ইনবক্সে ও কমেন্টে অনেকে সাইমুম সিরিজ ও ক্রুসেড সিরিজ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। সবাইকে আলাদা আলাদা উত্তর দেয়া কষ্টকর। তাই এখানেই মোটাদাগে কয়েকটি কথা বলে দিচ্ছি।
১। সাইমুম সিরিজ ও ক্রুসেড সিরিজ দুটিই সাহিত্যের বই। কেউ এগুলো পড়লে সাহিত্যের বই মনে করে বিনোদনের জন্য পড়বেন। এগুলোকে জ্ঞানের বই কিংবা ধর্মীয় বই মনে করার কিছু নেই। এসব বই থেকে কর্মপন্থাও শেখার নেই। এই মৌলিক বিষয়টি স্পষ্ট থাকলে আর বেশি কথা বলার দরকার হয় না। সমস্যা হলো, এই বিষয়টি অনেকের কাছেই স্পষ্ট না। অনেকেই ক্রুসেড সিরিজকে ইতিহাসের বই মনে করেন, সাইমুম সিরিজকে উম্মাহর অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি নির্দেশিকা মনে করেন। ফলে বিষয়টি নিয়ে দুয়েকটি পর্যবেক্ষন বলতেই হয়।
২। ক্রুসেড সিরিজটি যদিও আসাদ বিন হাফিজের নামে প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু এটি তার মৌলিক কোনো লেখা নয়। এটি এনায়েতুল্লাহ আলতামাশের দাস্তান ঈমান ফারুশোকি গ্রন্থের অনুবাদ। অনুবাদটিও আসাদ বিন হাফিজের নয়। এটি অনুবাদ করেছিলেন আবদুল হক নামে আরেকজন অনুবাদক। ক্রুসেড সিরিজ যখন প্রীতি প্রকাশন থেকে খন্ডে খন্ডে বের হত, তখন বইয়ের প্রচ্ছদে থাকতো আসাদ বিন হাফিজের নাম। ভেতরের পৃষ্ঠায় লেখা থাকতো, আলতামাশ রচিত ও আবদুল হক অনুদিত ‘দাস্তান ঈমান ফারুশোকি’র ছায়া অবলম্বনে। এর কয়েকবছর পর মাসিক আদর্শ নারীতে এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। সেখানে এর নাম ছিল ‘ষড়যন্ত্রের কবলে ইসলামি দুর্গ’। মূল – এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ। অনুবাদ- আসাদ বিন হাফিজ। এটি ছিল প্রীতির ওই ক্রুসেড সিরিজটাই, কিন্তু এখানে আসাদ বিন হাফিজকে পরিচিত করানো হয় অনুবাদক বলে। কিছুদিন পর প্রীতি ভলিউম আকারে ক্রুসেড সিরিজ ছাপায় ‘মহাকালের মহানায়ক’ নামে। এখানে ভেতরে বাইরে কোথাও আলতামাশের নাম ছিল না। আরো পরে অরণ্য প্রকাশনী থেকে ক্রুসেডসমগ্র নামে সবগুলো ক্রুসেডখন্ড প্রকাশিত হয়। এখনো এটি প্রকাশিত হচ্ছে। এখানে কোথাও আলতামাশের নাম নেই। লোকজন একে জানছে আসাদ বিন হাফিজের মৌলিক রচনা বলেই। কিন্তু এটি মূলত আলতামাশের বইয়ের অনুবাদ। তাই ক্রুসেড সিরিজ নিয়ে কথা না বলে আমরা মূল বই দাস্তান ঈমান ফারুশোকি নিয়েই কথা বলবো। কারণ, এই বইয়ের আরেকটি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে পরশমনি প্রকাশন থেকে। ঈমানদীপ্ত দাস্তান নামে।
আলতামাশের এই বইতে মৌলিক সমস্যা দুটি। প্রচুর বিকৃত ও বানোয়াট তথ্য লিখে ঐতিহাসিকদের নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। এগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করলেও অনেক বিশাল বই হয়ে যাবে। যারা এসব জানতে আগ্রহী তারা মাওলানা ইসমাইল রেহানের ‘দাস্তান ঈমান ফারুশোকি এক তাহকিকি জায়েজা’ বইটি পড়ে নিতে পারেন। একইসাথে এই বইতে নর-নারীর অবৈধ সম্পর্কের যে রসালো বর্ননা দেয়া হয়েছে, তা যে কোনো ভদ্র পাঠকের জন্য খুবই অস্বস্তিকর। মুবি-বালিয়ান-নাজি-উম্মে আম্মারা-রেশমা এই চরিত্রগুলো যেভাবে চিত্রায়ন করা হয়েছে তা খুবই আপত্তিকর।
আলতামাশের এই বই সম্পর্কে আমাদের যে মূল্যায়ন ক্রুসেড সিরিজ সম্পর্কেও সেই মূল্যায়ন। কারণ ক্রুসেড সিরিজ এটিরই অনুবাদ। অবশ্য আসাদ বিন হাফিজ ক্রুসেড সিরিজে বেশ কিছু বিষয় বাদ দিয়েছেন। তবে ভুল ইতিহাস আর আপত্তিকর অংশ ঠিকই রয়ে গেছে, সেগুলো বাদ দেননি।
৩। এবার আসি সাইমুম সিরিজের কথায়। এটি একটি থ্রিলার সিরিজ। আহমাদ মুসা এই সিরিজের কেন্দ্রিয় চরিত্র। বিশ্বের যেখানে মুসলমান নির্যাতিত হয়, সে সেখানেই ছুটে যায়। নানাভাবে তাদের সমস্যা সমাধান করে। সাইমুম সিরিজ সম্পর্কে বলতে গেলে পেছনের দুয়েকটি কথাও টানা দরকার। ১৯৬৪ সালে সেবা প্রকাশনী থেকে কাজি আনোয়ার হোসেন লেখা শুরু করেন কুয়াশা সিরিজ। দুবছর পর ১৯৬৬ সাল থেকে তিনি নিয়মিত লেখেন মাসুদ রানা সিরিজ। এই সময় রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুর সিরিজও চলছিল। এই সিরিজগুলো খুবই জনপ্রিয় ছিল। তবে এসব বইতে অশ্লীলতা ও ঈমান-বিধ্বংসী অনেক কথাই ছিল, বিশেষ করে মাসুদ রানা সিরিজে এই সমস্যা ছিল খুবই প্রকট। এই বিষয়টি দেখে আবুল আসাদ সিদ্ধান্ত নেন বিকল্প একটি সিরিজ দাঁড় করানোর। ১৯৭৬ সালে তিনি লেখেন অপারেশন তেল আবিব-১ বইটি। বইটি জনপ্রিয় হলে তিনি সিরিজটি নিয়মিত লিখতে থাকেন। এখন পর্যন্ত এই সিরিজের ৬২ টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এই সিরিজের সর্বশেষ বই ‘আবার আফ্রিকার অন্ধকারে’। এই সিরিজ সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ বলার আগে একটি বিষয় স্পষ্ট করে নেই।
আবুল আসাদ যে সময়ে কলম ধরেছিলেন, ঐ সময়টায় প্রচুর সিরিজ প্রকাশিত হচ্ছিল। তরুনদের সামনে ছিল মাসুদ রানা, জাকি আজাদ এই সিরিজগুলো। অবসর থেকেও কয়েকটি সিরিজ প্রকাশিত হয়, তবে শেষ পর্যন্ত টিকে যায় মাসুদ রানা সিরিজই। জাকি আজাদ সিরিজ কয়েক দশক বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি শেখ আবদুল হাকিম আবার এই সিরিজ লেখা শুরু করেছেন। এই সিরিজগুলোর প্রায় সব বইই ছিল পশ্চিমা থ্রিলার লেখকদের বই অবলম্বনে রচিত। ফলে এসব বইতে অশ্লীলতার ব্যাপক ছড়াছড়ি ছিল। এমনকি প্রচ্ছদেও নোংরা ছবি থাকতো। এক সময় ‘প্রজাপতির ছাপওয়ালা বই মানেই অশ্লীল বই’ এমন একটি ধারনাও ছড়িয়ে পড়ে সেবা প্রকাশনী সম্পর্কে। তরুণ সমাজকে এই সকল সিরিজ থেকে ফেরাতে আবুল আসাদ উদ্যোগী হয়েছিলেন, এর সমাধানের জন্য তিনি ভিন্নপথে লেখালেখি করেছেন, এজন্য তিনি অবশ্যই সাধুবাদ পাবেন। সাইমুম সিরিজের সুত্রপাত হয়েছিল আবুল আসাদের এক বৃহৎ ও মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই, আর সেই উদ্দেশ্য হলো যুবসমাজকে এসব অশ্লীল বইপত্র থেকে দূরে সরানো।
এখানে একটি কথা স্পষ্ট করা দরকার। কারো উদ্দেশ্য মহৎ হলেই, তার কর্মপদ্ধতী ও কর্ম সঠিক হওয়া জরুরি নয়। আবার কারো কর্মে কোনো ভুল থাকলে তার উদ্দেশ্য শতভাগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়, ব্যাপারটি এমনও নয়। মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যদি কেউ ভুল করে তাহলে তার সেই ভুল, ভুলই থাকে, শুদ্ধ হয় না। আমরা শুধু কর্মপদ্ধতী নিয়ে কথা বলবো। কারো উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করবো না। আবার উদ্দেশ্য মহৎ এই যুক্তি দিয়ে সকল কর্মের পক্ষে সাফাইও গাইবো না।
৪। সাইমুম সিরিজের মূল বিষয়টি ছিল যুবসমাজকে অশ্লীল সাহিত্য থেকে সরানো এবং তাদের মনে উম্মাহর প্রতি দরদ ও চেতনা জাগ্রত করে দেয়া। বিভিন্ন সাক্ষাতকারে আবুল আসাদ নিজেই এই বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। সাইমুম সিরিজের প্রতিটি বইয়ে পাঠকের বিভিন্ন চিঠি ছাপা হতো। সেখানে পাঠকরাও এমন অনুভূতি জানাতো।
–
সাইমুম সিরিজের বড় ব্যর্থতা, এই সিরিজ অশ্লীলতার জায়গা থেকে পাঠককে সরিয়ে আনলেও পর্দা ও ফ্রি মিক্সিং ব্যাপারটি ঠিকই হালকা করে দেখিয়েছে। আহমাদ মুসা তার বিভিন্ন অভিযানে অনেক মেয়ের সাথে পরিচিত হয়। তাদের সাথে সামনাসামনি বসে কথা বলে, দ্বীনি বিষয় আলোচনা করে, এমনকি সারা জেফারসন কিংবা ডোনা জোসেফাইনের সাথে বিয়ের আগে দীর্ঘসময় তার যোগাযোগ ও দেখাসাক্ষাত অব্যাহত থাকে। সিরিজের প্রথম বইটি থেকেই এই বিষয়টি হালকা করে দেখানো হতে থাকে। এই সিরিজে পর্দা বলতে শুধু স্কার্ফ কিংবা ওড়না পরাকেই বুঝানো হয়। এই সিরিজের পাঠকদের কাছেও তাই পর্দার এই ব্যখ্যাই দাঁড়ায় যে, মাথায় স্কার্ফ বা ওড়না পরলেই পর্দা হয়ে যায়। সাইমুম সিরিজের রেফারেন্স দিয়ে অনেককে তর্ক করতেও দেখেছি। এই সিরিজের কাহিনীতে বিয়ের আগে টুকটাক প্রেম দেখানো হয়। বিষয়টিকে ইতিবাচক করে ফেলা হয় পাঠকের কাছে।
এভাবে সাইমুম সিরিজ একটি ভুল বিষয়কে প্রমোট করেছে।
–
এখানে অনেকে আপত্তি তুলবেন এই বলে, এটি সাহিত্যের বই। একে নিয়ে এত চুলচেরা বিশ্লেষণ করে লাভ কী? আপনারা তো হুমায়ুন কিংবা শামসুল হকের বই নিয়ে কথা বলেন না।
দেখুন, মদ যে হারাম এটা পৃথিবীর কোনো দারুল ইফতা ফতোয়া দিবে না। ফতোয়া দিবে ওই পানীয় সম্পর্কে সমাজে যা হালাল পানীয় হিসেবে পরিচিত কিন্তু তাতে রয়েছে মদের কিছু অংশ। সাইমুমের ব্যাপারটিও এমন। লোকজন যদি একে সাহিত্য মনে করে পড়তো তাহলে এত কথা দরকার ছিল না। সমস্যা হলো, তারা একে ধর্মীয় বই মনে করে পড়ে। যারা সাইমুমের চিঠিপত্র বিভাগ পড়েছেন তারা জানেন, প্রায়ই অনেক পাঠক লিখতো, ইসলামের এই ব্যাখ্যা আগে বুঝিনি, সাইমুম সিরিজ পড়ে বুঝেছি। কেউ লিখতো, আমি বন্ধুদেরকে ইসলাম শেখার জন্য সাইমুম পড়তে বলি।
এই যে সাহিত্যের একটি বইকে ধর্মীয় জ্ঞানের বই মনে করা, এই প্রবনতাতেই আমাদের আপত্তি। এখানেই উঠে আসে প্রশ্ন। আবারও বলি, সাইমুমের বইগুলো সাহিত্যের বই। এখান থেকে ধর্ম শেখার কিছু নেই। এজন্যই যখন সারা জেফারসনকে আহমাদ মুসা দ্বিতীয় বিয়ে করে তখন পাঠকদের অনেকেই শক্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। কারণ বিষয়টি তারা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেনি।
–
সাইমুম সিরিজকে অনেকে জিহাদি বই মনে করেন। এমনকি অনেকে আহমদ মুসাকেও বাস্তব চরিত্র মনে ফ্যান্টাসিতে ভুগতেন। তারা চিঠি লিখে জানতে চাইতেন, এই চরিত্রটি আসলেই আছে কিনা। অনেকে মনে করতেন, আহমাদ মুসা উম্মাহর জন্য লড়ে যাচ্ছেন। এই কারণে অনেকে ইতিবাচক মানসিকতা রাখেন এই সিরিজের প্রতি। তাদের বক্তব্য, এই সিরিজ তো অনেকের মাঝে জিহাদের প্রেরণা জাগাচ্ছে।
এই কথাও ভুল। লোকজন সাইমুম পড়ে যে জিহাদি আবেগ অনুভব করে সেটা মূলত কাল্পনিক ফ্যান্টাসির জিহাদ। ময়দানের বাস্তব জিহাদ নয়। এজন্য আহমাদ মুসা নিয়ে পাঠকের অনেক আবেগ থাকলেও খোরাসানের মাটিতে যে লড়াকু কাফেলার জন্ম হয়েছে তা নিয়ে তাদের কোনো আবেগ নেই। সাইমুম ভক্ত লোকজনের সাথে আলাপ করলেই এ কথার সত্যতা মিলবে। খোরাসানের মাটিতে যখন ক্রুসেডারদের সাথে জিহাদ শুরু হয়, তখন আরবের এক সিংহপুরুষ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল আবুল আসাদ সাহেবকে। লিখিত উত্তরে তিনি বলেছিলেন, তাকে আমি চিনি না, এই নামে কেউ আছে কিনা তাও জানি না। হতে পারে সে আমেরিকার সৃষ্টি।
আবুল আসাদ সাহেবের এই উত্তরই সাইমুম সিরিজের সামগ্রিক চিত্র স্পষ্ট করে দেয়। সাইমুমের বেশিরভাগ পাঠকদের সাথে কথা বলে দেখেছি তাদের অবস্থা এমনই। কল্পিত চরিত্র আহমদ মুসার প্রতি এদের অনেক আবেগ, কিন্তু খোরাসানের লড়াকু কাফেলা এদের কাছে ‘আমেরিকার সৃষ্টি’ ‘উগ্রবাদী’ ‘শান্তিপূর্ন ইসলামকে কলুষিত করা এক দল’ ইত্যাদী।
কারণ একটাই, কল্পিত উপন্যাস আর বাস্তব জিহাদের ময়দান এক নয়।
–
সাইমুম সিরিজে আহমাদ মুসার যে কর্মপদ্ধতি দেখানো হয়, সেটাও হাস্যকর। প্রায় সব বইতেই দেখা যায়, কুফফার রাষ্ট্রের প্রধানরা বেশ ভালো মানুষ। শুধু সন্ত্রাসী সংঘঠনগুলো (ক্লু ক্ল্যাক্স ক্ল্যান, ব্ল্যাক ক্রস) এইসব ভালো মানুষ কাফের রাষ্ট্রপ্রধানদের ‘ভুল বোঝায়’। আহমাদ মুসা গিয়ে নানাভাবে ওইসব কুফফারদের ‘সঠিকটা’ বুঝিয়ে দেন, ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরেন, ব্যস সেই এলাকা থেকে সেসব সন্ত্রাসী সংঘঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়। মুসলমানরা নির্যাতন থেকে মুক্ত পায়। সাইমুম সিরিজ অধ্যয়ন করলে যে কারো মনে হবে, আসলে কাফের রাষ্ট্রনায়করা ভালো মানুষ। শুধু সন্ত্রাসীরা এইসব ‘হজরত’দের ‘ভুল বোঝায়’। আহমদ মুসা সঠিকটা বুঝিয়ে দিলে তারা শুধরে যায়। মুসলমান না হয়েও ইসলাম ও মুসলমানদের একনিষ্ঠ সেবকে পরিনত হয়।
একজন সাইমুম পাঠক দেখেন, মোটাদাগে আমেরিকা বা আমেরিকান আর্মির সাথে মুসলিমদের কোনো সমস্যা নেই। কোনো কুফফার রাষ্ট্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামছে না। সাধারণ কাফের এবং কাফের নেতৃত্ব সবাই খুব ভালো মানুষ, আন্তরিক মানুষ, শুধু ওইসব রাষ্ট্রের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা দুয়েকটি সন্ত্রাসী সংঘঠনের সাথে মুসলিমদের সমস্যা। এটা সলভ করে ফেললেই সবার জীবন রুপকথার গল্পের শেষ লাইনের মত ‘অবশেষে তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো’ হয়ে যাবে।
এভাবে আবুল আসাদ নিজের অজান্তেই কুফফারদের প্রতি একটা সফটকর্নার তৈরী করে দেন তার পাঠকদের মনে। ইসলামের সাথে কুফরের যে দ্বন্দ্ব তা থেকে পাঠকের মনোযোগ সরে যায়। পাঠকের মাথায় ঘুরতে থাকে, দ্বন্দ্বটা আসলে ইসলামের সাথে ক্লু ক্ল্যাক্স ক্ল্যান কিংবা ব্ল্যাক ক্রসের। এই যে চিন্তার বিপর্যয়, এটি খুবই ক্ষতিকর। চিন্তার এই বিপর্যয় শূন্যতা তৈরী করে, লড়াইয়ের মূল পক্ষ-বিপক্ষই যদি আপনি বুঝতে না পারেন, তাহলে পুরো ব্যাপারটিই তো আপনার কাছে অস্পষ্ট। এই লড়াই নিয়ে আপনার আবেগ জেগেই বা লাভ কী? যেখানে আপনি শত্রুকেই ঠিকমতো চিনতে ব্যর্থ হয়েছেন।
এই গৎবাঁধা, একঘেয়ে, ক্লান্তিকর প্লট সাইমুম সিরিজের প্রতিটি বইতেই। এই পুরো ব্যাপারটি এতটাই অবাস্তব ও অসম্ভব, যা নিয়ে বিস্তারিত আলাপেরও দরকার নেই। যারা মনে করেন, সাইমুম সিরিজ পড়ে জিহাদি চেতনা জাগে, তাদের মনে রাখা উচিত বাস্তব দুনিয়া এত সরল ও মাইডিয়ার টাইপ না।
খোরাসানের মাটিতে যখন আমেরিকান হিংস্র সেনাদের বিরুদ্ধে লড়ছিল ছিন্নভিন্ন পোশাকের ‘বাস্তবতার নায়কে’রা, আহমাদ মুসা তখন এফ বি আই প্রধান জর্জ আবরাহামের বাসায় ডিনার সারছে, সারা জেফারসনের সাথে খোশগল্প করছে, হোয়াইট ঈগল প্রধানের সাথে একসাথে চলছে।
এটাই হলো বাস্তব দুনিয়ার জিহাদ ও সাইমুমের কল্পিত দুনিয়ার লড়াইয়ের তফাত।
–
যে যাই বলুক, উপন্যাস পড়ে সিরিয়াল দেখে উম্মাহর প্রতি আবেগ আসবে না, জিহাদি প্রেরণা জাগবে না, এটাই বাস্তব। শরনার্থিদের নিয়ে নির্মিত মুভি দেখে আমাদের চোখে পানি আসে, কিন্তু বাস্তব দুনিয়ার রোহিঙ্গা কিংবা সিরিয়ান শরনার্থিদের করুণ চিত্র, আমাদের চোখে পানি আনতে ব্যর্থ হয়। এজন্য উপন্যাস পড়ে বা সিরিয়াল দেখে যে আবেগ জন্ম নেয়, তাকে চুড়ান্ত কিছু মনে করাটা ভুল।
উম্মাহর প্রতি দরদ আনতে আমাদের ফিকহ পড়তে হবে, সালাফে সালেহিনের জীবনি পড়তে হবে। বর্তমান সময়কে তাদের সময়ের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে শিক্ষা অর্জন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প কিছু করতে গেলে বিকল্প কিছুই হবে। মূল জিনিস থেকে তা দূরে সরবে।
শেষ কথা
এই দুই সিরিজকে লোকজন সাহিত্য মনে করে পড়ুক, আমাদের মাথাব্যাথা নেই। লোকজন কত সাহিত্যই তো পড়ে। কেউ তো বাধা দিচ্ছে না। কিন্তু এগুলোকে ইতিহাস ও ধর্মীয় জ্ঞানের বই মনে করলে তা নিয়ে কথা বলা ও পর্যবেক্ষন তুলে ধরা জরুরী।
Facebook Comments