সংকলন
ইতিহাস ইমরান রাইহান

ক্রুসেডে আলেমদের ভূমিকা (পর্ব-১) | ইমরান রাইহান

৪৯০ হিজরী। ১০৯৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাস।

এন্টিয়ক অবরোধ করেছে ক্রুসেডাররা। আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহর (রা) হাতে বিজিত এই শহরের পতন ঘটাতে তারা দৃঢ়-সংকল্প। তারা অবরোধ বসিয়েছে শহরের উত্তর ও পশ্চিম প্রান্তে। পূর্ব ও দক্ষিন দিকে অবরোধের উপায় নেই। ওদিকে রয়েছে সুউচ্চ পর্বতমালা। প্রাকৃতিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কাজ করছে তা।
ক্রুসেডাররা শহর অবরোধ করতেই অর্থোডক্স খ্রিস্টান ও আর্মেনিয়ানরা আস্তিনের সাপ হয়ে ছোবল মারে মুসলমানদেরকে। তারা ক্রুসেডারদের কাছে শহরের যাবতীয় সামরিক তথ্য সরবরাহ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ক্রুসেডাররা যেন মুসলমানদের সকল তথ্য জেনে যায় এবং শহর জয় করা তাদের জন্য সহজ হয়। তাদের এমন আচরণই ছিল স্বাভাবিক। কারণ, কোরআনের নির্দেশনা,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَتَّخِذُواْ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاء بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاء بَعْضٍ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللّهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ

হে মুমিণগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না। [ সুরা মায়েদা ৫:৫১ ]

টানা কয়েক মাস এই অবরোধ চলতে থাকে। ১০৯৮ সালের ৩ জুন পতন ঘটে এন্টিয়কের। এই পতনের পেছনেও লুকিয়ে আছে ফিরোজ নামে এক আর্মেনিয়ান খ্রিস্টানের বিশ্বাসঘাতকার গল্প। সে জায়গীরের লোভে ক্রুসেডারদের জন্য নগরীর কয়েকটি দ্বার খুলে দিয়েছিল। ক্রুসেডাররা শহরে প্রবেশ করতেই শুরু করে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। নারী ও শিশুদেরকেও তারা ছাড় দেয়নি। ঐতিহাসিক ইবনুল কলানিসির ভাষ্যে, সেদিন তরবারী নেমে এসেছিল জিহাদ ও দ্বীন রক্ষায় আগ্রহী স্বেচ্ছাসেবক ও মুজাহিদদের উপর।(১)

ঐতিহাসিক ইবনুল আদিমও এই হত্যাযজ্ঞের বিবরণ দিয়েছেন।
ইবনুল কলানিসির বক্তব্যে নজর দেয়া যাক। তার কথা থেকে পরিষ্কার সে সময় শহরবাসী অনেকের মধ্যেই জিহাদের প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত ছিল। জিহাদের ময়দানে তারা নেমেছিল স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। মূলত এটি ছিল আলেমদের অবদান। আলেমরা জনগনের মাঝে আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারের কাজ অব্যাহত রেখেছিলেন। তাদেরকে বহিশত্রু সম্পর্কে সচেতন করেছিলেন এবং করনীয় বাতলে দিয়েছিলেন। ফলে শরহবাসীর মনে জাগ্রত হয় দ্বীনি চেতনা এবং নিজেদের কর্তব্য পালনে তারা সচেষ্ট হয়ে উঠে।

এন্টিয়কের পর ক্রুসেডাররা এগিয়ে যায় বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে। শহরের প্রাচীরের গায়ে বসানো হয় সীজ ইঞ্জিন। সময়য় নষ্ট না করে ক্রুসেডাররা একটানা গোলাবর্ষণ করতে থাকে প্রাচীর লক্ষ্য করে। এ সময়য় বাইতুল মুকাদ্দাস ছিল মিসরের উবাইদি সাম্রাজ্যের অধীনে। এখানকার গভর্নর ছিলেন উবাইদি প্রশাসক ইফতেখারুদ্দৌলা। অবরোধের শেষদিকে তিনি তার সাথিদের নিয়ে আশ্রয় নিলেন দাউদের মিহরাবে। শহরের পতন ঘটলে বের হয়ে এলেন তিনি এবং নিরাপদে রওনা হলেন আসকালানের পথে। পুরো শহরে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়া ক্রুসেডাররা রহস্যজনকভাবে ইফতেখারুদ্দৌলাকে কিছুই বলেনি। সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে, নিজের নিরাপত্তার বিনিময়ে বাইতুল মুকাদ্দাস ক্রুসেডারদের হাতে তুলে দেয়ার চুক্তি করেছিল ইফতেখারুদ্দৌলা।

ক্রুসেডাররা শহরে প্রবেশ করে চালায় নির্মম হত্যকান্ড। ঐতিহাসিক ইবনুল আসিরের ভাষায়, উবাইদি সামরিক রেজিমেন্ট ছাড়া বাকি সবাই সেদিন হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিল। (২) হত্যা করা হয়েছিল নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, কিশোর সবাইকেই। বাদ যায়নি শহরের সম্ভ্রান্ত কেউ কিংবা কোনো আলেম। ক্রুসেডারদের হাতে নিহত হন শহরের কাজি আবুল কাসিম মাক্কি বিন আবদুস সালাম বিন হুসাইন আল আনসারি আশ শাফেয়ী। একজন আলেম হিসেবে মিসর ও সিরিয়াতেও তার খ্যাতি ছিল। অনেক সময় এসব অঞ্চল থেকে তার কাছে ফতোয়া জিজ্ঞেস করা হত। এন্টিয়ক ফটকের সামনে পাথর নিক্ষেপ করে তাকে হত্যা করে ক্রুসেডাররা।(৩)

শায়খ আবুল কাসেম আবদুল জাব্বার বিন আহমাদ ছিলেন বাইতুল মুকাদ্দাসের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের একজন। ক্রুসেডাররা শহর অবরোধ করলে তিনি হাতে অস্ত্র তুলে নেন। ক্রুসেডারদের সাথে লড়াই করে তিনি শহীদ হন।

বাইতুল মুকাদ্দাসের পতন ঘটলো নির্মমভাবে। রক্ত ও বারুদের গন্ধে ভারী হয়ে উঠে শহরের বাতাস। নিহতদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ পড়ে রইলো পবিত্র শহরের অলিগলিতে। রক্ত ও লাশের মধ্যে মাথা উঁচু করে রইলো ডোম অব রকের সোনালী গম্বুজ। হিংস ক্রুসেডাররা ততক্ষনে খুলে ফেলেছে এর মূল্যবান ঝাড়বাতিগুলো। ইসলামি নিদর্শনগুলোর উপর উপর্যুপরি আঘাত হানলো ক্রুসেডাররা, বাইতুল মুকাদ্দাসে সেদিন ধ্বংসই হয়ে উঠেছিল একমাত্র সত্য।

দামেশকের কাজি যাইনুদ্দিন আবু সাদ হারাবির কানে এলো বাইতুল মুকাদ্দাসের পতন ও ক্রুসেডারদের নির্মমতার বিবরণ। ব্যথিত হলেন তিনি। উম্মাহর জন্য বিচলিত হলো তার অন্তর। সে বছর রমজানে তিনি রওনা হন বাগদাদের উদ্দেশ্যে। আব্বাসি খলিফা আল মুস্তাযহির বিল্লাহ ও সেলজুক সুলতান বারকিয়ারুক বিন মালিকশাহর সাথে সাক্ষাত করেন তিনি। তাদেরকে শোনান বাইতুল মুকাদ্দাসে কী ঘটেছে মুসলমানদের সাথে। পরের শুক্রবার বাগদাদের জামে মসজিদে কাজি যাইনুদ্দিন আবু সাদ বক্তব্য রাখেন সাধারণ মানুষের সামনে। আবেগজড়িত কন্ঠে তিনি শোনান, বাইতুল মুকাদ্দাসের পতনের কথা। তার কন্ঠ কাঁপছিল। কখনো কখনো আবেগের আতিশয্যে তিনি চিৎকার করছিলেন। কাজি সাহেব শোকের কবিতা আবৃত্তি করছিলেন তার কথার মাঝে। জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলোয় দেখা গেল মসজিদে উপস্থিত লোকজনের গাল ভিজে গেছে অশ্রুতে। তাদের চেহারায় চিকচিক করছে অশ্রুকনা। (৪)

আব্বাসি খলিফা নিজেও কাজি সাহেবের বক্তব্যে প্রভাবিত হন। তিনি তখনই আলেমদের একটি প্রতিনিধিদল প্রস্তুত করেন। এই প্রতিনিধিদলকে বিভিন্ন এলাকার মুসলিম শাসকদের কাছে পাঠানো হয় তাদেরকে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য। এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন বাগদাদের কাজিউল কুজাত আবুল ওয়াফা বিন আকিল হাম্বলি। (৫)

(চলবে, ইনশাআল্লাহ)

সুত্র
——————-
১। যাইলু তারিখি দিমাশক, ১৩৬
২। আল কামিল ফিত তারিখ, ৯/১৯
৩। তবাকাতুশ শাফিয়িয়্যাতিল কুবরা, ৫/৩৩২
৪। আল মুখতাসার ফি আখবারিল বাশার, ২/২২১
৫। প্রাগুক্ত, ২/২২২

Facebook Comments

Related posts

লাল ফৌজের আতঙ্ক | আহমাদ উসমান

সমকালীন জনজীবনে সালাফদের প্রভাব: পর্ব -২ | ইমরান রাইহান

সংকলন টিম

সমরকন্দ বিজেতা কুতাইবা বিন মুসলিম | ইমরান রাইহান

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!