‘মুরতাদ’ শব্দের সাথে আমাদের অধিকাংশেরই কমবেশি পরিচিতি থাকলেও ‘যিন্দিক’ ও ‘মুলহিদ’ শব্দদুটির সাথে পরিচয় আছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। আবার যারা শব্দদুটি সম্পর্কে অবগত তাদের অনেকেই এর সঠিক অর্থ জানেন না বা প্রয়োগ করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন।তাই এই তিন পরিভাষা সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
মুরতাদ : কোন প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে অপব্যাখ্যা না করে সরাসরি কোন সুস্পষ্ট কুফরী কথা-কাজে লিপ্ত হলে কিংবা ইসলাম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করলে বা ধর্মহীন হয়ে গেলে তাকে মুরতাদ বলা হয়।আর তার এই কাজকে বলা হয় রিদ্দা বা ইরতিদাদ।
মুরতাদের সংজ্ঞা থেকে বোঝা গেল যে, যে ব্যক্তি কখনো মুসলিমই ছিলো না তাকে শরীয়তের পরিভাষায় মুরতাদ বলা হয় না। সুতরাং হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিস্টান,ইয়াহুদী ইত্যাদি ধর্মের লোকদের ‘মুরতাদ’ বলে অভিহিত করা যাবে না। তাদেরকে মুশরিক বা কাফির শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হবে।আর যারা পূর্ববর্তী কোন আসমানী কিতাবে বিশ্বাসী বলে দাবি করে তাদেরকে বিশেষভাবে ‘আহলে কিতাব’ বলেও সম্বোধন করা যাবে। তবে এদের কেউ যদি একবার হলেও ইসলাম গ্রহণ করে এরপর ইসলাম ত্যাগ করে বা কোন কুফরী কথা ও কাজে লিপ্ত হয় তাহলে সেও মুরতাদ।
(একটা কথা বলে রাখা ভালো। শরীয়তের দৃষ্টিতে এরা সবাই ‘কাফির’ জাহান্নামী। মুশরিক,আহলে কিতাব,মুলহিদ, যিন্দিক, নাস্তিক ইত্যাদি ‘কাফিরে’রই বিভিন্ন প্রকার। দুনিয়াতে প্রত্যেক প্রকারের ভিন্ন ভিন্ন বিধান রয়েছে। কিন্তু আখিরাতে সবাই চিরস্থায়ী জাহান্নামী।)
মুরতাদের সংজ্ঞা থেকে আমরা জানতে পারি যে, মুরতাদ হওয়ার জন্য ইসলাম ধর্ম ছেড়ে দিয়ে অন্য ধর্ম গ্রহণ করা আবশ্যক নয়। বরং ছেড়ে দিলেই মুরতাদ হয়ে যাবে। এরপর সে নাস্তিক হয়ে যাক কিংবা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করুক সেটা দেখার কোন প্রয়োজন নেই।সে যাই করুক না কেন তাকে মুরতাদই বলা হবে এবং তার উপর মুরতাদের বিধানই প্রয়োগ করা হবে।
এ সংজ্ঞা থেকে আমরা আরো জানতে পারলাম যে, মুরতাদ হওয়ার জন্য পূর্ণ ইসলাম ছেড়ে দেয়া জরুরি নয়। বরং যেকোনো একটা কুফরী কাজ করলেই বা কোন একটা কুফরী কথা বললেই পূর্ণ ঈমান চলে যায় এবং সে ব্যক্তি মুরতাদ হয়ে যায়।
এখন আমাদের জানতে হবে কুফরী কথা ও কাজ কী কী যাতে লিপ্ত হলে একজন মুসলিম ঈমান ও ইসলামের গণ্ডি পেরিয়ে মুরতাদে পরিণত হয়।তো এ বিষয়টি স্বাতন্ত্র্য আলোচনার দাবি রাখে।এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা উল্লেখ করা সম্ভব নয়।আলোচ্য প্রবন্ধে তা উদ্দেশ্যও না। আল্লাহ তা’আলার তাওফীক শামিলে হাল হলে এ সম্পর্কে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র একটি প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছে আছে।
সংজ্ঞায় বলা হয়েছে ‘কোন’ অপব্যাখ্যা ব্যতীত। তো এর ব্যাখ্যা যিন্দিক ও মুলহিদের আলোচনায় স্পষ্ট করা হবে ইনশাআল্লাহ।
রিদ্দার প্রকারভেদ : পূর্বেই বলা হয়েছে যে,মুরতাদ হওয়াকে শরীয়তের পরিভাষায় বলা হয় ‘রিদ্দা’ বা ইরতিদাদ। এখন আমরা রিদ্দার প্রকারভেদ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করবো ইনশাআল্লাহ।
রিদ্দা দুই প্রকার :
১।الردة المجردة -রিদ্দায়ে মুজাররাদা (সাধারণ রিদ্দা)
২।الردة المغلظة -রিদ্দায়ে মুগাল্লাযা (গুরুতর রিদ্দা)
১। রিদ্দায়ে মুজাররাদা (সাধারণ রিদ্দা) :
রিদ্দায়ে মুজাররাদা হলো স্বাভাবিকভাবে একজন মুসলিম কর্তৃক ইসলাম ত্যাগ করা কিংবা কোন একটি কুফরী কথা বা কাজে লিপ্ত হয়ে মুরতাদ হয়ে যাওয়া।
২। রিদ্দায়ে মুগাল্লাযা (গুরুতর রিদ্দা)
রিদ্দায়ে মুগাল্লাযা হলো মুরতাদ হওয়ার পাশাপাশি ইসলাম নিয়ে কটুক্তি করা, আল্লাহ বা তাঁর রাসূলকে গালি দেয়া, ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা,কোন মুসলিমকে হত্যা করা,কাফিরদের সাথে মিলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি কাজসমূহের কোন একটিতে লিপ্ত হওয়া।
সংজ্ঞা থেকেই দুই প্রকারের মাঝে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে গেছে। তবু দুয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি আরো স্পষ্ট করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
উদাহরণটা বাংলাদেশকে দিয়েই দিই। রংপুর, কুড়িগ্রামসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা, পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা সমূহ, সিলেট,মোমেনশাহীসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় হতদরিদ্র বিভিন্ন মুসলিম পরিবারের অনেক সদস্য দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে খ্রিস্টান মিশনারিদের প্ররোচনায় ইসলাম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু খ্রিস্টান হয়ে গিয়ে অধিকাংশই এমন যারা শুধু খ্রিস্ট ধর্মটাই গ্রহণ করেছে কিন্তু ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে না, মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় না বা মুসলিমদেরকে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের জন্য প্ররোচনা বা চাপ দেয় না।তো এই ধরণের লোকগুলো হলো প্রথম প্রকারের মুরতাদ অর্থাৎ তারা রিদ্দায়ে মুজাররাদায় লিপ্ত।
অপরদিকে যারা খ্রিস্টান হওয়ার সাথে সাথে এসব অপকর্মের কোন একটিতে লিপ্ত হবে তারা দ্বিতীয় প্রকারের মুরতাদ। অর্থাৎ তারা রিদ্দায়ে মুগাল্লাযায় লিপ্ত। এমনিভাবে যেসব ব্লগার আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করেছিল এবং করছে তারাও রিদ্দায়ে মুগাল্লাযায় লিপ্ত। আশা করি বিষয়টি এই দুটি উদাহরণের মাধ্যমেই স্পষ্ট হয়ে গেছে।
উভয় প্রকারের হুকুম :
মুরতাদ যে প্রকারেরই হোক না কেন আখিরাতের হুকুম একই। অর্থাৎ এ অবস্থায় মারা গেলে চিরস্থায়ী জাহান্নামী। তবে দুনিয়াতে কিছু কিছু বিধানে পার্থক্য আছে। আমরা এখানে শুধু মৌলিক কিছু পার্থক্য উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হবো।এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে মুরতাদের সমস্ত বিধান নিয়ে আলোচনা করা সম্ভবও না এবং তা আমাদের উদ্দেশ্যও না।
প্রথম প্রকার তথা রিদ্দায়ে মুজাররাদার শাস্তির ব্যাপারে ইমামদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম মালিক, ইমাম শাফিয়ী, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলসহ অধিকাংশ ইমামদের (রহ:) মতে এই প্রকার মুরতাদ পুরুষ হোক বা নারী হোক তার শাস্তি হলো হত্যা। তবে মুরতাদ হওয়ার সাথে সাথে তাকে হত্যা করা হবে না। বরং হত্যা করার পূর্বে তাকে তওবা করতে বলা, অর্থাৎ পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করতে বলা ওয়াজিব। পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করতে না বলে সরাসরি হত্যা করা জায়েয নেই। এরপর যদি ইসলাম গ্রহণ না করে তাহলে তাকে হত্যা করা হবে।
আর ইমাম আবু হানিফা (রহ:) ও হানাফী আলেমদের মতে এ প্রকার মুরতাদের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের বিধানে পার্থক্য আছে। নারী হলে তাকে হত্যা করা হবে না। বরং ইসলাম গ্রহণের আগ পর্যন্ত তাকে বন্দী করে রাখা হবে। আর পুরুষ হলে তাকে হত্যা করা হবে এবং হত্যার পূর্বে তাওবা করতে বলা অর্থাৎ পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করতে বলাও আবশ্যক নয়; তবে উত্তম।
সবার মতেই এই শাস্তি প্রয়োগ করবে খলীফা বা তার প্রতিনিধি। সাধারণ মানুষ এই শাস্তি প্রয়োগ করবে না। যদি কেউ করে তাহলে তার উপর কোন জরিমানা আসবে না বটে। তবে খলীফা বা তার প্রতিনিধি তাকে ধমকাবে এবং ভবিষ্যতে এমনটি না করতে আদেশ করবে।
আর দ্বিতীয় প্রকার তথা রিদ্দায়ে মুগাল্লাযার ক্ষেত্রে সকল ইমামের মতে নারী পুরুষ সবাইকেই হত্যা করা হবে। তাকে যেখানে পাওয়া যায় সেখানেই হত্যা করা হবে এবং তাওবাও করতে বলা হবে না। হাঁ তাকে পাকড়াও করার আগেই যদি তাওবা করে পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে তা গ্রহণ করা হবে এবং তাকে হত্যা করা হবে না। কিন্তু যদি আল্লাহর রাসূলের গালিদাতা হয় তাহলে শাইখুল ইসলাম ইবনে তামিয়্যাহ(রহ)-সহ অনেকের মতে তার তাওবা খাঁটি হলে আল্লাহর কাছে আখিরাতে গ্রহণযোগ্য হলেও দুনিয়াতে তার একমাত্র শাস্তি হলো হত্যা। এবং এ মাসআলায় তিনি অনেকগুলো শক্তিশালী দলীলও পেশ করেছেন। তবে এ ব্যাপারে সবাই একমত নয়।
এ হলো উভয় প্রকার রিদ্দার সংক্ষিপ্ত পার্থক্য। আশা করি বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।
তথ্যসূত্র:
১। ইকফারুল মুলহিদীন
২। রদ্দুল মুহতার
৩। আস-সারিমুল মাসলূল আলা শাতিমির রাসূল
৪।আল হিদায়া
৫। রদ্দুল মুহতার
৬। আল মুগনী
ফিকহের বিভিন্ন কিতাব…
Facebook Comments