সংকলন
আমুরিয়া-বিজয়
আহমদ উসমান ইতিহাস

আমুরিয়া বিজয় | আহমাদ উসমান

বাবাক খুররামি ছিল এক দুর্ধর্ষ বিদ্রোহী। অগণিত নিরপরাধ মানুষের হত্যাকারী। দীর্ঘদিন আব্বাসিয়রা শত চেষ্টা করেও তাকে দমাতে পারেনি। প্রতিবারই সে নতুনভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে৷ শেষতক ২২২ হিজরিতে খলিফা মু’তাসিম প্রেরিত সেনাপতি আফসিন বাবাককে কোনঠাসা করে ফেলে। এ সময় বাবাক রোম সম্রাট তুফাইল বিন মিখাইলকে আব্বাসিয়দের উপর হামলা করার আহবান জানিয়ে একটি পত্র প্রেরণ করে৷ পত্রে সে লেখে, খলিফা এই মুহুর্তে তার অধিকাংশ ফৌজ আমার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছে। সীমান্ত খালি পড়ে আছে৷ সুতরাং আপনি যদি বিজয় ও গনীমত লাভ করতে চান তাহলে আপনার সাম্রাজ্য সংলগ্ন ভুখণ্ডের দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়ে তা দখল করে নিন।

এমন ফুসরত আর কখনো আসবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তুফাইল বিন মিখাইল এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেননি। একলক্ষ সৈন্য নিয়ে মুসলিম ভূমিতে হামলার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। রোমান সৈন্যরা সর্বপ্রথম জিবাত্রা ও মালাতিয়া নামক দুটি সীমান্তবর্তী এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসলীলা ও লুটপাট চালায়। এই হামলায় তারা বহু সংখ্যক মুসলমান হত্যা করে। হাজার হাজার মুসলিম নারী ও শিশুকে বন্দী করে নিয়ে যায়৷ বন্দীদের মধ্যে ছিল এক হাজার মুসলিম নারী৷

২২৩ হিজরি৷ বাবাককে হত্যার কিছুদিন পরের কথা বলছি। খলিফা মু’তাসিম তখন সামাররা শহরে অবস্থান করছিলেন। দিনের কোন এক প্রহরে দরবারে বসে ছিলেন খলিফা। হঠাৎ এক লোক দরবারে এলো একটা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে। ‘হে আমীরুল মুমিনীন, সীমান্তে রোমানরা আক্রমণ করেছে। জিবাত্রায় তারা সীমাহীন হত্যাযজ্ঞ ও লুটপাট চালিয়েছে।’

খলিফা চোখ বড় হয়ে গেল রোমানদের এই দুঃসাহস দেখে। বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। একপর্যায়ে লোকটি বলল, রোমান সৈন্যরা জনৈকা হাশেমী নারীকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি দুর থেকে শুনেছি ‘সে আর্তনাদ করে বলছিল, ‘ওয়া মু’তাসিমা! ওয়া মু’তাসিমা!’ (হায় মু’তাসিম! হায় মু’তাসিম)। এটা শুনতেই খলীফার চেহারা অগ্নিশর্মা হয়ে জ্বলে উঠল। উচ্চ কন্ঠে জবাব দিলেন ‘লাব্বাইকি ইয়া উখতা’ লাব্বাইকি ইয়া উখতা (আমি হাজির হে বোন আমার)।

তৎক্ষণাৎ খলিফা বাহিনীকে প্রস্তুতি নিতে আদেশ দিলেন। আমির উমারাদের ডাকলেন। নিজের সকল সম্পত্তির তালিকা করে এক তৃতীয়াংশ তার সন্তানদের এবং অপর এক-তৃতীয়াংশ খাদেমদের আর বাকি এক অংশ ওয়াকফের জন্য ভাগ করে দেন। ক্ষুব্ধ খলিফা সিংহাসন ছেড়ে শুভ্র অশ্বে আরোহন করলেন। যুদ্ধের আমামা বেধে নিলেন। এদিকে পর্বতসম বাহিনী পরিপূর্ণ প্রস্তুত। ইবনে কাসির জানান, ‘খলিফা এমন বাহিনী প্রস্তুত করেন যা ইতিপূর্বে কেউ করতে পারেনি। যুদ্ধের জন্য এতো বিপুল পরিমাণে অস্ত্রসস্ত্রস, সরঞ্জাম নেয়া হয় যা কেউ কোনদিন শুনেনি।’ রণ দামামা বাজিয়ে বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন খলিফা।

২২৩ হিজরির জামাদিউল উলার দুই তারিখে দজলা নদীর পশ্চিম তীর থেকে সৈন্যরা যাত্রা করে। অগ্রবর্তী বাহিনীরুপে একদল সৈন্যসহ যাবতীয় রসদ দিয়ে পাঠানো হয়৷ তারা জিবাত্রায় দ্রুত অগ্রসর হয়ে দেখে ইতিমধ্যে রোমানরা শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তখন তারা সংঘটিত বিষয় সম্পর্কে খলীফাকে অবহিত করলেন। কিন্তু খলিফা বসে রইলেননা। তার কানে তখনো আর্তনাদের ধ্বনিগুলো বেজে উঠছিল। খলীফা তখন সভাসদে জিজ্ঞেস করলেন, রোমকদের কোন শহর সবচেয়ে দুর্ভেদ্য ও সমৃদ্ধ? সবাই জানাল, আমুরিয়া৷ ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত মুসলিমরা তা অধিকার করতে পারেনি এবং এই শহর তাদের কাছে কনস্টান্টিনোপলের অপেক্ষা অধিক মর্যাদাসম্পন্ন। খলিফা দৃপ্তকন্ঠে জানালেন, তাহলে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য আমুরিয়া। সবাই প্রস্তুত হয়ে নাও।

আমুরিয়ার উদ্দেশ্যে মুসলিম বাহিনী এগিয়ে চললো। ২৫ শাবান একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মুসলিমরা আঙ্কারা বিজয় করল। অতঃপর বাহিনী পুনরায় আমুরিয়া পানে পথ ধরল। এখানে মুতাসিম তার সেনাবাহিনী তিনভাগে বিভক্ত করলেন, ডান বাহুর দায়িত্ব অর্পণ করেন আফসীনকে, বাম বাহুর দায়িত্ব অর্পণ করেন আশনাসকে আর তিনি নিজে মধ্যবর্তী বাহিনীর পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এছাড়া উভয় সকলকে নির্দেশ দিলেন যে, চলার পথে যে জনপদ তারা অতিক্রম করবে তা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে বিরান করবে এবং তার অধিবাসীদেরকে বন্দী করবে এবং সম্ভাব্য সকল গনীমত হাসিল করবে৷ এভাবে তিনি তাদেরকে নিয়ে আমুরিয়ার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলেন৷

সময়টা ছিল রমাদানের ছয় তারিখ। শুক্রবার সকালে খলীফা মু’তাসিম বাহিনী নিয়ে আমুরিয়া পৌছেন। এদিকে আমুরিয়াবাসী শহরের ফটক বন্ধ করে দেয়। খ্রিস্টানরা সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। শহরে দুর্গের চূড়াসমুহ যোদ্ধায় পুর্ণ হয়ে যায়। আর আমুরিয়ার ছিল দুর্ভেদ্য নগর প্রাচীর এবং বহু সংখ্যক বিশালকার দুর্গ বিশিষ্ট এক বিশাল শহর৷ এই সময় আমুরিয়ার জনৈক ব্যক্তি মুসলিমদের নিকট আসে। বলা হয় এই ব্যক্তি পূর্বে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল। সে যখন স্বয়ং আমীরুল মু’মিনীনকে দেখতে পায় তখন ইসলামের দিকে ফিরে আসে৷

শহর থেকে বের হয়ে খলিফার সাথে দেখা করে। নগর প্রাচীরের এমন একটি দুর্বল অংশের কথা সে জানায় যা ইতিপূর্বে বন্যায় ধ্বসে পড়েছিল, এরপর তেমন কোন ভিত্তি ছাড়া দুর্বলভাবে তা পূণনির্মান করা হয়৷ এসময় মু’তাসিম ঐ স্থান বরাবর মিনজানিক স্থাপন করতে আদেশ করেন৷ ক্রমাগত পাথর নিক্ষেপ চলতে থাকে সেই অংশে। এদিকে শহরবাসী কনস্টান্টিনোপলের কাছে সাহায্য চেয়ে দুই জন সৈন্যকে প্রেরণ করে। পথিমধ্যে মুসলিম সৈন্যদের কাছে তারা বন্দি হয় এবং পরবর্তীতে মুসলিম হয়ে যায়। আদেশানুসারে প্রাচীরে ধারাবাহিক পাথর নিক্ষেপ চলতে থাকে। এরপর একদিন দেয়ালের একাংশ প্রচন্ড আওয়াজে ধ্বসে পড়ে। কিন্তু এবারও শহরে প্রবেশ করা গেল না। আরেকটি বাধা নতুন সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো।

প্রাচীরের বাইরে খুব বড় ও গভীর পরিখা খনন করা ছিল। চতুর্পাশ্বের পরিখার গভীরতা প্রত্যক্ষ করলেন খলিফা। খলিফা সমস্যা সমাধানে একটা পদ্ধতি অবলম্বন করলেন। রসদ হিসেবে সৈন্যরা সাথে করে প্রচুর ভেড়া নিয়ে এসেছিল। খলিফা আদেশে, সকল ভেড়া জবাই করে গোস্ত সংরক্ষণ করা হয়। তারপর চামড়াগুলো মাটি দিয়ে পূর্ণ করে সেলাই করা হয়। এরপর সেগুলো পরিখায় নিক্ষেপ করা হয়। এভাবে নিক্ষিপ্ত চামড়া মাটিতে পরিখা পূর্ণ হয়ে মাটির সমান হয়ে যায়৷ এরপর তার উপর পুনরায় মাটি ফেলা হয়। ফলে অনায়াসে চলাচলের উপযোগী পথে পরিণত হয়৷ খলীফা মুসলিম বাহিনীকে শহরে প্রবেশের নির্দেশ প্রদান করেন৷

এ সময় একের পর এক মুসলিম সৈন্য তাকবীর ধ্বনি দিতে দিতে শহরে প্রবেশ করে। অল্প সময়েই গোটা শহর দখল হয়ে যায়। খলিফার আদেশে সকল রোমান সৈনদের গণহারে হত্যা করা হয়। শহরের অলিগলিতে তাদের লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। গির্জার দরজায় আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়৷ এই যুদ্ধাভিযান থেকে মুসলমানরা বিপুল ও বর্ণনাতীত পরিমাণ ধন সম্পদ লাভ করে৷ মু’তাসিম সকল যুদ্ধোপকরণ জ্বালিয়ে ফেলার নির্দেশ প্রদান করেন যাতে রোমানরা আর কোন কিছু দ্বারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শক্তি অর্জন করতে না পারে৷ রোমানদের সীমালঙ্ঘনের দরুন খলিফা এতোই রাগান্বিত হয়েছিলেন যে, তার আদেশে সমগ্র শহর প্রায় ধূলিস্যাৎ করে দেয়া হয়। নগরীর এমন চিত্র হয়েছিল দেখলে মনে করার সুযোগ থাকবেনা এখানে কিছুদিন পূর্বেও মানুষ বসবাস করতো।

সুবহানাল্লাহ! এক অসহায় মুসলিম নারীর আর্তনাদে গোটা শহর ধ্বংস করে দেয়া মু’তাসিম বিল্লাহ কোথায়, আর কোথায় আজকের নপুংসক, কাপুরুষ শাসকেরা। প্রতিনিয়ত সিরিয়া, আরাকান, কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, সোমালিয়ায় নিপীড়িত মানবাত্মার ক্রন্দনে যাদের অন্তরে এতটুটু নাড়া দেয়না। মুসলিমদের রক্ত বিক্রি করে তারা উদরপূর্তি করে। তাদের সামনেই কুফফাররা কতশত মুসলিম বোনের ইজ্জত, আব্রু লুন্ঠন করেছে কিন্তু এই মুসলিম শাসকরা যেন বধির। কুফফারদের হাতে লাঞ্চিতা মুসলিম বোনেরা চিৎকার করেছে একটু সাহায্যের আশায় অথচ তারা ব্যস্ত ছিল কুফফারদের পদলেহন আর গোলামিতে। ওয়াল্লাহি! এসকল জালিমকে আগামীকাল আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে, আল্লাহর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে, জবাব না দিয়ে কারো এক কদম এগুনোর সুযোগ থাকবেনা।

Facebook Comments

Related posts

মুতার ঐতিহাসিক যুদ্ধ এবং তিন শহীদ সেনাপতি | মাহদি হাসান

আফগানিস্তানের প্রথম বিজেতা: আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনু কুরাইজ । মাহদি হাসান

মুসলিম ইতিহাসচর্চার গোড়ার কথা | মাহমুদ সিদ্দীকি

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!