খুব কম মানুষই এই মহান ব্যক্তিকে চেনেন। আবু সাহবা সেলাহ ইবনে উশাইম ছিলেন একজন দুনিয়া বিরাগী সাধক ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন আলেমা মুআযাহ আদাবীয়ার স্বামী। মহান এই সংগ্রামী সাধক মুসলিম সমাজে রেখেছিলেন অনন্য অনেক অবদান; সমাজের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে তার জন্য ছিল সীমাহিন ভালোবাসা ও ব্যাপক প্রভাব।
ধৈর্য ও আল্লাহর সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট থাকা ছিল তার অনন্য গুণের একটি। সাবিত বর্ণনা করেন : একবার এক ব্যক্তি সেলাহর নিকট তার ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শোনাতে এলে সেলাহ তাকে বললেন, ‘এখানে এসে বসো; খাবার খাও! আমার ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ বেশ কিছুক্ষণ আগেই আমার নিকট পৌঁছেছে। আল্লাহ তাআলা তো বলেছেন, ‘তুমিও মারা যাবে, তারাও মৃত্যুবরণ করবে।’[১]
সেলাহ ইবনে উশাইম থেকে প্রকাশিত হয়েছিল আশ্চর্য অনেক কারামত। জাফর ইবনে যিয়াদ বর্ণনা করেন, তার বাবা যিয়াদ তাকে বলেছেন : আমরা কাবুল অভিযানে বের হলাম। আমাদের বাহিনীতে সেলাহও ছিলেন। বাহিনী একটি স্থানে বিশ্রামের জন্য যাত্রা বিরতি দিলে আমি মনে মনে সংকল্প করলাম, সেলাহ আজ কী করেন তা আমি দেখব। তিনি প্রথমে নামাজ পড়লেন; তারপর শুয়ে শুয়ে অন্যদের অচেতন হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলেন। বাহিনীর অন্য সদস্যরা ঘুমিয়ে পড়লে তিনি দ্রুত শোয়া থেকে উঠে প্রবেশ করলেন পাশে থাকা একটি ঝোঁপে। তার পেছনে পেছনে আমিও সেখানে প্রবেশ করে দেখলাম, তিনি প্রথমে ওযু করলেন, তারপর দাঁড়িয়ে গেলেন নামাজে। হঠাৎ দেখলাম একটি বাঘ বের হয়ে একদম তার দিকেই এগিয়ে আসছে, বাঘ দেখে ভয়ে আমি গাছে উঠে গেলাম; কিন্তু তিনি নামাজেই মশগুল রইলেন। মনে মনে বললাম, আজ এই বাঘ তাকে চিড়ে খাবে―কিন্তু কিছুই হলো না। তিনি শান্তভাবে সালাম ফিরিয়ে বলে উঠলেন, ‘ওহে হিংস্র প্রাণী, অন্য কোথাও গিয়ে তোমার রিযিক তালাশ করো!’ আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, বাঘটি তার এ-কথা শুনে চলে যাচ্ছে।
সুবহে সাদিক হলে প্রথমে তিনি বসে বসে আল্লাহর প্রশংসা আদায় করলেন, তারপর হাত তুলে বললেন, ‘হে আল্লাহ, আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি; আমাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দাও! আমার মতো মানুষ কি তোমার নিকট জান্নাত প্রার্থনা করার সাহস করতে পারে!?’[২]
শাহাদাত ছিল এই সংগ্রামী সাধকের পরম চাওয়া। আলা ইবনে হেলাল বলেন : এক ব্যক্তি সেলাহ ইবনে উশাইমকে বলল, ‘আমি স্বপ্নে দেখেছি আমাকে একবার শহীদ করা হয়েছে, আর আপনাকে দু-বার।’ একথা শুনে তিনি বললেন, ‘এর ব্যাখ্যা হলো, তোমাকে শহীদ করে দেওয়া হবে এবং আমাকে ও আমার ছেলেকেও শহীদ করা হবে।’
হিজরী ৬২ সনে ইয়াযিদ ইবনে যিয়াদের সময় তুর্কিরা সিজিস্তানে মুসলিমদের সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে সেলাহ তার ছেলেকে বলেছিলেন, ‘পুত্র আমার, তুমি তোমার মায়ের নিকট চলে যাও!’ উত্তরে ছেলে পিতাকে বলেছিল, ‘বাবা, তুমি নিজের জন্য কল্যাণ প্রত্যাশা করো, অথচ আমাকে ফিরে যেতে বলছ!?’ ছেলের মুখে এমন উত্তর শুনে সেলাহ বললেন, ‘তাহলে চলো, সামনে অগ্রসর হও!’
ছেলেটি অগ্রসর হয়ে লড়াই করতে করতে অবশেষে পান করলো শাহাদাতের অমীয় সুধা।[৩]
হাম্মাদ ইবনে সালামাহ বলেন, সাবিত আমাদেরকে বলেছেন : সেলাহ ইবনে উশাইম ছেলেকে নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি তার ছেলেকে বললেন, ‘পুত্র আমার, সমুখপানে এগিয়ে গিয়ে লড়াই করো।’ পিতার উৎসাহে সে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং লড়াই করতে করতে শহীদ হয়ে যায়। এরপর তিনিও শত্রু সারিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে লড়াই করতে করতে শাহাদাতের অনন্য মর্যাদা লাভ করেন।
পিতা-পুত্রের শাহাদাতের সংবাদ শুনে অন্যান্য নারীরা তার বিবি মুআযাহর নিকট একত্রিত হয়ে শোক জানাতে এলে বীরাঙ্গনা এই রমনী তাদেরকে বলেছিলেন, ‘তোমরা যদি আমাকে মোবারকবাদ জানানোর জন্য এসে থাকো, তাহলে আমি তোমাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছি। আর যদি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এসে থাকো; তাহলে ফিরে যাও!’[৪]
তথ্যসূত্র :
১। সূরা যুমার : ৩০।
২।সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৩/৪৯৯।
৩। সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৩/৫০০।
৪। তবাকাতে ইবনে সাদ, ৭/১৩৭; সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৩/৯৭।
Facebook Comments