সংকলন
সমাধান তো কোরআনেই!
আত্মশুদ্ধি প্রতিযোগিতা-১

সমাধান তো কোরআনেই! | মাসুদুর রহমান

কোরআনের আলোচ্য বিষয়গুলোকে আমরা মোটা দাগে আলাদা করলে পাই আল্লাহ্‌ কোরআনে তাওহীদ, হুকুম-আহকাম সম্পর্কিত আয়াত, রিসালাতের কথা, পরকালের কথা এবং পূর্ববর্তী বিভিন্ন জাতি ও নবীদের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। পূর্ববর্তী নবীদের দাওয়াতের মানহাজ কী ছিল এবং তাঁদের প্রতি কওমের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল, এসব বিষয় আল্লাহ্‌ তা’আলা তাঁর কালামে বর্ণনা করেন। অনুধাবনের বিষয় হলো, সেসব ঘটনা থেকে সাহাবায়ে কেরাম ও আমাদের সালাফগণ কী শিক্ষা নিয়েছেন? বর্তমানে এই মসিবত ও ফিতনার যুগে আমরাও কি পারি না, তাঁদের নেওয়া সেই শিক্ষার অনুসরণ করে নিজের ইমান ও আমলের হেফাজত করতে? মসিবত থেকে মুক্তির প্রকৃত দুয়ারে কড়া নাড়তে? হুম চাইলেই পারি। প্রয়োজন সদিচ্ছা আর সেই মহান সত্তার কাছে সাহায্য কামনা।

হযরত নূহ আলাইহিস সালামকে আল্লাহ্‌ তা’আলা তাঁর কওমের কাছে প্রেরণ করেন। উদ্দেশ্য, তাদের প্রতি শাস্তি আসার পূর্বেই যেন তাঁদের সতর্ক করতে পারেন। আযাব আসার পূর্বেই সতর্ক হওয়া চাই! কারণ কোন এলাকায় যখন আযাব চলে আসে তা যে শুধু ওই নর্তকী, সুদখোর আর জিনাকারীর উপর আপতিত হয় তা কিন্তু নয়। আবেদ বান্দাও পড়ে যেতে পারেন সেই আযাবে। তাই উম্মাহর যখন ক্রান্তিলগ্ন, চারিদকে যখন মৃত্যু আর জুলুমের হাহাকার, তখন দ্বীনের হক্কানী আলেম ও আবেদ বান্দাদের রাতের শেষ প্রহরের চোখের পানি হয়তো আল্লাহ্‌ তা’লার রাগকে প্রশমিত করবে। আল্লাহ্‌ মাফ করুন আমাদের।

নূহ আলাইহিস সালাম কীসের দাওয়াত দিলেন তাঁর জাতিকে?

আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেন,

তিনি (নূহ আলাইহিস সালাম)বললেন, “হে আমার সম্প্রদায়, নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য স্পষ্ট সতর্ককারী, এ বিষয়ে যে তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর, তাঁর তাকওয়া অবলম্বন কর আর আমার আনুগত্য কর।” (সূরা নূহঃ ২-৩)

আল্লাহর শাস্তি আসার আগে তিনি কী বলে সতর্ক করলেন? উক্ত আয়াত থেকে পাই তাঁর তিনটি বার্তা-

১. আল্লাহর ইবাদাত কর,

২. তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অবলম্বন কর,

৩. আমার তথা নবীর আনুগত্য কর।

আজ আমরাও তো মুক্তি চাই। আমরাও তো আযাব থেকে রেহাই চাই। কিন্তু এই তিনটি মাপকাঠিতে কি জীবনের কর্মগুলোকে একবার বিচার করার সময়টুকু পেয়েছি? হয়তো পাইনি। কারণ, খুজেই তো দেখিনি। আল্লাহ্‌ পয়গাম পাঠালেন তাঁর আনুগত্য করতে, আর আমি বলি কাল থেকে সালাত শুরু করব। কোথায় যে কালকে বেঁচে থাকার গ্যারান্টি পেলাম। আল্লাহু আ’লাম।

গত কিছুদিন ফেসবুকে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধে উঠে এসেছে, কী হতে যাচ্ছে আগামি কয়েক বছর। কোন খাতে কত ক্ষতি হতে যাচ্ছে। বড় বড় কোম্পানীগুলো কীভাবে সামলে উঠবে। নিশ্চিতভাবে কাজগুলো প্রশংসনীয়। কিন্তু যারা এতকিছু ভাবছি বা যারা তাঁদের ভাবনাগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করছি, তারা কি একবারো ভেবেছি কাল মৃত্যু চলে আসলে আমি কই যাব? জান্নাত না জাহান্নাম? আল্লাহ্‌ যদি একটা প্রশ্নও করেন যে, বান্দা তোমার উপর কয় ওয়াক্ত সালাত ফরয ছিল, আর তুমি কয় ওয়াক্ত আদায় করেছ? উত্তর টা সন্তোষজনক হবে তো? যাই হোক।

তো নূহ আলাইহিস সালাম যখন কওমকে আহ্বান জানালেন এক আল্লাহর ইবাদাত, আল্লাহভীতি ও তাঁর আনুগত্য করার জন্য তখন তাঁদের প্রতিক্রিয়া ছিল-

আল্লাহ্‌ বলেন-

তিনি বললেন,”হে আমার রব, আমি তো আমার সম্প্রদায় কে দিনরাত ডেকেছি। কিন্তু আমার ডাক তাদের পলায়নপ্রবণতাই বৃদ্ধি করেছে। আমি যখনই তাদেরকে ডাকি যাতে আপনি তাদের ক্ষমা করেন, তারা নিজেদের কানে আঙ্গুল দিয়েছে, কাপড় দ্বারা ঢেকে দিয়েছে নিজেদেরকে এবং জেদ করতে থেকেছে আর খুবই ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছে।”(সূরা নূহঃ ৫-৭)

নাহ! তারা গ্রহণ করলো না। মুখ ফিরিয়ে নিল। যুগে যুগে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছে কপালপোড়া মানুষগুলো। এখনও করেই যাচ্ছে। হয়তো ভবিষ্যতেও করতেই থাকবে। আমাদের প্রিয়নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথেও অনুরূপ আচরণ করে মক্কার কাফেররা। তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। এমন ভাব করে যেন তারা তাঁর কথা শুনতেই পায় নি। কিন্তু মহান আল্লাহর চোখে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করা নিতান্ত বোকামি ছাড়া আর কি ই বা হতে পারে। মক্কার সেই ভ্রান্ত লোকদের কথাও আল্লাহ্‌ তাঁর কালামে বর্ণনা করেন।

তিনি বলেন,

দেখ এসব লোক তাদের বক্ষ ঘুরিয়ে নেয় যাতে তারা রাসূলের চোখের আড়ালে থাকতে পারে। সাবধান! যখন এরা কাপড় দ্বারা নিজেদেরকে ঢেকে আড়াল করে তখন আল্লাহ্‌ তাদের প্রকাশ্য বিষয়গুলোও জানেন এবং গোপন বিষয়গুলোও জানেন। তিনি তো মনের মধ্যকার গোপন কথাও জানেন। (সূরা হূদঃ ৫)

এরপর নূহ আলাইহিস সালাম সেই মুখ ফিরিয়ে নেওয়া জাতির সামনে নিয়ে এলেন এক মেগা অফার। কী ছিল সেই ঘোষণা?

পবিত্র কোরআনে এসেছে,

অতঃপর বলেছি,”তোমাদের রবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয় তিনি মহাক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন এবং তিনি তোমাদেরকে সমৃদ্ধ করবেন ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততিতে। তোমাদের জন্য প্রবাহিত করবেন উদ্যান ও প্রবাহিত করবেন নদী নালা।”(সূরা নূহঃ ১০-১২)

আহ কার বান্দা আমরা! ছোট্ট একটা কাজ শুধু ক্ষমা প্রার্থনা কর। বিনিময়ে দুনিয়াতে শান্তির সমগ্র উপকরণের ঘোষণা। সাথে পরকালীন মুক্তি তো আছেই। কত অধম আমরা! মালিকের ভান্ডারে তো অভাব নেই একটু চেয়ে নিব! সেটাও পারি না। একটু হাত বাড়াব! একবার চোখের পানি দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করব! নাহ, হয়ে উঠে না কেন জানি!

একইভাবে হূদ আলাইহিস সালাম ও কওমের লোকদেরকে বলেন,

হে আমার কওমের লোকেরা, তোমরা তোমাদের প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। তাঁর দিকে ফিরে যাও। তিনি তোমাদের ওপর আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন এবং তোমাদের শক্তি ও ক্ষমতা বাড়িয়ে দিবেন। (সূরা হূদঃ ৫২)

আর কী চাই! দুনিয়ার শান্তির সব উপকরণের ঘোষণা। শক্তি ও ক্ষমতা! এই দুনিয়ার জীবনের জন্য তো এর থেকে বেশি কিছু দরকার নেই।তবুও কেন আমরা আসহায় আজ? কেন আমাদের মাথার ওপর দিয়ে শত্রুদের বিমান ওড়ে? কেন আজ বিশ্বসভ্যতা ঘরে বন্দি? কেন এই পৃথিবী স্তব্ধ?

কারণ-

আল্লাহ্‌ বলেন,

আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার দুনিয়ার জীবন হবে সংকীর্ণ। আর কিয়ামতের দিন আমি তাকে অন্ধ করে ওঠাব। (সূরা ত্বা-হা, ১২৪)

আল্লাহ্‌ সত্য! তাঁর নিয়ামতের প্রতিশ্রুতি সত্য! তাঁর আযাবের প্রতিশ্রুতিও সত্য! আজ বিশ্ব হাড়ে হাড়ে তা টের পাচ্ছে। হয়তো স্বীকার করবে না। কিন্তু আমরা তো মুক্তি চাই।

নাহ শুধু হতাশা না! শান্তির বাণীও আছে। কী করেছিলেন সেই সোনালী যুগের সাহাবাগণ?

ছোট্ট একটি ঘটনা আজ যেন পুরো বিশ্ববাসীর জন্য শিক্ষা। কুরআন মাজীদের এই নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে একবার দুর্ভিক্ষের সময় উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বৃষ্টির জন্য দু’আ করতে বের হলেন এবং শুধু ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করেই শেষ করলেন। সবাই বলল, হে আমিরুল মু’মিনীন আপনি তো আদৌ কোন দু’আ করলেন না। তিনি বললেন, আমি আসমানের ঐ সব দরজায় করাঘাত করেছি যেখান থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়। একথা বলেই তিনি সূরা নূহের আয়াতগুলো পাঠ করে শুনালেন। অনুরূপ এক ঘটনা আছে। একবার হাসান বসরির কাছে বিভিন্ন জন এসে বিভিন্ন সমস্যার কথা বললেও তিনি সবাই কে একই সমাধান দিলেন যে, ক্ষমা প্রার্থনা কর।

তাই আমাদের ও আজ সমাধান খোঁজার জন্য মনে হয় আর কোথাও যাওয়ার দরকার নাই। সমাধান একটাই। ক্ষমা চাইতেই হবে। তাঁর সামনে মাথা নত করতেই হবে। জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা, পাপের কথা ভেবে চোখের পানিতে বুক ভাসাতে হবে।

মাবূদ গো! আমরা তো দুর্বল। অত কিছু বুঝি না। তুমি শুধু মাফ করে দাও। বিপদ থেকে মুক্তি দাও। আর কিছু চাইনা।

Facebook Comments

Related posts

নির্মল জীবন-২ | ইমরান রাইহান

সংকলন টিম

আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা, পথ ও পদ্ধতি | মুশতাক আহমাদ

নির্মল জীবন-৯ | ইমরান রাইহান

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!