সংকলন
ব্যবসায়িদের ইসলামপ্রচার
মাহমুদ সিদ্দিকী

ব্যবসায়িদের ইসলামপ্রচার : একটি বক্তব্যের ঐতিহাসিক পর্যালোচনা | মাহমুদ সিদ্দিকী

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে দ্বীনদারদের সংখ্যা বেড়েছে। তাদের কেউ-কেউ ইলমচর্চা করছেন, কেউ দ্বীনের পক্ষে নিজস্ব ইলম নিয়ে লেখালেখি করছেন। আলহামদুলিল্লাহ, এটি আশাব্যঞ্জক খবর। কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো, তাদের মধ্যে এমন একটি শ্রেণি তৈরি হয়েছে, যারা আলিমদেরকে তাদের কাজের বাধা ও প্রতিপক্ষ মনে করেন। সুযোগ পেলেই আলিমদেরকে নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ বা সরাসরি অসমীচিন কথা বলেন। দ্বীন, ঈমান ও ইসলাম প্রচার-প্রসার এবং রক্ষাকর্মে আলিমদের অবদানকে তাচ্ছিল্য কিংবা অস্বীকার করেন। এঁদের মধ্যে শিক্ষিত সাধারণ দ্বীনদার যেমন আছেন, তেমনি প্রচলিত নন-আলিম সেলিব্রেটি লেখকও আছেন।

সম্প্রতি এমন একটি বিভ্রান্তিকর বাণী অনলাইনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাণীটি এক প্রকাশনীর কোনো এক বই থেকে জনৈক প্রফেসরের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা। আমাদের পর্যবেক্ষণে বাণীটি সর্বপ্রথম শরিফ আবু হায়াত অপু ভাই তার টাইমলাইনে শেয়ার করেছেন। এরপর অনেকে তার আইডি থেকে নিয়ে নিজ নিজ আইডিতে শেয়ার করেছেন। ইসলামের ইতিহাস ও সালাফদের জীবন সম্পর্কে নিদারুণ অজ্ঞতার স্মারক হিসেবে তাদের টাইমলাইনে সেই বাণী ঝুলে আছে। গবেষণা হোক আর যাই হোক—বাণীটি যে আগাগোড়া দলিলবিহীন, মনগড়া, ভিত্তিহীন ও অসত্য—ইতিহাস ঘেঁটে আমরা একটু সেগুলোই দেখার চেষ্টা করব।

বিভিন্নজনের টাইমলাইনে ঘোরা সেই বাণীটি হলো—“আমি মনে করতাম পৃথিবীতে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন আলেমগণ। কিন্তু ইসলামের ইতিহাস পড়ে জানতে পারি, পৃথিবীর সকল স্থানে ইসলামের বাণী সর্বপ্রথম পৌঁছিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীগণ। কীভাবে? এর উত্তর পাওয়ার জন্য গবেষণা করে যা পাই তা হলো, ব্যবসায়ীরা আলেমগণের ন্যায় আগে ঈমান এবং ইলম না নিয়ে হালাল ও আখলাক নিয়ে যান। পরবর্তীতে নিয়ে যান ঈমান ও ইসলাম। আগে যায় হালাল ও আখলাক, পরে যায় ঈমান ও ইসলাম।”

প্রথমেই কিছু জরুরি বিষয় আলোচনা করে নেওয়া যাক।

প্রথমেই বুঝতে হবে ইসলাম প্রচার দ্বারা উদ্দেশ্য কী? যিনি বক্তব্যটি দিয়েছেন, তিনি ঈমান, ইসলাম, ইলম, হালাল ও আখলাক ইত্যাদি শব্দাবলি একটাকে আরেকটার বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গুবলেট পাকিয়ে ফেলেছেন। শুরুতে এই শব্দগুলোর মূল অর্থ ও হাকিকত জেনে নিই।

সহিহ মুসলিমের হাদিসে ঈমান ও ইসলামের পরিচয় দেওয়া আছে। হযরত জিবরিল আলাইহিস সালাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জানতে চান—“আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন”। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বলেন—“ইসলাম হলো আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার রাসূল এই সাক্ষ্য দেওয়া। আর সালাত আদায় করা, যাকাত প্রদান করা, রমজানের রোজা রাখা এবং সামর্থ্য থাকলে হজ করা”। জিবরিল বলেন, আপনি সত্য বলেছেন। হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা আশ্চর্য হই দেখে। সে-ই জিজ্ঞাসা করছে আবার সে-ই সত্যায়ন করছে। এরপর জানতে চান—“আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন”। নবীজি বলেন, “ঈমান হলো—আল্লাহ তাআলা, ফেরেশতা, আসমানি কিতাব, নবী-রাসুল, আখেরাত দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখা। আর, ভালোমন্দ সবকিছু তাকদিরের ভিত্তিতে হয়—এই বিশ্বাস রাখা”। জিবরিল বলেন, আপনি সত্য বলেছেন। (১)

তাহলে দেখা যাচ্ছে—ঈমান এনে সর্বপ্রথম কাজই হচ্ছে আমল করা। ইসলামের যেসব আমল হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তার হালাল-হারাম তথা বৈধ-অবৈধ হওয়ার যে বিবরণ ও বিধান—সেটি হলো শরিয়ত। আর ঈমান ও ইসলাম মানার যে শরঈ বিধান—এর জ্ঞান হলো ইলম। তার মানে হলো—ঈমান-ইসলাম ও ইলম—এই তিনটি একে-অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর শরিয়তের হালাল-হারাম বিধান ইলমের অন্তর্ভুক্ত। একজন মানুষ ঈমান এনে ইসলামে প্রবেশ করামাত্র তার জন্য আমল করা ফরজ হয়ে যায়। আর সেই আমলের জন্য ইলম অর্জন করা ফরজ হয়ে যায়।

অর্থাৎ, ইসলাম প্রচার মানে শুধু কাউকে কালিমা পড়িয়ে দেওয়া নয়; বরং তাকে ঈমান আনার পর প্রয়োজনীয় ইলম ও আমল শিক্ষা দেওয়ার সমন্বিত নাম হলো ইসলাম প্রচার। এজন্য আমরা সামনে দেখব, নববী যুগ থেকেই ইসলামপ্রচারকারী সেনাবাহিনী হোক কিংবা দাঈ দল, তাতে নেতৃত্বে বা উপদেষ্টা থাকত বিজ্ঞ আলিম ব্যক্তি।

উপরোক্ত বক্তব্যদাতা ঈমান, ইসলাম ও ইলমকে একসাথে রাখলেও হালাল ও আখলাককে এগুলোর বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গুবলেট পাকিয়ে ফেলেছেন। তিনি লিখেছেন—“আগে যায় হালাল ও আখলাক, পরে যায় ঈমান ও ইসলাম।” যে-হালাল ঈমান ও ইসলামকে রেখে যায় সে হালাল কোন হালাল? যে-আখলাক ঈমান ও ইসলামকে রেখে যায়, সে আখলাক কোন আখলাক? এই আখলাকের আদৌ কি কোনো শরঈ মর্যাদা আছে?

এতটুকু প্রাথমিক আলোচনার পর এবার চলুন ইতিহাসের দিকে যাই।
ইসলাম কাদের হাত ধরে প্রসারিত হয়েছে? যাদের হাত ধরে প্রসারিত হয়েছে, তাদের ইলমি অবস্থা কী ছিল? তারা কি আলিম ছিলেন না ব্যবসায়ী?

এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য একদম নববী যুগ থেকে শুরু করা যাক।

নববী যুগে ইসলাম প্রচার

সন্দেহ নেই—পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আলিম ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। সরাসরি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে তাঁরা ইলম অর্জন করেছেন। সাহাবিদের একটি দল দিনের পর দিন না খেয়ে নবীজির দরবারে পড়ে থাকতেন কেবল ইলম অর্জনের জন্য। যারা সার্বক্ষণিক থাকতে পারতেন না তাঁরা দুজন মিলে পালা করে থাকতেন। একজন বাড়িতে থাকলে অপরজন ইলম অর্জন করতেন। আবার দ্বিতীয়জন মজলিসে থাকলে প্রথমজন বাড়িতে কাটাতেন। পরে একে-অপর থেকে শিখে নিতেন।

সাহাবায়ে কেরাম ইলমের ময়দানে ছিলেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ—একথার বিবরণ শুনুন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহুর মুখে।
كانوا خير هذه الأمة، أبرها قلوبا، وأعمقها علما، وأقلها تكلفا.
“সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন এই উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ জামাত। তাঁদের হৃদয় সবার চেয়ে পুণ্যবান, তাঁদের ইলম সবার চেয়ে গভীর এবং কৃত্রিমতা সবার চেয়ে কম।” (২)

নববী যুগে মক্কা-মদিনা ও তায়েফ সহ বেশিরভাগ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে সরাসরি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে। এর বাইরে কিছু অঞ্চলে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে সাহাবিদের মাধ্যমে, নবীজির নির্দেশে। তখন যেসব অঞ্চলে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে তার একটি হলো হাবশা। হাবশায় ইসলাম প্রচারের প্রথম সূচনা হয় হযরত উসমান ইবনে আফফান রাযিয়াল্লাহু আনহুর মাধ্যমে। হাবশার প্রথম হিজরত নামে যেটি পরিচিত। উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর পর লম্বা সময় হাবশায় ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব যিনি পালন করেন তিনি হলেন নবীজির চাচাতো ভাই জাফর ইবনে আবি তালিব রাযিয়াল্লাহু আনহু। বাদশা নাজাশি যখন মুসলিমদেরক আহ্বান করে তখন তাঁর সামনে ইসলামের পরিচয় তুলে ধরেছিলেন জাফর রাযিয়াল্লাহু আনহু। (৩)

নবীজির সিরাত ও ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম হৃদয়বিদারক একটি ঘটনা হলো বিরে মাউনার ঘটনা। এই ঘটনার পেছনের ঘটনাটা কী ছিল? কেন যাচ্ছিলেন এই সাহাবিরা?

বিরে মাউনায় যেসব সাহাবি শহিদ হন, তাঁরা নজদে যাচ্ছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য। নজদের মুশরিক আবুল বারা আমির ইবনে মালিক নবীজির কাছে কোনো একটি কাজে এসেছিল। নবীজি তার কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। আমির ইবনে মালিক তখনো ইসলাম গ্রহণ করেনি। আবার করবে না এমনও বোঝা যাচ্ছে না। সে নবীজির কাছে প্রস্তাব দেয়, এক কাজ করুন, পুরো নজদে ইসলাম প্রচারের জন্য আপনার সাহাবিদের একটি দল পাঠান আমার সাথে। তাঁরা সেখানে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিবে। আশা করি নজদবাসীরা ইসলাম গ্রহণ করে নিবে। সবার সাথে আমিও ইসলাম গ্রহণ করব। আমির ইবনে মালিকের প্রস্তাবে নবীজি প্রথমে আশঙ্কা ব্যক্ত করলেও তার অভয়দানের কারণে সাহাবিদের একটি দল পাঠান। (৪)

যারা ইসলাম প্রচারের জন্য যাচ্ছিলেন তাঁরা কেমন ছিলেন? শুনুন সহিহ মুসলিমের বর্ণনায়। হযরত আনাস ইবনে মালিক বলেন, “নবীজির কাছে ক’জন মানুষ এসে আবেদন জানায়, আপনি আমাদের সাথে এমন কিছু মানুষ পাঠান, যারা আমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ শিক্ষা দিতে পারবে। নবীজি তখন তাঁদের সাথে সত্তরজন আনসার সাহাবির একটি দল পাঠান। যাদেরকে বলা হতো ‘কুররা’।” (৫)

তাহলে দেখা যাচ্ছে, সাধারণভাবে সাহাবিরা তো আলিম ছিলেনই। তাঁদের মধ্যেও নজদে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে বিরে মাউনায় শাহাদাত বরণ করা সাহাবিরা ছিলেন বিশিষ্ট। অন্যদের চেয়ে কুরআন-সুন্নাহর ইলমে তাঁরা এতটাই প্রাজ্ঞ ছিলেন, যাদেরকে কুররা বলে আলাদা নামে ডাকা হতো।

ইয়েমেনে ইসলাম প্রচারের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফ বিজয়ের পরপর খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনী পাঠান। পরক্ষণে হযরত খালিদকে ফেরত এনে হযরত আলি রাযিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে বাহিনী পাঠান এবং তাঁর হাতে হামদান গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে। (৬)

ইয়েমেনের আহলে কিতাবদের মাঝে ইসলাম প্রচার এবং শাসনের জন্য পাঠান হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহুকে। হাদিসের ভাষ্যই শুনুন—“হযরত ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুয়াজকে ইয়েমেন পাঠান। পাঠানোর সময় বলেন, তুমি তাদেরকে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহ রাসুল—এই দাওয়াত দিবে।” (৭) হযরত মুয়াজকে ইয়েমেনে পাঠানোর হাদিস কুতুবে সিত্তায় অসংখ্যবার এসেছে।

ইয়েমেনে আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ সাহাবিকে নবীজি ইসলাম প্রচারের জন্য পাঠিয়েছেন। তিনি হলেন আবু মুসা আশআরি রাযিয়াল্লাহু আনহু। সহিহ বুখারির বর্ণনায় জানা যায় হযরত মুয়াজ এবং আবু মুসা আশআরি রাযিয়াল্লাহু আনহুমাকে বিদায় হজের আগে ইয়েমেনে পাঠানো হয়। (৮)

হযরত আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু কে ছিলেন, কেমন ছিল তাঁর ইলম—তা আশা করি বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। ‘আমি ইলমের নগরী আর আলি সেই নগরীর ফটক’—ইবনে আব্বাস বর্ণিত এই হাদিসটিকেও ইমাম সাখাবি রহ. সামগ্রিকভাবে হাসান বলেছেন। (৯) হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য হলো—“মুয়াজ হালাল-হারামের ইলমে সবার চেয়ে বড় আলিম।” (১০) হযরত আবু মুসা আশআরি রাযিয়াল্লাহু আনহুও প্রথম সারির আলিম সাহাবি। উপরোক্ত সাহাবিদের কেউ ব্যবসায়ী হয়ে ইলম প্রচার করতে যাননি। হয়ত দাঈ হিসেবে গিয়েছেন, নতুবা জিহাদের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করতে গিয়েছেন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে—নববী যুগে কোনো অঞ্চলে কোনো ব্যবসায়ী ইসলাম প্রচারে অবদান রাখেননি। বরং প্রবীণ, প্রাজ্ঞ ও শীর্ষ আলিম সাহাবিগণের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটেছে।

খিলাফতে রাশেদার যুগে ইসলাম প্রচার

খুলাফায়ে রাশেদার যুগে শামে ইসলাম প্রবেশ করে নবীজির আদরের সাহাবি উসামা ইবনে যায়দ রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাত ধরে। নাতী হাসান ইবনে আলি এবং উসামা ইবনে যায়দ—দুজনকে একসাথে কাছে টেনে নবীজি বলতেন, ইয়া আল্লাহ, আমি এই দুজনকে ভালোবাসি। সুতরাং আপনিও তাদেরকে ভালোবাসুন। (১১) উসামা ইবনে যায়দ রাযিয়াল্লাহু আনহুর বাবা-মা যায়দ ইবনে হারিসা এবং উম্মে আইমান ছিলেন নবী-পরিবারেরই সদস্য। দীর্ঘদিন তাঁরা নবী-পরিবারে ছিলেন। পরবর্তীতে তাঁদের সন্তান উসামা ইবনে যায়দ নবীজির নাতীদের সাথে নবীজির নৈকট্য ও সান্নিধ্য পেয়েছেন একদম শৈশব থেকে।

১১ হিজরিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে উসামা ইবনে যায়দ রাযিয়াল্লাহু আনহু শামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার জন্য বাহিনী প্রস্তুত করেন। এমন সময় নবীজির ওফাত হয়ে যায়। পরবর্তীতে অন্য সাহাবিগণ অমত করলেও আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু নবীজির নির্দেশ বহাল রেখে উসামা ইবনে যায়দকে শামে বাহিনী দিয়ে পাঠান। (১২)

বাহরাইনে ইসলাম প্রবেশ করে খোদ নববী যুগে, পত্রের মাধ্যমে। (১৩) ইরাকে ইসলাম প্রবেশ করে মুসান্না ইবনে হারিসা রহ. ও খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহুর মাধ্যমে। (১৪)

আফ্রিকায় ইসলাম প্রবেশ করে উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে, ২৪ হিজরিতে, আব্দুল্লাহ ইবনে সা’দ ইবনে আবি সারহ রাযিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে। এই বাহিনীতে আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর, আব্দুর রহমান ইবনুল আসওয়াদ, আব্দুর রহমান ইবনে আবি বকর এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাযিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ সাহাবিগণ অংশগ্রহণ করেন। (১৫)

এছাড়া রোম-পারস্য সহ বড়-বড় সাম্রাজ্যে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে খোদ নবীজির পাঠানো দূত ও পত্রের মাধ্যমে। পরবর্তীতে সেখানে ইসলাম প্রবেশ করে খুলাফায়ে রাশেদিনের যুগে। পূর্বেই বলেছি—ইসলাম প্রচার বলতে সামগ্রিক দ্বীন উদ্দেশ্য। হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর যুগে কুফার মানুষদের মাঝে দ্বীন প্রচার ও ইলম শিক্ষা দানের জন্য বিশিষ্ট আলিম আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহুকে পাঠিয়ে দেন। (১৬)

আরবদের মূল বাণিজ্য ছিল শাম, ইয়েমেন, হাবশা ও হিন্দুস্তানের সাথে। (১৭) উপরে আমরা দেখেছি—শাম ও ইয়েমেনের কোনো শহরেই ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ইসলাম পৌঁছেনি। বরং ইসলাম পৌঁছেছে নবীজির সুহবতে বিশেষভাবে ইলম অর্জনকারী উসামা ইবনে যায়দ, আলি ইবনে আবি তালিব, মুয়াজ ইবনে জাবাল ও আবু মুসা আশআরি রাযিয়াল্লাহু আনহুমের মাধ্যমে।

হিন্দুস্তানে ইসলাম প্রচার

এখন বাকি রইল হিন্দুস্তান। হিন্দুস্তানের সাথে আরব ব্যবসায়ীদের সংযোগটা ছিল অনেক পুরাতন। ব্যবসায়িক কারণে তারা নিয়মিত হিন্দুস্তানে যাতায়াত করত। আরবদের মধ্যে যখন ইসলাম প্রসার লাভ করে, তখন মুসলিম ব্যবসায়ীরাও হিন্দুস্তানে আসা-যাওয়া করতে থাকেন। তখন তারা সেখানে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং মানুষজন ইসলাম প্রবেশ করে। (১৮) তারিখুল ইসলাম ফিল হিন্দের সূত্রে মাহমুদ শিত খাত্তাবও এই কথাগুলো লিখেছেন। তবে, এই ঘটনা ঠিক কত হিজরির, ব্যবসায়ীদের দ্বীন প্রচারের কর্মপন্থা কী ছিল বা তারা কী-কী করেছেন, তা নির্দিষ্টভাবে কোথাও পাইনি।

ডক্টর আব্দুল মুনঈমও স্বীকার করেছেন সেকথা। তিনি লেখেন—“ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে এই আরব ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত পদক্ষেপ ও অবদান সম্পর্কিত তথ্য ইতিহাসগ্রন্থগুলোতে সুলভ নয়। এজন্য তারা কেবল অনির্দিষ্টভাবে শিরোনাম উল্লেখ করেছেন।” (১৯) এরপর তিনি ব্যবসায়ীদের হাতে মালাবারের রাজার ইসলাম গ্রহণ সংক্রান্ত ভিত্তিহীন ঘটনাটি উল্লেখ করেন।

তাহলে এতটুকু জানা যাচ্ছে যে, হিন্দুস্তানে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার ঘটেছে। কিন্তু কখন, কোথায়, কীভাবে ও কতটুকু—এ সম্পর্কে ইতিহাসে নির্ভরযোগ্য সূত্রে খুব বেশি তথ্য আমরা পাচ্ছি না। তবে এ থেকে অনুমান করা যায়, এর পরিধি ছিল খুবই সীমিত। বিভিন্ন ব্যবসায়ী নিজ ব্যবসার পরিসরে বা নিজ ব্যবসায়িক এলাকায় ইসলামের প্রচার করেছেন। ব্যাপক পরিসরে হলে এর তথ্য কিছুটা হলেও পাওয়া যেত।

হিন্দুস্তানে ইসলাম প্রচার সম্পর্কে যে-নিশ্চিত তথ্যগুলো বিশুদ্ধ সূত্রে পাওয়া যায় তা হলো—উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর যুগে বাহরাইন ও ওমানের আমির উসমান ইবনে আবিল আস সাকাফি তার ভাই মুগিরা ইবনে আবিল আসকে দেবল সাগরে অভিযানে পাঠান। তিনি সেখানে শত্রুদের সাথে লড়াই করে বিজয় লাভ করেন। এই ঘটনা ১৫ হিজরির পরের কথা। উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে তার নির্দেশে হাকিম ইবনে জাবালা হিন্দের সীমান্ত অঞ্চলে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রেকি করে যান। কিন্তু অভিযান হয়নি।

৩৮ হিজরির শেষ বা ৩৯ হিজরির শুরুতে হারিস ইবনে মুররাহ সিন্ধের সীমান্তে হামলা করে বিজয় লাভ করেন। কিন্তু পরে খোরাসান সংলগ্ন কীকান অঞ্চলে তাকে এবং তার সাথীদেরকে হত্যা করা হয়। মুহাল্লাব বিন সুফরা দ্বিতীয়বার সীমান্ত অঞ্চলে হামলা করেন। তিনি মুলতান ও কাবুলের মধ্যবর্তী পান্না ও আহওয়ার পর্যন্ত পৌঁছে যান। (২০)

অর্থাৎ, ১৫ হিজরিতে দেবল সাগরে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে। কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করেনি। সুতরাং এই সময়ে ইসলাম প্রবেশ করেছে কি না—তা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও ৩৮/৩৯ হিজরিতে হারিস ইবনে মুররাহর মাধ্যমে মূলত হিন্দুস্তানে ইসলামের প্রবেশ ঘটে। এরপর তা আরও ব্যাপকতা লাভ করে মুহাম্মাদ বিন কাসিমের বাহিনীর মাধ্যমে।

এখন কথা হলো—যেসব ব্যবসায়ী নিজ উদ্যোগে হিন্দুস্তানে ইসলাম প্রচার করেছেন, তারা কি নিছক ব্যবসায়ী ছিলেন না আলিমও ছিলেন?

যেহেতু তাঁদের ইসলাম প্রচারের নিশ্চিত সময়কাল জানা যাচ্ছে না, তাহলে ধরে নিতে পারি চল্লিশ হিজরির আগে ঘটেছে। কারণ, এর পরে হিন্দুস্তানে বিজয়ী বেশে ইসলাম প্রবেশ করেছে। এই ঘটনাগুলো যখন ঘটে, তখন খাইরুল কুরুন চলছে। হাজারও সাহাবি তখনো জীবিত। একজন শিশু জন্মের পর তার প্রথম শিক্ষা হতো ইলম অর্জন এবং যুদ্ধবিদ্যা। ব্যবসা কিংবা দুনিয়াবি পেশা ও শিল্প শেখার ধাপ ছিল তারও পরে। ফলে সেসময় আলাদা করে সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার যেমন বিষয় ছিল না, তেমনি আলিম হবার জন্য সবকিছু থেকে ফারেগ হতে হতো না। মসজিদ, ঘর, বৈঠক—প্রতিটি জায়গাই ছিল একেকটি মাদরাসা। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য কাজী আতহার মুবারকপুরি রহ. রচিত ‘খাইরুল কুরুন কি দরসগাহেঁ আওর উনকা নেযামে তালিম ও তারবিয়ত’ বইটি দেখা যেতে পারে। মোটকথা, একজন সাধারণ সৈনিক থেকে সেনাপতি—স্তরভেদে সকলেই ইসলামের মৌলিক ও প্রয়োজনীয় ইলমে আলিম ছিলেন।

খাইরুল কুরুনের বিখ্যাত কয়েকজন শিল্পপতির নাম দেখি আমরা।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ.-এর কথাই ধরুন। ১৮১ হিজরিতে তাঁর ইন্তেকাল। ইলমের ময়দানে যেমন তারকাতুল্য, তেমনি অর্থনৈতিকভাবে ছিলেন বিশাল ব্যবসায়ী। আব্বাস ইবনুল মুসআব বলেন—আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক হাদিস, ফিকহ, ভাষাদক্ষতা, ইতিহাস, সাহসিকতা, দানশীলতা, ব্যবসা এবং ভালোবাসা—সবকিছুর আধার ছিলেন। (২১) তাঁর বাৎসরিক দানের পরিমাণ ছিল এক লাখ দিরহাম। দানের ক্ষেত্রে একবার যা কলম দিয়ে বের হতো, সেটা আর ফেরত নিতেন না। (২২)

ইবনুল মুবারকের উস্তাদ ইমাম আজম আবু হানিফার কথাই ধরুন। একদিকে ইমাম আজম, অন্যদিকে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। ভুলে কোনো দোষযুক্ত কাপড় বিক্রি করে ফেললে সেটার মূল্য সদকা করে দিতেন। (২৩) ব্যবসায়িকভাবে কতটা লাভবান ছিলেন তিনি, তার ধারণা পাওয়া যায় এই ঘটনায়। তাঁর ছেলে হাম্মাদ সুরা ফাতিহা পড়া শেষ করলে ছেলের উস্তাদকে তিনি পাঁচশো দিরহাম হাদিয়া দেন। অন্য বর্ণনামতে এক হাজার দিরহাম হাদিয়া দেন। (২৪) তাঁর ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ রহ.-এর পড়াশোনার ব্যয়ভার তিনি নিজে বহন করতেন। (২৫)

১৭৫ হিজরিতে ইন্তেকাল করা মিশরের শাইখুল ইসলাম ইমাম লাইছ ইবনে সা’দ ছিলেন আরেক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। ব্যবসার বিনিয়োগ থেকে ইমাম লাইছের বাৎসরিক আয় ছিল বিশ হাজার দিনার। তবু কখনো যাকাত ফরজ হতো না। ইবনে লাহিআকে পাঠাতেন এক হাজার দিনার, ইমাম মালেককে পাঠাতেন এক হাজার দিনার, মানসুর ইবনে আম্মারকে দিতেন এক হাজার দিনার; আরেক মেয়ের খরচ দিতেন তিনশো দিরহাম। এভাবে তাঁর অর্থ ব্যয় হয়ে যেত। (২৬)

তো, যে-যুগের শিল্পপতিরা ছিলেন যুগের সেরা ইমাম, সে-যুগের সাধারণ ব্যবসায়ীরা যে নিউ মার্কেট আর চাঁদনীচকের নিছক ব্যবসায়ী ছিলেন না—এই বিষয়টা অনুধাবন করা খুবই জরুরি। ইলমের স্বর্ণযুগ হওয়ার ফলে মোটামুটি সবাই আলিম ছিলেন। কুরআন ও হাদিসের দরসে শৈশব থেকে বসা ছিল একপ্রকার বাধ্যতামূলক। যারা বিশেষভাবে ইলমের জন্য উৎসর্গিত হতেন, তাঁরা হতেন যুগশ্রেষ্ঠ ইমাম। আর যারা বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে যেতেন, তাঁরাও হতেন বর্তমানের বহু আলিমের চেয়ে অগাধ ইলমের অধিকারী।

সেকালে ইলম কতটা বিস্তৃত ছিল, তার কিছু নমুনা উল্লেখ করা যাক।
চতুর্থ খলিফা হযরত আলি ইবনে আবু তালিব রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর খেলাফতকালে দারুল খেলাফত স্থানান্তর করেন কুফাতে। কুফায় এসে ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাজারও ছাত্র দেখতে পান। আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু একইসাথে অবাক ও মুগ্ধ হন। তারপর মন্তব্য করেন—“আল্লাহ তাআলা ইবনে উম্মে আব্দের প্রতি রহম করুন। তিনি এই জনপদকে ইলম দিয়ে পূর্ণ করে দিয়েছেন”। (২৭)

আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন, আমি ইলম অর্জন করেছি চার হাজার শায়খের কাছ থেকে। কিন্তু বর্ণনা করেছি এক হাজার শায়খ থেকে। (২৮)
এগুলো ছাড়াও এমন অসংখ্য ইলমি মজলিসের কথা পাওয়া যায়, যেখানে একসাথে পাঁচ-সাত হাজার মানুষ ইলম অর্জন করত। মোটকথা, ইলম অর্জন তখন জরুরী এবং সহজলভ্য ছিল। পাশাপাশি বিজিত অঞ্চলগুলোতে ইসলামি খেলাফতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আলিমগণ স্বেচ্ছায় কিংবা খলিফার নির্দেশে ইসলাম প্রচারের জন্য চলে যেতেন।

এর প্রমাণ পাওয়া যায় মুসা বিন নুসাইর যখন মরক্কো বিজয় করেন, তখনকার ঘটনায়। ৮৬ হিজরিতে মুসা বিন নুসাইর মরক্কোর তানজিয়ার শহর বিজয় করেন। সেখানে অবস্থানকারী আমাজিগ জাতি তাঁর অধীনতা মেনে নিলে তারিক বিন যিয়াদকে সেখানকার গভর্নর নিযুক্ত করে আফ্রিকায় ফিরে আসেন। সেখানকার মোট বসবাসকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় সতেরো হাজার আরব এবং বারো হাজার বারবার। মুসা বিন নুসাইর মরক্কোবাসীকে কুরআন ও দ্বীনের ফিকহ শিক্ষা দিতে আরবদেরকে নির্দেশ দেন।

পরবর্তীতে মাসামিদা গোত্র সহ বেশ কয়েকটি গোত্রে যুরআ বিন মুদরিককে দিয়ে বাহিনী পাঠালে তারাও আনুগত্য স্বীকার করে নেয়। তাদেরকেও তারিক বিন যিয়াদের অধীনস্ত করে স্পেনের দিকে রওয়ানা করেন। যাওয়ার আগে সতেরোজন আরবকে রেখে যান মাসামিদাদেরকে কুরআন ও শরঈ আহকাম শিক্ষা দেওয়ার জন্য। ইতিপূর্বে উকবা বিন নাফেও মাসামিদাদেরকে কুরআন ও শরঈ আহকাম শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাঁর কয়েকজন সঙ্গীকে রেখে গিয়েছিলেন। এঁদের মেহনতে ইসলাম গ্রহণ করা আমাজিগ জাতি ও আফ্রিকানদের নিয়ে তারিক বিন যিয়াদ স্পেন বিজয় করেন। (২৯)

তাহলে সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, হিন্দুস্তান ও আশেপাশের কিছু অঞ্চলে ব্যবসায়ীদের দ্বারা ইসলামের প্রচার-প্রসার হয়েছে। তবে তাও সীমিত পরিসরে। তবে এই ব্যবসায়ীরাও বর্তমান ব্যবসায়ীদের মতো ইলমের শিশু ছিলেন না, বরং সে-যুগে একজন সাধারণ মানুষের ইলম বর্তমানের বহু আলিমের চেয়ে অগাধ ছিল। এর বাইরে ইসলামের প্রচার-প্রসার হয়েছে মুসলিম সেনাবাহিনী ও আলিমদের দাওয়াতি মেহনতের মাধ্যমে। একটি অঞ্চলে ইসলাম প্রবেশের পর সেখানে প্রয়োজন পরিমাণ আলিমদের রেখে আসা হতো। তাদের মেহনতে মুসলিমদের মাঝে ইলমের এবং কাফিরদের মাঝে ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটত।

নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্যাদির আলোকে দেখা যাচ্ছে—শরীফ আবু হায়াত অপু ভাইয়ের শেয়ার করা জনৈক প্রফেসরের বক্তব্যটি আগাগোড়া সম্পূর্ণ দলিলবিহীন ও মনগড়া মিথ্যা। যেখানে অল্পকিছু অঞ্চলে সীমিত পরিসরে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ইসলাম পৌঁছেছে, সেখানে তিনি দাবি করেছেন—“পৃথিবীর সকল স্থানে ইসলামের বাণী সর্বপ্রথম পৌঁছিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীগণ”। এই অদ্ভুত ইতিহাস তিনি কোথায় পড়েছেন, কোন সূত্রে পড়েছেন—তা আমাদের জানা নেই। সেই সূত্রগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো যে নির্ভরযোগ্য নয়, তা স্পষ্ট।

মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসের ভান্ডার এতটাও দেউলিয়া নয় যে, একটা কিছু দলিলবিহীন মনে এলেই গবেষণা বলে প্রচার করে দেওয়া যাবে। কোনো দাবি বা গবেষণা করতে হলে প্রথমে এর পক্ষে দলিল প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত সেই দলিলটির সত্যাসত্য ও নির্ভরযোগ্যতা-অনির্ভরযোগ্যতা যাচাই করা আবশ্যক। এর কোনোটি অনুপস্থিত থাকলে নতুন কোনো দাবি করবার সুযোগ নেই।

স্রোতের বিপরীত মানেই যে সত্য নয়; বহুকিছু মিথ্যাও হয়—এই বিষয়টি স্মরণ রাখা অতীব জরুরি। কোনো তথ্য বা লেখা সম্পর্কে এর নির্ভরযোগ্যতা যাচাই না করে; যাচাই করার যোগ্যতার অভাব থাকলে যোগ্য ব্যক্তি থেকে না জেনে প্রচার করা গোনাহের কাজ। এজন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করে দিয়েছেন—“একজন মানুষের মিথ্যায় জড়িত হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা-ই শোনে (যাচাই-বাছাই না করে) তা-ই বলে বেড়ায়”। (৩০)

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ভুলভ্রান্তি থেকে রক্ষা করুন। এবং যেকোনোকিছু প্রচারে আরও সতর্ক ও দায়িত্ববান হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

টীকা :

(১) সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৮
(২) শারহুস সুন্নাহ, ১/২১৪, ইমাম বাগাভি, আল-মাকতাবুল ইসলামি, ১৪০৩ হিজরি
(৩) আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ, ১/৩৬৪-৩৬৭, যাহাবি, মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ
(৪) সিরাতে ইবনে ইসহাক, ২/৩৭৮[ধারাবাহিক নাম্বার], দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৪২৪ হিজরি; আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ, ১/৪৪৯-৪৫০, যাহাবি, মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ
(৫) সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৬৭৭
(৬) সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৪৩৪৯; মা’রিফাতুস সুনানি ওয়াল আসার, হাদিস নং-৪৭৪৪, ইমাম বাইহাকি
(৭) সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৩৯৫, ১৪৯৬
(৮) সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৪৩৪১
(৯) আল-মাকাসিদুল হাসানাহ ফিল আহাদিসিল মুশতাহিরাহ আলাল-আলসিনাহ, পৃষ্ঠা-১৬৯-১৭০, দারুল কিতাবিল আরাবি, ১৪০৫ হিজরি
(১০) সুনানুত তিরমিযি, হাদিস নং-৩৭৯০
(১১) সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৩৭৪৭
(১২) আল-মুন্তাযাম ফি তারিখিল মুলুকি ওয়াল উমাম ৪/১৬-১৭ ও ৪/৭৩-৭৪, ইবনুল জাওযি
(১৩) আল-মুন্তাযাম ফি তারিখিল মুলুকি ওয়াল উমাম ৪/৮৩, ইবনুল জাওযি
(১৪) আল-মুন্তাযাম ফি তারিখিল মুলুকি ওয়াল উমাম ৪/৯৭, ইবনুল জাওযি
(১৫) আল-বায়ানুল মুগরিব ফিখতিসারি আখবারি মুলুকিল আন্দালুস ওয়াল মাগরিব ১/৩১, ইবনুল আযারি, দারুল গারবিল ইসলামি, ১৪৩৪ হিজরি
(১৬) আল-ইসাবা ফি তাময়িযিস সাহাবা ৪/২০১, ইবনে হাজার, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, প্রথম সংস্করণ
(১৭) তারিখুল ইসলামিল ওয়াজিয, পৃষ্ঠা-২০, সুহাইল তাক্কুশ
(১৮) তারিখুল ইসলাম ফিল হিন্দ, পৃষ্ঠা-৮৭, ড. আব্দুল মুনইম নামির
(১৯) তারিখুল ইসলাম ফিল হিন্দ, পৃষ্ঠা-৮৯, ড. আব্দুল মুনইম নামির
(২০) ফুতুহুল বুলদান, পৃ. ৬০৭-৬০৯, বালাজুরি, মুয়াসসাসাতুল মাআরিফ, ১৪০৭ হি.
(২১) সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৮/৩৮৩, যাহাবি, মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, প্রথম সংস্করণ
(২২) সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৮/৩৮৬, যাহাবি, মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, প্রথম সংস্করণ
(২৩) আল-খাইরাতুল হিসান ফি মানাকিবি আবি হানিফাতান নু’মান, পৃষ্ঠা-৪৪, ইবনে হাজার হাইতামি, হিন্দুস্তানি সংস্করণ, ১৩২৪ হি.
(২৪) আল খাইরাতুল হিসান ফি মানাকিবি আবি হানিফাতান নু’মান, পৃ. ৪২, ইবনে হাজার হাইতামি, হিন্দুস্তানি সংস্করণ, ১৩২৪ হি.
(২৫) সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৮/৫৩৬, যাহাবি, মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, প্রথম সংস্করণ
(২৬) সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৮/১৪৮-১৪৯, যাহাবি, মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, প্রথম সংস্করণ
(২৭) ফিকহু আহলিল ইরাক ওয়া হাদিসুহুম, পৃষ্ঠা-৪০, দারুল বাসাইর, প্রথম সংস্করণ
(২৮) সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৮/৩৯৭, যাহাবি, মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, প্রথম সংস্করণ
(২৯) আল-বায়ানুল মুগরিব ফিখতিসারি আখবারি মুলুকিল আন্দালুস ওয়াল মাগরিব ১/৬৯-৭০, ইবনুল আযারি, দারুল গারবিল ইসলামি, ১৪৩৪ হিজরি
(৩০) সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৫

Facebook Comments

Related posts

ইলম অর্জনের মুতাওয়ারাস ধারা | মাহমুদ সিদ্দিকী

নববর্ষের ইসলামাইজেশন : শরয়ি দৃষ্টিকোণ | মাহমুদ সিদ্দিকী

মিসকালা হাব্বাতিম মিন খারদালিম মিনাল ইমান | মাহমুদ সিদ্দিকী

সংকলন টিম

1 comment

Haris Rehman December 6, 2020 at 12:44 pm

দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ইতিহাসের তেমন কিছুই উল্লেখ করা হয়নি যেটা শরীফ সাহেবের মূল পোস্টে ছিল। সেকুলার ইতিহাসবেত্তারা আরবদের নৌপথে বাণিজ্যের কথা বলেন অল্পবিস্তর, তাতেই ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনেই, মালয়েশিয়ার ইতিহাসের কভারেজ হয়ে যায়। কিন্তু আপনি যেহেতু আলিম ব্যবসায়ীদের ইতিহাস লিখছেন, ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোতে যেসব আলিম পৌঁছেছেন তাঁদের ব্যাপারে আরো তথ্যের উপস্থাপনা দরকার সর্বজনীনতার অংশ হিসেবে। আমি ইসলামের ভৌগোলিক সর্বজনীনতা নিয়ে একটা সময় সংশয়ে ভুগতাম। এর একটা কারণ ছিল অধিকাংশ ইতিহাসে আরব, পারস্য আর ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরের ইসলামের ইতিহাসের প্রাধান্য থাকে না। এখানে তার ব্যতিক্রম আশা করেছি।

Reply

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!