সংকলন
ইমাম আবু হানিফা রহ.
জীবনী

ইমাম আবূ হানীফা রহঃ এর জীবন ও কর্ম | মাওলানা মুহসিনুদ্দীন খান

মুসলিম উম্মাহর ঐতিহাসিক অহংবোধের প্রতীক এক উজ্জ্বল চরিত্রের মানুষ

ইমাম আবু হানীফা রহ.! [জীবনকাল : ৮০ হি.-১৫০ হি.= ৬৯৯-৭৬৭ খ্রী:] আমাদের গর্ব ও গৌরবের প্রতীক। আখলাকে নববীর মিছালি ও বাস্তব নমুনা। জ্ঞানের আকাশে পৃথিবী আলোকরা পূর্ণিমার চাঁদ। কূলহীন জ্ঞানসমুদ্র। তাঁর জ্ঞান প্রজ্ঞা ও প্রতিষ্ঠার ছবি আঁকা, তাঁর বিদ্যাপর্বতের পরিমাপ করা, তাঁর অবাক করা আখলাক ও মহামানবোচিত চরিত্রকে সঠিকভাবে চিত্রন করা আমাদের পক্ষে কি সম্ভব? তাই তো শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী হাদীসশাস্ত্রের প্রাণপুরুষ ইমাম ইবনুল আছীর আলজাযারী রহ. (ওফাত : ৬০৬ হি.) মন্তব্য করেছেন—

ولو ذهبنا إلى شرح مناقبه وفضائله لأطلْنا الخَطْب، ولم نصلْ إلى الغرض منها، فإنه كان عالما عاملا زاهدا عابدا ورعا تقيا، إماما في علوم الشريعة مرضيا.

‘যদি আমরা তাঁর বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীর বিশদ বিশ্লেষণ করি, তাহলে বক্তব্য অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে; আর আমরা এ মহিমা কীর্তনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব না। কেননা তিনি ছিলেন আলেম—আলেম বিল্লাহ ওয়া বি- আমরিল্লাহ, ব্যক্তি জীবনে ধর্মীয় অনুশাসনের যত্নবান অনুসারী, যাহেদ—দুনিয়া নির্মোহতায় চূড়ান্ত, (অতি উচ্চ মার্গের) ইবাদতগুজার, খোদাভীরু ও মুত্তাকী এবং ইলমে শরীয়াতের গ্রহণযোগ্য ইমাম।’ [দ্বীনদারিও ছিল গভীর।] (জামেউল উসুল—ইমাম আবু হানীফার তরজামা)

ইমাম আযমের মাকাম ও মর্যাদা ফুটিয়ে তোলার জন্য কি উদার সুন্দর কথা! এই সংক্ষিপ্ত জীবনী ও রচনার নানা অংশে তাঁর বৈচিত্রময় শুভ্র-সুন্দর জীবনের বিভিন্ন দিক ও তাঁর জ্ঞানবিদ্যার যৎসামান্য পরিচয় তুলে ধরতে সামান্য চেষ্টাচরিত্র করা হয়েছে মাত্র। ইতিহাস কেবল অতীত নয়, এক কথায় আমাদের ভবিষ্যতও। আমাদের মনীষী ও গৌরবময় ইতিহাসের চর্চা যতই বেগবান হবে ততই মুসলিম উম্মাহর আত্মার রূপরেখা নির্মাণের কাজটি সহজ হবে। আল্লাহ্ তাআলা এ ক্ষুদ্র প্রয়াসকে কবুল করুন। আমীন।

কাশফুয যুনূন প্রণেতা হাজী খলীফা (ওফাত : ১০৬৭ হি.) বলেন—

قال أصحاب المناقب : ينبغي لكل مقلد إمام أن يعرف حال إمامه الذي قلده، ولا يحصل ذلك إلا بمعرفة مناقبه وشمائله وفضائله وسيرته في أحواله وصحة أقواله، ثم إنه لابد من معرفة اسمه وكنيته ونسبه وعصره وبلده، ثم معرفة أصحابه وتلامذته.

মানাকিব প্রণেতাগণ—ইমামদের জীবনীকারগণ বলেন, ‘প্রত্যেক মুকাল্লিদের জন্য তার অনুসৃত ইমামের বৃত্তান্ত জানা থাকা দরকার; আর তা জানা সম্ভব হবে না তাঁর চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী শামায়েল (স্বভাব চরিত্র, আচার-ব্যবহার, অভ্যাস) প্রভৃতি লিপিবদ্ধ এবং বিভিন্ন অবস্থায় তাঁর আচরণ ও উচ্চারণ তথা ব্যক্তিগত জীবন ও তাঁর বক্তব্যের যথার্থতা সম্পর্কে অবগত হওয়া ছাড়া। তদুপরি তাঁর নাম, কুনিয়াত (ডাকনাম), নসব, যুগ ও দেশ এবং তাঁর অনুগামী ও শাগরিদবৃন্দ সম্পর্কেও জানা থাকতে হবে।’ [কাশফুজ যুনূন-২/৬৭২]

এককথায়, অনুসৃত ইমামের জীবনের প্রত্যেকটি দিক মুকাল্লিদের সামনে উজ্জ্বল ও প্রোজ্জ্বল থাকবে। অতি স্পষ্টরূপে দেদীপ্যমান থাকবে। তা দৃষ্টির অন্তরালে প্রচ্ছন্ন থাকা মোটেও কাম্য নয়। কেননা চোখওয়ালা ভক্ত ও বীর-ভক্তই কাম্য।

জন্ম ও পরিচয়

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের ৬৯ বছর পরে ৮০ হিজরীতে (প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী) আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের আমলে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বায়আতে রিযওয়ানে অংশগ্রহণকারী বিখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আওফা রা. (ওফাত : ৮৭ হি.) তখন কুফাতেই অবস্থান করছিলেন। [আসসিয়আহ এর মুকাদ্দিমায় ইমাম আযমের জীবনী অংশ দ্র:]

ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর নাম নুমান। কুনিয়াত আবু হানীফা। আর ইমামে আযম হল তাঁর লকব। আমরা পর্যায়ক্রমে তাঁর নাম ও কুনিয়াতের অর্থ ও তাৎপর্য নিয়ে কিছু কথা আরজ করব। তবে ইমামে আযম লকবের তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এ গ্রন্থের শেষ পর্যায়ের দিকে।

নুমান শব্দের অর্থ :

জীবনীকারগণ এ বিষয়ে একমত যে, ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর নাম হল ‘আননুমান।’ আরবী ‘আননুমান’শব্দের অর্থ—

১। রক্ত, শোণিত। আর রক্তই হল শরীরের প্রধান উপাদান ও জীবনের জীবনী রস। [আবু নুআইম সংকলিত মুসনাদে আবু হানীফা, পৃ. ১৯॥ তারীখে বাগদাদ ১৫/৪৪৬॥ ]

২। পরবর্তী অর্থ হিসেবে কারো মতে ‘আননুমান’ শব্দের অর্থ রূহ। [উকুদুল জুমান পৃ. ৫৮]

বাস্তবেও তিনি ছিলেন মুসলিম মিল্লাতের রক্তবাহী ধমনীর মত। এটি কোন অতিশয়োক্তি নয়।

৩। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহ. নুমান শব্দটিকে আরব দেশের অনারব অধিপতি বা রাষ্ট্রপতির উপাধি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন—

وكل من ملك العرب من قبل العجم يسمى النعمان

ইমাম আবু হানীফা রহ. হলেন ফিকহশাস্ত্রের প্রাণপুরুষ ও রাজাধিরাজ। আবার তিনি অনারবও বটে। ‎অতএব এ বিবেচনায় বলা যায় যে, তাঁর নামের সাথে কর্মের অপূর্ব সামঞ্জস্যতা রয়েছে। যা একটি চমকপ্রদ ‘কাকতালীয়’ও বটে। [বদরুদ্দীন আইনী রহ., শরহু সুনানে আবু দাউদ ১/৩৬৫; মাকতাবাতুর রুশদ, রিয়াদ। ]

৪। সুরভিত ও সুঘ্রাণযুক্ত এক প্রকার লাল উদ্ভিদকেও আরবীতে আননুমান বলা হয়। [আলখাইরাতুল হিসান, পৃ. ৬০॥]

আরবী অভিধানে শাকায়েকুন নুমান-এর অর্থ লেখা হয়েছে—এক প্রকার লাল ফুলবিশিষ্ট উদ্ভিদ। যাকে ইংরেজীতে বলে ধহবসড়হব। ইমাম আবু হানীফা রহ.ও তাঁর চারিত্রিক শুচিতায় পূর্ণতা অর্জন করে ইলমে নববীর সুরভিত উদ্যানে একটি শুভ্র-সুন্দর ফুল হিসেবে যেন আজো ফুটে আছেন সকল ফুলের সৌন্দর্য ও সৌরভ নিয়ে এবং আমাদের হৃদয়গ্রামের গভীর পরিতৃপ্তির জন্য আজো হৃদয়জুড়ানো সুবাস ঢালছেন। তাই সারা পৃথিবী এখনও তাঁর সৌরভে মোহিত। [আলখাইরাতুল হিসান, পৃ. ৬০]

‘হানীফুন’ শব্দের অর্থ ও তাৎপর্য

ইমাম আযম রহ.-এর উপনাম আবু হানীফা। তাঁর এই কুনিয়াত বা উপনামটি এতই খ্যাত হয়ে যায় যে, কালে তাঁর প্রকৃত নামই কেমন যেন এই কুনিয়াতের প্রভাবে ম্লান হয়ে পড়ে। حنفية শব্দের মূল ধাতু হল—حنَف আল্লামা রাগেব ইসবাহানী রহ. (৫০২ হি.) শব্দটির প্রকৃত ও অন্তর্নিহিত অর্থ এভাবে তুলে ধরেছেন, الحَنَفُ هو ميل عن الضلال إلى الاستقامة، অর্থাৎ ভ্রষ্টতার পথ পরিহার করে সিরাতে মুস্তাকীমের পথে চলা।

ধরেছেন, الحَنَفُ هو ميل عن الضلال إلى الاستقامة، অর্থাৎ ভ্রষ্টতার পথ পরিহার করে সিরাতে মুস্তাকীমের পথে চলা।

আরবী ‘হানীফাতুন’ শব্দটি স্ত্রীবাচক। এটি ‘হানীফুন’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। পাক কালামে ‘হানীফ’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন,

إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتًا لِلَّهِ حَنِيفًا وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ.

নিশ্চয় ইবরাহীম ছিল এক আদর্শ পুরুষ আল্লাহর অনুগত, একনিষ্ঠ এবং যারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। (সূরা নাহল ১২০)

সূরা আল-ইমরানেও (আয়াত-৬৭) ইবরাহীম আ.-কে حَنِيفًا مُسْلِمًا বা একনিষ্ঠ মুসলিম অভিধায় উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া নিজেকে আল্লাহর অভিমুখী করে রাখা। (সূরা নাহল : ১২৩) বা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর অভিমুখী হয়ে থাকা। (সূরা হজ্জ-৩১) প্রভৃতি অর্থেও শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। সূরা বাকারাতেও (আয়াত: ১৩৫) [বলে দাও বরং (আমরা তো) ইবরাহীমের দ্বীন (মেনে চলব), যিনি যথাযথ সরল পথের উপর ছিলেন।] কাছাকাছি অর্থে ব্যবহারিত হয়েছে।

আল্লামা রাগেব ইসবাহানী রহ. আরো বলেন,

وسمت العرب كل من حج أو اختتن حنيفا تنبيها أنه على دين إبراهيم صلى الله عليه وسلم.

‘(জাহেলী যুগে) ইবরাহীমী ধর্মের অনুসারী বুঝাতে আরবরা হজ¦ আদায় করেছে কিংবা খাৎনা করেছে এরূপ ব্যক্তিকে ‘হানীফ’ বলত।’

উপরের আলোচনা থেকে আমরা মোটামুটিভাবে বুঝতে পারলাম যে, হানীফ শব্দটি একনিষ্ঠ, ইবাদতগুজার, সরল, পুণ্যস্বভাব, হজ¦ পালনকারী, জাহেলী যুগে ইবরাহীমী ধর্মের অনুসারী, সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিরেটভাবে কেবল আল্লাহ্ পাকের জন্য আত্মনিবেদিত বা ইসলামে অবিচল ও নিবেদিত ব্যক্তি প্রভৃতি অর্থে ব্যবহার হয়।

অতএব তাঁর কুনিয়াতের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করলে কুনিয়াতটির মূল রূপ দাড়ায় এরূপ— أبو الملة الحنفيةঅর্থাৎ মিল্লাতে হানাফী বা ইসলাম ধর্মের পথিকৃৎ (চরড়হববৎ) ইমাম। কেননা আল্লাহ তাআলা দ্বীনে হানীফকে ইমাম আবু হানীফার ইলমের দ্বারা মজবুত ও পরিপক্ব করেছেন। তাঁর মাধ্যমে মিল্লাতে হানাফিয়্যাহ-এর কল্পনাতীত খেদমতের আঞ্জাম দিয়েছেন।

২. দোয়াত-কালি ও লেখার সরঞ্জাম। ইরাকের পরিভাষায় দোয়াতকে ‘হানীফ’ বলা হয়। আর যেহেতু তিনি নিজের সাথে সর্বদা দোয়াত রাখতেন, তাই লোকেরা তাকে আবু হানীফা বলতে শুরু করে। [দেখুন—উকুদুল জুমান, পৃ. ৫৮] তবে এ মতটি ধারণাপ্রসূত। [ইমাম আযম আওর ইলমে হাদীস, পৃ. ১২০]

বংশ তালিকা ও পূর্বপুরুষদের বিবরণ

হানাফী মাযহাবের ইমাম, ইমাম আবু হানীফা রহ. ঈমানের রঙে রঙিন পরিবেশে চোখ খোলেন। ইলম ও আমলের কোলে বেড়ে ওঠেন। তাঁর পিতার নাম ছাবিত। তবে দাদার নাম নিয়ে বিভিন্ন মতামত পরিলক্ষিত হয়, যা নিম্নে উল্লেখ করা হল।

এক.

ঈসমাইল বিন হাম্মাদের বর্ণনায় দাদার নাম নুমান; আর পরদাদার নাম মারযুবান বলে উল্লেখ রয়েছে। [তারীখে বাগদাদ ১৫/৪৪৮]

দুই.

ঈসমাইল-এর ভাই উমর-এর বর্ণনা মতে দাদার নাম যূতা; আর পরদাদার নাম মাহ। উভয় বর্ণনার মাঝে এভাবে সমন্বয় করা যায় যে, হতে পারে তাঁর দাদা ও পরদাদা উভয়েরই দু’টি করে নাম ছিল। কিংবা একটি হল মূল নাম আরেকটি হল লকব। কিংবা হতে পারে (দাদা) যূতা এর আরবী অর্থ (বা ইসলামী নাম) নুমান। আর (পরদাদা) মাহ অর্থ মারযুবান—সরদার। [উকুদুল জুমান, পৃ. ৫৪]

কীর্তিমান গবেষক আল্লামা শিবলী নুমানী মনে করেন, মাহ বা মারযুবান হল যূতা‘র পিতার লকব। আর মাহ বা মারযুবান সমার্থবোধক শব্দ। উভয়ের অর্থ সরদার। [সীরাতুন নুমান, পৃ. ২২]

উপরি-উক্ত বিশ্লেষণের সারকথা হল, যূতা ও নুমান মূলত একই ব্যক্তি। একই ব্যক্তির দুই নাম। অনুরূপভাবে পরদাদা মাহ বা মারযুবান মূলত একই ব্যক্তি। যার নাম মাহ তারই লকব মারযুবান।

তিন.

সীরাতুকোন কোন বর্ণনায় তাঁর দাদার নাম মারযুবান বলেও উল্লেখ রয়েছে। [ওয়াহবী সুলাইমান গাবুজী, আবূ হানীফা আননুমান, পৃ-৪২]

(উল্লেখ্য যে, ফারসী উচ্চারণে মীম বর্ণটি যের যোগে শব্দটি এরূপ مِہ। যার অর্থ সরদার (‘noble of the town’)। একটু চেহারা বদল করে আরবীতে লেখা হয় এভাবে- ماه ॥

অগ্রগণ্য মত : এসব বর্ণনার মধ্যে আল্লামা যাহেদ আলকাউসারী রহ. ঈসমাইল বিন হাম্মাদের বর্ণনাকে প্রাধান্য দিয়ে বলেন, ‘যূতা ছাবিতের সরাসরি পিতা নন। বরং যূতা ও ছাবিতের মাঝের ব্যক্তি হলেন নুমান বিন মারযুবান। আর যূতার পিতা হলেন মাহ, যেমনটি মাসঊদ বিন শাইবা তাঁর মুকাদ্দিমাতু কিতাবুত তালীমের মাঝে (পৃ. ৩) উদ্ধৃত করেছেন। এটিই ঈসমাইল বিন হাম্মাদ থেকে বর্ণিত বিশুদ্ধ বর্ণনার মুওয়াফিক।’ [ইমাম যাহাবী রহ., মানাকিবুল ইমাম আবী হানীফা এর টীকা, পৃষ্ঠা-১৩]

হযরত আলী রা.-এর সঙ্গে তাঁর পিতা ও দাদার যোগসূত্রতা ও ঘনিষ্ঠতা

নুমান বিন সাবেত বিন মারযুবান—তিনি স্বাধীন পারসিক রক্তের অধিকারী ছিলেন। তাঁর দাদা উমর রা.-এর খেলাফতকালে ইসলাম গ্রহণ করেন। নিজ আবাস ভূমি (বর্তমান আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল) থেকে হিজরত করে ইসলামের দারুল খিলাফাত কুফাতে নিবাস পাতেন। অগ্রগণ্য মতানুযায়ী আবু হানীফা রহ. খলীফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের শাসনামলে ৮০ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। [ওয়াহবী সুলাইমান গাবুজী, আবূ হানীফা আননুমান, পৃষ্ঠা ৪১, মুকাদ্দিমাতু কিতাবিত তা’লীম-৩]

ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর পিতা ছাবিতকে তাঁর পিতা মারযুবান নিয়ে গিয়েছিলেন আলী রা.-এর কাছে। (তাঁরা থাকতেন কুফাতে। আলী রা.ও তাঁর খেলাফতের সময় কুফায় ছিলেন। তিনি ছাবিতকে আলী রা.-এর কাছে নিয়ে বললেন—এ আমার ছেলে।) ফলে আলী রা. ছাবিত এবং তাঁর বংশধরের জন্য বরকতের দুআ করেন। [তারীখে বাগদাদ-১৩/৩২৬]

হযরত আলী রা.-এর দুআর ফসল

আবু আব্দুল্লাহ্ বিন আহমদ বিন কিদাম বলেন,

وقد استجاب الله دعاءه، حيث جعل خلفاء الأرض، وملوك الآفاق، وأكثر أهل الإسلام تبعا له في الدين، وعالة عليه في الفقه.

‘আল্লাহ্ তাআলা হযরত আলী রা.-এর এ দুআকে কবুল করেছেন। যেহেতু দ্বীনের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা তাঁকে বিভিন্ন দেশ ও রাষ্ট্রের কর্ণধারদের এবং পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমানের মুক্তাদা ও অনুসৃত বানিয়েছেন। এবং ফিকহ তথা ইসলামের সামগ্রিক বিধানাবলীর ক্ষেত্রেও তাদেরকে তাঁর পরিবারভুক্ত বানিয়েছেন।’ [মুহাদ্দিস ও ফকীহ মাসঈদ বিন শাইবা সিন্ধী, মুকাদ্দামাতু কিতাবিত তালীম-১১৭]

সারকথা, হযরত আলী রা.-এর ওই দুআর সবচেয়ে বেশি ভাগ পেয়েছেন ইমাম আবু হানীফা রহ.। তার প্রমাণ হল, আল্লাহ তাআলা ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর অনুসারীদেরকে অসংখ্য বরকতে সিক্ত করেছন।

হযরত আলী রা.-কে হাদিয়া প্রদান

সাবিতের পিতা নুমান বিন মারযুবান হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি আলী ইবনে আবী তালেব রা.-কে তৎকালীন সামাজিক মর্যাদার স্মারক হিসেবে ‘নওরোয’—ইসলামপূর্ব বর্ষবরণ উৎসবের দিন ফালুদা উপহার দিয়েছিলেন। তখন আলী রা. (বর্ষবরণ উপলক্ষ্যের এ সংস্কৃতির উপর আপত্তি জানিয়ে) বলেছিলেন, আমাদের উৎসব তো প্রতিদিন। [তারীখে বাগদাদ-১৫/৪৪৮]

কোন বর্ণনায় মেহেরজান (নবান্ন উৎসব) এর কথাও রয়েছে।

হায়দারী ঝাণ্ডা বহনের গৌরবময় মর্যাদার অধিকারী

বাগদাদ ও ওয়াসিত এর মধ্যে অবস্থিত একটি বৃহৎ অঞ্চলের নাম ‘নাহরাওয়ান।’ ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী ‘দুমাতুল জান্দাল’ নামক স্থানে হযরত আলী রা. ও হযরত মুআবিয়া রা.-এর মধ্যকার সালিশী বৈঠক অনুষ্ঠানের পর খারেজীরা একটা স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। তারা হযরত আলী রা.-এর বাইআত ভঙ্গ করে আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহাব আর-রাসেবীর হাতে বাইআত গ্রহণ করে। এবং কুফা, বসরা, আম্বার, সাদায়েন প্রভৃতি এলাকায় এই দলের যত লোক ছিল তারা সবাই নাহরাওয়ানে একত্রিত হয়ে ব্যাপক হত্যা ও লুণ্ঠনকার্যে লিপ্ত হয়।

হযরত আলী রা.-কে তারা কাফের সাব্যস্ত করে (নাউযুবিল্লাহ্) তওবার আহবান করে। হযরত আলী রা. এদের সাথে আলোচনা, বিতর্ক ও হিদায়েত দানের সকল প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু যখন তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল তখন তিনি বাধ্য হয়ে সেনাদলকে প্রস্তুতির হুকুম দিলেন। ৯/২/৩৮ হিজরীতে শালিসীব্যবস্থা অস্বীকারকারী এ খারেজীদের সাথে ‘নাহরাওয়ান’ নামক স্থানে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। শ্রেষ্ঠতর একদল সাহাবী এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।

হযরত আলী রা. বামভাগে হুজ্র বিন আদী ও ডানভাগে শাবাছ বিন রিবয়ীকে নিযুক্ত করলেন এবং পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী পরিচালনায় যথাক্রমে হযরত আবু কাতাদাহ আনসারী রা. ও হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা.-কে নিযুক্ত করলেন। [আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া-১০/৫৮৭, যিরিকলী, আল আলাম-৪/২৯৫, আত তামহীদ-২৩/৩২২, ড. মুহাম্দ আলী আস সাল্লাবী লিখিত ‘আসমাল মাতালিব ফী সীরাতি আমীরিল মুমিনীন আলী বিন আবী তালিব রাঃ, পৃষ্ঠা-৭৩০-৭৩৪]

ইমাম আবু হানীফার পিতামহ মারযুবান-এর জীবনে এ গৌরবময় যুদ্ধে অংশ গ্রহণ ছিল সৌভাগ্যের স্বর্ণসোপান। এ যুদ্ধে তিনি হযরত আলী রা.-এর হেলালী ঝাণ্ডাবহনকারী ছিলেন। খতীব বাগদাদীর সমসাময়িক ঐতিহাসিক ফকীহ ও আল্লামা আবুল কাসেম আলী বিন মুহাম্মাদ আসসিমনানী (ওফাত : ৪৯৯ হি.) তাঁর রওজাতুল কুযাত ওয়া তরীকুন্নাজাত গ্রন্থে বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করেছেন—

وأبو حنيفة في رواية ابن كاس (ولد) سنة سبعين وفي رواية حماد سنة ثمانين وتوفى سنة خمسين ومائة وهو صاحب المذهب اسمه النعمان بن ثابت بن المرزبان والمرزبان صاحب راية علي بن أبي طالب يوم النهروان.

মোটকথা, আবু হানীফা ও তাঁর পিতা ইসলামের উপরই জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর দাদাও ছিলেন মুসলমান। পারিবারিক ঐতিহ্য বা আবহাওয়া ও পরিবেশ বলে যে একটা কথা আছে তা ইমামে আযমেরও ছিল। [রওজাতুল কুযাত ওয়া তরীকুন্নাজাত-৪/১৪৯৭, মুআসসাতুর রিসালাহ, বৈরূত, লেবানন, তানীবুল খতীব, পৃষ্ঠা-১৬০, আত তালীকুল কাবীর আলা মুকাদ্দিমাতি কিতাবিত তালীম-৮]

পাঠকদেরকে একটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ‘নাহরাওয়ান’ যুদ্ধ এটি যেমন-তেমন কোন যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধে খারেজীদের শক্তি বিধ্বস্ত হয়েছিল বটে; কিন্তু তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল দেশের বিভিন্ন অংশে বর্তমান ছিল। ফলে এ যুদ্ধের রেশ ধরেই খারেজীদের হাতে হযরত আলী রা.-এর মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনা ঘটে। বিস্তারিত জানতে দেখুন, ড. মুহাম্মাদ আলী আস-সল্লাবী লিখিত ‘আসমাল মাতালিব ফী সীরাতি আমীরিল মুমিনীন আলী ইবনে আবী তালিব রা.’, পৃ. ১০২৭, ১০২৮॥

‘মাওলা’ শব্দের বিশ্লেষণ ও মর্মকথা

ইমাম আবু হানীফা রহ. ছিলেন বনী তায়মুল্লাহ বিন সালাবা বিন বকর বিন ওয়ায়েল গোত্রের জনৈক ব্যক্তির মাওলা। [মানাকিবুল ইমাম আবী হানীফা ওয়া সাবিাইহি আবী ইউসুফ ও মুহাম্মদ ইবনুল হাসান, পৃষ্ঠা-১৪]

তাই মাওলা সম্পর্কে মৌলিক কিছু কথা পাঠকের খেদমতে পেশ করা শোভনীয় বলে মনে হচ্ছে। মাওলা শব্দটির সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ যুক্ত আছে। মানাযির আহসান গীলানী রহ. (১৩৭৫ হি.)-এর বিশ্লেষণে সেই ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ উঠে এসেছে সুন্দরভাবে। নিম্নে তা পেশ করা হল। তিনি বলেন—

‘মাওলা বা الموالى শব্দটি সেসব অনারব লোকদের বেলায় ব্যবহৃত হয় যে নিজে বা তার পিতা, পিতামহ দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়ে আযাদি লাভ করেছে। অনুরূপভাবে আরব বংশদ্ভূত নয় এবং আরব দেশের বাইরে অবস্থিত কোন দেশ বা এলাকার অধিবাসী তারা ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও ন্যায় বিচারের কথা শুনে ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছে।

ইসলাম গ্রহণের পর তারা যখন যে কোন আরব কবীলার বাসস্থানসমূহ, যেমন—কুফা, বসরা ইত্যাদি শহরে নিবাস পাততে চাইলো তখন আরবদের কোন একটি গোত্রের সাথে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের চুক্তি করে সেখানেই থেকে যেত। এ শ্রেণীর লোকও মাওলার অন্তর্ভুক্ত। আর যে গোত্রের সাথে তাদের এরূপ সম্পর্ক তৈরী হত তাদেরকে সেই গোত্রের ‘মাওয়ালী’ বা বন্ধুত্বের চুক্তিতে আবদ্ধ লোক বলে সম্বোধন করা হত।

অনুরূপভাবে কোন অনারব ব্যক্তি আরব ব্যক্তির হাতে ইসলাম গ্রহণ করলে ওই নব দীক্ষিত অনারবকেও আরব লোকটির গোত্রের দিকে সম্পৃক্ত করে ঐ গোত্রের ‘মাওয়ালী’ বলে পরিচয় দেয়া হত। ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর পৌত্র ঈসমাইল ইবনে হাম্মাদ-এর দাবিও তাঁর ব্যাপারে এমনই ছিল।

তবে ইসলাম গ্রহণের কারণে যারা موالىনামে পরিচিত লাভ করতেন, তাদেরকে موالى الإسلام বা ইসলাম গ্রহণসূত্রে মাওলা বলা হত। পরস্পর সহযোগিতার চুক্তিতে আসার কারণে যাদেরকে موالى বলা হত তাদেরকে موالى الحلف বা চুক্তিসূত্রে মাওলা বলা হত। আর প্রকৃত কৃতদাস থাকায় যারা موالى পরিচয় পেত তাদেরকে موالى العتاقة বা দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভের সূত্রে দাস/মুক্তিপ্রাপ্ত মাওলা বলা হত। موالى শব্দের ব্যবহার সবার ক্ষেত্রে পাওয়া যেত।’ [মানাযির আহসান গিলানী রহ., তাদবীনে হাদীস-১৪১-১৪২]

মাওলা শব্দের অর্থের মাঝে ব্যাপকতার কারণে ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর ব্যাপারে কেউ কেউ এ বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন যে, তাঁর ক্ষেত্রে যে মাওলা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এর অর্থ গোলাম।

কিন্তু খোদ ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর সুস্পষ্ট বক্তব্য এর বিপরীত। ইমাম ত্বহাবী রহ. তাঁর শরহু মুশকিলিল আছার কিতাবে আকদে মুওয়ালাতের উপর আলোচনা করতে গিয়ে ইমাম আযম থেকে সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন যে, আবু আব্দুর রহমান আলমুকরী বলেন, আমি ইমাম আবু হানীফার নিকট আসলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন—

ممن الرجل ؟ فقلت: رجل من الله عز وجل عليه بالإسلام , فقال لي: لا تقل هكذا ولكن والِ بعضَ هذه الأحياءَ , ثم انتَمِ , فإني أنا كنت كذلك”.

তোমার পরিচয় কী? নিবেদন করলাম, এমন এক ব্যক্তি যার উপর আল্লাহ্ তাআলা ইসলামের কারণে অনুগ্রহ করেছেন। (অর্থাৎ সবেমাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছি।) ইমাম আযম বললেন, তুমি এমনটি বলো না।

বরং কোন কবীলা বা গোত্রের সাথে মুওয়ালাত বা পারস্পরিক সৌহার্দ্যভিত্তিক চুক্তি কর, তাহলে এ গোত্রের দিকেই তুমি ইনতেসাব বা সম্পৃক্ত হবে। কেননা আমার নিজের ব্যাপারটিও অনুরূপ। [শরহু মুশকিলুল আছার-৪/৫৪, দায়েরাতুল মাআরেফ, হায়দ্রাবাদ, দাকান, শাইখ শুআইব আলআরনাউত এ বর্ণনার রাবীদেরকে সিকাহ বলেছৈন, দেখুন, শরহু মুশকিলুল আছার, মুআসসাতুর রিসালা-৭/২৮৪]

ইমাম আযমের এই ওয়ালাউল মুওয়ালাত বা পারস্পরিক সৌহার্দ্যভিত্তিক ওয়ালা কোন গোত্রের সঙ্গে ছিল তা শরহু মুশকিলুল আছার‘র উক্ত বর্ণনায় উল্লেখ না থাকলেও ইবনে আবী আবিল আওয়ামকৃত ফাযায়িলু আবী হানীফাতে উক্ত গোত্রের নাম—বনু তায়মুল্লাহ বিন ছা’লাবা বিন বকর বিন ওয়ায়েল—বলে উল্লেখ রয়েছে। [ফাযায়েলে আবী হানীফা, পৃষ্ঠা-৪০, নং ৪, আখবারুল কুযাত, মুহাম্মদ বিন খালফ বিন হাইয্যান ওয়াকীকৃত-২/১৯৭]

মোদ্দাকথা, তায়মুল্লাহ বিন ছা’লাবা গোত্রের সাথে ইমাম আবু হানীফার ওয়ালা ছিল ওয়ালাউল মুওয়ালাত—পারস্পরিক সৌহার্দ্যভিত্তিক বা বন্ধুত্বের সূত্রে সম্পর্কিত ওয়ালা। ইমাম আযমের পূর্বপুরুষদের কেউ বনী তায়মুল্লার কারো কাছে ইসলাম গ্রহণসূত্রে মাওলা ছিলেন না। [ইমাম যাহাবী, মানাকিবুল ইমাম আবী হানীফা, কাওসারী রহঃ এর টীকা, পৃষ্ঠা-১৫, তানীবুল খতীব-১৬০]

আবার এ গোত্রের কেউ ইমাম আবু হানীফার পূর্ব পুরুষদের কাউকে দাসত্ব থেকে মুক্তিপ্রদানের সূত্রেও তিনি মাওলা ছিলেন না। তিনি স্বাধীন পারসিক রক্তের অধিকারী ছিলেন। দাসত্বের ছাপ তাঁর বংশে কখনো পড়েনি। [ইকদুল জুমান ফী তারীখি আহলিয যামান, বরাতে শায়েখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহঃ কৃত, আইন্তেকারের টিকা-১৮৯-১৯১]

Facebook Comments

Related posts

হযরত মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী এবং তার কিতাব আত তামহিদ | ড. আকরাম নদভী

সংকলন টিম

এক নজরে পালনপুরী রহ. | শারাফাত শরীফ

সংকলন টিম

খাইরুদ্দিন বারবারোসা | ইমরান রাইহান

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!