিচ্ছেদটি এনেছেন “কিতাবুন নিকাহ” বা বিবাহ অধ্যায়ের অধীনে। বোঝাতে চেয়েছেন—স্বামী-স্ত্রীর মাঝে গাইরাত থাকতে হয়।
স্ত্রীর ব্যাপারে নবীজির গাইরাতের কথা শুনুন উম্মুল মুমিনি আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহার মুখে। আম্মাজান বলেন—“একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার ঘরে এসে দেখেন—আমার কাছে এক লোক বসে আছে। বিষয়টি নবীজির কাছে খুব ভারী হয়ে দাঁড়ায়। নবীজির চেহারা মুবারকে আমি রাগ দেখতে পাই। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, বিষয়টি বুঝতে পেরে আমি বলি, ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইনি আমার দুধভাই। উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের দুধভাইদের বিষয়গুলো ভালোভাবে খোঁজ নিয়ে দেখো। কারণ, দুধপান করে ক্ষুধা নিবারনের বয়সে পান করলে একমাত্র ধাত্রীসংক্রান্ত হুকুম সাব্যস্ত হয়।”[৯]
নবীজির গাইরাত এতটাই জেগেছে যে, খোদ আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা পর্যন্ত চেহারা দেখে বুঝে ফেলেন। পরবর্তী বাক্যে আরও সতর্ক করে দেন—শুধু এক মায়ের দুধপান করলেই এই সংক্রান্ত হুকুম সাব্যস্ত হয়ে যায় না। বরং একমাত্র দুধ পান করেই বেঁচে থাকার যে বয়স, সে বয়সে হতে হবে। সুতরাং এগুলোও খতিয়ে দেখতে হবে।
নবীজির গাইরাতের আরেকটি ঘটনা পাওয়া যায় উম্মে সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহার ঘরে। নবীজি উম্মুল মুমিনিনের ঘরে ঢুকে দেখতে পান—তাঁর কাছে এক হিজড়া বসা। উম্মে সালামার সাথে সে অরুচিশীল কথা বলছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন স্পষ্ট করে বলে দেন—এ যেন আর তোমাদের কাছে না আসে।[১০]
৪.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুহবত লাভ করার ফলে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে আজিব গাইরাত গড়ে উঠেছিল।
যুবাইর ইবনুল আওয়াম রাযিয়াল্লাহু আনহু। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘হাওয়ারি’। নবীজির ফুফাতো ভাই। জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবির অন্যতম। নবীজির ওফাতের পর ছিলেন খেলাফতে রাশেদার ছয় শূরা সদস্যের একজন। ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম তরবারি কোষমুক্ত করার ফজিলতও তাঁর।[১১]
বিয়ে করেন আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহার কন্যা আসমা বিনতে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহাকে। বিয়ের সময় ছিলেন কপর্দকশূন্য। কিন্তু, স্ত্রীর বিষয়ে গাইরাত ও আত্মমর্যাদার ক্ষেত্রে ছিলেন পরিপূর্ণ সচেতন। আসমা রাযিয়াল্লাহু আনহার মুখ থেকেই শুনুন।
হযরত আসমা বলেন, “যুবাইর যখন আমাকে বিবাহ করেন, তখন পৃথিবীতে তাঁর অর্থবিত্ত, গোলাম-বাঁদি—কিছুই ছিল না। ছিল কেবল পানি টানার জন্য একটা উট আর তাঁর নিজের একটা ঘোড়া। আমি নিজেই ঘোড়াকে ঘাস খাওয়াতাম। উটে করে পানি আনতাম। পানির মশক সেলাই করতাম। আটা পিষতাম। কিন্তু আমি সুন্দর করে রুটি বানাতে পারতাম না। অন্য আনসার নারীরা রুটি বানিয়ে দিত। তাঁরা খুব ভালো মানুষ ছিলেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবাইরকে একখণ্ড জমি দিয়েছিলেন। সেই জমি থেকে আমি খেজুরের আঁটির বোঝা মাথায় করে আনতাম। জমিটি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে।
একদিন আমি খেজুরের আঁটির বোঝা মাথায় করে ফিরছি। পথিমধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা। নবীজির সাথে কয়েকজন আনসারি সাহাবি। আমাকে দেখে নবীজি উট থামান। পিছনে উঠিয়ে নেওয়ার জন্য ডাক দেন। কিন্তু পুরুষদের সাথে যেতে আমার লজ্জা লাগছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝতে পারেন—আমি লজ্জা পাচ্ছি। তারপর চলে যান।
বাড়িতে ফিরে যুবাইরের সাথে সাক্ষাৎ হলো। বিস্তারিত খুলে বললাম তাঁকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে পথে সাক্ষাৎ হয়েছিল। আমার মাথায় তখন খেজুরের আঁটির বোঝা। নবীজির সাথে কয়েকজন আনসারি সাহাবি ছিলেন। আমাকে পিছনে উঠিয়ে নেওয়ার জন্য নবীজি উট থামান। কিন্তু আমার লজ্জা লাগছিল আর আপনার গাইরাতের উপলব্ধি মনে পড়ছিল। যুবাইর ইবনুল আওয়াম রাযিয়াল্লাহু আনহু উত্তরে বলেন—কসম আল্লাহর, কষ্ট করে তোমার বোঝা বহনের চেয়ে নবীজির উটের পিঠে চড়া আমাকে বেশি কষ্ট দিত।
আসমা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, এরপর আবু বকর আমার জন্য একজন খাদেম পাঠান। যে ঘোড়া পালনের দায়িত্ব পালন করত। এতেই মনে হতো—আমাকে যেন আযাদ করে দেওয়া হয়েছে।”[১২]
এখানে দেখার বিষয় কয়েকটি। একদিকে আসমা রাযিয়াল্লাহু আনহা অবিরাম কষ্ট করছেন। মাথায় করে বোঝা টানতে হয় দুই মাইল। এমন সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে উটে বসিয়ে এগিয়ে দিতে চান। কিন্তু সাথে আরও পুরুষ থাকায় তিনি লজ্জায় উঠেননি। বরং স্বামীর গাইরাতের কথাকে তিনি মাথায় রেখেছেন। ইবনে হাজার রহ. এই হাদিসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন—ঘটনাটি পর্দার আয়াত নাযিল হওয়ার আগের।
দ্বিতীয়ত, যুবাইর ইবনুল আওয়াম রাযিয়াল্লাহু আনহুর উক্তি। স্ত্রীর কায়িক কষ্টে তিনিও কষ্ট পান। কিন্তু তাঁর গাইরাত এতটাই বেশি ছিল যে, অন্য পুরুষদের সাথে দেখলে তিনি আরও কষ্ট পেতেন। পর্দার বিধান নাযিল না হলেও স্বামীর গাইরাত তাঁর স্ত্রীকে গাইরে মাহরাম পুরুষদের সাথে চলতে বাধা দিয়েছে। এই গাইরাত হলো মুমিন-মুমিনার সম্পদ।
৫.
স্ত্রীর প্রতি গাইরাতের প্রসঙ্গ এলেই যে শব্দটি সামনে চলে আসে তা হলো—‘দাইয়ুস’। “স্ত্রীর প্রতি যে স্বামীর গাইরাত নেই তাঁকে বলা হয় ‘দাইয়ুস’।”[১৩]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট বলেছেন—“তিন ধরনের মানুষের প্রতি আল্লাহ তাআলা ফিরেও তাকাবেন না। পিতামাতার অবাধ্য সন্তান, পুরুষের বেশধারী নারী এবং দাইয়ুস।”[১৪] অন্য হাদিসে “জান্নাতে প্রবেশ করবে না” বলেও বাক্য আছে।
এখন সমস্যা হলো—আধুনিক যুগে এসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে এই গাইরাতের উপলব্ধিতে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। দ্বীনি ঘরানার মধ্যেও এই গাইরাতহীনতার মহামারী তৈরি হয়েছে। একদিকে অনেক ভাই বেখেয়ালে স্ত্রীর সাথে নিজেদের ঘরোয়া খুনসুঁটি লিখে যাচ্ছেন। মাস্তুরাতের ঘরানাতে গেলে হয়ত দেখা যাবে সেখানেও একই অবস্থা। বোনেরা তাঁদের ঘরোয়া খুনসুঁটির নানান ফিরিস্তি লিখে যাচ্ছেন।
লেখক এবং লেখিকাদের বিপদটা আরও বড়। শক্তভাবে যদি ফ্রেন্ডলিস্ট ও কমেন্ট নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তখন “দাওয়াহ” ও “লেখা”র নামে ভয়াবহ ফিতনা তৈরি হয়। নারীরা কমেন্ট করেন পুরুষদের পোস্টে; পুরুষরা কমেন্ট করেন নারীদের পোস্টে। কেউ-কেউ ইনবক্সেও লেখার প্রশংসা করতে যান। একজন গাইরাতমন্দ পুরুষ তাঁর স্ত্রীর কমেন্টে অপর পুরুষের লাভ রিয়েক্ট আর গদগদ কমেন্ট কখনোই হজম করতে পারেন না। একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারী তাঁর স্বামীর কমেন্টে অপর নারীর লাভ রিয়েক্ট আর প্রশংসা হজম করতে পারেন না।
যে স্বামী তাঁর স্ত্রীর এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, তিনি গাইরাতহীন। যে স্ত্রী তাঁর স্বামীর এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, তিনিও গাইরাতহীন।
অনেক আগে এক গাইরাতমন্দ ভাইয়ের এক আক্ষেপভরা লেখা পড়েছিলাম। পাঠকগণ কীভাবে তাঁকে ছোট করে তাঁর স্ত্রীকে শ্রেষ্ঠ লেখিকা প্রমাণের জন্য বিশ্লেষণ শুরু করেছেন—তা দেখে আক্ষেপভরা এক লেখা লিখেছিলেন। যিনি লিখেছেন, তিনি অন্য পুরুষের প্রশংসা চাননি। যিনি প্রশংসা করেছেন, তিনি অতকিছু ভাবেননি। কিন্তু স্বামী হিসেবে তাঁর গাইরাতে লেগেছে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা তাঁদেরকে নিয়ে, যাদের মধ্যে গাইরাতের উপলব্ধিই নেই।
এই ফিতনা থেকে বাঁচার পথ তাহলে কী?
পথ সেটাই, যেটা আসমা রাযিয়াল্লাহু আনহা গ্রহণ করেছেন। স্বামী গাইরাতের সাথে স্ত্রীকে রক্ষা করবেন; আর স্ত্রী স্বামীর গাইরাতের দাবি রক্ষা করবেন।
৬.
শেষ করি মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসের আরেকজন গাইরাতমান্দ পুরুষের ঘটনা দিয়ে।
আব্বাসি আমলের ঘটনা। সময়টা ২৮৬ হিজরি। রায় শহরের বিচারক তখন মুহাম্মাদ বিন ইসহাক। বিচারকক্ষ প্রস্তুত। বাদী একজন নারী। ওই নারীর অভিভাবকদের অভিযোগ—স্বামীর কাছে সে ৫০০ দিনার মহর পাবে। কিন্তু স্বামী তা অস্বীকার করছে।
—সাক্ষীদেরকে উপস্থিত করুন। বাদীপক্ষকে বিচারক নির্দেশ দেন।
বাদীপক্ষ জানায়—সাক্ষীদেরকে উপস্থিত করা হয়েছে।
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জনৈক সাক্ষী দাবি জানায়—মহিলার চেহারা খুলতে হবে। সাক্ষ্যপ্রদানের সময় ইশারা করার জন্য মহিলাকে দেখতে হবে।
—আপনি উঠে দাঁড়ান। বাদী মহিলাকে সাক্ষী নির্দেশ দেয়।
অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো স্বামী তৎক্ষণাৎ সচেতন হয়ে ওঠেন—করছেন কী আপনারা?
—আপনার স্ত্রীর মুখ ঢাকা। সাক্ষীরা দেখে যেন ভালোভাবে চিনতে পারেন—এজন্য তাঁর মুখ খুলতে হবে। উকিল জবাব দেন।
তৎক্ষণাৎ গাইরাতমন্দ স্বামী বলে ওঠেন—আমি বিচারক মহোদয়কে সাক্ষী রেখে বলছি, আমার স্ত্রী যা মহর দাবি করছে, সে তা পায় আমার কাছে। তাঁর চেহারা যেন খোলা না হয় এখানে।
স্বামীর গাইরাত দেখে স্ত্রী এবার আসল মহরের পরিমাণ উল্লেখ করে বলে ওঠেন—আমিও বিচারক মহোদয়কে সাক্ষী রেখে বলছি—আমার মহর আমি স্বামীকে হাদিয়া দিয়ে দিলাম। দুনিয়া ও আখেরাতে তাঁকে এর দায় থেকে মুক্ত করে দিলাম।
বিচারক মুসা বিন ইসহাক মুচকি হেসে বলেন—এই ঘটনা উত্তম আখলাকের উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকবে।[১৫]
টীকা
——-
[১] সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১/২৭০-২৭৮, মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ
[২] সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৬৮৪৬
[৩] সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫২২৩
[৪] মাশারিকুল আনওয়ার ২/১৪১, কাজি ইয়ায, দারুত তুরাস, কায়রো
[৫] ফাতহুল বারি, ৯/২৬৪, মাকতাবাতুস সফা, প্রথম সংস্করণ
[৬] প্রাগুক্ত
[৭] সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২৭৬১
[৮] মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-৭২১০
[৯] সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-১৪৫৫
[১০] সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫২৩৫
[১১] সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১/৪১, মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ
[১২] সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫২২৪
[১৩] লিসানুল আরব, ১৫/১৪৬৫, দারুল মাআরিফ
[১৪] সুনানুন নাসায়ি, হাদিস নং-২৫৬২
[১৫] আল-মুন্তাযাম ফি তারিখিল মুলুকি ওয়াল উমাম ১২/৪০৩, ইবনুল জাওযি, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ
Facebook Comments