সংকলন
খোরাসান-বিজেতা
ইতিহাস মাহদি হাসান

খোরাসান বিজেতা আব্দুল্লাহ ইবনু আমের ইবনু কুরাইজ (রাঃ) | মাহদি হাসান

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের পর কেটে গেছে চারটি বছর। সে বছর মক্কার বনু শামস গোত্রে আমের ইবনু কুরাইজ আল-আবশামির ঘরে জন্ম নিল শুভ্র সুন্দর এক শিশু। তিন বছর পর সপ্তম হিজরীতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় এলেন উমরাতুল কাজার উদ্দেশ্যে। সেদিনের সেই ছোট্ট শিশুর বয়স এখন তিন। গুটিগুটি পায়ে হাঁটতে শিখেছে সবে। তাঁকে নিয়ে আসা হলো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে। রাসুল তাঁকে দেখে বনু শামসকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এ তো দেখছি আমারই মতো। তোমাদের চেয়ে আমার সাথে এর সাদৃশ্যতা বেশি। এরপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিশুটির মুখে তাহনিক করলেন। ছোট্ট শিশুটি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বরকতময় লালা গিলতে শুরু করল। রাসুল তা দেখে তাঁকে দোয়া করলেন। বললেন, আশা করি আল্লাহ তায়ালা তাঁকে পানি থেকে বঞ্চিত করবেন না। এরপর সেই ছোট্ট শিশুটি যেখানেই গিয়েছে সেখানেই সে পেয়েছে পানির সন্ধান। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দোয়া কখনো বিফল হতে পারে না। (তবাকাতু ইবনি সাদ, আল-ইসাবাহ-ইবনু হাজর আসকালানি)

সেদিনের সেই ছোট্ট শিশুটির নাম আবদুল্লাহ ইবনু আমের ইবনু কুরাইজ। উসমান রা.এর মামাতো ভাই। অল্প কয়েক বছর পরেই সেই ছোট্ট শিশুটিকে দেখা যাবে বসরার গভর্নর পদে। যার হাত ধরে বিজিত হবে সমগ্র খোরাসান (আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান)। যার পদতলে লুটাবে পারস্য, সিজিস্তান। তাঁর হাতেই হবে পারস্যের কিসরার মুন্ডুপাত। আরাফার ময়দানে হাজীদের তেষ্টা মেটাতে তাঁকেই দেখা যাবে প্রথম হাউজ খনন করতে এবং তাতে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা নিতে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই তো তাঁকে দোয়া করে বলেছিলেন, সে কখনো পানি থেকে বঞ্চিত হবে না। তাঁর মাধ্যমে লোকেরা পাবে পানির ক্ষেত্র।

২৯ হিজরি। চলছে উসমান ইবনু আফফান রা.এর খেলাফত। ইসলামি সাম্রাজ্যের সীমানা হয়েছে বিস্তৃত। রোমকদের কাছ থেকে সিরীয় অঞ্চল অধিকৃত হয়েছিল ওমর রা.এর খেলাফতকালেই। বিস্তৃত হয়েছে সুদূর ইউরোপ এবং আফ্রিকা পর্যন্তও। পারস্যের কিছু অঞ্চলও এসেছে মুসলমানদের করতলে। তবে মধ্য এশীয় অঞ্চলে তখনো ইসলাম ছড়াতে শুরু করেনি। এমনই সময়ে উসমান রা.আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনু কুরাইজকে বসরা এবং পারস্যের বিজিত অঞ্চলসমূহের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করেন। অতঃপর তিনি রওয়ানা হন শামের দিকে। সেখানে অবস্থান করছেন মুয়াবিয়া রা.। মুয়াবিয়া রা.এর কাছে গেলে তিনি আবদুল্লাহ ইবনু আমের রা.এর সাথে নিজ মেয়ে হিন্দার বিবাহ সম্পন্ন করেন। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, তারিখে তবারি)

কাদিসিয়ার যুদ্ধে বিশাল পরাজয়ের পর পারসিকরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে ইয়াজদগরিদ বিন শাহরিয়ার বিন কিসরার হাত ধরে। এমনই সময়ে তাদের মাঝে দুঃস্বপ্ন হয়ে আসেন আবদুল্লাহ ইবনু আমের ইবনু কুরাইজ রা.। প্রথমেই তিনি জয় করে নেন পারস্যের এস্তেখার শহর। এ শহরে মুসলিম বাহিনী এবং পারসিকদের মধ্যে হয় তুমুল লড়াই। নিহত হন অন্যতম সেনাপতি আবদুল্লাহ ইবনু মামার রা.এর মতো সাহাবি। (সিয়ার) অতঃপর তিনি আরেক সাহাবি আবদুর রহমান ইবনু সামুরা রা.কে পাঠিয়ে দেন সিজিস্তান অভিমুখে।(১) তিনি সন্ধিচুক্তির মাধ্যমে সে অঞ্চল বিজিত করে নেন। অতঃপর তিনি জয় করে নেন হেলমান্দের দাওয়ার নামক অঞ্চল। (তবাকাতু ইবনি সাদ)

এবার আবদুল্লাহ ইবনু আমের রা.এর মনোযোগ নিবদ্ধ হয় খোরাসানের প্রতি। তাঁকে বলা হয় কিসরার বংশধর ইয়াজদগরিদ এবং তার সৈন্যরা সেখানেই অবস্থান করছে। নাহাওয়ান্দের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর তারা নিজেদের খাজানা বহন করে নিয়ে গেছে সেখানে। ইবনু আমের রা.অনুমতি চেয়ে চিঠি পাঠান উসমান রা.এর কাছে। উসমান রা.তাঁকে অভিযান পরিচালনার অনুমতি প্রদান করেন। অনুমতি পেয়ে তিনি সেনাবাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়েন এস্তেখারের পথ ধরে। অতঃপর পথিমধ্যে জয় করে নেন নিশাপুর এবং ইস্পাহানের মধ্যবর্তী তাবাস শহর। এবার তাঁর গন্তব্য মারভের (২) উদ্দেশ্যে। এরপর তিনি প্রেরণ করেন আরও কিছু অভিযান। একের পর বিজিত হয় বাদগিস, সারাখস, নিশাপুর, তুস এবং আরও কিছু শহর। এভাবে বিজিত হয়ে যায় প্রায় পুরো খোরাসান অঞ্চল। বর্তমান আফগানিস্তানের সিংহভাগ অঞ্চল চলে যায় মুসলিমদের দখলে। এরপর নিশাপুর থেকে তিনি শুকরিয়া জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে হজের উদ্দেশ্যে ইহরাম বেঁধে মক্কা অভিমুখে সফর করেন। হজ শেষে তিনি পুনরায় খোরাসানে ফিরে এসে জয় করে নেন কাবুল এবং যাবুলিস্তান। এভাবে খোরাসান তথা আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং পারস্য অঞ্চল সম্পূর্ণরূপে মুসলিম বাহিনীর হাতে বিজিত হয়ে যায়। এই বিজয়যাত্রায় সেনাপতি আহনাফ ইবনু কায়েস রা. প্রমুখগণের ছিল অগ্রগন্য অবদান। (তবাকাত, ৪/৩১)

আবদুল্লাহ ইবনু আমের রা.উসমান রা.এর শাহাদাত পর্যন্ত বসরা এবং পারস্যের প্রশাসক পদে বহাল ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন উদার মনের ব্যক্তি। ইসলামি ইতিহাসের বিজেতাগণের মধ্যে তাঁকে অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়। বিজয়যাত্রার পাশাপাশি শাসিত অঞ্চলের উন্নয়নেও তিনি কোনো কমতি করেননি। বসরার খাল তিনিই খনন করিয়েছিলেন। আরাফার ময়দানে হাজিদের জন্য তিনিই হাউজ খনন করেছিলেন এবং খাল খনন করে হাউজের সাথে সংযুক্ত করেছিলেন। উসমান রা.এর মৃত্যু সংবাদ শুনে তিনি মক্কায় চলে আসেন। এখানে এসে তিনি তালহা, যুবায়ের এবং আয়েশা রা.এর সাথে সংযুক্ত হোন। তাঁরা তখন শামের উদ্দেশ্যে সফর করছিলেন। তিনি তাদেরকে বলেন বসরার উদ্দেশ্যে সফর করতে। সেখানে রয়েছে তাঁর অবদান এবং জনবল। তাদের সাথে তিনি জঙ্গে জামালে শরীক হয়েছিলেন। এ যুদ্ধের পর তিনি দামেস্কে চলে যান এবং সেখানেই অবস্থান করেন। মুয়াবিয়া রা.এর খেলাফতের সময়ে তিনি পুনরায় বসরার প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হন। তিন বছর প্রশাসক থাকার পর মুয়াবিয়া রা.তাঁকে অব্যহতি দেন। অতঃপর সাতান্ন মতান্তরে আটান্না হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

তাঁকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করায় শিয়ারা উসমান রা.এর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনেছিল। প্রকৃতপক্ষেই আবদুল্লাহ ইবনু আমের রা.ছিলেন এ পদের জন্য যোগ্য। একজন প্রশাসক হিসেবে আবদুল্লাহ ইবনু আমের রা.এর সামরিক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবদান কিছুতেই কম নয়।

(১) বিলুপ্ত ঐতিহাসিক অঞ্চল। এর অধিকাংশ আফগানিস্তানে, কিছু অংশ পাকিস্তান এবং ইরানে।
(২) বর্তমান তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশখাবাদ। মারভ নামে পূর্বে পাশাপাশি দুটি শহর ছিল।

Facebook Comments

Related posts

কারবালা ও ইয়াযিদ : বহুল প্রচলিত কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর | ইমরান রাইহান

ফিতনার উপলব্ধিঃ প্রথম পর্ব । আবদুল্লাহ বিন বশির

সাহাবায়ে কেরাম কি বিজিত এলাকার মূর্তি অক্ষত রেখেছিলেন? | ইমরান রাইহান

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!