একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, দৃশ্যমান জগতের আড়ালেও ভিন্ন জগত আছে। এই ভিন্ন জগতকে নিয়ে রচিত হয়েছে নানা মিথ ও কুসংস্কার। লেখা হয়েছে কল্পনা নির্ভর সাহিত্য। বিষয়টি সবার কাছে পরিচিত। অদৃশ্য জগতের মতই চোখের আড়ালেও চোখ আছে। যে চোখকে চোখ কখনো দেখে না। শুনতে অদ্ভুত শুনালেও কথাটি আমার নয়। কথাটি বলেছেন খালেদ বিন মাদান রহিমাহুল্লাহ। তিনি ছিলেন সিরিয়ার বিখ্যাত আলেমদের একজন।
তিনি বলেন, আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকে চারটি চোখ দান করেছেন। দুটি চোখ তাঁর চেহারায়, দৃশ্যমান। এই দুটি চোখ দ্বারা সে দুনিয়ার বিষয়াবলী দেখে। আর দুটি চোখ রয়েছে তাঁর অন্তরের ভেতর। সেই দুই চোখ দ্বারা সে আখিরাতের বিষয়াবলী দেখে। যখন আল্লাহ কোনো বান্দার কল্যান কামনা করেন তখন তাঁর অন্তরের দুই চোখ খুলে দেন। বান্দা অন্তরের চোখ দিয়ে আল্লাহ গায়েবের যে সংবাদ দিয়েছেন তা অনুভব করে। গায়েবের প্রতি তাঁর বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে উঠে। (সিফাতুস সাফওয়াহ, ২/৩৭৪)
খালেদ বিন মাদান অন্তরের চোখের কথা বলেছেন। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের এই চোখ খুলে দেন। এই চোখ খুলে গেলে বান্দা এমন অনেক বিষয় অনুভব করে যা চর্মচক্ষু দেখতে পায় না।
- চর্মচক্ষু দেখে হারাম সম্পদে প্রাচুর্য আছে। আছে আয়েশের সুখ ও সমৃদ্ধি। কিন্তু অন্তরের চোখ দেখে হারাম সম্পদ মানেই আগুনের ফুলকি। এই আগুনের ফুলকি জাহান্নামের অগ্নিকুন্ড হয়ে পুড়িয়ে দিবে হারাম সম্পদ উপার্জনকারীকে।
- চর্মচক্ষু দেখে যখন আমি একা হই তখন আমি সবার চোখ থেকে নিরাপদ। যা ইচ্ছা করতে পারি। আমাকে বাধা দেয়ার কেউ নেই, দেখার কেউ নেই, গালমন্দ করার কেউ নেই। চাইলে নিজেকে জড়াতে পারি যে কোনো অপরাধে কিংবা গোপন গুনাহয়। এ সময় বাধ সাধে অন্তরের চক্ষু। অন্তর্চক্ষু বলে, তুমি একা নও। রব তোমার সাথে আছেন। তিনি তোমাকে দেখছেন। কী করে তুমি তাঁর অবাধ্য হবে? তাঁর নাফরমানি করবে? ব্যক্তি যখন অন্তর্চক্ষুর এই অনুভূতি নিয়ে চিন্তা করে তখন তাঁর যাহের ও বাতেন সমান হয়ে যায়। নির্জনতাও তাকে গুনাহে প্ররোচিত করতে পারে না।
- চর্মচক্ষু দেখে যাকাত দেয়া মানে সম্পদ কমে যাওয়া। কিন্তু অন্তর্চক্ষু দেখে যাকাত রবের বিধান। এই বিধান মেনে নিলে দুনিয়াতে রব স্বচ্ছলতা দিবেন। আখিরাতে দিবেন বিশেষ পুরষ্কার। যাকাত মানে সম্পদ কমে যাওয়া নয়। বরং নিজের সম্পদে থাকা গরিবদের হক তাদেরকে দেয়ার মাধ্যমে রবের নিকটবর্তী হওয়ার পদ্ধতীর নাম যাকাত।
- চর্মচক্ষু দেখে জিহাদ মানে নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলা, সন্তানদের ইয়াতিম করা। অনর্থক নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়া, যার কোন অর্থ বা যুক্তি নেই। কিন্তু অন্তর্চক্ষু দেখে এটি ইসলামের সর্বোচ্চ চূড়া। এটি জান্নাতে নিজের বাসস্থান গড়ে নেয়ার অপূর্ব সুযোগ। এটি হুরদের বিয়ের মোহর।
এই যে চর্মচক্ষুর সাথে অন্তর্চক্ষুর পর্যবেক্ষনের একটা ফারাক দেখছি এর মূল কারণ কী? এর মূল কারণ হলো অন্তর্চক্ষু সিদ্ধান্তে আসে কিছু বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে। সে প্রথমে রবের আদেশ নিষেধ বিশ্বাস করে ফেলে নির্দ্বিধায়। ফলে যে কোনো বিষয়ে সে সহজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সে প্রতিটি বিষয়ের মূল রুপ সহজে অনুধাবন করে। কারণ, তাকে পথ দেখায় রবের নির্দেশনা। রবের নির্দেশনার প্রতি এই দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থার নামই ইয়াকিন।
আহমাদ বিন আসিম আল আনতাকি ছিলেন দামেশকের বিখ্যাত ওয়ায়েজ। অন্তরের রোগসমুহ সম্পর্কে তিনি গভীর জ্ঞান রাখতেন। তাঁর বন্ধুরা তাকে এজন্য নাম দিয়েছিল জাসুসুল কুলুব (অন্তরের গোয়েন্দা)। তিনি একবার ইয়াকিন সম্পর্কে বলেছিলেন, অন্তরে যখন ইয়াকিন প্রবেশ করে তখন অন্তর থেকে সকল সন্দেহ সংশয় দূর হয়।(নুযহাতুল ফুজালা, ২/৯৫৫)
ইয়াকিনের রয়েছে অদ্ভুত এক সম্মোহনী শক্তি। অন্তরে যখন প্রোথিত হয় ইয়াকিনের চারা, ধীরে ধীরে ডালপালা মেলে তা, বান্দার মন থেকে দূর হয় সন্দেহ সংশয়ের জাল। ইয়াকিন এক দৃঢ় বিশ্বাসের নাম, যা ঈমানেরই দাবী। আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা) বলেছেন, ঈমান পুরোটাই ইয়াকিনের নাম। (ফাতহুল বারী, ১/৪৮)
হাসান বসরি বলেছেন, ইয়াকিনের মাধ্যমে মানুষ জান্নাত কামনা করে, জাহান্নাম থেকে দূরে সরে, রবের নির্ধারিত ফরজ আদায় করে এবং হকের উপর অটল থাকে। (নুজহাতুল ফুযালা, ২/৫৫৫)
ইয়াকিন কোনো নীরস বিষয় নয়। বক্তৃতা-আলোচনার তত্ত্বকথা নয়, কিংবা ভাষার অলংকরণ নয়। ইয়াকিনের সম্পর্কে আমলের সাথে। সব ইয়াকিনের সাথেই আমল জরুরি। এই বিষয়ের ইংগিত রয়েছে আল্লাহর বানীতে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, যারা নামায কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং পরকালে নিশ্চিত বিশ্বাস করে। (সুরা নাম’ল ২৭:৩) এখানে আল্লাহ তাআলা নেক আমলের সাথে ইয়াকিনকে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ ইয়াকিনের জন্য নেক আমল জরুরি। নেক আমল না করলে ইয়াকিন দৃঢ় হতে পারে না। এই আয়াতের তাফসিরে মুফাসসিরগন লিখেছেন, এই আয়াত থেকে বুঝা যায়, আখিরাতের প্রতি প্রকৃত ইয়াকিন তখনই গ্রহনযোগ্য হবে যখন ঈমান ও নেক আমল একত্রিত হবে।
আল্লাহ আমাদেরকে ঈমানের সাথে নেক আমলের তাওফিক দিন। অন্তরে ইয়াকিন দৃঢ় করে দিন।
Facebook Comments