পূর্বের আলোচনায় অনেক সাহাবী ও তাবেয়ী থেকে বর্ণণা করা হয়েছে যে, তারা একই রাকাতে সম্পূর্ণ কুরআন খতম করেছেন। কেউ কেউ মাগরিব থেকে ইশার নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে কুরআন খতম করেছেন। প্রশ্ন দেখা দেয়, এটি কীভাবে সম্ভব।
অল্প সময়ে অধিক আমল
বোখারী শরীফে এ বিষয়ে রাসূল স. এর একটি হাদীস রয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল স.বলেন,
خُفِّفَ على داود القرآنُ، فكان يأمر بداوبِّه، فتسرج، فيقرأ القرآن قبل أن تسرج دوابه، ولا يأكل إلا من عمل يده
অর্থ: হযরত দাউদ আ. এর জন্য তেলাওয়াত হালকা করে দেয়া হয়। তিনি তার বাহনের জিন প্রস্তুত করতে বলতেন। বাহনে জিন লাগানোর পূর্বেই তিনি যাবুর পড়ে শেষ করতেন। তিনি শুধু নিজ হাতের উপার্জনই ভক্ষণ করতেন।
-বোখারী শরীফ, হাদীস নং ৩৪১৭
এই হাদীস থেকে স্পষ্ট, হযরত দাউদ আ. খুব অল্প সময়ে যবুর পড়ে শেষ করতেন। তিনি খুব দ্রুত পড়তেন বিষয়টি এমন নয়। সুললিত কন্ঠে ধীর-স্থিরভাবে তেলাওয়াতের জন্য তিনি বিখ্যাত। ঘোড়ার জিন লাগাতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। এই অতি অল্প সময়ে তিনি সম্পূর্ণ যবুর পড়ে শেষ করতেন।
উপর্যুক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন,
وَفِي الْحَدِيث أَنَّ الْبَرَكَة قَدْ تَقَع فِي الزَّمَن الْيَسِير حَتَّى يَقَع فِيهِ الْعَمَل الْكَثِير . قَالَ النَّوَوِيّ : أَكْثَر مَا بَلَغَنَا مِنْ ذَلِكَ مِنْ كَانَ يَقْرَأ أَرْبَع خَتَمَات بِاللَّيْلِ وَأَرْبَعًا بِالنَّهَارِ،
অর্থ: হাদীস থেকে প্রমাণিত, কখনও খুব অল্প সময়ে ব্যাপক বরকত হয়। ফলে অল্প সময়ে অধিক কাজ করা সম্ভব হয়। ইমাম নববী রহ. বলেন, এ বিষয়ে অনেক বর্ণনা আমাদের নিকট পৌছেছে যে, অনেকে এক রাতে চার খতম ও এক দিনে চার খতম কুরআন তেলাওয়াত করেছেন।
-ফাতহুল বারী, খ.৬, পৃ.৪২৪
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহ. উমদাতুল কারীতে লিখেছেন,
وفيه الدلالة على أن الله تعالى يطوي الزمان لمن يشاء من عباده كما يطوي المكان وهذا لا سبيل إلى إدراكه إلا بالفيض الرباني … ولقد رأيت رجلاً حافظاً قرأ ثلاث ختمات في الوتر في كل ركعة ختمة في ليلة القدر
অর্থ: হাদীসে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা যে কোন বান্দার জন্য সময়কে সংকোচন করতে পারেন। যেমন স্থানকেও সংকোচন করতে পারেন। আল্লাহর পাকের পক্ষ বিশেষ ফয়জ ও অনুগ্রহ ছাড়া এটা অনুধাবন করা সম্ভব নয়….। আমি নিজে এক হাফেজকে দেখেছি, শবে কদরে বিতর নামাযের তিন রাকাতে তিন খতম কুরআন তেলাওযাত করেছে।
-উমদাতুল কারী, খ.২৩, পৃ.৩৬৮
ইমাম নববী রহ. বলেন,
ينبغي أن يحافظ على تلاوته ، ويكثر منها . وكان السلف رضي الله عنهم لهم عادات مختلفة في قدر ما يختمون فيه .
فروى ابن أبي داود عن بعض السلف رضي الله عنهم ، أنهم كانوا يختمون في كل شهرين ختمة واحدة ، وعن بعضهم في كل شهر ختمة ، وعن بعضهم في كل عشر ليال ختمة ، وعن بعضهم في كل ثمان ليال ، وعن الأكثرين في كل سبع ليال ، وعن بعضهم في كل ست ، وعن بعضهم في كل خمس ، وعن بعضهم في كل أربع ، وعن بعضهم في كل ليلتين ، وختم بعضهم في كل يوم وليلة ختمة ، ومنهم من كان يختم ثلاثا ، وختم بعضهم ثمان ختمات ، أربعا بالليل وأربعاً بالنهار .
فمن الذين كانوا يختمون ختمة في الليل واليوم : عثمان بن عفان رضي الله عنه و تميم الداري و سعيد بن جبير و مجاهد و الشافعي وآخرين.
ومن الذين كانوا يختمون ثلاث ختمات : سليم بن عمر رضي الله عنه قاضي مصر في خلافة معاوية رضي الله عنه ، وروى أبو بكر بن أبي داود أنه كان يختم في الليلة أربع ختمات ، وروى أبو عمر الكندي في كتابه في قضاة مصر أنه كان يختم في الليلة أربع ختمات.
قال الشيخ الصالح أبو عبد الرحمن السلمي رضي الله عنه : سمعت الشيخ أبا عثمان المغربي يقول : كان ابن الكتاب رضي الله عنه يختم بالنهار أربع ختمات وبالليل أربع ختمات ، وهذا أكثر ما بلغنا من اليوم والليلة.
وروى السيد الجليل أحمد الدورقي بإسناده عن منصور بن زادان من عباد التابعين رضي الله عنه أنه كان يختم القرآن فيما بين الظهر والعصر ويختمه أيضا فيما بين المغرب والعشاء في رمضان ختمتين ، وكانوا يؤخرون العشاء في رمضان إلى أن يمضي ربع الليل.
وروى أبو داود بإسناده الصحيح : أن مجاهدا كان يختم القرآن فيما بين المغرب والعشاء.
وعن منصور قال : كان علي الأزدي يختم فيما بين المغرب والعشاء كل ليلة من رمضان.
وعن إبراهيم بن سعد قال : كان أبي يحتبي فما يحل حبوته حتى يختم القرآن.
وأما الذي يختم في ركعة ، فلا يحصون لكثرتهم ، فمن المتقدمين : عثمان بن عفان و تميم الداري و سعيد بن جبير رضي الله عنهم ختمة في كل ليلة في الكعبة.
অর্থ: কুরআন তেলাওয়াতের প্রতি মনযোগী হওয়া উচিৎ। অধিক কুরআন তেলাওয়াত মু’মিনের বিশেষ কর্তব্য। কতো দিনে কুরআন খতম করতে হবে, এ বিষয়ে সালাফে -সালেহীনের বিভিন্ন আমল ছিল। ইবনে আবি দাউদ কিছু সালাফ থেকে বর্ণনা করেছেন, তারা প্রতি দু’মাসে একবার কুরআন খতম করতেন। কোন কোন সালাফ এক মাসে একবার খতম করতেন। কেউ কেউ প্রতি দশরাতে একবার খতম করতেন। কেউ কেউ আট রাতে। তবে অধিকাংশ থেকে সাত রাতে খতমের কথা বর্ণিত আছে। কিছু সালাফ থেকে ছয়দিন, পাচ দিন ও চার দিনে খতমের কথা বর্ণিত আছে। কিছু সালাফ দু’রাতে খতম করতেন। কেউ কেউ এক দিন ও একরাতে এক খতম করতেন। কিছু সালাফ একদিনে ও একরাতে তিন খতম তেলাওযাত করেছেন। কোন কোন সালাফ আট খতম তেলাওয়াত করেছেন। চার খতম দিনে ও চার খতম রাতে।
সালাফে-সালেহীনের মাঝে যারা একদিন ও একরাতে কুরআন খতম করেছেন, তাদের কয়েকজন হলেন, ১. হযরত উসমান রা ২, তামীম দারী রা. ৩. তাবেয়ী সাইদ ইবনে জুবাইর রহ. ৪.ইমাম মুজাহিদ রহ. ৫. ইমাম শাফেয়ী রহ. সহ অন্যান্য সালাফগণ।
যারা দিনে তিন খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন, এদের মাঝে রয়েছেন, সুলাইম বিন উমর রা. । তিনি হযরত মুয়াবিয়া রা. এর সময় মিশরের বিচারপতি ছিলেন। ইমাম আবু বকর ইবনে আবি দাউদ বর্ণনা করেন, তিনি এক রাতে চার খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন। আবু বকর আল-কিন্দী তার ‘কুজাতু মিসর’ বইয়ে লিখেছেন, তিনি রাতে চার খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন।
শায়খ আবু আব্দুর রহমান সুলামী বলেন, আমি শায়খ আবু উসমান মাগরিবীকে বলতে শুনেছি, “ইবনুল কাতিব রহ. দিনে চার খতম ও রাতে চার খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন।”
আমার (ইমাম নববী) জানা মতে এটি সর্বোচ্চ পরিমাণ।
ইমাম আহমাদ দাওরাকী নিজ সনদে বিখ্যাত তাবেয়ী ও আবেদ ইমাম মানসুর ইবনে যাজান সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন, ইমাম মানসুর ইবনে যাজান রহ.যোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে কুরআন খতম করতেন। তিনি রমজান মাসে মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে দু’খতম কুরআন তেলাওযাত করতেন। তিনি রমজানে রাতের এক চতুর্থাংশের পরে ইশার নামায আদায করতেন।
ইমাম আবু দাউদ সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন, ইমাম মুজাহিদ রহ. মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে এক খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন।
ইমাম মানসুর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলী আল-আজদী রহ. রমজান মাসে প্রত্যেক রাতে মাগরিব থেকে ইশার মধ্যবর্তী সময়ে এক খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন।
হযরত ইব্রাহীম ইবনে সায়াদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার পিতা মাঝে মাঝে লোকান্তরে যেতেন। এসময়ে তিনি এক খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন।
সালাফের মাঝে এক রাকাতে কুরআন খতম কারীদের সংখ্যা এতো বেশি যে গণনা করে শেষ করা যাবে না। এদের মাঝে অগ্রণী ছিলেন, হযরত উসমান রা, হযরত তামীম দারী রা ও হযরত সাইদ ইবনে জুবাইর রহ. ।তিনি কা’বা শরীফে এক রাকাতে এক খতম তেলাওয়াত করেছেন।
[আত-তিবয়ান, পৃ.৫৯-৬০]
এধরনের বক্তব্য ইমাম নববীর কিতাবুল আজকারেও রয়েছে।
বিখ্যাত ইমাম তাজুদ্দীন সুবকী রহ. বলেন,
(النوع الرابع والعشرون: ما سُهِّلَ لكثير من العلماء من التصانيف في الزمن اليسير، بحيث وزع زمان تصنيفهم على زمان اشتغالهم بالعلم إلى أن ماتوا فوجد لا يفي به نسخاً، فضلاً عن التصنيف، وهذا قسم من نشر الزمان الذي قدمناه،
فقد اتفق النقلة على أن عُمُرَ الشافعي رحمه الله لا يفي بعشر ما أبرزه من التصانيف، مع ما يثبت عنه من تلاوة القرآن كل يوم ختمة بالتدبر، وفى رمضان كل يوم ختمتين كذلك، واشتغاله بالدرس، والفتاوى والذكر والفكر والأمراض التي كانت تعتوره، بحيث لم يخلُ رضي الله عنه من علة أو علتين أو أكثر، وربما اجتمع فيه ثلاثون مرضاً.
وكذلك إمام الحرمين أبو المعالي الجويني رحمه الله، حُسِبَ عُمُرُه وما صنفه مع ما كان يلقيه على الطلبة، ويُذَكِّرْ به في مجالس التذكير فوجد لا يفي به.
وقرأ بعضهم ثماني ختمات في اليوم الواحد، وأمثال هذا كثير.
وهذا الإمام الرباني الشيخ محيى الدين النووي رحمه الله، وُزِّعَ عُمُرُه على تصانيفه، فوجد أنه لو كان ينسخها فقط لما كفاها ذلك العمر، فضلاً عن كونه يصنفها، فضلاً عما كان يضمه إليها من أنواع العبادات وغيرها.
وهذا الشيخ الإمام الوالد رحمه الله إذا حُسِبَ ما كتبه من التصانيف مع ما كان يواظبه من العبادات، ويمليه من الفوائد، ويَذْكُرُه في الدروس من العلوم، ويكتبه على الفتاوى، ويتلوه من القرآن، ويشتغل به من المحاكمات، عرف أن عمره قطعاً لا يفي بثلث ذلكن فسبحان من يبارك لهم ويطوى لهم وينشر
অর্থ: কারামতের চব্বিশতম প্রকার হল, অল্প সময়ে ইমামগণের অধিক গ্রন্থ রচনা। ইমামগণ যে পরিমাণ কিতাব লিখেছেন, যে সময় তারা ইলম শিখেছেন, এবং যতো দিন বেচে ছিলেন, এগুলো যদি হিসেব করা হয়, তাহলে এই সময়ে এতো কিতাব লেখা সম্ভব নয়। এটি মূলত: সময়কে প্রশস্ত করে দেয়ার একটি উদাহরণ। পূর্বে এ বিষয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। বর্ণনাকারীগণ এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, ইমাম শাফেয়ী রহ. যে পরিমাণ জীবন পেয়েছিলেন, এই সময়ে স্বাভাবিকভাবে তার লিখিত গ্রন্থের দশভাগের একভাগও লেখা সম্ভব নয়। অথচ তার থেকে প্রমাণিত আছে, তিনি প্রতি দিন এক খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন অত্যন্ত ধীর-স্থির ও মর্ম অনুধাবন করে। রমজানে একইভাবে দু’খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন। নিয়মিত দরস, ফতোয়া, জিকির ও গবেষণা করতেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত থাকতেন। তিনি সব সময় দু’একটি রোগে ভুগতনে। কখনও ত্রিশটিও রোগও দেখা দিতো।
একইভাবে ইমামুল হারামাইন আবুল মায়ালী জুয়াইনী রহ. তিনি যে পরিমাণ কিতাব লিখেছেন, দরস, নসীহত ও দীনের কাজে সময় দিয়েছেন, তার জীবনে স্বাভাবিকভাবে এটি সম্ভব নয়।
কোন কোন সালাফ দিনে আট খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন। এজাতীয় অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে।
তুমি ইমাম নববীর কথা চিন্তা করো। তার জীবনের সময়টা যদি তার লিখিত গ্রন্থ দিয়ে ভাগ করা হয়, তাহলে তার পক্ষে এগুলো শুধু কপি করেই শেষ করাই সম্ভব নয়। অথচ গবেষণা করে এগুলো লেখা তো অনেক কঠিন বিষয়। অথচ গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি তিনি সর্বদা বিভিন্ন ইবাদতে মগ্ন থাকতেন।
আমার পিতা তকীউদ্দীন সুবকী রহ. কে দেখো। গ্রন্থ রচনা, বিভিন্ন ইবাদত, সূক্ষ্ম বিষয়ে গবেষণা, ইলমের বিভিন্ন শাখায় নিয়মিত দরস প্রদান, নিয়মিত ফতোয়া প্রদান, কুরআন তেলাওয়াত, বিচার কার্য পরিচালনাসহ তিনি যেসব কাজে ব্যস্ত থাকতেন, এগুলো দিয়ে যদি তার জীবনের সময়কে ভাগ করা হয়, তাহলে এর এক তৃতীয়াংশও সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়। সেই মহান সত্তার জন্য পবিত্রতা, যিনি তাদের জীবনে বরকত দিয়েছেন। তাদের জন্য সময় সংকুচিত ও বিস্তৃত করেছেন।
[ত্ববাকাতুশ শাফিইয়্যা আল-কুবরা, খ.২, পৃ.৩৪২]
সালাফে-সালেহীনের কুরআন তেলাওয়াত:
১. হযরত আব্দুর রহমান ইবনে কাসিম (মৃত:১৯১ হি:) রহ. প্রতি দিন দু’বার কুরআন খতম করতেন।
[ওফায়াতুল আ’য়ান, খ.১, পৃ.২৭৬, তাজকিরাতুল হুফফাজ, খ.১, পৃ.২৫৬, হুসনুল মুহাজারা, খ.১, পৃ.৩০৩]
২. ইমাম আবু বকর ইবনে আয়্যাশ রহ. ত্রিশ বছর যাবৎ প্রতি দিন একবার কুরআন খতম করতেন। এ সম্পর্কে ইমাম নববী রহ. বলেন,
وروينا عن إبراهيم بن أبي بكر بن عياش أنه ( أي إبراهيم ) قال: قال لي أبي: إنَّ أباك لم يأت فاحشة قط ، و إنَّه يختم القرآن منذ ثلاثين سنة كلَّ يوم مرَّة .
و روينا عنه أنَّه قال لابنه : يا بني ! إيَّاك أن تعصي الله في هذه الغرفة فإنِّي ختمت فيها اثني عشر ألف ختمة .
و روينا عنه أنَّه قال لبنته عند موته و قد بكت : يا بنية لا تبكي ، أتخافين أن يعذبني الله و قد ختمت في هذه الزَّاوية أربعة و عشرين ألف ختمة ؟
অর্থ: হযরত ইব্রাহীম ইবনে আবু বকর আয়্যাশ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার পিতা আমাকে বললেন, নিশ্চয় তোমার পিতা কখনও ফাহিশা (গর্হিত, যিনা-ব্যভিচার) কাজ করেনি। আর সে ত্রিশ বছর যাবৎ প্রতি দিন এক খতম কুরআন তেলাওয়াত করেছে।
ইমাম আবু বকর আয়্যাশ থেকে আরও বর্ণিত আছে, তিনি তার ছেলেকে বলেন, বৎস!, এই ঘরে আল্লাহর নাফরমানী থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকবে। আমি এই ঘরে বার হাজার বার কুরআন খতম করেছি।
তাঁর থেকে আরও বর্ণিত, মৃত্যুর সময়ে তার মেয়ে কাঁদছিলো। তিনি মেয়েকে বললেন, কেদো না। তুমি কি ভয় করছো, আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিবেন; অথচ আমি ঘরের এই কোণে চব্বিশ হাজার খতম দিয়েছি?
-শরহে মুসলিম, ইমাম নববী রহ, খ.১, পৃ.৭৯
৩. ইমাম ইবনে কাসীর রহ. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-তে লিখেছেন,
ذكر ابن عساكر في ترجمة سليم بن عنز التجيبي قاضي مصر، و كان من كبار التابعين … و كان من الزهادة و العبادة على جانب عظيم ، و كان يختم القرآن في كل ليلة ثلاث ختمات في الصلاة و غيرها .اهـ .
অর্থ: ইমাম ইবনে আসাকির মিশরের বিচারপতি হযরত সুলাইম বিন হানাজ আত-তুজাইবির জীবনীতে লিখেছেন, তিনি একজন বড় তাবেয়ী ছিলেন। দুনিয়া বিরাগী ও অধিক ইবাদত বন্দেগীকারীদের প্রথম সারিতে ছিলেন। তিনি প্রতি নামায ও নামাযের বাইরে তিন খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন।
-আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ.৯, পৃ.১৩৬
৪. ইমাম ইবনে কাসীর রহ. ইমাম বোখারী রহ. এর জীবনী লিখেছেন আল-বিদায়াতে। ইমাম বোখারীর আমল সম্পর্কে লিখেছেন,
قد كان يصلي في كل ليلة ثلاث عشرة ركعة ، و كان يختم القرآن في كل ليلة من رمضان ختمة
অর্থ: তিনি প্রত্যেক রাতে তেরো রাকাত নামায আদায় করতেন। আর রমজান মাসে প্রত্যেক রাতে এক খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন।
আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ.১১, পৃ.৩১
৫. ইবনে কাসীর রহ. লিখেছেন,
محمد بن علي بن أحمد بن العباس الكرخي الأديب ، كان عالماً زاهداً ورعاً ، يختم القرآن كل يوم ، و يديم الصيام
অর্থ: সাহিত্যিক মুহাম্মাদ বিন আলী বিন আহমাদ বিন আব্বাস আল-কারখী, তিনি বড় আলেম, যাহিদ (দুনিয়াত্যাগী) ও খোদাভীরু ছিলেন। প্রত্যেক দিন কুরআন খতম করতেন। আর লাগাতার রোজা রাখতেন।
-আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ.১১, পৃ.২৫৯
৬. ইমাম যাহাবী রহ. সিয়ারু আ’লামিন নুবালাতে হযরত ইব্রাহীম নাখয়ী রহ. থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,
عَنْ إِبْرَاهِيْمَ ، قَالَ :
كَانَ الأَسْوَدُ بن يزيد يَخْتِمُ القُرْآنَ فِي رَمَضَانَ فِي كُلِّ لَيْلَتَيْنِ ، وَ كَانَ يَنَامُ بَيْنَ المَغْرِبِ وَ العِشَاءِ ، وَ كَانَ يَخْتِمُ القُرْآنَ فِي غَيْرِ رَمَضَانَ فِي كُلِّ سِتِّ لَيَالٍ .
অর্থ: হযরত আসওয়াত ইবনে ইয়াজীদ রহ. রমজানের প্রতি দু’রাতে কুরআন খতম করতেন। তিনি মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে নিদ্রা যেতেন। রমজান ব্যতীত অন্য সময়ে ছয় রাতে তিনি কুরআন খতম করতেন।
-সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.৪, পৃ.৫১
৬.ইমাম যাহাবী রহ. সিয়ারু আ’লামিন নুবালাতে উল্লেখ করেছেন,
عَنْ وِقَاءِ بنِ إِيَاسٍ ، قَالَ :كَانَ سَعِيْدُ بنُ جُبَيْرٍ يَخْتِمُ القُرْآنَ فِيْمَا بَيْنَ المَغْرِبِ وَ العَشَاءِ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ ، وَ كَانُوا يُؤَخِّرُوْنَ العِشَاءَ
অর্থ: হযরত বিকা ইবনে ইয়াস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তাবেয়ী হযরত সাইদ ইবনে জুবাইর রহ. রমজান মাসে মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে কুরআন খতম করতেন। রমজানে তাঁরা ইশার নামায বিলম্বে আদায় করতেন।
-সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.৪, পৃ.৩২৪
৭. ইমাম যাহাবী রহ. লিখেছেন,
قَالَ سَلاَمُ بنُ أَبِي مُطِيْعٍ : كَانَ قَتَادَةُ يَخْتِمُ القُرْآنَ فِي سَبْعٍ ، وَ إِذَا جَاءَ رَمَضَانُ ، خَتمَ فِي كُلِّ ثَلاَثٍ ، فَإِذَا جَاءَ العَشرُ ، خَتَمَ كُلَّ لَيْلَةٍ .
অর্থ: সালাম ইবনে আবী মুতী বলেন, ইমাম কাতাদা রহ. সাত দিনে কুরআন খতম করতেন। রমজান মাস এলে তিন দিনে কুরআন খতম করতেন। রমজানের শেষ দশকে প্রতি রাতে কুরআন খতম করতেন।
-সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.৫, পৃ.২৭৬
৮. ইমাম যাহাবী রহ. লিখেছেন,
قَالَ يَزِيْدُ بنُ هَارُوْنَ : كَانَ مَنْصُوْرُ بنُ زَاذَانَ يَقْرَأُ القُرْآنَ كُلَّه فِي صَلاَةِ الضُّحَى ، وَ كَانَ يَخْتِمُ القُرْآنَ مِنَ الأُوْلَى إِلَى العَصْرِ ، وَ يَخْتِمُ فِي اليَوْمِ مَرَّتَيْنِ ، وَ يُصَلِّي اللَّيْلَ كُلَّه .وَ عَنْ هِشَامِ بنِ حَسَّانٍ ، قَالَ :
كَانَ يَخْتِمُ فِيْمَا بَيْنَ المَغْرِبِ وَ العِشَاءِ مَرَّتَيْنِ ، وَ الثَّالِثَةُ إِلَى الطَّوَاسِيْنَ ، وَ كَانَ يَبُلُّ عِمَامَتَه مِنْ دُمُوْعِ عَيْنَيْهِ .
অর্থ: ইমাম ইয়াজিদ ইবনে হারুন রহ. বলেন, ইমাম মানসুর ইবনে জাযান চাশতের নামাযে সম্পূর্ণ কুরআন খতম করতেন। তিনি যোহরের সময় থেকে আসর পর্যন্ত কুরআন খতম করতেন। দিনে দু’বার কুরআন খতম করতেন। তিনি সারা রাত জেগে নামায আদায় করতেন।
হিশাম ইবনে হাসসান রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইমাম মানসুর ইবনে জাযান রহ. মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে দু’খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন। তৃতীয় খতমে ত্বসীন পর্যন্ত পড়তেন। তার চোখের অশ্রুতে সামনের পাগড়ী ভিজে যেত।
-সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.৫, পৃ.৪৪১-৪৪২
৯. ইমাম যাহাবী রহ. সিয়ারু আ’লামিন নুবালাতে লিখেছেন,
حَدَّثَنَا أَحْمَدُ الدَّوْرَقِيُّ ، حَدَّثَنِي سَعِيْدٌ أَبُو عُثْمَانَ ، سَمِعْتُ ابْنَ عُيَيْنَةَ يَقُوْلُ : قَالَ ابْنُ شُبْرُمَةَ : سَأَلَ كُرْزٌ رَبَّهُ أَنْ يُعْطِيَهُ الاسْمَ الأَعْظَمَ ، عَلَى أَلاَ يَسْأَلَ بِهِ شَيْئاً مِنَ الدُّنْيَا ، فَأُعْطِيَ ، فَسَأَلَ أَنْ يُقَوَّى حَتَّى يَخْتِمَ القُرْآنَ فِي اليَوْمِ وَ اللَّيْلَةِ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ
অর্থ: হযরত সাইদ ইবনে আবু উসমান বলেন, আমি ইমাম সুফিয়ান ইবন উয়াইনাকে বলতে শুনেছি, ইমাম ইবনে শুবরুমা বলেন, ইমাম কারজ আল্লাহর কাছে ইসমে আ’জম প্রাপ্ত হওয়ার দুয়া করলেন। তিনি ওয়াদা করেছিলেন, এর দ্বারা দুনিয়ার কোন কিছু কামনা করবেন না। আল্লাহ তায়ালা তাকে এটি দান করলেন। তিনি আল্লাহর কাছে ইসমে আ’জমের মাধ্যমে দুয়া করলেন, আল্লাহ যেন তাকে দিনে ও রাতে তিন বার কুরআন খতমের ক্ষমতা দান করেন ।
-সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.৬,পৃ.৮৫
১০. ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত আতা ইবনে সাইব রহ. আল্লাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বান্দা ছিলেন। তিনি প্রতি রাতে এক খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন।
-সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.৬, পৃ.১১২
১১. অনেক সনদ দ্বারা প্রমাণিত, হযরত আবু বকর আয়্যাশ রহ. চল্লিশ বছর যাবৎ দিনে ও রাতে একবার কুরআন খতম করতেন।
-সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.৮, পৃ.৫০৩
১২.ইমাম যাহাবী রহ. লিখেছেন,
قَالَ عَبْدُ اللهِ بنُ جَعْفَرِ بنِ خَاقَانَ : سَمِعْتُ عَمْرَو بنَ عَلِيٍّ يَقُوْلُ : كَانَ يَحْيَى بنُ سَعِيْدٍ القَطَّانُ يَخْتِمُ القُرْآنَ كُلَّ يَوْمٍ وَ لَيْلَةٍ ، يَدعُو لأَلفِ إِنْسَانٍ ، ثُمَّ يَخْرُجُ بَعْدَ العَصْرِ ، فَيُحَدِّثُ النَّاسَ .
অর্থ: আব্দুল্লাহ বিন জা’ফর বিন খাকান বলেন, আমি আমর বিন আলীকে বলতে শুনেছি, ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে সাইদ আল-কাত্তান রহ. প্রত্যেক দিনে ও রাতে এক খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন। এক হাজার মানুষের জন্য দুয়া করতেন। এরপর আসরের পরে বের হয়ে মুহাদ্দিসদের নিকট হাদীস বর্ণনা করতেন।
-সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.৯, পৃ.১৭৮
১৩.ইমাম যাহাবী রহ. লিখেছেন,
قَالَ الرَّبِيْعُ بنُ سُلَيْمَانَ مِنْ طَرِيْقَيْنِ عَنْهُ ، بَلِ أَكْثَرَ : كَانَ الشَّافِعِيُّ يَخْتِمُ القُرْآنَ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ سِتِّيْنَ خَتْمَةً .و رَوَاهَا ابْنُ أَبِي حَاتِمٍ عَنْهُ ، فَزَادَ : كُلُّ ذَلِكَ فِي صَلاَةٍ .
অর্থ: ইমাম রবী ইবনে সুলাইমান থেকে দু’টি বা দুয়ের অধিক সূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ইমাম শাফেয়ী রহ. রমজানে ষাট খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন। ইমাম ইবনে আবী হাতেম এটি বর্ণনা করেছেন। তিনি এর সাথে অতিরিক্ত বর্ণনা করেছেন, ষাট খতমই তিনি নামাযে তেলাওয়াত করতেন।
-সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.১০, পৃ.৩৬
১৪. ইমাম যাহাবী রহ. লিখেছেন,
كَانَ بقي بن مخلد يَخْتِم القُرْآنَ كُلَّ لَيْلَةٍ ، فِي ثلاَثَ عَشْرَةَ رَكْعَةً ، وَ كَانَ يُصَلِّي بِالنَّهَارِ مائَةِ رَكْعَةٍ ، وَ يَصُوْمُ الدَّهْرَ
অর্থ: ইমাম বাকী ইবনে মাখলাদ প্রত্যেক রাতে তেরো রাকাত নামাযে কুরআন খতম দিতেন। দিনে এক শ রাকাত নফল নামায পড়তেন এবং লাগাতার রোজা রাখতেন।
-সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.৩, পৃ.২৯৮
১৫. ইমাম যাহাবী রহ. ইমাম হাকিম থেকে বর্ণনা করেছেন,
قَالَ الحَاكِمُ : سَمِعْتُ طَاهِرَ بنَ أَحْمَدَ الوَرَّاق يَقُوْلُ : تُوُفِّيَ أَبُو العَبَّاسِ بنُ شَادَل ، وَ كَانَ يختمُ القُرْآنَ كُلَّ يَوْم
অর্থ: ইমাম হাকেম রহ. বলেন, আমি ত্বাহের ইবনে আহমাদ আল-ওররাককে বলতে শুনেছি, আবুল আব্বাস বিন শাদাল ইন্তেকাল করেন। তিনি প্রত্যেক দিন কুরআন খতম করতেন।
১৬.ইমাম আবুল ওয়ালীদ মুরসী রহ. সম্পর্কে আবু উমর ইবনুল হাজ্জা বলেন,
مَا لَقَيْتُ أَتمَّ وَرَعاً وَ لاَ أَحْسَنَ خُلُقاً وَ لاَ أَكْمَلَ عِلْماً مِنْهُ ، كَانَ يَخْتِمُ القُرْآنَ عَلَى قَدَمِيْه فِي كُلِّ يَوْمٍ وَ ليلَةٍ .
অর্থ: আমি আবুল ওয়ালীদ এর চেয়ে খোদাভীরু, সুন্দর চরিত্র ও পরিপূর্ণ ইলমের অধিকারী কাউকে দেখিনি। তিনি প্রত্যেক দিন ও রাতে দাড়িয়ে দাড়িয়ে (নামাযে) কুরআন খতম করতেন।
-সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.১৭, পৃ.৫৮৬
১৭. খতীব বাগদাদী রহ. তারীখে বাগদাদে উল্লেখ করেছেন,
* عن محمد بن زهير بن محمد قال : كان أبي يجمعنا في وقت ختمة القرآن في وقت شهر رمضان في كل يوم وليلة ثلاث مرات تسعين ختمة في شهر رمضان
অর্থ: মুহাম্মাদ ইবনে যুহাইর ইবনে মুহাম্মাদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রমজান মাসে আমার পিতা প্রত্যেক কুরআন খতম শেষে আমাদেরকে একত্র করতেন। এভাবে প্রত্যেক দিন ও রাতে তিনি আমাদেরকে তিনবার ডাকতেন। অর্থাৎ রমজানে তিনি নব্বই খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন।
[তারীখে বাগদাদ, খ.৮, পৃ.৪৮৫]
আমরা যেসব ইমামের কথা উল্লেখ করেছি, তারা সত্যিকার অর্থেই সালাফে-সালেহীন ছিলেন। অধিকাংশই খাইরুল কুরুন তথা প্রথম তিন যুগের। তাদের এই ইবাদতের কথা এতো অধিক সংখ্যক কিতাবে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে, এগুলো অস্বীকারের কোন সুযোগ নেই। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাদের পদাংক অনুসরণের তৌফিক দান করেন। আমীন।