সংকলন
নাজমুস সাকিব
প্রতিযোগিতা-২

নীড়ে ফেরার গল্প-৩৩ | নাজমুস সাকিব

প্রত্যাবর্তন, এই শব্দটা অনেকের অভিধানের সবচেয়ে মূল্যবান শব্দ। এই একটি শব্দে মিশে আছে অনেকের হার না মানা প্রচেষ্টা, নিরন্তর সাধনা, নফসের বিরুদ্ধে নির্মোহ জিহাদ। মিশে আছে কত রাতজাগা ইবাদত, নিভৃতে ফেলা চোখের পানি।

হেদায়েত এত সহজে ধরা দেয়না। সেদিক দিয়ে ভাবলে আমার হেদায়াতের গল্প লেখা খানিকটা হিপোক্রেসিই বটে। সবেমাত্র আলোর দেখা পেয়েছি, জানিনা সামনে কত ঘোর অমানিশা ঘিরে ধরবে আর ঈমান নিয়ে তা পাড়ি দিতে পারব কিনা। তবুও আমার উসিলায় যদি কারো কপালে আল্লাহ হেদায়েত লিখে থাকেন সেই আশা নিয়ে লিখতেছি।

Tijarah Shop

শুরুটা সেই ছোট্ট আমিকে দিয়েই, বাবার কোলে বসে কোরআন শিখি। বাবা-মায়ের ইচ্ছাতে ভর্তি হই মাদ্রাসায়। ছোট থেকেই আমি ছিলাম অন্তর্মুখী স্বভাবের। একদিক দিয়ে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তাও ছিলোনা। যে বয়সে সমবয়সীদের নামে পাড়ার লোকে নালিশ করত, আমার বাবা-মায়ের আমাকে নিয়ে সে দুশ্চিন্তা করা লাগেনি।

৮ম শ্রেণী পর্যন্ত একরকম মায়ের আঁচলের তলায় থেকেই মাদ্রাসার শিক্ষাটা শেষ করলাম।ততদিনে ইসলামের বেসিক বিষয়গুলো জানা হয়েছিলো। এটুক বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ছোট থেকে আমি নীড়েই ছিলাম বলা যায়।

মায়ের স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্য নিয়ে মাদ্রাসা থেকে স্কুলে ভর্তি হই নবম শ্রেণীতে। স্কুলে ভর্তি হলেও তার প্রভাব আমার উপর খুব একটা পড়েনি, ওই যে অন্তর্মুখী স্বভাব।

জীবনের সোনালী সময়টা পার করে ইন্টারে ওঠার পরে প্রথম হাতে আসে স্মার্টফোন, আমার নষ্ট হওয়াও শুরু হয়। অন্ধকারের গহীনে হারিয়ে যেতে থাকি ক্রমশঃ। নিজের স্বকীয়তাকে হারিয়ে গাঁ ভাসিয়ে দিই আধুনিকতার স্রোতে..সাঁতরে বেড়াই পাপে পূর্ণ এক কলুষিত নদীতে।

ধীরে ধীরে নামাজের প্রতি বাড়তে থাকে অবহেলা। তবে একটা ইতিবাচক দিক ছিলো নামাজ একদমই ছেড়ে দেইনি কখনো। অনুশোচনা বোধটুকু হারাইনি। পাপবোধ সবসময়ই তাড়িয়ে বেড়াতো..

কিন্তু দুনিয়ার সাফল্যের নেশা আখিরাতকে ফ্যাকাশে করে দিচ্ছিলো। ঠিক যেন কুরআনের ঐ আয়াতের মত, আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়াকে কিনে নিচ্ছিলাম।

অন্ধকারের পথচারী হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় নিয়ামক ছিলো বন্ধু-বান্ধব। যেই সময়টা স্রষ্টার মাহাত্ম্য খুঁজে, ইবাদত করে, পড়াশোনা করে ব্যয় করার কথা ছিলো। সে সময়ে আমার বয়সী ছেলে-মেয়ে গুলো অতিবাহিত করছিলো অনলাইন গেম খেলে, হারাম রিলেশনে জড়িয়ে। তাদের সংস্পর্শে আমিও যেন ভুলেই বসেছিলাম
রাসূলুল্লাহর বিখ্যাত হাদিসটি,
“সাত শ্রেণির মানুষকে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাঁর (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ হলো সে সব যুবক-যুবতি; যারা তার রবের ইবাদতের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে।” (সহীহ বুখারি)

সেক্যুলার সমাজ আমাদেরকে শিখিয়েছে দাঁড়ি-টুপি মানে আনস্মার্টনেস। নামমাত্র মুসলিম হয়ে পার্থিব ভোগ-বিলাস, প্রবৃত্তির পেছনে ছোটায় কোন দোষ নেই, বরং সবাই তো তাই করে। এমন মন্ত্রই গেঁথে দিয়েছিলো মস্তিষ্কে।

মাঝে একটা বছর হারিয়েছি এডমিশন টেস্টে, দুনিয়ার সাফল্য ধরতে গিয়ে।
চান্স পেলাম একটা পাবলিক ভার্সিটিতে, বাসা থেকে অনেক দূরে। পরিবারের সাথে থাকায় আগে যেটুকু নিয়ন্ত্রণ ছিলো সেটুকুও আর থাকলো না। মুক্ত হয়ে দিগ্বিদিক ডানা ঝাপটাতে লাগলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখলাম ফ্রি মিক্সিং, আড্ডা এ যেন এক অন্য পরিবেশ। রঙিন দুনিয়া, অথচ বুঝিনি এই দুনিয়ার আসল রঙ ছিলো কালো।
ভার্সিটির ক্যাম্পাসে এসে অসৎ সঙ্গে সর্বনাশের পথটা যেন আরও উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছিলো। আলোর রেখা আমার জন্য ক্ষীণ হয়ে আসছিলো।

কিন্তু মনের মাঝে ইসলামের প্রতি খানিকটা আবেগ রয়ে গিয়েছিলো। তবে তার কার্যকারীতা ছিলোনা বললেই চলে।
বাকী সবার মত আমিও মডারেট ভাবে লাইফ লিড করছিলাম।
বাসায় আসলে বাবা-মায়ের কথায় নামাজটা হয়ত পড়তাম কিন্তু ইবাদতে মন ছিলোনা একদম।

হারাম কখনো মানুষকে প্রশান্তি দেয় না, আমাকেও দেয়নি। মহামারি শুরু হলে, ভার্সিটি বন্ধে বাসায় আসার পর আমার অর্ধমৃত জীবনে বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম। প্রচন্ড হতাশ হয়ে পড়লাম। ডিপ্রেশন যেন শাখা-প্রশাখা মেলে আমাকে জাপ্টে ধরল।

একটা পর্যায়ে নিরুপায় হয়ে স্রষ্টার কাছে উত্তরণের উপায় চাইতে লাগলাম। ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়া শুরু করলাম, কোরআন পড়তে শুরু করলাম। প্রার্থনা করতে থাকলাম..
আল্লাহ তো তার বান্দার চোখের পানি উপেক্ষা করতে পারেন না, করেনও নি।
তিনিই তো বলেছেন,
“হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [ সুরা যুমার ৩৯:৫৩ ]

এখানে আমার বাবার কথা না বললেই নয়। জীবন নিয়ে যখন হতাশায় নিমজ্জিত ছিলাম একইসাথে থাকার পরেও খুব দরকার ছাড়া বাবা-মায়ের সাথে কথা বলতাম না। বাবার সাথে তো একদমই বলতাম না, আব্বু কষ্ট পেত তবুও আমাকে নিয়ে আশাহত হয়নি।
আমার নামাজটা যেন মিস না হয় এজন্য আমাকে নিয়ে নামাজ পড়ত। আমিও খোলস ছেড়ে বের হতে থাকলাম। যেই ছেলে তার সাথে দরকার ছাড়া কথা বলেনা, সেই আমিই কিনা তার সাথে দেশ কিংবা দ্বীন নিয়ে বিভিন্ন আলাপ করা শুরু করলাম।

মায়ের কাছে সমস্যার কথাগুলা খুলে বললাম। আমার পাপের কথা শুনেও রাগ করলেন না, সাহস দিলেন। আমার জন্য দোয়া করলেন..

ঘরে বসে থাকায় অনলাইনে এক্টিভ থাকার সময়টা বাড়লো। অনলাইনে বেশ কিছু দ্বীনী ভাইকে ফলো করা শুরু করলাম। তাদের লেখা পড়ে নিজের মাঝে আরো ভাবান্তর হলো। অবাক হলাম জেনারেল লাইনে পড়েও তারা উম্মাহকে কত সাবলীলভাবপ দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছে।
তাদের দেখে আমারও ইচ্ছা হলো দ্বীনের খেদমতে জীবনটা উৎসর্গ করব। লিখেই হোক বা অন্যভাবে, বাতিলের মোহে পড়ে হক কে যেন ভুলতে না হয় তার জন্য দাওয়াত দিয়ে যাব ইনশাআল্লাহ।

এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দেয়া বাকি। এই পাড়ি দিতে গিয়ে যেন হোঁচট না খাই এবং জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত যেন ঈমান ও আমলের উপর অটুট থাকতে পারি সেই দোয়ার আরজি রেখে শেষ করছি। ফি আমানিল্লাহ্..

Facebook Comments

Related posts

নীড়ে ফেরার গল্প-৮ | উম্মে যুহাইর

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প -১৭ | মুক্তা থেকে মারইয়াম

সংকলন টিম

নীড়ে ফেরার গল্প-২৪ | ফাহিম দানিয়াল

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!