সংকলন
সুলতান সুলেমান
ইমরান রাইহান জীবনী লেখক

সুলতান সুলেমান | ইমরান রাইহান

তিনটি মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল তাঁর সাম্রাজ্য। তিনি শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন ৪৬ বছর। এই সময়ের মধ্যে ১০ বছরই কেটেছে বিভিন্ন যুদ্ধে। তিনি স্বশরীরে অংশ নিয়েছেন ১৩ টি যুদ্ধে, অতিক্রম করেছিলেন ৪৮ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব, যেখানে পৃথিবীর পরিধিই মাত্র ৪০ হাজার কিলোমিটার। তিনি ছিলেন সর্বকালের সেরা সম্রাটদের একজন। তাঁর পিতা যে সাম্রাজ্য রেখে যান তাঁর পরিধি ছিল ৬৫ লক্ষ সাতান্ন হাজার কিলোমিটার। তিনি এই সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করেছিলেন ১ কোটি ৪৮ লক্ষ ৯৩ হাজার কিলোমিটারে।

তিনি দশম অটোমান সুলতান সোলাইমান আল কানুনি। সাধারণত তিনি সুলতান সুলেমান নামেই পরিচিত। পাশ্চাত্য তাকে নাম দিয়েছে সোলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট। সুলতান সুলেমানের জন্ম ৬ নভেম্বর ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে, কৃষ্ণ সাগর বরাবর ট্রেবিজোন্ড শহরে। তাঁর পিতা সুলতান প্রথম সেলিম, যিনি মিসরে মামলুক সাম্রাজ্যের পতন ঘটয়ে মিসরকে অটোমান সাম্রজায়ের অন্তর্ভুক্ত করেন। মা আস্যাহ হাফসা সুলতানা ছিলেন ধর্মান্তরিত মুসলমান।

সুলেমান বেড়ে উঠেছিলেন আর দশজন তুর্কি শাহজাদার মতই। ৭ বছর বয়সে তাকে তোপকাপি প্রাসাদের স্কুলে পাঠানো হয়। এখানে তিনি বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব ও সামরিক কৌশল বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ১৫ বছর বয়সে দাদা সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ তাকে কারাহিসার শহরের গভর্নর (সানজাক বে) নিয়োগ দেন। কিন্তু চাচা শাহজাদা আহমদের বিরোধিতার কারণে তাঁর এই নিয়োগ বাতিল করে তাকে ক্রিমিয়ার থিউডসিয়াতে পাঠানো হয়। এখানে তিনি তিন বছর অবস্থান করেন।

১৫২০ খ্রিস্টাব্দের ২২ সেপ্টেম্বর কোর্লুতে সেনাশিবিরের সুলতান প্রথম সেলিম ইন্তেকাল করেন। শাহজাদা সোলাইমান তখন ম্যাগনিসায় অবস্থান করছিলেন।  উজিরে আজম পিরি পাশা সুলতানের মৃত্যুসংবাদ গোপন রেখে শাহাজাদার কাছে পত্র লিখে দ্রতু তাকে রাজধানীতে ফেরার আদেশ দেন। পিরি পাশার আশা ছিল তিনি ৭ দিন সুলতানের মৃত্যুসংবাদ গোপন রাখতে পারবেন। তাঁর আশঙ্কা ছিল সুলতানের মৃত্যুসংবাদ জেনে গেলে জেনিসারিরা বিদ্রোহ করে বসবে, যাদের দমন করা তরুণ শাহজাদার জন্য কঠিন হবে। পিরি পাশার কঠোর সতর্কতা সত্ত্বেও ৫ দিন পর সুলতানের মৃত্যুসংবাদ জানাজানি হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে পিরি পাশা স্বীকার করেন সুলতান ইন্তেকাল করেছেন। তবে জেনিসারিরা কোনো গোলযোগ পাকায়নি। তারা শোক প্রকাশ করছিল বুক চাপড়ে।

৩০ সেপ্টেম্বর সোলেমান বসফরাস প্রণালীর এশীয় উপকূল উস্কুদারে এসে পৌছেন। এখানে উজিরে আজম পিরি পাশা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পরদিন ভোরে আলেম-উলামা ও গন্যমান্য ব্যক্তিরা দিওয়ান তথা কাউন্সিল কক্ষে সোলেমানকে স্বাগত জানান। সোলেমানের আর কোনো ভাই জীবিত ছিল না। ফলে শাসনক্ষমতার জন্য তাকে বিশেষ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি। শাইখুল ইসলাম তাঁর হাত ধরে তাকে একটি মঞ্চে নিয়ে আসেন এবং উচ্চস্বরে ঘোষণা করেন, মহান আল্লাহ তাকে উসমান বংশের সুলতান হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। তারপর তিনি সুলতানের কোমরে ঐতিহ্যবাহী তরবারী বেধে দেন। এ সময় সুলেমানের বয়স ছিল ২৬ বছর।

এর কয়েকদিন পর ভেনিসীয় দূত বার্টলমিউ কন্টারিনি সুলতানের সাথে দেখা করেন। তাঁর বর্ননামতে, সুলতানের দেহ ছিল লম্বা ও সরু। মুখের গড়ন ছিপছিপে । ভ্রু ছিল ঘন। তাকে দেখতে বন্ধুবতসল্মনে হত।

দিনের শুরু দেখে অনেকসময় বোঝা যায় দিনের শেষটি কেমন হবে ।

সুলতান সুলেমান সিং হাসনে আরোহনের কয়েকদিন পর সভাসদদের নিয়ে বসলেন। হলঘরের মাঝামাঝি একটি বড় মানচিত্র বিছানো ছিল।

‘আপনাদের কি ধারণা আছে এই মানচিত্র এখানে এনেছি কেন?’ সুলতান জিজ্ঞেস করলেন।

সভাসদরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারা নীরব থাকে।

‘এই মানচিত্র দেখে সিদ্ধান্ত নিতে চাই আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে? আমাদের সাম্রাজ্য শুধু বলকানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বেলগ্রেড, রোম, বুদাপেস্ট ও ভিয়েনায় আমাদের তরবারি ঝলসে উঠবে। আমাদের আঘাতে পরাস্ত হবে ইউরোপিয়ানরা। আমরা পাড়ি দেবো কাস্পিয়ান সাগর। আমরা পাড়ি দিব ভূমধ্যসাগর। রোমান সম্রাট চার্লস, ফ্রান্সের রাজা ফ্রান্সিস, হেনরি ট্রোডরকে আমরা শায়েস্তা করবো। ভূমধ্যসাগর থাকবে আমাদের দখলে। আমাদের অনুমতি ছাড়া কোনো জাহাজ পাল তুলবে না, কোনো জাহাজ নোঙ্গর ফেলবে না’ হলঘরে গমগম করে উঠে সুলতানের কন্ঠ।

সুলতান সুলেমান তাঁর ক্ষমতা আরোহনের শুরুতেই নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ করে নিয়েছিলেন। সভাসদদের স্পষ্টকন্ঠে তা জানিয়েছেনও। তাঁর সামনে দ্রুতই রাজ্যজয়ের সুযোগ এসে যায় যখন হাঙ্গেরিয়াতে রাজস্ব সংগ্রহে নিয়োজিত অটোমান কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। এই হত্যা সুলতান সুলেমানকে রাগানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন হাংগেরিতে অভিযান চালাবেন। ১৫২০ খ্রিস্টাব্দের পুরো শীতকাল কনস্টান্টিনোপলে চলছিল যুদ্ধের মহড়া। সেনাবাহিনীর জন্য রসদ ও ঘোড়া সংগ্রহ করা হচ্ছিল। সেনাবাহিনীর যাত্রাপথে নির্মাণ করা হয় সড়ক ও সেতু। সুলতানের ইচ্ছে ছিল দানিয়ুবের প্রবেশদ্বার বেলগ্রেড। বেলগ্রেড দুর্গের পতন ঘটলে অটোমান সেনাদের জন্য ভিয়েনা ও ভিজা উপত্যকা উন্মুক্ত হয়ে যাবে।

১৫২১ খ্রিস্টাব্দের ৬ ফেব্রুয়ারী অটোমান বাহিনী কনস্টান্টিনোপল থেকে যাত্রা শুরু করে। এটি ছিল সুলতান সুলেমানের প্রথম অভিযান। অটোমান সেনারা যাত্রাকালে কঠোর শৃংখলা মেনে চলে। তারা সকল থেকে দুপুর পথ চলতো। দুপুরে তাবু খাটিয়ে বিশ্রাম। আবার পরদিন সকালে যাত্রা। অটোমান বাহিনী সাভা ও দানিয়ুবের মোহনায় পৌঁছে যায়। এখানে এসে সুলতানের আদেশে একটি দ্বীপে কামান বসানো হয়। সিদ্ধান্ত হয় এই দ্বীপ থেকেই বেলগ্রেড দুর্গে গোলা নিক্ষেপ করা হবে। টানা তিন সপ্তাহ অটোমানরা গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে।

কিন্তু কোনো ফলাফল এলো না। বেলগ্রেড দুর্গে ছিল মাত্র সাতশো সৈন্য। তাদের সহায়তায় কেউ এগিয়ে আসেনি। কিন্তু দুর্গ ছিল মজবুত ফলে তারা টিকে যাচ্ছিল। সুলতানের একরোখা মনোভাবের ফলে টানা গোলাবর্ষণ চলতে থাকে। দুর্গ প্রাচীরের নিচে বসানো হয় মাইন। অবশেষে দুর্গবাসী আত্মসমর্পন করে। বেল্গ্রেড দুর্গের অধিপতি এসে সুলতানের হাত চুম্বন করেন। তাকে সম্মানসূচক একটি আলখেল্লা পরিয়ে দেয়া হয়। সুলতানের আদেশে সেনারা শোকরানা সালাত আদায় করে।

বেলগ্রেড দুর্গের ভেতর তিনবার বেজে উঠে জেনিসারি রণসংগীত। সুলতান নিজেও দুর্গে প্রবেশ করেন। একটি গির্জায় তিনি জুমার সালাত আদায় করেন। বালি আগাকে বেলগ্রেডের নতুন গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়। আবার শুরু হয় অটোমানদের বিজয়রথ। তারা সাবাক, সেমলিন ও সামানদিরা শহর জয় করে। কেটে ফেলা হয় উপকূলের বনভূমি। উন্মুক্ত হয়ে যায় মধ্য ইউরোপগামী পথ।

অটোমানদের বিজয়কাহিনী পৌঁছে যায় ইউরোপের সর্বত্র। ভেনিস ও রাশিয়ার দূতরা সুলতানকে অভিনন্দন জানান। সে সময় তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও আতংকিত ছিল। ভেনিসে নিযুক্ত অটোমান দূতকে পাচশো স্বর্নমুদ্রা উপহার দেয়া হয়। সুলতান ফিরে আসেন কনস্টান্টিনোপলে। আইউব মসজিদে তিনি শোকরানা সালাত আদায় করেন। রাস্তার দুপাশে সারীবদ্ধভাবে অপেক্ষা করছিল জনতা। সুলতানকে এক নজর দেখার জন্য তারা ছিল উৎসুক। সুলতান জয়ের আনন্দে সবার জন্য একটি ভোজের আয়োজন করেন।

হাঙ্গেরি ও অস্ট্রিয়া জয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। কিন্তু সুলতান তখনই সেদিকে মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। কারণ, তাকে বারবার বিরক্ত করছিল রোডস দ্বীপে অবস্থানরত হসপিটালার নাইটরা। তাদেরকে শায়েস্তা না করে সুলতান সামনে এগুতে চাচ্ছিলেন না। ১৫২২ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে সুলতান রওনা হলেন রোডস অভিমুখে। তাঁর সাথে ছিল এক লাখ সেনা। তিনি দ্বীপের বিপরীতপ্রান্তে অবস্থান নেন। পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া চারশো জাহাজের নৌবহর পাঠান রোডস দ্বীপ অভিমুখে।

২৬ জুন কোবান পাশার নেতৃত্বে চারশো অটোমান জাহাজ এসে রোডস দ্বীপে উপস্থিত হয়।  ২৮ জুলাই সুলতান নিজে উপস্থিত হয়ে বাহিনীর কমান্ড বুঝে নেন। অটোমানরা পোতাশ্রয় অবরোধ করে। ২৯ জুলাই থেকে শুরু হয় লাগাতার গোলাবর্ষন। গোলাবর্ষনে প্রাচীরের খুব একটা ক্ষতি হচ্ছিল না। ৪ সেপ্টেম্বর মাইন বিষ্ফোরণে প্রাচীরের প্রায় ১২ মিটার অংশ ধবসে যায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত লড়াই চলতে থাকে। অটোমানদের নেতৃত্বে ছিলেন কাসিম পাশা। নাইটদের নেতৃত্ব ছিল দ্য লায়ল এডামের হাতে।

এদিন অটোমানরা বারবার দেয়াল আঘাত হানে। তবে সব হামলা সফল হয়নি। ২৪ সেপ্টেম্বর সুলতানের নির্দেশে প্রাচীরের বিভিন্ন স্থানে জোরালো আঘাত হানা হয়। প্রচন্ড লড়াইতে প্রায় ৪৫ হাজার অটোমান সেনা নিহত হয়। সুলতান সেদিনের জন্য যুদ্ধ স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন।

অবরোধ দীর্ঘ হচ্ছিল। দুপক্ষকেই প্রচুর সেনা হারাতে হছচিল। এদিকে শহরে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে থাকে। দুপক্ষেরই মনোবল ভেঙ্গে যায়। তবু থেমে থেমে লড়াই চলতে থাকে। ২২ ডিসেম্বর নাইটরা আত্মসমর্পণ করে। সুলতান তাদেরকে দ্বীপ ত্যাগের জন্য ১২ দিন সময় বেঁধে দেন। এছাড়াও সুলতান ঘোষণা দেন, কাউকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হবে না, শিশুদেরকে দাস বানানো হবে না, কোনো গির্জাকে মসজিদে রুপান্তরিত করা হবে না, কারোসম্পদ কেড়ে নেয়া হবে না। কেউ বিদায় নিতে চাইলে তুর্কি জাহাজে করে তাকে ক্রিট দ্বিপে পৌঁছে দেয়া হবে। এমন উদার শর্ত নাইটরাও বিশ্বাস করতে পারছিল না। সুলতানের সাথে দ্য লায়ল এডামের সাক্ষাত হয়।

রোডস জয়ের পর সুলতানকে অভিনন্দন জানিয়ে ভেনিস, মক্কা ও পারস্য থেকে পত্র আসে। এমনকি মস্কো থেকেও পত্র মারফত তাকে অভিনন্দন জানানো হয়।

১৫২৩ খ্রিস্টাব্দের পহেলা জানুয়ারী নাইটরা শহর ছেড়ে বিদায় নেয়। তারা ৫০টি জাহাজে করে ক্রীটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।

রোডস বিজয়ের গুরুত্ব অপরিসীম । এই জয়ের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরে অটোমানদের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। কন্সটান্টিনোপল, শাম, ও কায়রোর বিভিন্ন বন্দরের সাথে যোগাযোগ সহজ হয়।

১৫২০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সুলেমান হাঙ্গেরি জয়ের ইচ্ছা করেছিলেন। সে লক্ষ্যে তিনি বেলগ্রেড জয় করেছিলেন। কিন্তু পরে নানা ব্যস্ততায় তিনি আর সামনে এগুতে পারেননি। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন চুড়ান্ত আঘাত হানবেন। ততদিনে সাম্রাজ্যের নানা ব্যস্ততা থেকে অবসর হয়েছেন তিনি। এক লাখ সেনা ও তিনশো কামান নিয়ে ইস্তাম্বুলের আদ্রিয়ানোপল ফটক থেকে হাঙ্গেরির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন সুলতান সুলেমান। দিনটি ছিল ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ এপ্রিল। তাঁর সাথে ছিলেন উজিরে আজম ইবরাহিম পাশা, ভগ্নিপতি মোস্তফা পাশা, আয়াজ বে ও ইউনুস বে।

অটোমান বাহিনী দ্রুত পথ চলছিল। তারা অতিক্রম করে বলকান পর্বতমালা। তারা পিটারভারাদ, ইউজলাক ও ইসজাক শহর অবরোধ করে। পন্টুন ব্রিজ দিয়ে মাত্র ৫ দিনে সাভা ও দ্রাভা নদী অতিক্রম করে। হাংগেরির রাজা দ্বীতিয় লুইয়ের অটোমানদের মোকাবেলা করার মত তেমন কোনো শক্তিই ছিল না। তিনি সর্বসাকুল্যে মাত্র ২৫/৩০ হাজার সেনা একত্র করতে পেরেছিলেন। তাঁর বাহিনী ছিল ভারী বর্মে সজ্জিত নাইটদের উপর নির্ভরশীল।

তবে অটোমান বাহিনী ছল তাদের চেয়ে আধুনিক। তাদের ছিল মাস্কেট সজ্জিত দুই হাজার জেনিসারি সেনা। ২৯ আগস্ট দুপুর তিনইটার দিকে দুই বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যুদ্ধ মাত্র ৪ ঘন্টা স্থায়ী হয়। ১৪ হাজারের বেশি হাংগেরিয়ান সেনা নিহত হয়। রাজা লুই পলায়ন করেন। ইতিহাসে এই যুদ্ধ মোহাকচের যুদ্ধ নামে প্রসিদ্ধ। সুলতান নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিলনে না এত সহজে তিনি যুদ্ধ  জয়লাভ করবেন। তিনি এটিকে শত্রু চাল মনে করে আরও কয়েকদিন যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করেন।

কিন্তু অপরপক্ষের সাড়া না পেয়ে তিনি রাজধানী বুদার দিকে যাত্রা শুরু করেন। ১০ সেপ্টম্বর সুলতান জনশূন্য বুদায় প্রবেশ করেন। দুর্গ ও এর আশেপাশের এলাকায় কয়েকটি অভিযান চালিয়ে তিনি ফিরে আসেন।

১৫২৯ ) ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ভিয়েনা দখলের জন্য দুটি অভিযান চালান। কিন্তু দুটিতেই অটোমানরা পরাজিত হয়। এ পরাজয়ের জন্য বৈরী আবহাওয়া দায়ী ছিল।

১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রিসের উত্তর-পূর্ন অংশে অটোমান নৌবহর ও খ্রিস্টান জোটের মধ্যে সং ঘঠিত হয় প্রিভেজা যুদ্ধ। পোপ তৃতীয় পলের আহবানে খ্রিস্টান নৌবহর একত্রিত হয়েছিল অটমানদের মোকাবেলা করার জন্য। প্রিভেজা যুদ্ধ ছিল ষোড়শ শতাব্দিতে ভূমধ্যসাগরে অনুষ্ঠিত বৃহৎ তিনটি যুদ্ধের একটি। এই যুদ্ধে তিনশো জাহাজের অধিকারী খ্রিস্টান জোট তাদের চেয়ে অনেক দুর্বল অটোমান নৌবহরের কাছে পরাজিত হয়। খাইরুদ্দিন বারবারোসার অসামান্য নৈপুন্যের ফলে অটোমানদের জয় নিশ্চিত হয়। এই যুদ্ধের ফলে লিপান্টোর যুদ্ধের আগ পর্যন্ত ৩৩ বছরের জন্য ভুমধ্যসাগরে অটোমানদের আধিপত্য নিশ্চিত হয়।

১৫৪১ সালে সুলতান তার বাহিনী নিয়ে হাংগেরির রাজধানী বুদা অবরোধ করেন। সুলতানের বাহিনীতে সেনাসংখ্যা ছিল ৩১ হাজার । এর মধ্যে জেনিসারি সৈন্য ছিল ৬ হাজার ৩৬২ জন। ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দের ২১ আগস্ট এই বাহিনী বুদায় পৌঁছে এবং উইলহেম ভন রোজেনডর্ফের বাহিনীর সাথে সঙ্গঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ যুদ্ধে অটোমানরা জয়ী হয়। প্রায় দেড়শো বছরের জন্য হাঙ্গেরিতে অটোমান শাসনের সূচনা হয়।

সুলতানের শেষ অভিযান ছিল হাংগেরীতে । ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ আগস্ট অটোমান বাহিনী জিগেতভার দুর্গ অবরোধ করে। যুদ্ধ যাত্রাকালে সুলতান ছিলেন গুরুতর অসুস্থ। ডাক্তার বারবার নিষেধ করছিলেন , কিন্তু সুলতান কারো কথা না শুনেই যুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় তার বয়স ছিল ৭২ বছর। দুর্গ অবরোধ করার পর অটোমান কামানগুলো একটানা গোলাবর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু কোনো ফলাফল আসছিল না।

সুলতান মানসিকভাবে কিছুটা ভেঙ্গে পড়েন। ৬ সেপ্টেম্বর সুলতান সেনাদের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেন। এই ভাষণের পর তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভাষনের পরেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। চিকিতসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে ইস্তাম্বুলে তার নির্মিত সোলাইমানিয়া মসজিদের সামনে তাকে দাফন করা হয়।

সুলতান সুলেমান ছিলেন অটোমান শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী একজন শাসক। তিনি নিয়মিত দিনলিপি লিখতেন। তার এই দিনলিপিও হয়ে উঠছে ইতিহাসের মূল্যবান উৎস। তিনি একজন কবিও ছিলেন। মুহিব্বি ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন।  তিনি নিজ হাতে কোরানুল কারিমের ৮টি কপি সংকলন করেন এবং সোলাইমানিয়া মসজিদে তা দান করেন। তিন পবিত্র কাবা শরিফ সংস্কার করেছিলেন। তার শাসনামলে অটোমান সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি পায়। জনসংখ্যা বেড়ে দেড় কোটি থেকে আড়াই কোটিতে পরিণত হয়।

আধুনিক হাংগেরির বুদাপেস্ট থেকে সৌদি আরবের মক্কা, আলজেরিয়া থেকে বাগদাদ ছিল তার রাজ্যের সীমানা। ভারত মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরে  ঘুরে বেড়াত তার নৌবহর। ১৫৪৮ সালে অটোমান নৌবহর পর্তুগিজদের সাথে লড়াই করে এডেন বন্দর উদ্ধার করে নেয়। ১৫৫২সালে তারা দখল করে মাস্কাট।  তিনি তিনবার ইরানের শিয়া পরিচালিত সাফাবি সাম্রাজ্যে আক্রমন করেছিলেন।

সুলতান সুলেমানের মৃত্যুর পর অটোমানদের মধ্যে এমন শক্তিশালী শাসক আর দেখা যায়নি। দিনদিন তাদের দূর্বলতা স্পষ্ট হতে থাকে। ক্রমশ এই সাম্রাজ্য দূর্বল হতে থাকে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে এর চুড়ান্ত পতন ঘটে।

উসমানিয়রা এখন ইতিহাসের অংশ। বসফরাসের পাড়ে কান পাতলে এখনো শোনা যায় তাদের বিজয়গাঁথা।

Facebook Comments

Related posts

নেকীর বৃক্ষটির পরিচর্যা নিন | মাহদি হাসান

সংকলন টিম

থানভীর পরশে-৬ | ইমরান রাইহান

সংকলন টিম

সুবাস জড়ানো অলিন্দে-৩ | আহমাদ সাব্বির

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: