সংকলন
মা আমিনার কোলে হাসে পূর্ণিমারই চাঁদ
ঈদসংখ্যা ২০২০ সীরাত

মা আমিনার কোলে হাসে পূর্ণিমারই চাঁদ যে! | নকীব মাহমুদ

সুবহে সাদিক। মক্কার আকাশে নতুন সূর্যদয়ের প্রস্ততি চলছে সবেমাত্র। অনেকেই এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহর খুব কাছাকাছি প্রায় পরিত্যক্ত জীর্ণ একটা কুটির। একজন মহীয়সী নারী মাত্রই সন্তান প্রসব করেছেন। জীর্ণকুটিরের থোকা থোকা অন্ধকারের ভেতর এ যেনো নতুন চাঁদের হঠাৎ আগমন। চাঁদ- নাহ, চাঁদ বললেও ঠিক ভুল হবে। চাঁদের চাইতেও আরো উজ্জ্বল আরো সুন্দর সে মুখ! ভূবন জুড়ানো হাসি সে মুখে। চোখের তারায় যেনো দ্যুতি ছড়ায়। আচ্ছা, তোমরা জানো, কে এই নতুন অতিথি? হুমম… বুঝতে পেরেছো, তাইতো? হ্যাঁ, ঠিক ধরতে পেরেছো- ত্রিভূবন আলোকিত করে মক্কার জীর্ণকুটিরে আজ যে ছেলেটি জন্ম নিলেন তিনিই আমাদের প্রিয় নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মা আমেনার কোল আলোকিত করে সুবহে সাদিকের সময়ে পৃথিবীর বুকে জন্ম নিলেন আমাদের প্রাণের নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কী চমৎকার সেই মুহূর্তটি! অন্ধকারে নিমজ্জিত পৃথিবীর বুকে আলোর ফোয়ারা নিয়ে- মানবতার মুক্তির দূত হয়ে- মা আমেনার ছোট্ট কুটিরে, একটুকরো নতুন চাঁদের মতোই আগমন করলেন আমাদের সবার প্রিয় মানুষ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ! আহা-কী সুখ সুখ লাগা সেই ভোর!

যখন কোনো মা সন্তান প্রসব করেন তখন তার কী যে ভীষণ কষ্ট হয়, তোমরা সেটা কল্পনাও করতে পারবে না। সন্তান প্রসবের সময় একজন মা পৃথিবীর সবচে’ কঠিন কষ্টটা অনুভব করেন, সহ্য করেন।

কিন্তু কী আশ্চর্য জানো! আমাদের প্রিয় নবির জন্মের সময়ে মা আমেনা সামান্য কষ্টও অনুভব করেননি। কী আশ্চর্য তাই না? আরে, যিনি পৃথিবীতে এসেছেন মানুষের কষ্ট লাঘব করার জন্যে তিনি কি কাউকে কষ্ট দিতে পারেন? পারেন না! তাহলে মা আমেনার কেনো কষ্ট হবে? আল্লাহ মা আমেনার প্রসবকালীন সমস্ত কষ্ট দূর করে দিয়েছেন। কারণ, আমেনা- তিনি যে আমাদের প্রিয় নবির মা! তিনি যে ভাগ্যবতী!

 

স্বপ্নে আসে রাজপুত্র!

জীবন সঙ্গী, স্বপ্নপুরুষ-প্রাণপ্রিয় স্বামী আব্দুল্লাহ ইন্তেকাল করেছেন আজ ছয় মাস হতে চললো। দীর্ঘ এ ছয় মাসেও স্বামীর স্মৃতি ভুলতে পারেন না আমিনা। কীভাবে ভুলবেন তিনি? প্রেম কি ভোলা যায়? তারপরও স্বাভাবিক হতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান আমিনা। তার যে স্বাভাবিক হতেই হবে! নিজের জন্য না হোক- নিজের ভেতর যাকে এতোটা মাস বহন করে চলেছেন। প্রাণপ্রিয় স্বামীর আমানত, শেষ এবং একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন কী করে এড়িয়ে যাবেন তিনি? সব কষ্ট ভুলে তাই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেন। দিন গিয়ে রাত আসে। রাত গিয়ে দিন ফুরোয়। আমিনা নতুন অতিথির অপেক্ষায় প্রহর গুনেন।

রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয় না আমিনার। প্রায় দিনই মধ্যরাতে ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠেন। উঠেই পেটের উপর হাত তুলিয়ে একটা তৃপ্তির হাসি হাসেন। তারপর সদ্য দেখা স্বপ্নের কথা ভেবে চিন্তায় চিন্তায় রাত পার করেন। ভেবে পান না- কী ব্যখ্যা হতে পারে এমন স্বপ্নের? কী বিস্ময়কর সে স্বপ্ন! মা আমিনা স্বপ্নের কথা ভেবে ভেবে কূল হারান। শুনতে চাও কী এমন স্বপ্ন দেখে দেখে মা আমিনার ঘুম ভেঙে যেতো? শুনলে তোমরা অবাক না হয়ে পারবে না। একদিনের কথাই শোনো না- ঘুটঘুটে অন্ধকার মক্কার আকাশে। তার চাইতে বেশি অন্ধকার মা আমিনার জীর্ণ কুটিরে। হঠাৎ মা আমিনা স্বপ্নে দেখেন, তার ঘরের ভেতর আলোর একটা ঝলকানি খেলে গেল। কী তীব্রতা সে আলোয়। মা আমিনার মনে হচ্ছিলো আলোটা তার ভেতর থেকেই যেনো হঠাৎ বেরিয়ে এসেছে। ধিরে ধিরে আলোটা আরও প্রখর হয়ে চারপাশ ঝাপটে ধরলো! সে আলোর ঝলকানিতে মা আমেনার চোখ জ্বালা করে ওঠে। মা আমিনার অন্তর্দৃষ্টি কী খুলে গেল? তিনি দেখতে পাচ্ছেন। স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছেন, বুসরার রাজ-প্রাসাদগুলো। ওই তো, প্রাসাদের ছোটো তোরণটা পর্যন্তও দিবালোকের ন্যায় ভেসে উঠছে মা আমিনার চোখের কোণে। শুধু কি এই-ই? উঁহু, মা আমিনার চোখের সামনে পূর্ব-পশ্চিমের সব কিছু একেবারে ছায়াছবির মতো ফুটে উঠছে! আহা এ যেনো রুপকথার রুপের জাদু! এরপর কী হলো জানো? হঠাৎ অদৃশ্য হতে একটা মোলায়েম কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো! কী মায়া ছড়ানো সে কণ্ঠে! যেনো জাদুমাখানো! মা আমিনা সুবোধ বালিকার মতো তন্ময় হয়ে শোনেন সে কণ্ঠস্বর। অনেকটা আদেশের মতোই শোনায় সে কণ্ঠস্বর- আমিনা, তোমার গর্ভের এ সন্তানের নাম আহমদ রাখবে! শোনো! সে হবে বিশ্বজগতের সরদার- মনে রেখো!

এ কী আদেশ? নাকি অনুরোধ? অদৃশ্য সে কণ্ঠস্বরে মা আমিনার মনে একটা স্বর্গীয় সুখ উঁকি মেরে ওঠে। রাজপুত্রের মা হতে চলেছেন তিনি! স্বপ্নের ভেতরই আরেকবার নিজের পেটের উপর হাত বুলান। ভবিষ্যৎ রাজপুত্রের মাথায় এ যেনো স্নেহময়ী মায়ের ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দেয়া।

 

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!

অন্য আর দশটা সকালের চাইতে আজকের সকালটা একটু অন্যরকম। সূর্যটা সবেমাত্র তার কর্মব্যস্ততা শুরু করতে বসেছে। কেমন ঝকঝকে আর তকতকে সূর্যের রঙ! যেনো গোলাবের জলে ধুয়ে এসেছে নিজের শরীর। বায়তুল্লাহর আঙিনা থেকে তাকালে সামনেই যে খেজুর গাছের সারিটা দেখা যাচ্ছে সেগুলোতেও আজ কেমন যেনো একটা চনমনে ভাব! মরুভূমির দেশ হওয়ায় এমনিতেই মক্কার আকাশ সবসময় ফুটন্ত কড়াইয়ের মতো রেগে থাকে, তার উপর এখন আবার চলছে এপ্রিল মাস- বুঝো তাহলে অবস্থাটা! কী সকাল আর কী রাত গরমে সবাই কুপোকাত! কিন্তু কী আশ্চর্য দেখো- আজকের সকালটা একবারেই ভিন্ন! প্রকৃতির মনে যেনো আজ বসন্তের রঙ লেগেছে!

এতো সকাল সকাল মক্কার লোকেদের ঘুম ভাঙে না সহজে। যারা ভালো মনের মানুষ তারা সকাল সকাল উঠে বাইতুল্লায় গিয়ে উপাসনা করে। আমাদের নবিজির প্রিয় দাদুমণি আব্দুল মুত্তালিবকে তো চেনোই। তিনি ছিলেন তেমনি ভালো মানুষদের একজন। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে শিষ্য-শাগরেদ, গোত্রীয় লোকদের নিয়ে কাবা চত্বরে বসে জ্ঞানগর্ব আলোচনা করেন। প্রতিদিনকার মতো আজও তিনি কাবা চত্বরে বসে আলোচনা করছিলেন। প্রকৃতির মধ্যে সাজ সাজ রব পড়ে যাওয়া তার চোখেও বেশ ভালোরকমভাবেই ধরা পড়েছে। তিনিও ভাবছিলেন, মক্কার উগ্র আকাশ আজ হঠাৎ এমনভাবে বদলে গেল- ব্যাপার কী!

সারি সারি খেজুর গাছগুলো বাতাসে তির তির করে কাঁপছিলো। তাদের কাঁপুনিতে কেমন যেনো একটা আহ্লাদের ভাব ফুটে উঠেছিল। এসব কোনো কিছুই চোখ এড়ায়নি দাদা আব্দুল মুত্তালিবের। তিনি ভাবছিলেন। এমন সময়ই একজন এসে খবরটা দিয়ে গেল তাকে। বসা থেকে লাফিয়ে উঠলেন তিনি। দৌঁড়ে চলে গেলেন বৌমা আমিনার ঘরে। মজমা ছেড়ে আব্দুল মুত্তালিবের হঠাৎ এমন প্রস্থানে সবাই হতভম্ব! কি হলো! নতুন কোনো দুঃসংবাদ নয়তো? মাস তিন পার হয়নি। মক্কার উপর শয়তান আবরাহার কু-নজর পড়েছে। আল্লাহ অবশ্য শয়তানটাকে উচিত শিক্ষা দিয়েছেন। মক্কার লোকেদের মনে তবুও একটা ভয় কাজ করে, যদি নতুন করে আবার কোনো শয়তানের চোখ পড়ে কাবার উপর! ভীত ভীত চোখে আব্দুল মুত্তালিবের চলে যাওয়া দেখছিলেন সবাই। দেখলেন, কাবা চত্বর পার হয়েই আব্দুল মুত্তালিব সোজা পুত্রবধু আমিনার গৃহে প্রবেশ করলেন।

তারপর?

তারপর?

আহা সে দৃশ্য যদি তোমরা দেখতে! আব্দুল মুত্তালিবের সে কী আনন্দ! আজ যে তার সবচে’ খুশির দিন। আজ যে তার কেবলই আনন্দের দিন। তার প্রিয় পুত্র আব্দুল্লাহর ঘরে যে আজ আকাশের চাঁদ নেমেছে!

আব্দুল মুত্তালিব ঘরে ঢুকতেই মা আমিনা শিশু নবী মুহাম্মদকে দাদার কোলে তুলে দেন। মাথায় ঘোমটা টেনে বলেন, আব্বাজান! এই নিন আপনার আহমাদ!

আব্দুল মুত্তালিব প্রাণপ্রিয় নাতিকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু খান। চোখে চুমু খান। গালে চুমু খান। তার যেনো আনন্দ আর ধরে না! নাতিকে আদর করতে করতে বলেন, আমিনা, মা আমার! আমার কলিজার টুকরোর নাম কি আহমদই ঠিক করেছো?

আমিনা ভাঙা ভাঙা শব্দে বলেন, আব্বাজান, আপনার নাতি যখন গর্ভে তখন এ নামটি রাখার ব্যাপারে আমি সুন্দর একটি স্বপ্ন দেখেছিলাম। এ নামটি-ই  রাখতে চাই আমি!

আব্দুল মুত্তালিব বলেন, আহমাদের সাথে তবে মুহাম্মাদও থাকুক না!

মুহাম্মাদ- আহা! পৃথিবীর সবচে’ মিষ্টি সে নাম! কী মধুময়! কী যাদুময়! তাই না?

মা আমিনার ঘর থেকে বের হয়ে নাতি মুহাম্মাদকে কোলে নিয়ে আব্দুল মুত্তালিব কাবা ঘরে ঢুকে পড়লেন। সবাই চেয়ে দেখলো, আব্দুল মুত্তালিব একটি চাঁদের টুকরো কোলে করে কাবার দরজা ধরে দীর্ঘক্ষণ দোয়া করলেন। দোয়া শেষ হলে কাবা চত্বরে  দাঁড়িয়েই উল্লাস করে উঠলেন- এ্যাই! এ্যাই! আরে কে কোথায় আসিস! দেখ তোরা! আমার কলিজা, আমার চোখের মণি- এই যে দেখ, আমার আব্দুল্লাহ! আরে গেলি কোথায় সব? আজ যে খুশির দিন! তোরা সব জয়ধ্বনি কর!

লেখক : নবিজীবনের গল্পভাষ্য মুস্তফার রচয়িতা

Tijarah-Shop

Facebook Comments

Related posts

‘ইসলামি উপন্যাস’ ও ‘দিরিলিস সিরিয়াল’ : বাস্তবতা ও পর্যালোচনা | ইমরান রাইহান

সংকলন টিম

শিশুদের জন্য দীনি প্রশ্নোত্তর : ১ | সালিম বিন সাদ আত-তাওয়িল

সংকলন টিম

রাহমাতুল্লিল আলামিন | সুমাইয়া মারজান

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!