সংকলন
সালাফ পরিচিতি
ইমরান রাইহান সালাফ পরিচিতি

সমকালীন জনজীবনে সালাফদের প্রভাব: পর্ব -২ | ইমরান রাইহান

আলেমদের ইন্তেকালের পর স্পষ্ট হত মানুষের মনে তাদের প্রতি ভালোবাসা কতটা গভীর ছিল। আলেমদের মৃত্যু সংবাদ মানুষকে গভীর শোকাহত করতো, যার প্রকাশ ঘটতো তাদের জানাযার সময়। তাদের জানাযায় দেখা যেত মানুষের উপচেপড়া সমাগম। বকর বিন আবদুল্লাহ মাযিনির ইন্তেকালের পর তার জানাযায় মানুষের ভীড় দেখে হাসান বসরি মন্তব্য করেছিলেন, সওয়াবের বদলে গুনাহই বেশি হচ্ছে। (১)

আমর বিন কাইস যেদিন ইন্তেকাল করেন সেদিন কুফার বাসিন্দারা ঘরের দরজা আটকে তার জানাযায় অংশ নেয়। (২) আলি বিন হুসাইন ইন্তেকাল করলে মদীনার সবাই নিজেদের কাজকর্ম রেখে তার জানাযায় অংশ নিয়েছিল। শুধু সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব সেদিন নিজের মসজিদে অবস্থান করছিলেন। (৩)

হাসান বিন আবুল হাসান বসরি ইন্তেকাল করেন বসরা শহরে। সেদিন ছিল শুক্রবার। সবাই তার জানাযায় অংশ নেয়। ভীড়ের কারণে দাফন সারতে অনেক দেরি হয়। দাফন শেষ হতে হতে আসরের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যায়। যেহেতু শহরের সবাইই জানাযায় অংশ নিয়েছিল তাই সেদিন শহরের জামে মসজিদে আসরের জামাত অনুষ্ঠিত হয়নি। (৪)

বিখ্যাত সুফি দাউদ তাঈ ইন্তেকাল করলে তার জানাযায় প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। মানুষের ভীড়ের কারণে লাশ বহনকারি খাটিয়া তিনবার বদলাতে হয়, কারণ এটি ভেংগে যাচ্ছিল। (৫)

লাইস ইবনু সাদ ছিলেন মিসরের বিখ্যাত ফকিহ। তার জানাযায় ছিল প্রচুর মানুষের ভীড়। খালেদ ইবনু আবদিস সালাম সাদাফি উপস্থিত হয়েছিলেন তার জানাযায়। তিনি বলেন,

‘বাবার সাথে আমি লাইস ইবনু সাদের জানাযায় উপস্থিত হই। এত বড় জানাযা আমি আর দেখিনি। সবার চেহারায় ছিল শোকের ছায়া। তারা একে অপরকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল আবার পরক্ষনেই শোকে ভেঙ্গে পড়ছিল। বাবা আমাকে বললেন, এমন দৃশ্য তুমি আর কখনো দেখতে পাবে না’। (৬)

ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বলের জানাযায় অন্তত ১০ লক্ষ মানুষ উপস্থিত হন। (৭) সুনানে আবু দাউদের সংকলক আবু দাউদ সিজিস্তানির জানাযায় প্রায় তিন লাখ মানুষ অংশ নেন। (৮)

সালেম বিন আবদুল্লাহ বিন উমরের জানাযায় প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। এই জানাযায় উপস্থিত ছিলেন উমাইয়া খলিফা হিশাম বিন আবদুল মালেক। জানাযায় উপস্থিত মানুষের আধিক্য দেখে তিনি চমকে যান। মদীনায় এত মানুষ বসবাস করে তা-ই তার জানা ছিল না। এর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে সংখ্যার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। কিন্তু সালেমের জানাযায় মানুষের আধিক্য দেখে হিশাম বিন আবদুল মালেক আদেশ দেন, এখন থেকে প্রতি যুদ্ধে মদীনা থেকে অন্তত ৪ হাজার যোদ্ধা পাঠাতে হবে। (৯)

আলেমদের জানাযাতে শুধু মুসলিমরাই অংশ নিতেন এমন নয়। বরং অমুসলিমরাও উপস্থিত হতেন তাদের জানাযায়। এ থেকে বুঝা যায় অমুসলিমদের মাঝেও তাদের ব্যক্তিত্বের প্রভাব ছিল। ইমাম আউযায়ি ইন্তেকাল করলে তার জানাযায় ইহুদি খ্রিস্টান ও কিবতিরাও উপস্থিত হয়েছিল। (১০)

অমুসলিমদের এই উপস্থিতির পেছনে কোনো পার্থিব স্বার্থ ছিল না। মূলত একজন মুখলিস আলেমের কর্মের প্রভাবই তাদেরকে টেনে এনেছিল তার জানাযায়। শুধু জানাযায় উপস্থিত থেকেই ক্ষান্ত হয়নি তারা। জানাযার পরে অনেকেই সেদিন ইসলাম গ্রহন করেছিল। (১১)

মানসুর বিন যাদান ইন্তেকাল করেন ওয়াসিত শহরে। তার জানাযায় এসেছিল ইহুদি, খ্রিস্টান ও অগ্নিপূজকরাও।(১২)

আলেমদের জানাযার এই অবস্থার দিকে লক্ষ্য করেই ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল বলেছিলেন, বিদআতিদের বলে দাও, আমাদের মাঝে আর তোমাদের মাঝে পার্থক্য রচিত হবে জানাযার দিনে। (১৩)

শুধু সাধারণ মানুষ নয়, আলেমদের প্রভাব ছিল শাসকবর্গের মাঝেও। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শাসকরা নিজেদের ধর্মীয় বিষয়ে আলেমদের সিদ্ধান্তকেই চুড়ান্ত মনে করতেন। এই শাসকদের অনেকের মাঝে ক্ষমতার লোভ প্রকট ছিল, এমনকি এজন্য নিজের প্রতিদ্বন্দ্বিকে শেষ করতেও তাদের কোনো দ্বিধা ছিল না, কিন্তু তবু দেখা যেত ধর্মীয় বিষয়ে তারা নিজেরা সরাসরি হস্তক্ষেপের সাহস করতেন না। তারা জানতেন, জনগন ধর্মীয় বিষয়ের সিদ্ধান্তের জন্য আলেমদের দিকেই চেয়ে থাকে। এক্ষেত্রে নিজের প্রভাব খাটানো মানে নিজেকে তাদের কাছে নেতিবাচক করে উপস্থাপন করা।

উমাইয়া শাসক আবদুল মালেক ইবনু মারওয়ানের কথা বলা যায়। তিনি নানা সময় অনেকের প্রতি জুলুম করেছেন এমনকি অনেক জালেমকেও সাহায্য করেছেন। তিনি ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মত জালিমের সরাসরি পৃষ্ঠপোষক। ইমাম যাহাবী বলেছেন, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, আবদুল মালেক ইবনু মারওয়ানের অপরাধসমূহের একটি। (১৪)। এই আবদুল মালেক ইবনু মারওয়ানের মত প্রভাবশালী শাসকও আলেমদের প্রভাবকে অস্বীকার করতে পারেননি। একবার তার কিছু মাসআলার সমাধান দরকার হলে তিনি ইবনু শিহাব যুহরিকে ডেকে আনেন। দীর্ঘ সময় আলাপের পর ইবনু শিহাব যুহরি মাসআলাগুলোর সমাধান দেন। খুশি হয়ে আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান রাষ্ট্রীয় ভাতাপ্রাপ্তদের নামের তালিকায় ইবনু শিহাব যুহরির নামও অন্তর্ভুক্ত করেন। (১৫)

আবদুল মালেক ইবনু মারওয়ানের ভাই আবদুল আযিয বিন মারওয়ান ছিলেন মিসরের গভর্নর। তিনিও নানা সময় স্থানীয় আলেমদের ডেকে এনে বিভিন্ন মাসআলায় তাদের মতামত জানতে চাইতেন। (১৬)

শুধু ফিকহি সমস্যা নয়, নিজেদের পারিবারিক নানা সমস্যা মেটাতেও শাসকরা আস্থা রাখতেন আলেমদের উপর। প্রভাবশালী আব্বাসি শাসক আবু জাফর মানসুর একবার বিখ্যাত আলেম গাউস বিন সুলাইমানকে ডেকে আনেন তার একটি পারিবারিক সমস্যা মেটাতে। মূলত সে সময় খলিফার সাথে তার একজন স্ত্রীর দ্বন্দ্ব চলছিল। গাউস বিন সুলাইমান সব শুনে খলিফার স্ত্রীর পক্ষে ফয়সালা দেন। খলিফা এই ফয়সালা সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেন এবং গাউস বিন সুলাইমানকে কুফার কাজি নিযুক্ত করেন। (১৭)

আলেমদের প্রতি শাসকদের শ্রদ্ধা ও ভক্তির নানা বিবরণ পাওয়া যায় ইতিহাসে। মূলত শাসকরা দুকারনে আলেমদের এই প্রভাব মেনে নিতেন। প্রথমত, ছিল অন্তরের স্বাভাবিক টান যা নেককার প্রতি অন্য মানুষদের অন্তরে আল্লাহ ঢেলে দেন। দ্বিতীয়ত, তারা জনজীবনে আলেমদের প্রভাব জানতেন। তাই কোনোভাবে তাদের সম্মানহানি করে নিজের ক্ষমতার ভিত নষ্ট করতে চাইতেন না।

উলামাদের এই প্রভাব বুঝা যায় আবদুর রহমান ইবনু আশআসের বিদ্রোহ থেকে। এই বিদ্রোহে ইমাম শাবি, সাঈদ ইবনু জুবাইর, আবুল বুখতারি, আবদুর রহমান বিন আবি লাইলা, মুহাম্মদ বিন সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসসহ আলেমদের একাংশ অংশ নেন। এই বিদ্রোহ দমন করতে হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে বেশ বেগ পোহাতে হয়। কিছু আলেমদের অংশ নেয়ার ফলে জনমনে এই বিদ্রোহ গ্রহনযোগ্যতা লাভ করে। যদি আলেমদের সবাই এই বিদ্রোহকে সমর্থন দিতেন তাহলে ফলাফল ভিন্ন কিছুও হতে পারতো। (১৮)

আলেমরা কীভাবে শাসকদের প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন সে রহস্যের জবাব মেলে হাম্মাদ বিন সালামাহর কথায়। একবার তিনি বসরার আমির মুহাম্মদ বিন সুলাইমানের সাথে দেখা করতে যান। আমির তাকে বলেন, আমি যখনই আপনার দিকে তাকাই আমার অন্তর প্রভাবিত হয় আপনার ভয়ে। হাম্মাদ বিন সালামাহ বলেন, আলেম যখন তার ইলমকে আল্লাহর সন্তুষ্টির কাজে ব্যয় করে তখন তাকে সবাই ভয় করে। আর যখন সে ইলমকে পার্থিব সুবিধা অর্জনের জন্য ব্যয় করে তখন সে সবাইকে ভয় করে। (১৯)

লাইস ইবনু সাদ একবার মিসরে নিযুক্ত গভর্নরের ব্যাপারে অসন্তুষ্টি জানিয়ে খলিফাকে পত্র লিখেছিলেন। ফিরতি পত্রেই সেই গভর্নরকে অপসারণ করা হয়। (২০)

আলেমরা অনেক সময় শাসকদের কাছে আসা যাওয়া করতেন। তাদেরকে নানা বিষয়ে নসিহত করতেন। শাসকদের মাঝে এসব নসিহতের প্রভাব ছিল। আমর বিন উবাইদ একবার আব্বাসি খলিফা আবু জাফর মানসুরের দরবারে প্রবেশ করলে খলিফা বলেন, আমাকে কিছু নসিহত করুন। আমর বিন উবাইদ নসিহত শুরু করেন। খলিফা কান্না করতে থাকেন। আমর বিন উবাইদ থামলে খলিফা বলেন, আরো কিছু নসিহত করুন। আমর বিন উবাইদ আবার কথা শুরু করেন। খলিফা এবার আগের চেয়েও জোরে কান্না করতে থাকেন। (২১)

আলেমরা সামাজিক ব্যবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে এ সংক্রান্ত নির্দেশনাও দিতেন শাসকদের। আতা ইবনু আবি রবাহ একবার হিশাম বিন আবদুল মালিকের সাথে সাক্ষাত করে মক্কা মদীনার মানুষের জন্য বার্ষিক ভাতার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেন। খলিফা সাথে সাথে এ আদেশ বাস্তবায়ন করেন। (২২) আতা ইবনু রবাহ যখন আবদুল মালেক ইবনু মারওয়ানের দরবারে প্রবেশ করতেন তখন তিনি সসম্মানে উঠে দাঁড়াতেন এবং আতাকে নিজের আসনে বসিয়ে নিজে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। (২৩) সালেম বিন আবদুল্লাহ বিন উমর যখন সুলাইমান বিন আবদুল মালিকের দরবারে প্রবেশ করতেন তখন তিনিও তাকে অনেক সম্মান দেখাতেন। (২৪)

শাসকরা অনেকসময় আলেমদেরকে নিজের উপদেষ্টা বানাতেন। যেমন সুলাইমান বিন আবদুল মালিক নিজের উপদেষ্টা বানান রজা বিন হাইওয়াহকে। তার পরামর্শেই তিনি উমর বিন আবদুল আযিযকে পরবর্তী খলিফা মনোনিত করে যান। (২৫) উমর বিন আবদুল আযিযের জীবনেও দেখা যায় তিনি আলেমদের সম্মান করতেন। তাদের পরামর্শ ছাড়া বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতেন না। তিনি যখন মদীনার প্রশাসক ছিলেন তখন সেখানকার আলেমদের সাথে পরামর্শ করতেন। দামেশকে আসার পর স্থানীয় আলেমদের সাথে পরামর্শ করতেন। (২৬)

আব্বাসি আমির ঈসা বিন মুসা প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়ে কুফার কাজি

ইবনু শুবরুমাহর সাথে পরামর্শ করতেন। (২৭)

 

টীকা

১। ভীড়ের কারনে অনেকের কষ্ট হচ্ছিল, এদিকে খেয়াল করে হাসান বসরি এই মন্তব্য করেন। দেখুন, আত তবাকাতুল কুবরা, ৭/২১১। সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৪/৫৩৫।

২। আল মুন্তাজাম, ৮/১০০। হিলয়াতুল আউলিয়া, ৫/১০১।

৩। আত তবাকাতুল কুবরা, ৫/২২২।

৪। ওফায়াতুল আইয়ান, ৫/৭২।

৫। হিলয়াতুল আউলিয়া, ৭/৩৪১।

৬। সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৮/১৩৬, ১৬২।

৭। প্রাগুক্ত , ১১/৩৩৯।

৮। প্রাগুক্ত, ১৩/২৩১।

৯। ওফায়াতুল আইয়ান, ২/৩৪৯। আত তবাকাতুল কুবরা, ৫/২০১।

১০। সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৭/১২৭।

১১। শিহাবুদ্দিন আহমাদ বিন মুহাম্মদ (মৃ-৮৭০ হিজরি) লিখিত মাহাসিনুল মাসায়ি ফি মানাকিবিল আউযায়ি গ্রন্থ থেকে জানা যায় এদিন অন্তত ত্রিশ হাজার অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেছিল। প্রকৃত সংখ্যা ত্রিশ হাজার নাও হতে পারে , তবে এটি নিশ্চিত সেদিন অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল।

১২। আল মাশাহির, ২৭৯।

১৩। সুওয়ালাতুস সুলামি লিদ দারাকুতনি, ৩৬১।

১৪। সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৪/২৪৭।

১৫। আল মুন্তাজাম, ৭/২৩২।

১৬। সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৪/২৮৫।

১৭। আল মুন্তাজাম, ৮/২৯৯।

১৮। তারিখুত তাবারি, ৬/৩৪৬-৩৫০।

১৯। আল মুন্তাজাম, ৮/২৯৫।

২০। ওফায়াতুল আইয়ান, ৪/১৩১।

২১। আল মুন্তাজাম, ৮/৬০।

২২। প্রাগুক্ত, ৭/১৬৭।

২৩। সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৫/৮৪। আল মুন্তাজাম, ৭/১৬৬।

২৪। তাহযিবু তারিখি দিমাশক, ৭/১৬।

২৫। তারিখুত তাবারি, ৬/৫৫০। আল মুন্তাজাম, ৭/৩২।

২৬। আত তবাকাতুল কুবরা, ৫/৩৯৫।

২৭। সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৬/৩৪৮।

(চলবে, ইনশাআল্লাহ)

Related posts

সুলতানী আমলে ভারতবর্ষে হাদিসচর্চা (পর্ব-১) | প্রফেসর যফরুল ইসলাম ইসলাহী

সংকলন টিম

ইলমের অফুরন্ত দরিয়া আমরাহ বিনতে আব্দুর রাহমান রাহিমাহাল্লাহ | তাসনীম জান্নাত

সংকলন টিম

ঈমানদীপ্ত দাস্তানের স্বরুপ সন্ধানে (পর্ব-১) | ইসমাইল রেহান

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!