সংকলন
salaf
ইমরান রাইহান সালাফ পরিচিতি

সমকালীন জনজীবনে সালাফদের প্রভাব: পর্ব -১ | ইমরান রাইহান

সালাফদের জীবন পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি জনসাধারণের মনে তাদের প্রতি ছিল শ্রদ্ধা ও সম্মান। সালাফরা নিজেদের ইলম ও আমলের মাধ্যমে অর্জন করতেন মানুষের ভালোবাসা। সমকালীন সমাজজীবনে তাদের ব্যক্তিত্বের প্রভাব ছিল অপরিসীম। নিজেদের ধর্মীয় সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে মানুষ ভরসা করতো তাদের উপর। তাদের একটু সান্নিধ্য নেয়ার জন্য ব্যাকুল থাকতো সবাই।

শাসকের ফটকে মানুষ ছুটে যেত রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক আনুকূল্য পেতে, অপরদিকে সালাফদের মজলিসে তারা ছুটে আসতো ইলম অর্জন করতে, একটু দ্বীন শিখতে। সালাফদের ঘরের সামনে প্রায় সবসময় ভীড় লেগেই থাকতো। মদীনায় কিছুদিন বসবাস করেছিলেন বিখ্যাত ফকিহ ও মুহাদ্দিস ইবনু শিহাব যুহরি। তার ঘরের সামনে মানুষের ভীড় সবসময় লেগেই থাকতো। ইবনু শিহাব যুহরি সে সময় ছিলেন বয়সে তরুণ, কিন্তু তার ইলমের খ্যাতি ছড়িয়েছিল মদীনায়, ফলে তিনি হয়ে উঠেন সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। (১)

ইমাম মালেক ইবনু আনাস ছিলেন এমন আরেকজন আলেম। তার গৃহের সামনে এত মানুষের ভীড় হত, ভীড়ের কারনে কয়েকজন মারাও গিয়েছিল। (২) আলেমদের গৃহের সামনে অবস্থান করা, ভীড় করা এসব ছিল সে যুগের পরিচিত দৃশ্য। আমর বিন হারিসের গৃহের সামনেও লোকজন বসে অপেক্ষা করত। তিনি ঘর থেকে বের হলে তারা তাকে মাসআলা জিজ্ঞেস করে সমাধান জেনে নিত। (৩)

তবে সালাফরা তাদের প্রতি মানুষের এই আগ্রহ থেকে অহংকারের উপাদান খুঁজতেন না। তারা নিজেদের কাজে ইখলাস বজায় রাখতেন। বিনয় ছিল তাদের সার্বক্ষনিক সঙ্গী। খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা খুব কমই তাদের ধোঁকায় ফেলতে সক্ষম হত। সুলাইমান বিন মেহরানের কথা বলা যায়। একজন আলেম ও নেককার মানুষ হিসেবে তার খ্যাতি ছিল সর্বত্র। একবার তার কাছে এক ব্যক্তি এসে বললো, আমি কিছু সমস্যায় আছি। আপনি অমুকের কাছে সুপারিশ করলে আমার এই সমস্যা কেটে যাবে। সুলাইমান বিন মেহরান বললেন, চলো। এই বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ঐ ব্যক্তি লক্ষ্য করলো সুলাইমান বিন মেহরানের পোষাকের কিছু অংশ ছেড়া। সে ভাবলো এই পোশাকে তিনি যার কাছে যাবেন সে তো উনাকে গুরুত্ব দিবে না। সুলাইমান বিন মেহরানকে এ কথা বলতেই তিনি বললেন, আরে তোমার সমস্যার সমাধান তো আল্লাহর হাতে। (৪)

এই এক কথার মাধ্যমে তিনি লোকটির চিন্তা বদলে দিলেন।

আল্লাহ যখন কোন মানুষকে ভালোবাসেন তখন মানুষের অন্তরেও তার প্রতি ভালোবাসা তৈরী করে দেন। সালাফদের জীবনে এই বিষয়টি বারবার দেখা যায়। তাদের ইখলাস, তাকওয়া ও আখলাকের কারণে মানুষ তাদের ভালোবাসতো। তাদের সুখে দুঃখে সবসময় সাধারণ মানুষ তাদের পাশে থাকতো। মানুষ তাদেরকে নিজের ইমাম বানাতো। তারা যখন কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন, তখন মানুষও তাদের সমর্থন দিত।

মুহাম্মদ বিন আজলান ছিলেন মদীনার বিখ্যাত মুফতি। আব্বাসি খলিফা আবু জাফর মানসুরের সময় মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ বিন হাসান যখন বিদ্রোহ করেন তখন তাকে সমর্থন দেন মুহাম্মদ বিন আজলান। বিদ্রোহ দমনের পর আবু জাফর মানসুর মদীনার গভর্নর জাফর বিন সুলাইমানকে নির্দেশ দেন মুহাম্মদ বিন আজলানকে শাস্তি দিতে। জাফর বিন সুলাইমানের আদেশে গ্রেফতার করা হয়। এ সংবাদে ক্ষিপ্ত হয় মদীনার লোকজন। তারা দ্রুত জাফর বিন সুলাইমানের ঘরের সামনে ভীড় করে। শোরগোল শুনে জাফর বিন সুলাইমান তার চাকরকে জিজ্ঞেস করেন, কী হয়েছে? সে বলে, লোকজন আপনার ঘরের সামনে ভীড় করেছে। তাদের দাবি মুহাম্মদ বিন আজলানকে মুক্তি দিতে হবে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে জাফর তখনই মুহাম্মদ বিন আজলানকে মুক্তি দেন। (৫)

আরেকবারের ঘটনা। উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ বিন ইয়াযিদ বিন আবদুল মালিক চিন্তা করলেন হজ্ব করবেন। একজন সেনাপতিকে তিনি দিলেন সেগুন কাঠের তৈরী একটা গম্বুজ। তাকে নির্দেশ দিলেন কাবার পাশে এটি রেখে দিতে। খলিফা এর পাশ দিয়ে তাওয়াফ করবেন। সেনাপতিকে দেয়া হলো অনেক অর্থ, মক্কা মদীনায় দান করার সাথে। সাথে দেয়া হলো এক হাজার সৈন্য। কোনো ঝামেলা হলে যেন তাদের কাজে লাগানো যায়। উমাইয়া সেনাপতি মক্কায় এসে এই কাজ করলে জনমনে অসন্তোষ দানা বাঁধে। তারা ক্ষোভে ফুসতে থাকে। শেষে তারা ঠিক করে এই বিষয়ে সাদ বিন ইবরাহিমের পরামর্শ নেয়া হবে। তিনি ছিলেন সে সময় মদীনার কাজি। একজন নেককার আলেম হিসেবে তার সুনাম ছিল। তিনি দিনে রোজা রাখতেন। রাতে দীর্ঘসময় কোরআন তিলাওয়াত করতেন।

সাদ বিন ইবরাহিম সব শুনে বললেন, সেই গম্বুজ আগুনে পুড়িয়ে ফেল। লোকজন বললো, কাজটি কঠিন, কারন উমাইয়া সেনাপতির সাথে আছে এক হাজার সেনা। এই কথা শুনে সাদ বিন ইবরাহিম নিজেই রওনা হলেন মক্কায়। তাকে অনুসরণ করলো সাধারণ মানুষ। সাদ বিন ইবরাহিম নিজ হাতে সেই গম্বুজ পুড়িয়ে দিলেন। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল উমাইয়া সেনাপতি। লোকেরা তাকে বললো, ইনি মদীনার কাজি। দেখুন তার সাথেই সকল মানুষ। এখন তার বিরুদ্ধে কিছু করার সামর্থ্য আপনার নেই। পরিস্থিতির নাজকতা বুঝে উমাইয়া সেনাপতি নীরবেই সিরিয়া ফিরে গেল। (৬)

আলেমরা যখন কোন শহরে প্রবেশ করতেন তখন বুঝা যেত তাদের প্রতি মানুষের মনের টান। আলেমরা শহরে প্রবেশ করতেন রাজকীয়ভাবে। তাদের অভ্যর্থনা জানাতে ছুটে আসতো সর্বস্তরের মানুষ। একবার সুফিয়ান সাওরি গিয়েছিলেন মার্ভ শহরে। তার আগমনের দিন শহরের অলিগলিতে ঘোষনা হতে থাকে, সুফিয়ান সাওরি আসছেন, সুফিয়ান সাওরি আসছেন। পুরো শহরে সাড়া পড়ে যায়। অথচ এ সময় সুফিয়ান সাওরির বয়স ছিল খুব কম। ‘তখনো তার দাঁড়ি উঠেনি’ একজন প্রত্যক্ষদর্শী পরে বলেছিলেন। (৭)

হাবিব বিন আবি সাবেত গিয়েছিলেন একবার তায়েফে। তায়েফের মানুষের সেদিন আনন্দের অন্ত ছিল না। হাবিবের একজন বন্ধু পরে বলেছিলেন, মনে হচ্ছিল তাদের কাছে যেন কোনো নবী এসেছে। (৮)

আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারকের ঘটনা তো বেশ প্রসিদ্ধ। একবার তিনি গেলেন রাক্কা শহরে। পুরো শহরের লোকজন বের হলো তাকে অভ্যর্থনা জানাতে। মানুষের ভীড়ে ধুলি উড়তে থাকে। শোরগোলও বাড়তে থাকে। খলিফা হারুনুর রশিদ তখন রাক্কা শহরে অবস্থান করছিলেন। তার প্রাসাদ থেকেও শোনা যাচ্ছিল কোলাহল। খলিফার একজন দাসি জিজ্ঞেস করলেন, বাইরে কী হচ্ছে। খলিফা বললেন, খোরাসান থেকে একজন আলেম এসেছেন। মানুষ তাকে দেখতে বের হয়েছে। দাসি বললো, আল্লাহর কসম এটাই তো রাজত্ব। হারুনুর রশিদের রাজত্ব তো কোনো রাজত্বই নয় যেখানে পুলিশ ও সৈন্য ছাড়া কেউ তার পাশে একত্রিত হয় না। (৯)

আলেমদের জীবন ছিল বহতা নদীর মত। ইলমের অন্বেষনে তারা সফর করতেন এক শহর থেকে অন্য শহরে। তাদের সফর ও অবস্থান ছিল ইলমের সাথে সম্পর্কিত। ফলে কোথাও অল্প সময় অবস্থান করতেন, কোথাও দীর্ঘ সময়। তারা যে এলাকায় যেতেন সেখানকার মানুষ চাইত, তারা যেন থেকে যান। স্থায়ী বাসিন্দা হন সেই এলাকার। তাদের ইলমের আলোয় যেন আলোকিত হয় পুরো জনপদ।

বিখ্যাত ফকিহ যুফার বিন হুযাইল একবার তার বোনের সম্পদ থেকে প্রাপ্ত মিরাস বুঝে নিতে গেলেন বসরা শহরে। কয়েকদিন অবস্থান করে ফেরার সময় লোকেরা তার পথ আটকাল। তাদের এক কথা, তিনি যেন থেকে যান বসরায়। (১০)

আলেমদেরকে নির্দিষ্ট শহরে স্থায়ী করার জন্য মানুষ নানা ধরনের বুদ্ধি বের করতো। এমনই বুদ্ধির জালে আটকা পড়েন মা’মার বিন রাশেদ। তিনি একবার ইয়ামানের সানআ শহরে যান। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে ফেরার ইচ্ছা করলে লোকেরা তাকে থেকে যেতে বললো। কেউ একজন বুদ্ধি দিল, উনাকে আটকে ফেল।

বুদ্ধিমত আটকে ফেলা হয় মা’মার বিন রাশেদকে। এমনভাবেই আটকা পড়েন তিনি, আর কখনো সানআ শহর ত্যাগ করা হয়নি তার। কীভাবে তারা আটকেছিল মা’মার বিন রাশেদকে?

উত্তরটা সোজা।

মা’মার বিন রাশেদকে তারা সানআ শহরে বিয়ে করিয়ে দেয়। (১১)

(চলবে, ইনশাআল্লাহ)

সূত্র
১। সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৫/৩৪৩।
২। প্রাগুক্ত, ৮/১১১।
৩। প্রাগুক্ত, ৬/৩৫৩।
৪। প্রাগুক্ত, ৬/২২৯।
৫। প্রাগুক্ত, ৬/৩১৮।
৬। আল মুন্তাজাম, ৭/২৩৭। এই ঘটনাটি আরো কিছু ভাষ্যে বিবৃত আছে। বিস্তারিত জানতে দেখুন, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৫/৩১৭, ৩৭২। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১০/৫।
৭। সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৭/২৩৬।
৮। হিলয়াতুল আউলিয়া, ৫/৬০। সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৫/২৮৩।
৯। ওফায়াতুল আইয়ান, ৩/৩৩।
১০। সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৮/৩৯।
১১। প্রাগুক্ত, ৭/১১।

Facebook Comments

Related posts

ধর্ম বনাম মানবতা: আত্মপরিচয়ের সংকট | জাহিদ সিদ্দিক মুঘল

সংকলন টিম

কাজী শুরাইহ বিন হারিস (রহ.) | ইমরান রাইহান

সংকলন টিম

ইতিহাস পাঠ-প্রয়োজন নির্বাচিত অধ্যয়ন | ইমরান রাইহান

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!