সংকলন
লাবণ্য
প্রতিযোগিতা-২

নীড়ে ফেরার গল্প-৩৯ | লাবণ্য

আমি লাবণ্য।

যার জীবনের ১৮ টা বসন্ত ছিল ঘনকালো অন্ধকারময়। কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়া এক গ্রহের মতো যার শৈশব-কৈশোরের পুরোটাই কেটেছে শুধুই গাফেলতির জগতে ঘূর্ণিপাক খেয়ে। মোহ আর মিথ্যার মধ্যে পথ চলতে চলতে অন্ধকারের অতল গহব্বরে নিমজ্জিত আমার এই ক্ষুধার্ত আত্মাটা হঠাৎই সন্ধান পায় এক টুকরো স্নিগ্ধ আলোর। যে আলোর রোশনাইতে জীবনের অর্থ নতুন করে ধরা দিয়েছিল আমার দু’চোখে।

Tijarah Shop

সাল ২০১৭, ১৩ নভেম্বর, বিকাল ৩ টা বেজে কিছুক্ষণ।

ইউটিউব স্ক্রল করছিলাম হলের ফ্লোরে বসে ফোনটা চার্জে রেখে। কিছুক্ষণ এলোমেলো স্ক্রলিং এর পর হঠাৎ একটা ভিডিও সামনে আসলো, হেডলাইনে লিখা ছিল “ক্যানসার আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার জন্য উপহার স্বরুপ!” আমি এটা দেখার পর কিছুক্ষণ ভাবলাম, ক্যানসার মানে তো জীবন শেষ! মৃত্যু নিশ্চিত! তাহলে এটা আবার রহমত হয় কেমনে! কৌতূহলী মন আমার বাধ্য করেছিল ভিডিওটা অন করতে। তখনো বুঝিনি এই ভিডিও অন করাটা হবে আমার জীবনটাকেই নতুন করে অন করা। এটাই সেই ভিডিও যা আমার মধ্যে হেদায়াতের বীজ বপন করে দিয়েছিল আমার অজান্তেই। যার চারাগাছ আস্তে আস্তে বড় হয়ে ডাল পালা ছড়িয়ে আজ অনেক দূরের পথে এগিয়ে। ভিডিওটা ছিল আলী বানাত নামের এক ভিনদেশী যুবকের, যিনি প্রচুর বিলাসবহুল জীবন লীড করতেন, এমতাবস্থায় তাঁর শরীরে ক্যানসার ধরা পড়েছিল। এই ক্যানসারটাই তাঁকে জীবন নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছিল। উনি আল্লাহকে চিনতে পেরেছিলেন। অসম্ভব রকমের বদলে গিয়েছিলেন। জীবনের সকল বিলাসিতাকে দু’পায়ে ঠেলে দুর্দান্তভাবে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন আপনার প্রতিপালকের নিকটে।

ভিডিও দেখে চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছিল আর মনে হচ্ছিল আমার পুরো আমিটাই অবশ হয়ে গিয়েছে। এই একটা মাত্র ইউটিউব ভিডিও আমার পুরো জীবনটাকেই পাল্টে দিয়েছিল। শুরু হলো নতুন পথচলা। প্রত্যেকের জীবনেই কোনো না কোনো একজন মানুষ থাকেন, যিনি কঠিন মুহূর্তেও সবচেয়ে আপন হয়ে পাশে থাকেন, পথ চলতে সাহায্য করেন। আমারও এমন একজন ছিলেন, উনি আমার রুমমেট। ফরজ সালাতের পাশাপাশি নফল রোজা, হারাম-হালাল এর বিষয়টা জানানোর পাশাপাশি সকল বিষয়ে যিনি গাইড করেছিলেন। নতুন নতুন দ্বীনের পথের চলাটা আমার জন্য অসম্ভব রকমের কঠিন ছিল। ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন সময় থেকেই বোরখা হিজাব পড়লেও দ্বীনটাকে কখনোই প্রকৃত দ্বীন হিসেবে আপন করে নেয়া হয় নি। যখন সত্যিকার ভাবেই পর্দা আরম্ভ করলাম, সেটা আমার জন্য ছিল রীতিমত চ্যালেঞ্জিং একটা ব্যাপার। কারণ আমার বাবা এসব একদম পছন্দ করেন না। আমি প্রথম দিকে বাসায় যেতেও ভয় করতাম এই ভেবে যে, আমার উপর রাগারাগি করলে আমার জন্য সহ্য করা খুব কষ্টের হবে। কারণ আমি বাবার খুব বাধ্য মেয়ে। তার সব কথা শুনে চলি। আগে সালাত পড়ার একদমই অভ্যাস ছিল না। আসলে আমি সালাত আদায় করতেও পারতাম না। যেদিন প্রথম সালাতে দাঁড়িয়েছিলাম, সেটা ছিল যুহরের ওয়াক্ত। নির্জন একটা কক্ষে আমি একদম একা, আমার রবের সামনে দাঁড়িয়ে আছি! ভয় করছিল ভীষণ, আমি জীবনে কখনও তেমন সালাত আদায় করিনি। দুরুদুরু বুকে সালাতে দাঁড়িয়ে খুব কেঁদেছিলাম। খুব মানে খুব! যখন সিজদায় গেলাম, তখন এক অর্পাথিব সুখ অনুভব করেছিলাম, যে প্রশান্তি আজও আমার জীবনের প্রতিটা সালাতে আমি খুঁজে ফিরি।

সালাতটা কোনরকম আদায় করতে পারলেও আমি তখনো কুরআন তেলাওয়াত করতে পারতাম না। কখনো শেখাও হয়নি শুদ্ধভাবে। মাঝে মাঝে খুব কান্না করতাম এই ভেবে যে, আমি কুরআন পড়তে জানিনা! আমি কেমন মুসলিম!! আমার হৃদয়ের আকুলতা কতটা যন্ত্রণা দিত আমাকে সেটা একমাত্র আল্লাহ জানেন। আমার জীবনের এই বন্ধুর যাত্রাপথের পুরোটা সময়ই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ’লাই আমার জন্য উত্তম সাহায্যকারী ছিলেন। তিনি আমাকে কতটা ভালোবাসেন সে আমি কল্পনাও করতে পারিনা! সামান্য একটা ভিডিওর মাধ্যমে আমাকে হেদায়াতের পথ দেখিয়েছিলেন! আমার নিদারুণ আক্ষেপের অবসান ঘটলো। আমার রব আমায় মাদ্রাসায় পড়বার সৌভাগ্যও দান করলেন! জানেন তো, কখনও কখনও হাত তুলে বা মুখে না বললেও, অন্তরের তীব্র আকুলতা রব ঠিকই কবুল করে নেন! বান্দার অন্তরের একদম গভীর থেকে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসটা তিনি ঠিকই শুনে থাকেন! মাদ্রাসায় যাওয়া শুরু হলো। আমি অনেক ভালো ছাত্রী, আমার এডুকেশন ব্যাকগ্রাউন্ড যথেষ্ট ভালো আলহামদুলিল্লাহ। তা সত্বেও আমি একটুও আরবি পড়তে পারতাম না! ভীষণ কষ্ট হতো, মুখের জড়তাই কাটতো না। এভাবে কিছুদিন চলার পর হঠাৎ মাদ্রাসাতে যাওয়াই বন্ধ হয়ে গেল আমার।

নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগতো। মনে প্রচন্ড কষ্ট আর অনুশোচনা। আমার এক বান্ধবী কুরআন সহীহভাবে তেলাওয়াত করতে পারত। রমজান মাসে ক্লাস শেষ করে ও আমাকে শিখাত। কিন্তু এভাবে ওর জন্য টাইম ম্যানেজ করা কষ্টকর ছিল। এরপর আমার পুরো শহর ঘুরেছি শুধু একটা মাদ্রাসার জন্য, আমি পড়ব তাই! কিছুতেই কোন উপায় হচ্ছিল না। অবশেষে আমার হলের কাছাকাছি, অল্প দূরে একটা মাদ্রাসায় পড়ার সুযোগ হয়। ওখানে অল্প কয়েকদিন পড়ার পর আমার উস্তাযা আপু আমাকে রিং করে বলেন, ‘আগামীকাল থেকে এসো, রেগুলার পড়ো, হবে ইনশাআল্লাহ৷’ এই যে ‘হবে ইনশাআল্লাহ’ বলে যে দোয়া করেছিলেন, আল্লাহ তাআ’লাও আমাকে এত সুন্দরভাবে পুরো তাজবিদটা আয়ত্ত্ব করার তৌফিক দিয়েছিলেন যে কি বলব! এরপর দ্বীনের বিভিন্ন বিষয় শেখাসহ কুরআন পড়ার কাজটা আমার মাদ্রাসা দিয়েই সম্পন্ন হয় আলহামদুলিল্লাহ।

এর মধ্যে পরিবার বুঝতে শুরু করে, আমি চাচাতো ভাইদের সামনে যাইনা। বিশেষ করে ভাইয়া(দুলাভাই)। এর জন্য আমাকে পুরো একটা বছর কতটা কথার আঘাত সহ্য করতে হয়েছে সেটা আমার চোখের পানিগুলো আল্লাহর কাছে বলবে হয়তো ইনশাআল্লাহ। পরিবার থেকে পর্দার জন্যই সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা সহ্য করেছি। আজ আমি অনেকটাই সফল আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের বাড়িটা জয়েন ফ্যামিলি টাইপ হওয়া সত্বেও এখন আমি নিজেকে আড়াল করতে পারি। এটা আমার ধৈর্য, তাওয়াক্কুল আর দুয়ার সুফল আলহামদুলিল্লাহ। ছোটবেলা থেকে পড়ুয়া স্টুডেন্ট হওয়ার সুবাদে আমি দ্বীনের পথে ফেরার পরও বই পড়ার অভ্যাসটা ধরে রেখেছি। এটাও আল্লাহ তা’লার পক্ষ থেকে আমার জন্য রহমত স্বরুপ।

পর্দার বিষয়ে পরিবারের পর সবচেয়ে চাপের সম্মুখীন হয়েছি পরীক্ষার হলে। মুখ খুলে পরীক্ষা দিতেই হবে! না হলে বের হয়ে যাও! এসব কথা আমিও শুনেছি। এমনিতেই আমি প্রচুর ভিতু স্বভাবের মেয়ে। এজন্য কেউ একটু জোরে কথা বললেও আমি কষ্ট পাই, আমার খারাপ লাগে! তাহলে সেই একাকী, অসহায় পরিস্থিতিতে আমার অবস্থাটা ঠিক কেমন হতো? একে তো ম্যাথম্যাটিক্সের স্টুডেন্ট, শুধু ম্যাথই করতে হয়। দ্বিতীয়ত, এত মানসিক চাপ! সব সামলিয়ে নিজেকে আবৃত করে রাখতে পারাটাও আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশাল এক সাহায্য ছিল। আমাকে অপমান করা হয়েছে, কষ্ট দেওয়া হয়েছে ঠিক, কিন্তু তারা আমাকে দেখতে পাননি। আমিই সফল হয়েছি। দুনিয়ার বুকে কারো বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে অভিযোগ করার ইচ্ছে নেই আলহামদুলিল্লাহ। শুধু সেই সব টিচার বাদে, যারা আমার মত মেয়েদেরকে হেনস্তা করে, কষ্ট দেয়, অযথা অপমান করে!

দ্বীনে ফেরার আগে প্রচুর গান গান শোনার বদ অভ্যাস ছিল। এটা এতটাই মারাত্মক ছিল যে, আমি প্রায় প্রতিটা কাজে গান শুনতাম। যেমন, ম্যাথ করছি সাথে গান শুনছি, পড়ছি তাও গান শুনছি। ঘুমাব, তার আগেও গান শুনতাম! এতটাই মারাত্মক খারাপ অভ্যাস ছিল। যখন জানলাম, গান শোনা হারাম, এটা অন্তরে মাদকতার সৃষ্টি করে, তখন থেকেই চেষ্টা করলাম গান শোনা বন্ধ করার। সিদ্ধান্ত নেবার পর প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল ফোল্ডার থেকে সব গান ডিলিট করা! আমি যখন হাতে ফোনটা নিয়ে ফোল্ডারের অল ডিলিট অপশনে চাপ দিয়েছিলাম তখন আমার হাত কাঁপছিল, চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছিল। কারণ এই গানগুলো আমার ভীষণ পছন্দের ছিল। আমি চোখ বন্ধ করে সব এক ক্লিকে ডিলিট করে দিয়েছিলাম আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ আমাকে শক্তি না দিলে আমি কখনও এগুলো ডিলিট করতে পারতাম না। গান ডিলিট করার পর ফোনের ডাটা অন করে ইউটিউবে Quran recite লিখে সার্চ করেছিলাম। অনেক অনেক কুরআন তেলাওয়াতের মধ্যে একটা তেলাওয়াত ছিল Salim Bahanan এর সূরা ওয়াকিয়াহ এর একটা তেলাওয়াত, এটা Ammar Tv এর একটা ভিডিও ছিল। এই একটা তেলাওয়াত আমার গানের শূন্যস্থান পূরণ করেছিল আলহামদুলিল্লাহ। ভীষণ ভালো লেগেছিল সেই তিলাওয়াত। প্রায় সব কাজে শুনতাম, ম্যাথ করার সময়, ঘুমানোর আগে। ওই যে, আগে যেমন গান শুনতাম, ঠিক তেমনই ভাবে। এছাড়া আরো কয়েকটা তেলাওয়াত ছিল, Ismail Annuri এর সূরা ইয়াসিন, সূরা আর রহমান এর তিন মিনিটের একটা ভিডিও ছিল, অসম্ভব রকমের ভালো লাগত আলহামদুলিল্লাহ। Salem Al Ruwaili সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের তিলাওয়াত ছিল অনেক পছন্দের। আর ছিল হানি আর রাফিই’র সূরা ফাজর এর তেলাওয়াত। এই তিলাওয়াত আমাকে কুরআন শুনে কাঁদতে শিখিয়েছিল।

অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছি আমি। ছিটকে পড়া গ্রহের জন্য আপন কক্ষপথে ফেরাটা কঠিনই বটে! যেই মেয়েটি আরবি হরফ উচ্চারণই করতে জানত না সেই মেয়েটিই এখন অন্যদের হরফ শিখতে সহায়তা করে। চক্ষু হেফাজত করার পিছনেও আছে একটা দারুণ কাহিনী। একদিন ফেইসবুকে ঘুরছিলাম, এমন সময় একটা লেখা চোখে পড়েছিল- ‘যেই চোখে আল্লাহকে দেখার স্বপ্ন দেখি, সেই চোখে কি হারাম কিছু দেখা যায়!’ আমার নিজের চোখের হেফাজতের জন্য এই লাইনটাই যথেষ্ট ছিল আলহামদুলিল্লাহ। কোনো ছেলের দিকে তাকানোর আগে অন্তত একবার হলেও এই কথাটা মনে পড়ে, আর এটা ভেবে তাকানোও হয় না, আলহামদুলিল্লাহ।

কটু কথা, বাজে মন্তব্য আর সবার মত আমিও সহ্য করেছি। কখনও কখনও ভয়ংকর রকমের মন খারাপ হয়েছে, কখনও খুব কেঁদেছি। তবুও ধৈর্য ধরে আছি আলহামদুলিল্লাহ। আমি বলতে পারিনা, আমি নিজে সব গুনাহ থেকে মুক্ত হতে পেরেছি। আমিও আগেও গুনাহগার ছিলাম, এখনো তাই আছি। এখনো আমি মহাপাপী এক গাফেল বান্দা। পার্থক্য এতটুকুই, আগে তাওবা করতাম না। এখন তাওবা করতে শিখেছি আলহামদুলিল্লাহ। ফিরতে পেরেছি আপন কক্ষপথে। এখন চাওয়া শুধু একটাই, হেদায়েতের যেই স্নিগ্ধ আলোর পরশে আল্লাহ সুবহানু ওয়া তাআ’লা আমাকে আলোকিত করেছেন, সেই আলোয় যেন আমৃত্যু স্নাত হতে পারি। “রব্বানা-লা-তুযিগ্ কুলূবানা- বা’দা ইয্ হাদাইতানা-অহাবলানা-মিল্ লাদুন্কা রহ্মাতান্ , ইন্নাকা আন্তাল্ অহ্হা-ব্”।

Facebook Comments

Related posts

নীড়ে ফেরার গল্প-৪৫ | আবু তালেব (ছদ্মনাম)

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-৫০ | আমাতুল্লাহ

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-১৫ | হাসিবুল হোসেন

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!