আরাকানে বাংলা সাহিত্য :
উপরোক্ত সবাই ছিলেন বাংলার অধিবাসী। মুঘল আমলে বাংলার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল আরাকান ও ত্রিপুরা রাজ্যও রাজনৈতিক কারণে এই প্রদেশের সাথে জড়িত ছিল। বহু শতাব্দীব্যাপী আরাকানে অসংখ্য মুসলমান বসতি স্থাপন করেন এবং সেখানে মুসলিম সংস্কৃতির প্রচলন করেন। আরাকানে মুসলিম সংস্কৃতি এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, বোদ্ধ রাজারা মুসলিম নাম ও উপাধিও গ্রহণ করতে শুরু করেন। তারা বাংলা থেকে আগত বিদ্বান ও কবিদের আরাকানে বসতি স্থাপন করতে উৎসাহিত করতেন। যার ফলে আরাকান রাজ দরবারে বহু প্রতিভাবান বাঙালি কবির দেখা মেলে।
প্রথমেই বলব দৌলত কাজীর কথা। ১৭শ শতকের এই কবি চট্টগ্রামে জন্ম নিলেও তার কবিপ্রতিভার আত্মপ্রকাশ ঘটে আরাকান রাজসভায়। তিনি আরাকান অধিপতি থিরি থু ধম্মার সমর সচিব আশরাফ খানের পৃষ্ঠপোষকতায় কবিতা লিখতে শুরু করেন। তার কবিত্ব শক্তি ছিল অসাধারণ। পাশাপাশি তাঁর শিল্প ও সৌন্দর্যবোধ ছিল তীক্ষ্ণ ও হৃদয়গ্রাহী। বাংলার সাথে সাথে তিনি ব্রজবুলী ভাষায়ও সমান দক্ষতা রাখতেন। তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ কবিদের মাঝে তিনি গৌরবময় আসন দখল করে আছেন। আশরাফ খানের আগ্রহেই তিনি “সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী” কাব্য রচনা করতে শুরু করেন। তাঁর দূর্ভাগ্যই বলা চলে, এই মহাকাব্যটি তিনি শেষ করে যেতে পারেন নি। পরবর্তীতে বিখ্যাত কবি আলাওলের হাত ধরে এর সমাপ্তি ঘটে।
আরেকজন বাঙালি কবি আশরাফ খানের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। তার নাম কবি মর্দন (১৬০০—৪৫)। তিনি তার “নবীবংশ” কাব্যে আরাকানে বহু ধার্মিক ও বিদ্বান মুসলমান এবং বোদ্ধদের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেন।
আরাকানের মুখ্যমন্ত্রী মাগন ঠাকুর (১৭শ শতক) কে কুরাইশ বংশোদ্ভূত মনে করা হয়। তিনি নিজে কবি ছিলেন। “চন্দ্রাবতী” নামে তার একটি কাব্যগ্রন্থ পাওয়া যায়। পাশাপাশি তিনি কবি আলাওলের পৃষ্ঠপোষকতা করেও পরিচিতি লাভ করেন।
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগীয় কবিদের মাঝে যিনি ‘শিরোমণি’র মর্যাদা ধারণ করে আছেন, তার নাম কবি আলাওল (১৫৯৭—১৬৭৩)। অনেক বড়ো কবি। শব্দের কারিগর। সেকালের অনেক বড়ো বড়ো কবিও ছিলেন শব্দের ব্যবহারে গ্রাম্য। তারা যে কোন শব্দকে কবিতায় ঠাঁই দিতেন। কিন্তু আলাওল ছিলেন অন্যরকম। তিনি ভাষাকে সাজাতেন নানা অলঙ্কারে। অনেক অপ্রচলিত মনোহর শব্দকে তিনি ডেকে আনতেন আর কবিতাকে করে তুলতেন সুরম্য প্রাসাদের মত চমৎকার। আলাওলের জন্ম ফতেহাবাদে, যা বর্তমান মাদারিপুর জেলার জালালপুরে অবস্থিত। পিতা ফতেহাবাদের শাসনকর্তা মজলিস কুতুবের একজন আমাত্য ছিলেন। কিন্তু কবির ভাগ্য তাঁকে আরাকান রাজ্যে নিয়ে উপস্থিত করে।
-নৌযানে সফরকালে পর্তুগিজ হার্মাদ জলদস্যুদের আক্রমণে তাঁর বাবা নিহত হন। তিনি কোন মতে রক্ষা পেয়ে আরাকানে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তখন কবির বয়স কুড়িও পেরোয় নি। তিনি সেখানে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হন এবং মুসলমান বিদ্বান ব্যাক্তিদের উৎসাহে অবশেষে কাব্য রচনায় মন দেন। আলাওলের জীবনে মাগন ঠাকুরের প্রভাব অনেক বেশি। তার আদেশ ও উৎসাহেই তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্য “পদ্মাবতী” রচনা করেছিলেন। এটি মূলতঃ হিন্দি কবি মালিক মুহম্মদ জায়সির ‘পদুমাবৎ’ কবিতার কাব্যানুবাদ। বাংলা এই মহাকাব্যের রচনার সমাপ্তি হয় ১৬৫১ সালে। এরপর তিনি রচনা করেন “সয়ফুল মূলক বদিউজ্জামান” কাব্য (১৬৫৮)। অতঃপর কবির ভাগ্যাকাশে আবার দূর্যোগ নেমে আসে।
বাংলা থেকে বিতাড়িত হয়ে আরাকানে আশ্রয় নেয়া শাহজাদা শূজার বিদ্রোহের সাথে কবির আঁতাত রয়েছে মনে করে কবিকে কারারুদ্ধ করা হয় এবং পঞ্চাশ দিন বিনা বিচারে তাঁকে কারাগারে আটকে রাখা হয়। কবি এই দুঃসময়ের কথা বর্ণনা দিয়েছেন অত্যন্ত সাশ্রু নয়নে—
“মন্দকৃতি ভিক্ষাবৃত্তি জীবন কর্কশ“।
কবির শেষ জীবনও শান্তিতে কাটে নি। রাজা তার প্রতি সুদৃষ্টি দেন নি বলে। কবি তার সে সময়কার কষ্ট ব্যক্ত করেছেন ছন্দে ছন্দে—
“আয়ুবশ আমারে রাখিল বিধাতায়।
সবে ভিক্ষা প্রাণ রক্ষা ক্লেশে দিন যায়।।“
মাগন ঠাকুরের মৃত্যুর পর মন্ত্রী শ্রীমন্ত সুলায়মানের অনুরোধে দৌলত কাজীর “সতীময়না লোরচন্দ্রানী” মহাকাব্যের অবশিষ্টাংশ লেখেন। এই ভদ্রলোকের অনুরোধেই রচিত হয় “তোহফা” নামক তাঁর আরেকটি কাব্য। ধর্মীয় বিধিনিষেধ ও মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবন বিধান আলোচিত হয়েছে এই গ্রন্থে। “রাগমালা” ছিল আলাওলের রচিত অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ। এছাড়াও লস্কর উজীর সৈয়দ মুসার পৃষ্ঠপোষকতায় “হপ্ত পয়কর” ও শেষ বয়সে নবরাজ মজলিসের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি “সিকান্দরনামা” কাব্য রচনা করেন।
বাংলা সাহিত্যে আলাওলের আসনটি অনেক উঁচুতে। তিনি ছিলেন সেইসব খ্যাতনামা কবিদের অন্যতম, যারা উপমা, অলঙ্কার ও রসবোধের ঐশ্বর্য এবং বাস্তব জীবনের স্পর্শ দিয়ে বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন যুগের প্রবর্তন করে গেছেন। একজন নিপুণ কবি শিল্পী হিসাবে আলাওল সৌন্দর্য চিত্রণে ঐতিহ্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন। প্রথম যুগের মুসলমানরা মানবতাবাদের যেই ঐতিহ্য তুলে ধরার প্রয়াস পান, তারই পূর্ণ প্রকাশ দেখা যায় আলাওলের “চন্দ্রাবতী” কাব্যে। তাঁর এই কাব্যের জন্য বাংলা সাহিত্য তাঁকে বহুকাল স্মরণ রাখবে।
আরাকান রাজসভার আরেকজন প্রতিভাবান কবি ছিলেন আব্দুল করিম খোন্দকার। তিনি তার “হাজার মাসায়েল”, “তামিম আনসারী”, “নূরনামা” ও “দুল্লা মজলিস” ইত্যাদি কয়েকটি গ্রন্থ রচনার জন্য কৃতিত্বের দাবি রাখেন।
ত্রিপুরায় বাংলা সাহিত্য :
প্রাকৃতিকভাবেই ত্রিপুরা রাজ্য ছিল বাংলার অবিচ্ছিন্ন অংশ। প্রাচীনকাল থেকেই বহু সংখ্যক বাংলা ভাষাভাষী এ রাজ্যে বসবাস করে আসছেন এবং প্রায়ই ত্রিপুরার রাজারা বাংলার মুসলমান শাসকদের অধিনস্ত মিত্র ছিলেন। যার ফলে মুসলমানদের শাসন পদ্ধতি ও সংস্কৃতি ত্রিপুরা রাজ্যের সামাজিক জীবন ও রাজ দরবারে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। সেখানকার জনসংখ্যার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল বাংলা থেকে আগত হিন্দু মুসলিম অধিবাসী। বাংলা ভাষায় লিখিত ত্রিপুরা রাজবংশের ইতিহাস “রাজমালা” গ্রন্থ থেকে এই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উপর বাংলার প্রভাব অনেকটা উপলব্ধি করা যায়।
ত্রিপুরার একদল কবি বাংলা ভাষায় মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। এঁদের মধ্যে কবি শেখ চান্দ (১৫৬০—১৬২৬) সবচেয়ে প্রাচীন। তাঁর লিখিত চারটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্যের সন্ধান পাওয়া যায়। তার আধ্যাত্মিক গুরু শাহদৌলার আদেশে তিনি “রসুল বিজয়” কাব্যটি রচনা করেন। “কিয়ামৎনামা” তার ধর্মীয় কাব্যগ্রন্থ। এছাড়াও অতিন্দ্রীয় ভাবধারার উপর রচিত হয় তার “হরগৌরী সম্বাদ” ও “তালিবনামা”। “তালিবনামা”য় গদ্য ও পদ্য উভয় রীতির সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। এটি বাংলা সাহিত্যের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ। কারণ, এতে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম গদ্যের নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়।
ত্রিপুরার আরেকজন কবি ছিলেন সৈয়দ মুহম্মদ আকবর (১৬৫৭—১৭২০)। তিনি ফার্সি কাব্যের উপর ভিত্তি করে “জেবালমূলক সামারুখ” নামক একটি কাব্য রচনা করেন।
এছাড়াও কবি শুকুর মুহম্মদ (১৬৮০—১৭৫০) কতৃক রচিত “ময়নামতির গান”, মুহম্মদ রফিউদ্দিন রচিত “জেবালমূলক সামারুখ” ও মুহম্মদ আব্দুর রাজ্জাক রচিত “সয়ফুলমূলক লালবানু” কাব্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মুঘল যুগ শেষ করার আগে তাদের অবদানের আরেকটি পয়েন্ট উল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করছি। বাঙালিদের জাতীয় পঞ্জিকা বঙ্গাব্দ। এর সাথে বাংলার ছয়টি ঋতু জড়িত। পাশাপাশি বাঙালিদের ঐতিহ্যবাহী উৎসবগুলোকেও এর বাইরে নিয়ে গণনার সুযোগ নেই। আর এই সবেরই আবহমান কালীন প্রভাব রয়েছে বাংলা সাহিত্যে। মুহুর্মুহু বর্ষা, পেঁজা তুলোর মত শরৎ আর রবীন্দ্রনাথের বসন্ত গান ছাড়া তো বাংলার প্রকৃতি কল্পনাই করা যায় না। মুঘল শাসনামলেই এই বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করা হয়। বাদশাহ আকবরের নির্দেশে জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমীর ফতুল্লাহ সিরাজী ৯৯২ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সৌর বর্ষপঞ্জির প্রচলন করেন। যেহেতু সে বছর মুহাররম মাস ছিল বৈশাখে, এজন্য বৈশাখকেই প্রথম মাস গণনা করা হয়। অবশ্য এ ব্যাপারে ভিন্ন আরেকটি মত আছে। তবে যুক্তির নিরিখে এ মতটিই বেশি শক্তিশালী বলে মনে হয়।
পরাধীনতার শৃঙ্খল : একশ বছরের অন্ধকার
মীর জাফর, উমিচাঁদ, জগৎ শেঠ ও ঘষেটি বেগমের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলা তার স্বাধীনতা হারায়। শুরু হয় ধুরন্ধর ইংরেজদের দুইশ বছরের নির্যাতনের দিনলিপি। তারা একে একে নিঃশেষ করে বাংলার উন্নত অর্থনৈতিক অবকাঠামো, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সবুজ শ্যামল বিশুদ্ধতা। বাংলা সাহিত্যের ঐশ্বর্যের প্রাসাদ তাদের বাঁধায় নিমিষেই ধ্বসে পড়ে। বড়ো ধরনের ফাটল দেখা দেয়। বিশেষ করে মুসলমানদের উপর তাদের নির্যাতনটা ছিল সীমাতিরিক্ত। রাজনৈতিক কারণেই তারা মুসলমানদের ভয়ে তটস্থ থাকত। মুসলমানদের সংস্কৃতি ও আদর্শে ফাটল ধরানোর জন্য তারা কত কূটচালই না চেলেছে। বাংলা সাহিত্যে এই সময়টায় দেখা দেয় একটা বড় ধরনের ঘাটতি। বিশেষত মুসলিম সাহিত্যিকরা পরিস্থিতির দরুন অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছিলেন। একেবারেই যে কিছু লেখা হয় নি, তা নয়। তবে যা লেখা হয়েছে তার মধ্যে সাহিত্যরস খুবই কম। সে সময়কার প্রতিভাগুলোতেও কেমন যেন মরচে ধরে গিয়েছিল। কারণ, তারা নিজেদের টাকার জন্য বেঁচে দিয়েছিলেন। এজন্য তাদেরকে কবিও বলা হয় না। বলা হয়, কবিয়াল বা কবিওয়ালা।
যাই হোক, বাংলা সাহিত্যে ইংরেজদের অবদান কিছুটা হলেও আছে, তা অকপটেই স্বীকার করে নেয়া ভালো। রাজনৈতিক কারণেই তাদেরকে কিছু কিছু বাংলা শিখতে হয়েছে। তবে তারা যেহেতু জনসাধারণের সাথে মিশতে পারত না, এজন্য তারা সরাসরি ভাষা শিখতে পারে নি। কবিতার মর্ম বা ভাব উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় নি। ফলে তারা ব্যাকরণের সহায়তা নিয়েছে। অভিধান রচনা করেছে। বাংলা সাহিত্যে গদ্যের প্রবর্তন করেছে। অবশেষে হিন্দু মুসলিম সম্মিলিত প্রবল ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের মুখে তারা এদেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়। এই দীর্ঘ সময়ে তারা ভবিষ্যত বাঙালিদের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি করে গেছে। তারা জন্ম দিয়েছে এক অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের। এরা এখনও বাংলায় আছে এবং দিন দিন বাড়ছে বই কমছে না। এরা সাম্যের নামে ধর্মের কটুক্তি করে। উদারতার স্লোগানে বিদ্বেষ ছড়ায়। আর সাহিত্যের শিরোনামে চাটুকারিতার জয়গান করে। মধ্যযুগের মুসলিম কবিরাও তো উদারপন্থী ছিলেন। কিন্তু তারা ব্রিটিশ জন্মা ছিলেন না। যার ফলে আমরা কখনও তাদেরকে কোন ধর্মের ব্যাপারে গালাগাল করতে দেখি নি।
ঊনিশ শতক : বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ
আধুনিক যুগের সবচেয়ে প্রাচীন মুসলিম লেখক হিসাবে ধরা যায় মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭—১৯১১) কে। তাঁর ‘রত্নাবতী’ গল্পই মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম গদ্যে লিখিত গল্প। নাটক রচনার ক্ষেত্রেও তার নামই প্রথমে আসে। কবিতা, গল্প, গদ্য, প্রবন্ধ, নাটক, নক্সা, উপন্যাস, জীবনী, আত্মজীবনী এই সবই তিনি লিখেছেন। তার সর্বমোট ৩৬ টি রচনার উল্লেখ পাওয়া যায়। এর মধ্যে কারবালার ঘটনাকে উপজীব্য করে রচিত ‘বিষাদ সিন্ধু’ তার সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম। এটি তিন পর্বে বিভক্ত— মহরম পর্ব, উদ্ধার পর্ব ও এজিদ–বধ পর্ব। ঐতিহাসিকভাবে রচনাটির গুরুত্ব না থাকলেও গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস।
মহাকবি কায়কোবাদ (১৮৫৭—১৯৫১)। তার প্রকৃত নাম কাজেম আল কোরায়শী। সে যুগের মুসলিম সাহিত্যিকদের মাঝে তিনিই ছিলেন সর্বোতভাবে একজন কবি। কাব্যের আদর্শ ও প্রেরণা তার মাঝেই লীলাময় হয়ে ওঠে। তিনিই বাঙালি মুসলিম কবিদের মাঝে প্রথম সনেট রচয়িতা। “আযান” নিয়ে তার চমৎকার একটি কবিতা আছে। সেখানে আযানের প্রতি তার গভীর উপলব্ধি টের পাওয়া যায়। প্রথম কয়েকটি লাইন তুলে দিচ্ছি—
“কে ওই শোনাল মোরে আযানের ধ্বনি।
মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।
কি মধুর আযানের ধ্বনি!”
তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারোটি। এর মধ্যে ১৭৬১ সালে সংঘটিত পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মুসলমানদের গৌরবময় ইতিহাস নিয়ে রচিত ‘মহাশ্মশান’ কাব্য তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এছাড়াও তাঁর গীতিকবিতায় প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ ও আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ পেয়েছে। কায়কোবাদের কাব্যসাধনার মূল উদ্দেশ্য ছিল পশ্চাৎপদ মুসলমান সম্প্রদায়কে তার অতীত ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করা এবং তা পুনরুদ্ধারে উদ্বুদ্ধ করা।
শেখ আবদুর রহিম (১৮৫৯–১৯৩১)। একজন বাঙালি লেখক ও সাংবাদিক। তার লেখালেখির মূল বিষয় ছিল ইসলামী ইতিহাস ও সংস্কৃতি। সারাটা জীবন তিনি মুসলিমদের সামাজিক উন্নয়নের কাজে ব্যয় করে গেছেন। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল ইসলামি ভাবধারায় পশ্চাৎপদ মুসলমান সমাজে নবজাগরণ সৃষ্টি ও বাংলা ভাষার উন্নয়ন করা। ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ সম্পর্কে তিনি অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেছেন। তন্মধ্যে ‘হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনচরিত ও ধর্মনীতি’ এবং ‘ইসলামতত্ত্ব’ গ্রন্থ দুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তৎকালীন যুগে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জনকারী একজন ঔপন্যাসিকের নাম মোহাম্মদ নজিবর রহমান (১৮৬০-১৯২৩)। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিকাশোন্মুখ মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী এই লেখকের জন্ম সিরাজগঞ্জ শহরে। ২০ টির মত সামাজিক ও ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করেছেন। এর মধ্যে ‘আনোয়ারা’ তার প্রথম ও সবচেয়ে সার্থক উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের বেস্টসেলার গ্রন্থগুলোর একটি। “বিষাদ সিন্ধু”র পরেই এর অবস্থান। ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করা এই উপন্যাসে সপ্তদশ শতকের গ্রামীণ মুসলমানদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবন চিত্রিত হয়েছে।
মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক (১৮৬০-১৯৩৩)। প্রসিদ্ধ বাঙালি কবিদের মধ্যে অন্যতম। তিনিই সর্বপ্রথম বাঙালি মুসলমানের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। পেশাগতভাবে সাংবাদিক ছিলেন। ‘মোসলেম ভারত’ মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। মূল ফারসি থেকে শাহনামা কাব্যের প্রথমাংশের অনুবাদ তার অমর কীর্তি। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ তাকে “কাব্য কন্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করে। ‘ফেরদৌসি চরিত’ তার একটি জনপ্রিয় উপন্যাস। এছাড়াও হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, খাজা মইনউদ্দিন চিশতি, হাতেমতাই ও টিপু সুলতান সহ তার আরও বেশ কয়েকটি প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকাতে তিনি সেক্রেটারি ছিলেন। এই পত্রিকায় কাজি নজরুল ইসলামের অনেক লেখা প্রকাশিত হয়।
মুনশি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ (১৮৬১ – ১৯০৭)। বৃটিশ বাংলার অসাধারণ বাগ্মী, সমাজ সংস্কারক একজন প্রতিভাবান কবি। সেকালের খ্রিস্টান পাদ্রীদের নিজ ধর্ম প্রচার ও অন্য ধর্মের প্রতি কুৎসা রটনা তাকে ব্যাথিত করেছিল। তিনি এর শক্ত প্রতিবাদ করতে মাঠে নামেন এবং কুরআন সম্পর্কে তাদের উত্থাপিত অযথা প্রশ্নের দাঁতভাঙা জবাব দেন। তিনি তার তাবলীগি মিশনের কাজে একে একে লিখতে থাকেন— খ্রিস্টীয় ধর্মের অসারতা, রদ্দে খ্রিস্টান ও দলীলুল ইসলাম, জওয়াবে নাসারা। এছাড়াও তার আরও কয়েকটি গ্রন্থ আছে। ‘সুধাকর’ ও ‘ইসলাম প্রচারক’ ইত্যাদি পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লেখালেখি করতেন। পাশাপাশি তিনি ছিলেন বড় মাপের বিতার্কিক। তার সহায়তায় বহু খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণকারী মুসলিম আবার ইসলামে ফিরে আসতে সক্ষম হয়।
বাংলা ভাষায় প্রথম সংবাদপত্র “দৈনিক আজাদ” এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ (১৮৬৮—১৯৬৮)। পাশাপাশি তিনি একজন বাঙালি সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও ইসলামী পণ্ডিত। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম। আমপারার বাংলা অনুবাদ করেছেন। লিখেছেন পাঁচ খণ্ডের তাফসীরুল কুরআন। আরও লিখেছেন মোস্তফা চরিত, মুক্তি ও ইসলাম, মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস এবং বাইবেলের নির্দেশ ও প্রচলিত খ্রিস্টান ধর্ম। ১৯৮১ সালে মরনোত্তর তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা “স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার” লাভ করেন।
তারই সমসাময়িক আরেকজন সাংবাদিক ছিলেন মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০)। তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ও একজন ইসলামী চিন্তাবিদ। সফলভাবে বাংলা সাহিত্য চর্চা ও রচনা করে গেছেন। সাহসিকতায় ভরপুর ছিল তার রচনা। লিখেছেন ইসলামি সভ্যতা ও গণমানুষের অধিকার নিয়ে। লিখেছেন কবিতা ও গল্প। ইসলামি সংস্কৃতি ও ইতিহাসে তার অবদান অনস্বীকার্য। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন মাঠপর্যায়ের সৈনিক ছিলেন। ৪২ টির মত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তন্মধ্যে ১. ভারতে মুসলিম সভ্যতা, ২. সমাজ সংস্কার, ৩. ভূগোল শাস্ত্রে মুসলমান, ৪. ইসলাম জগতের অভ্যুত্থান ৫. ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের অবদান ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পরাধীন ব্রিটিশ ভারতে অসচেতন মুসলিম সমাজকে কলমের আঘাতে জাগাতে চেয়েছিলেন যেই গুটিকয়েক মুসলিম সাহিত্যিক, তাদের মধ্যে ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৭৯—১৯৩১) অন্যতম। তিনি মুসলমানদের জন্য বিজ্ঞান সাধনা, মাতৃভাষাচর্চা ও নারীশিক্ষা বিষয়ে লেখালেখি করেন। তার অনেকগুলো উপন্যাস ও কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। এর মধ্যে ‘অনল প্রবাহ’ কাব্যগ্রন্থটি সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল এবং এর জন্য তাকে কারাবন্দি হতে হয়। চেতনায় আগুন সেই কাব্যের কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি—
“আর ঘুমিও না নয়ন মেলিয়া,
উঠরে মোসলেম উঠরে জাগিয়া,
আলস্য জড়তা পায়েতে ঠেলিয়া,
পূত বিভু নাম স্মরণ করি।
যুগল নয়ন করি উন্মীলন,
কর চারিদিকে কর বিলোকন,
অবসর পেয়ে দেখ শত্রুগণ,
করেছে কীদৃশ অনিষ্ট সাধন,
দেখো চাহিয়া অতীত স্মরি।”
বাংলার মুসলিম সমাজের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে কলম ধরেছিলেন, এমন আরেকজন মুসলিম লেখকের নাম কাজী ইমদাদুল হক (১৮৮২—১৯২৬)। ‘আবদুল্লাহ’ উপন্যাসের জন্য তিনি অধিক খ্যাতি লাভ করেন। তার অন্যান্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে মোছলেম জগতে বিজ্ঞান চর্চা, নবীকাহিনী, আঁখিজল, কামারের কাণ্ড ও আবদুর রহমানের কীর্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ঊনিশ শতকের সর্বশেষ সাহিত্যিক হিসাবে যার নাম উল্লেখ করব, তিনি হলেন শেখ ফজলল করিম (১৮৮২—১৯৩৬)। তার প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫৫ টিরও বেশি। মাত্র ১২ বছর বয়সে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সরল পদ্য বিকাশ’ হাতে লিখে প্রকাশিত হয়। সাহিত্য সাধনা ছিল তার জীবনের ব্রত। গদ্য ও পদ্য উভয়ধারায় তার ছিল গৌরবময় পদচারণা। তার উল্লেখযোগ্য রচনার একটি ‘পথ ও পাথেয়’। সমকালীন কবিদের মাঝে তার স্থান ছিল প্রথম সারিতে। হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে তিনি কাজ করে গেছেন। তার প্রসিদ্ধ কবিতার কয়েকটি লাইন যার সাক্ষ্য বহন করছে—
“কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক, কে বলে তা বহু দূর,
মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরা-সুর।”
ঊনিশ শতকের আরও অনেক উল্লেখযোগ্য মুসলিম কবি সাহিত্যিক ছিলেন। কিন্তু আমরা সবার নাম উল্লেখ করি নি। কারণ, তারা হয়তোবা ইসলামী ভাবধারা ধরে রাখতে পারেন নি। ভেসে গেছেন ব্রিটিশ শেখানো আধুনিকতায়। তাদের অবিশ্বাসের বেড়াজাল আর চাটুকারিতার আধিক্য দেখে আমরা তাদের পূর্বপুরুষ ভাবতে পারি নি। বিশ শতকের অবস্থাও তাই। বরং বিশ শতকের শেষটা তো আরও করুণ। সব কিছু ডিঙিয়ে বাংলা আমাদের হয়েছিল। আমরা বাংলাদেশ নামে একটা দেশ পেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আমরা হারিয়েছি আমাদের পূর্বপুরুষদের আদর্শ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। খুঁইয়ে বসেছি আমাদের জন্মের ইতিহাস। তারপরও যারা সেই চেতনাকে ধরে রাখার নিরলস প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন, আমরা তাদের গর্ব ভরে স্মরণ করব।